Tuesday, September 23, 2008

দেশে ফেরা ফর ডামি'জ

দেশে ফিরছেন? কলকাতায়? অনেককাল বিদেশে আছেন কি? এই ধরেন আট-দশ-বারো বছর? একা না দোকা? নাকি পোঁটলা-পুঁটলি, থুড়ি ছানা-পোনাও আছে? তাইলে পড়ুন ভাট প্রকাশনী থেকে সদ্য প্রকাশিত "দেশে ফেরা ফর ডামিজ' - অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পান, জেনে নিন কি কি আপনার জন্যে অপেক্ষা করে আছে, কোথায় কখন কি করবেন এবং করবেন না৷ এই বই এক কথায় আপনাকে তৈরী করে দেবে দেশে পা রাখার জন্যে৷

তাইলে আর কি - চলুন বেড়িয়ে আসি, সরি, ঘরে ফিরি৷

এয়ারপোর্টে নামুন, লাইনে দাঁড়ান, পাসপোর্টে ছাপ্পা লাগান, কাস্টমস ক্লিয়ার করুন - এসব সিম্পল সিম্পল কাজকম্মোগুলো শেষ করে চলুন বেরোই৷ বাড়ির গাড়ি থাকলে তাতে, নয়তো "কলকাতা ক্যাব'-ও আছে৷ আর নেহাত পুরনোপন্থী হলে হলদে ট্যাক্সিও - ওই যে আকাশ থেকে হলদে মোজাইকটা দ্যাখেননি? শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে...না: আসলে মনে হয় কোটি কোটি৷

গাড়িতে উঠে রেডিও চালিয়ে দিন - 91.9FM - কলকাতার নতুন ক্রেজ - ফ্রেণ্ডস এফএম৷ অটটা থেকে দশটা, দশটা থেকে বারোটা - সিনেমার শোয়ের মতন খেপে খেপে প্রোগ্রাম - টক শো৷ গান শুনতে পাবেন, চাইলে ফোন করুন৷ আঙুলে বাত থাকলে ভালো ব্যায়াম হবে৷ ফোনে আড্ডা মারুন টক শো হোস্টের সঙ্গে৷ উত্তর দিন "উত্তমকুমার অভিনীত নায়ক সিনেমার নায়কের ভূমিকায় কে অভিনয় করেছিলেন' গোছের প্রশ্নের এবং জিতে নিন গিফট ভাউচার৷ তবে ফোন করার আগে নিজের বাংলা স্টাইলটা একটু ঝালিয়ে নিন৷

"হাই নীলানzনা, তুমি কেয়া say কড়ছিলে? ইসবার পূযোড় সময় হোয়াট আড় ইউ ডুইং?"
"আমি থিংক কড় ড়হি থি ekbar ক্যালিম্পং ভিzইট কড়ে আসি।"

ভাবছেন বানান ভুল? ব্যকরণ ভুল? এক্কেরে না৷ এগুলো সঅঅঅঅঅব ঠেকে শেখা - কলকাতার হালফিলের ভাষা-বিপ্লব৷ শপিং মলে আচ্ছন্ন ড্যাশিং কলকাতার ড্যাশিং ইয়ং বেঙ্গলের সাথে বাতচিত করতে হলে আপনাকে এই ভাষাবিপ্লবে ভাগ নিতে হবে৷

আপিস কোথায়? সেক্টর ফাইভে? আগে বাটার দোকানে গিয়ে একটা গামবুট কিনে আনুন, অভাবে রবারের জুতো৷ ল্যাপটপের ব্যাগের মধ্যে বা অন্য ব্যাগে সেগুলো ভরে আপিস চলুন - কারণ নবদিগন্ত বর্ষায় সত্যিই দিগন্তবিস্তৃত জলাশয়৷ সাড়ে ন'টায় আপিস? অবশ্যই কখন বেরোবেন সেটা নির্ভর করবে আপনার বাড়ি কোথায় তার ওপর৷ দক্ষিণ কলকাতার শহরতলি এলাকায় থাকলে এই সাড়ে সাতটা নাগাদ বেরিয়ে পড়াই ভালো কারণ ভূতল পরিবহণ নিগমের দ্রুতগামী বাসগুলো প্রতি দশ মিটারে একবার দাঁড়াবে যাত্রী তোলার জন্যে৷ যত পারবেন রোগা হয়ে যান, নইলে বাসে চড়া কঠিন হবে৷ কে বলে যানবাহনের অভাব? এত শাটল আছে কি করতে? রাস্তায় যদি দেখেন একটা গাড়ির (সাধারণত: অ্যাম্বাস্যাডর বা ইন্ডিকা) দিকে জনা পঞ্চাশেক লোক ছুটে যাচ্ছে, বুঝে নেবেন ওইটি শাটল৷ পারলে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে জায়গা করে নিন - অ্যাম্বাস্যাডরে ছয়জন, ইন্ডিকায় পাঁচ৷ ওই যে বল্লাম - একটু সরু হয়ে যান, ছোট হয়ে যান৷ এই হবে আপনার জীবনমন্ত্র - নইলে বাস, মেট্রো, অটো - কোথাওই চড়তে পারবেন না৷

নিজে গাড়ি কিনবেন? একবার Q-এর সাথে পারলে দেখা করুন - জেমস বণ্ডের মতন গেজেট লাগাতে হবে গাড়িতে, পাশের গাড়ি খুব কাছে এসে গেলেই যাতে আপনার গাড়ি থেকে ইস্পাতের ফলা বেরিয়ে আসে - নইলে আপনি আপনার গাড়িতে আছেন না পাশের গাড়িতে এই ধাঁধা উদ্ধার করতে করতে আপনার গাড়ির কোন একটা অংশ হাপিস হয়ে যাবে৷ রাস্তায় গাড়ি চালানোর আগে মন দিয়ে মাসখানেক অবস্ট্যাকল রেস অভ্যেস করুন, গাড়ি নিয়ে - ওই ফুটবল মাঠে ট্রেনিং হয় দেখেছেন - ফুটবলাররা প্র্যাকটিস কোনের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে ছোটে বল নিয়ে - সেরকম৷ আর কব্জির ব্যায়াম করুন - রজার ফেডারারের চেয়েও নমনীয় কব্জি চাই - নইলে ওই অবস্ট্যাকল রেসে কূল পাবেন না৷ ও হ্যাঁ, যদি সাবধানী ড্রাইভার হয়ে থাকেন কখনো, বা ভালোভাবে গাড়ি চালানো শিখে থাকেন, তাহলে চেষ্টা করুন সে সব ভুলে যেতে, নইলে গাড়ি স্টার্ট করে দাঁড়িয়েই থাকতে হবে৷ মুজতবা আলির দেশেবিদেশে পড়ে নেবেন - বিশেষ করে পেশোয়ারের রাস্তার বর্ণনা৷ শুধু মনে রাখবেন যতক্ষণ না মানুষের গায়ে ছোঁয়া লাগছে ততক্ষণ সবাই পাঠানদের মতন নির্লিপ্ত, ছোঁয়া লেগে গেলে আপনি সবসময়েই দোষী৷ ভালো দৌড়তে পারলে হয়তো বেঁচে গেলেও যেতে পারেন৷

পোঁটলা-পুঁটলি আছে বলেছিলেন না? স্কুলে ভর্তি করবেন নিশ্চয়৷ স্টেটাস বড় হলে আপনার জন্যে আছে হেরিটেজ বা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, তবে হেরিটেজ কি নামে হয়? সেই হেরিটেজ যদি আপনার চাহিদা হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে বেরোতে হবে - স্কুলে স্কুলে৷ ছানাপোনা পয়দা করে আপনি মহা অন্যায় করেছেন সেটা স্কুলের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আপিস থেকে হেডমাস্টার অবধি সবাই আপনাকে সফলভাবে বুঝিয়ে দেবেন৷ হ্যাঁ, ব্যতিক্রম আছে বৈকি - ছেলেমেয়ের ক্রিমিন্যাল বাপ-মা হিসেবে আপনার কর্তব্য সেই ব্যতিক্রম খুঁজে বের করা৷ কিন্তু তারপরেও কি পার পেয়ে যাবেন ভাবছেন? সে সিঙ্গুরে বালি - ছেলেমেয়ের স্ক্র্যাপবুকের জন্যে ছবি লাগবে - আঁকলে হবে না - দোকানে ঘুরে ঘুরে খুঁজুন কোথায় কামিনী/কাঞ্চন/দোপাটি ইত্যাদি ফুলের ছবি আছে, বর্ষার ফুলের চারখানি নমুনা লাগবে, তাও ছেলেমেয়ের ইস্কুলের খাতায় দিদিমণি যে ফুলগুলোর নাম বলেছেন সেগুলোই৷ হপ্তায় পঁয়তাল্লিশ ঘন্টা আপিসে কাজ করতে হবে - শ্রম আইনের মুখে জুতো মেরে - কম করেও রাত সাড়ে আটটা-নটায় ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়েকে হোমওয়ার্ক করাতে বসান৷ ওদের এখন আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ নয় - লেট টু বেড, আর্লি টু রাইজ৷ নইলে আপনার পথে তারা হাঁটবে কি করে? অবশ্য আপনি যদি ওদের ওই পথেই একশো মিটার স্প্রিন্টের গতিতে দৌড় করাতে চান তাহলে হয়তো সিস্টেমটা আপনার পছন্দ হয়ে গেলেও যেতে পারে৷ কথিত আছে যে কিছু স্কুলে যেখানে হোমওয়ার্কের চাপ তুলনামূলকভাবে কম, সেখানে অভিভাবকরা সোরগোল তোলেন কেন তাঁদের ছয়-সাত বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের অমুকতমুক স্কুলের চেয়ে কম কাজ করানো হচ্ছে৷ ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের গোটা প্ল্যানিংটা এক্ষুণি করে ফেলবেন কিনা সেটা অবশ্যই আপনার হাতে৷

সপ্তাহের শেষে বেড়াতে যাবেন? বা খেতে যাবেন? এই দুটো ব্যাপারে কলকাতা অভাবনীয় উন্নতি করেছে৷ সাউথ সিটি মল, প্যান্টালুনস, ওয়েস্ট সাইড, সিটি সেন্টার, ফ্যাবইন্ডিয়া - মলের কমতি আছে নাকি? ইরেসপেক্টিভ অব পকেটের ওজন, বেড়ানোর পক্ষে আইডিয়াল৷ ঠাণ্ডা হাওয়া পাবেন, চলমান সিঁড়ি পাবেন, মনের বয়স থাকলে পরস্পরের চোখ এড়িয়ে সুন্দর দৃশ্য পাবেন৷ পকেট ভারি হলে হালকা করুন, হালকা হলে গন্ধ শুঁকে অর্ধভোজন করুন - মানে উইন্ডো শপিং করুন৷ আর ভোজন - খাদ্যরসিক হলে কলকাতা এই মুহুর্তে আপনাকে দুই হাত তুলে স্বাগত জানাবে৷ ডেকার্স লেন এখনও আছে, ব্যাঙ্কশাল কোর্টের আশেপাশে বা শিপিং অথরিটির আশেপাশে সেই রাস্তার ধারের খাবারের দোকান থেকে শুরু করে সেক্টর ফাইভের "ঝুপস"; মাঝারি পকেটের জন্যে ভজহরি মান্না বা ফিঙ্গারটিপস; ভারী পকেটের জন্যে অর্কজ ইত্যাদি৷ নির্ভর করবে আপনি কুলপি কি ভাবে খান - দাম দেখে না স্বাদ দেখে, কারণ যে কুলপি ছেলেবেলায় আপনি আট টাকায় খেতেন, অর্কজে সেই কুলপিই পাবেন একশোকুড়ি টাকায়৷ বিশদ জানতে চাইলে অপেক্ষা করুন অদূর ভবিষ্যতের বই "কলকাতার খাবারদাবার ফর ডামিজ'-এর জন্যে৷

নাটক সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন তো অনেক সিনেমা হল আছে, মাল্টিপ্লেক্স গোছের৷ গ্রুপ থিয়েটার এখনও হয়৷ তবে চব্বিশ ঘন্টা নিরবচ্ছিন্ন নাটক দেখতে হলে টিউন ইন করুন বাংলা চব্বিশ ঘন্টার খবরের চ্যানেলগুলোতে৷ তারকাখচিত কাস্টিং৷ একদিকে রাজনীতির জগতের তারকারা, সাথে সঙ্গত করেন সুশীল তারকাদের এক মহা ব্যাটেলিয়ন, এবং কে নেই তাতে৷ কেউ ধর্না দেন তো কেউ মহামিছিল করেন তো কেউ মৃত্যুঘন্টার সাথে ভায়োলিনের সঙ্গত করেন তো কেউ মোমবাতির চাষ করেন৷ চব্বিশ ঘন্টা ঘটতে থাকা নানান নাটক ফলো করতে চাইলে এই নিউজ চ্যানেলগুলোর টেলিকাস্ট আর রিটেলিকাস্ট ছাড়া আপনার জীবন অন্ধকার৷ আপিস থেকে ফিরে এই চ্যানেলগুলো আপনার সঙ্গী, নিরবচ্ছিন্ন এন্টারটেইনমেন্টের জন্যে৷ কখনো সখনো একটু বোর হয়ে গেলে চ্যানেল ঘুরিয়ে দেখে নিন চলতে থাকা অসংখ্য রিয়েলিটি শো-র কোনো একটা - কচি ছেলেমেয়েরা সুপার ট্যালেন্ট হওয়ার লক্ষ্যে আপনার মন ভোলাবে "ধক্ ধক্ করনে লাগা" বা "তু চীজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত" দিয়ে, আর ফাউ হিসেবে সমস্ত হিট হতে চাওয়া বাবা-মা-অভিভাবকদের ইঁদুরদৌড়ও পেয়ে যাবেন, বিচারকদের "কনস্ট্রাকটিভ" সমালোচনা - যেগুলো কিনা প্রতিযোগীদের মানসিকভাবে ধাক্কা দেয় - সরি সরি - শক্ত করে - সেগুলোও পাবেন এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবে...

এই ভাবেই চলবে - ততদিন যতদিন আপনি তাল রেখে চলতে পারবেন৷ তাল রাখতে না পারলে এই কলকাতা আর আপনার জন্যে নয়৷ কলকাতা আপনাকে কখনও চায়নি, আপনি কলকাতাকে চেয়ে থাকলেও৷ আপনি পিছিয়ে আছেন, কলকাতা অনেক এগিয়ে গিয়েছে ব্ল্যাক হোলের দিকে - এর সাথে দৌড়নোর বয়স আপনার চলে গেছে৷ আপনার দৌড়নোর ক্ষমতা কতদূর সেটা জানতে হলে বরং আগে কিছুদিন ট্রায়াল দিয়ে নেবেন ফাইনাল সাইনিং-এর আগে - মানে বাক্সো-ডেক্সো গুটিয়ে নিয়ে আসার আগে৷ মাঝের এই বছরগুলোতে আপনাকে বাদ দিয়ে আপনার বাড়ি কতটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে সেটাও সেই ট্রায়ালের সময় আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠবে৷ আর সেটা আপনার পক্ষে বরং উপকারী - কারণ ওই একটা জায়গায় তাল কেটে গিয়ে থাকলে আপনি এই "দেশে ফেরা ফর ডামিজ" হাজারবার পড়েও নিজেকে তৈরী করতে পারবেন না৷

যদি তাল রাখতে পারেন তাহলে এই বইয়ের পরের এডিশন লেখার জন্যে প্রকাশক আপনার বাড়ি ধাওয়া করবে৷

(মূল লেখা এখানে)

এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু

এগারো বছর পর আবার এই শহরে৷ ১৯৯৭-এর পর এই ২০০৮, ঘাটে ঘাটে ঘুরে আবার ঘরে ফেরা, অথচ শহরটা নেহাতই অচেনা লাগে৷ একটা সময় ছিলো যখন দক্ষিণ কলকাতার শহরতলি এলাকায় রাত নামতো ন'টার সময় - এঁকেবেঁকে সাপের মতন শুয়ে থাকতো জনমানবশুণ্য চণ্ডী ঘোষ রোড৷ এগারো বছর পর রাত দশটাতেও মনে হয় দুর্গাপুজোর ভিড়৷ বা মহামিছিল৷ নেতাজিনগরের মোড়ের ওপর রাস্তাটা গত কয়েকমাসে বারতিনেক ধসে পড়েছে - বিস্কুটের তোবড়ানো টিনের মতন তোবড়ানো রাস্তা - লোকের ভিড়ের চাপে হলে আশ্চর্য হবে না কেউ৷ স্বনামধন্য ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস - শহরের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে ছুটে যাওয়া রাস্তা৷ ছিলো - এগারো বছর আগে৷ ওদিকটাকে এখন প্রান্ত বললে নিজেকে প্রান্তিক মনে হবে - রাস্তাবরাবর পেল্লায় উঁচু উঁচু বাড়ি৷ বাইপাস বল্লেও - কারণ ওটা আর বাইপাস নয় সে অর্থে, পুরো শহরের মধ্যে দিয়ে রাস্তা৷ শহরের মাঝখানটা আর একতলা নেই, ফ্লাইওভারের দৌলতে রাস্তাঘাট দোতলা থেকে তিনতলা ছুঁইছুঁই৷ প্যান্টালুনস আর স্পেন্সারসের ভিড়ে আকবর আলির পেন্টুলুনের দোকান লাটে উঠেছে৷ এর মাঝে শ্বেতাম্বর পক্ককেশ এক রাজা দিবারাত্র চেঁচিয়ে উঠছেন "উন্নয়ন উন্নয়ন" বলে...আর রাস্তার অন্যদিকে সাক্ষাত দুগ্গাঠাকুর কটমটিয়ে তাকিয়ে আছেন রাজার দিকে, হাত থেকে ত্রিশূলটা এই বেরোয় কি সেই বেরোয় - "আবাগীর বেটা..."

বছর তিনেক আগে যখন শপিং মল আর ফ্লাইওভারের হোলসেল বাজার দেখিয়ে উন্নয়নের প্রথম জিগিরটা ওঠে, তখন তারিক আলি একটা সাক্ষাতকারে বলেছিলেন একে উন্নয়ন বলে ভাবতে ওঁর কষ্ট হয়, আর এক বামপন্থী সরকারকে এই উন্নয়নের ফাঁদে পড়তে দেখে উনি হতাশ হন৷ একদিক থেকে দেখলে তারিক আলির খেদটা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত - শুধু শপিং মল আর ফ্লাইওভারই কি উন্নয়ন? সমস্ত লোকের জন্যে ভালো গণপরিবহণ ব্যবস্থা কোথায়? পরিবহণব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্যে ভালো রাস্তাঘাট? রাস্তায় নিশ্চিন্তে হাঁটার জন্যে ফুটপাথ? নিশ্চিন্তে নিশ্বাস নেওয়ার জন্যে পরিস্কার বাতাস? উন্নয়ন বলতে যদি শহুরে লোকজনের শুধুমাত্র একটা অংশের সুবিধা বোঝায় তাহলে সেই উন্নয়নকে কতটা সফল বলা যায়? অথচ শপিং মলের ভিতরে লোকের ঢল দেখলে এর প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করার উপায় নেই৷ বাজারও তো উন্নতি বা উন্নয়নের একটা মাপকাঠি৷

তো তাই এই এগারো বছর পর হাজার রকম মিডিয়ার ট্যাবলয়েডিজমের দৌলতে কনফিউজড এক বাঙালী রুদ্ধশাস রাজনৈতিক ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে দেখতে ইন্টারনেটের দুনিয়ায় বিড়বিড় করে নিজের কনফিউজনগুলো আওড়ায়...

কৃষি - শিল্প - বিতর্কের ব্যাকড্রপ

কৃষি না শিল্প? নাকি দুটোই? তর্কটা শুরু হল বছর দুই আগে যখন খোলা বাজারের আফটার এফেক্ট হিসেবে সেই শ্বেতাম্বর পক্ককেশ রাজা শিল্পপতিদের ডাকাডাকি শুরু করলেন রাজ্যে কারখানা তৈরী করার জন্যে৷ সেই ষাটের দশকে দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার পর সেভাবে এ রাজ্যে কোনও বড় কারখানা তৈরী হয়নি অনেকদিন - প্রায় নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধ অবধি৷ নানা কারণে পাটের ওপর নির্ভরশীল কারখানাগুলো উঠে গেছে - হাওড়ায় লাইন দিয়ে তাদের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়৷ সত্তরের দশকের শেষ থেকে এই রাজ্য নির্ভরশীল ছিলো কৃষি এবং কৃষিজাত দ্রব্যের ওপর - নজিরবিহীন অপারেশন বর্গা এবং বোরো ধানের দৌলতে৷ ২০০৪ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৬ লক্ষ বর্গাদার রেজিস্ট্রেশন হয় - সংখ্যাটা ভাগচাষীদের ৮৬%-এর কাছাকাছি৷ গোটা দেশের সাড়ে তিন শতাংশ জমির অধিকারি পশ্চিমবঙ্গে রিডিস্ট্রিবিউটেড জমির অনুপাত দেশের ২০% - বামফ্রন্ট সরকারের একটা বিরাট সাফল্য৷ এর পাশাপাশি শুরু হয় নতুন ধরণের বীজ ব্যবহার করে বোরো চাষ - ছোট জমিতে এই চাষের সাফল্যের পিছনে অপারেশন বর্গার অবদান বিরাট৷

"All this led to prosperity and growth in rural West Bengal. Land reforms, especially tenural security, provided the farmers the incentive to work harder. Boro technology helped them raise multiple crops with higher yields. Decentralisation of rural power ensured social stability and security so crucial for growth. West Bengal emerged as the largest rice producing state in India contributing more than 15 per cent of national production. During the 1980s boro cultivation grew at an average annual rate of 12 per cent and overall foodgrains at a rate of 5.5 per cent." - Development and Displacement, Abhirup Sarkar, Economic and Political Weekly, 21st April, 2007

আশির দশকের কৃষিক্ষেত্রের অগ্রগতি ক্রমশ: স্লথ হয়ে আসে নব্বইয়ের দশকে - বেশ কিছু কারণে৷ সংক্ষেপে বলতে গেলে বোরো ধানের জন্যে নতুন জমির অভাব, জলের অভাব ইত্যাদি কারণে ফলন কমতে শুরু করে৷ দ্বিতীয়ত: পুরনো মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির জন্যে এ রাজ্য থেকে চাল রপ্তানির সীমাবদ্ধতা৷ এর সাথে যুক্ত হয় এই রাজ্যে পড়তি চাহিদা থেকে পড়তি দাম৷ এসবের ফলে কৃষিজীবির সংখ্যা ৩৮% থেকে কমে দাঁড়ায় ২৫%-এ, ১৯৯১ থেকে ২০০১ - এই দশ বছরের মধ্যে৷ পশ্চিমবঙ্গে আরও বড় একটা সমস্যা ছিলো - মানুষ এবং জমির অনুপাত অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় খুবই কম - অনেকটাই দেশভাগের কারণে৷ দেশভাগের সময় ভারতের উত্তরপশ্চিমে উদ্বাস্তুদের মুভমেন্ট ছিলো দুইদিকেই - অনেকে পাঞ্জাব ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গেছেন, অনেকে ওদিক থেকে পাঞ্জাবে এসেছেন৷ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এটা ওয়ানওয়ে ট্রাফিক, এবং এই সমস্যা আজও রয়েছে - ফলত: জমি এবং মানুষের অনুপাতটা বেশ অ্যালার্মিংভাবে কমছে, আজও, এবং একই সাথে মাথাপিছু ফলন৷

"The problem got worse over time with an incessant inflow of people into the state from neighbouring countries and states continuing even today. The productivity of West Bengal agriculture is not very low. In fact, in foodgrains production it ranks right below Punjab and Haryana in terms of production per hectare. But if that production is divided by the number of heads dependent on land, the per capita availability is certainly low." - Development and Displacement, Abhirup Sarkar, Economic and Political Weekly, 21st April, 2007

এর মানেটা দাঁড়ালো এই - যে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা ভূমিসংস্কার এবং বোরো বিপ্লবের পরেও নতুন শতকের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে দারিদ্র খুব একটা কমে নি৷ ভারতের অন্যান্য গ্রামাঞ্চলের সাথে তুলনা করলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই পিছিয়ে পড়া অবস্থাটা চোখে পড়ে - পার ক্যাপিটা কনজাম্পশন, রুরাল আনএমপ্লয়মেন্ট রেট, গ্রামে পাকা বাড়ির সংখ্যা, বা বিদ্যুত - সবেতেই জাতীয় গড়ের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ বেশ কিছুটা পিছিয়ে৷ একটা উপায় কৃষিক্ষেত্রে আরো বিনিয়োগ এনে কনট্র্যাক্ট ফার্মিং চালু করা - যদিও সেখানে উদ্বৃত্ত কৃষকদের কর্মসংস্থানের প্রশ্ন এসে যায় - অর্থাত্ উন্নতির পথ সম্ভবত: কৃষিক্ষেত্রের বাইরে রয়েছে৷ বাকি রইলো দ্বিতীয় উপায় - শিল্পায়ন৷ যদিও এর অর্থ কৃষিক্ষেত্রকে উপেক্ষা নয়৷ এখানে কনসেপ্টটা হল অত্যন্ত খারাপ ল্যাণ্ড-টু-ম্যান অনুপাতের জন্যে কৃষিক্ষেত্রের বাইরে আরো অনেক সম্ভবনা তৈরী করতে হবে - যাতে কৃষির ওপর চাপটা ধীরে ধীরে কমে, পুরোপুরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল লোকেদের একটা অংশকে অন্য পথে নিয়ে আসা যায়৷

এবং এই জায়গা থেকেই শুরু হয় সিঙ্গুর কাপের প্রস্তুতি...

সিঙ্গুর কাপ

শিল্প এবং কৃষির লড়াইটা অনেকটাই আর্টিফিসিয়াল৷ অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখতে গেলে দুটো মোটেও মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ নয়৷ কৃষিক্ষেত্রে একটা দেশের স্বনির্ভরতা যেমন জরুরী, এর সাথে যেমন ফুড সিকিউরিটির ইস্যু জড়িয়ে থাকে, তেমনি, অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যে শিল্পায়ন একটা "নেসেসারি কণ্ডিশন'৷ শিল্পায়ন মানেই অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যে শিল্পায়ন জরুরী৷ এগারো বছর পশ্চিমের বিভিন্ন উন্নত দেশে ঘুরে এই ধারণাটুকু হয়েছে যে মানুষের সার্বিক বেঁচে থাকার কণ্ডিশন এই সমস্ত দেশে অনেক, অনেকই ভালো - এবং যে কোনোদিন যে কোনও লোকে ওই ব্যবস্থাই চাইবে - এবং সেই জায়গায় পৌঁছতে গেলে অর্থনৈতিক উন্নতি জরুরী, অর্থাত্, শিল্পায়ন জরুরী - অংকের হিসেবে এটুকু সহজে বলা যায়৷ কিন্তু কি পদ্ধতিতে? সিঙ্গুর কাপের রুদ্ধশ্বাস ম্যাচের পিছনে এই পদ্ধতিটা অনেক বড় জায়গা নিয়ে রয়েছে৷

শিল্পায়ন মানে শুধু একগুচ্ছ কারখানা নয়, তার সাথে প্রয়োজন পরিকাঠামো - অর্থাত্ রাস্তা, বড় শহরের সাথে ভালো যোগাযোগব্যবস্থা, ব্রিজ, শপিং মল, বাসস্থান, এয়ারপোর্ট, বন্দর ইত্যাদি৷ আর এর জন্যে চাই জমি৷ পশ্চিমবঙ্গ বসতির ঘণত্বের দিক থেকে ভারতের রাজ্যগুলোর ওপরদিকে আসে, এবং রাজ্যের ষাট শতাংশের বেশি জমি কৃষিজমি৷ সহজ অংকের হিসেবে বড় ধরণের শিল্পায়নের জন্যে যে পরিমাণ জমি দরকার তার জন্যে এই রাজ্যে কৃষিজমিতে হাত পড়বেই, স্বয়ং ব্রহ্মাও ঠেকাতে পারবেন না৷ এই জায়গাতে দাঁড়িয়ে উঠে আসে ফুড সিকিউরিটির প্রশ্ন, এবং একটি পাল্টা মত যে পুরনো বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার জমিতেই কেন নতুন করে শিল্পায়ন হবে না৷ এই পাল্টা যুক্তির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে একটি কঠিন বাস্তব - যে শিল্পপতি কারখানার জন্যে বিরাট অংকের বিনিয়োগ করছেন তিনি অবভিয়াসলি চাইবেন এমন একটা জায়গা বেছে নিতে যেখানে পরিকাঠামো রয়েছে, বা যেখানে পরিকাঠামোর পিছনে বিনিয়োগ যত্সামান্য৷ দেশের অন্যান্য এলাকায় এই সুবিধা পেলে তিনি সেখানেই যাবেন, কারণ তাঁর কাছে কোন রাজ্যে শিল্প তৈরীর কমিটমেন্টের চেয়ে বড় বিনিয়োগের রিটার্ন, বাজারের ভাষায় মুনাফা৷ এবং ফুড সিকিউরিটির প্রশ্নে বলা যায় যে শিল্পায়ন আদতে কৃষির কমপ্লিমেন্টারি, মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ নয় - কারণ ক্রমশ: যত বেশি সংখ্যক লোক কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে শিল্পক্ষেত্রে ঢুকবেন, কৃষির ওপর থেকে চাপ তত কমবে, জমি ক্রমশ: কনসলিডেটেড হবে, উন্নত কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে - ফলে আদতে কৃষিক্ষেত্র আরো উন্নতই হবে - অর্থনীতিবিদরা এই কথাই বলেন৷ [Development and Displacement, Abhirup Sarkar, Economic and Political Weekly, 21st April, 2007]

সিঙ্গুর একটা ক্লাসিক উদাহরণ - কলকাতা থেকে মাত্র তিরিশ মাইল দূরে, দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে, পরিকল্পিত ডাবলট্র্যাক রেললাইনের ধারে এমন একটা জায়গা যেটা রতন টাটার ড্রীম কার প্রোজেক্টের সমস্ত ক্রাইটেরিয়া সন্তুষ্ট করে৷ টাটা মোটরস সিঙ্গুর পছন্দ করেছিলো, সিঙ্গুর না হলে ভারতের অন্য কোথাও কারখানা তৈরী করতে টাটা মোটরসের বিন্দুমাত্র অনীহা হত না - এবং শিল্পায়নের বাস ধরার তাড়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই পছন্দ মেনে নিতে খানিকটা বাধ্যই ছিলো৷ শিল্পায়নের জন্য জরুরী ক্রাইটেরিয়াগুলো থেকে আরো অবভিয়াসলি যেটা প্রকাশ পায় সেটা হল কেন পুরুলিয়া বা বাঁকুড়ার পাহাড়ী পতিত এলাকায় এই প্রোজেক্টটা সম্ভব ছিলো না - খুব অবভিয়াস হলেও যেগুলো অনেক লোকের চোখ এড়িয়েছে, স্পেশ্যালি তাঁদের যাঁরা রাজনৈতিক এবং হয়তো অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে শিল্পায়নের দৌড়কেও সন্দেহের চোখে দেখেন বা দেখতে বাধ্য হন৷ এবং সেই দেখার এবং দেখানোর পথে তাঁরা ইতিহাস ভুলে একটা অচল যুক্তি তুলে আনেন - "যে সরকার গত তিরিশ বছরে কারখানা বন্ধ করা ছাড়া কিছু করেনি..." ইত্যাদি৷ ইতিহাস বলে পশ্চিমবঙ্গে ষাটের দশকের পর কোন বড় বিনিয়োগ হয়নি৷ এই ইতিহাসই সাক্ষী নানা অদ্ভুত আইনের যার জন্যে একটা সময় গোটা পূর্বাঞ্চল পিছিয়ে পড়েছিলো৷ এবং একই সাথে এই ইতিহাসই সাক্ষী ধ্বংসাত্মক ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্টের - ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাকশনকে বন্ধের চেহারা দেওয়ার সংস্কৃতির৷ কিন্তু জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্টের পাশাপাশি আরো অনেক ফ্যাক্টরই শিল্পের কবরখানার জন্যে দায়ী - এই বাস্তবটাকে কনভিনিয়েন্টলি ভুলে গিয়ে যাঁরা "কৃষিজমি রক্ষার্থে" রাজনৈতিক ক্রিকেট ম্যাচে নামলেন, অদ্ভুতভাবে তাঁদের ইতিহাস বরং আরোই স্পেক্ট্যাকুলারভাবে কৃষিজীবি বিরোধী৷

কিন্তু প্রশ্ন কি ছিলো না? ছিলো৷ প্রশ্ন ছিলো জমি অধিগ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে৷ প্রশ্ন ছিলো ১৮৯৪ সালের একটি কলোনিয়াল জমি অধিগ্রহণ আইন নিয়ে যার ভিত্তিতে সিঙ্গুরে প্রায় হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়৷ প্রশ্ন ছিলো ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন নিয়ে৷ এবং প্রশ্ন ছিলো ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার নিয়ে - কারণ অপারেশন বর্গা এবং সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি চিন্তাধারার ফসল৷ এবং প্রশ্ন ছিলো সরকারের তরফ থেকে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিয়ে৷ প্রশ্ন ছিলো একটা রাজনৈতিক দলের চিন্তাভাবনা নিয়ে যারা একই সময়ে দুটি ভিন্ন রাজ্যে প্রায় একই ইস্যুতে ভিন্ন স্ট্যাণ্ড নিয়েছে৷ শিল্পায়নের বাস ধরার তাড়ায় অনেক এথিক্যাল এবং মরাল ইস্যুকে এড়িয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে৷ এবং এই তাড়ার ফলে ভারতের প্রতিটা রাজ্যের মধ্যে প্রতিযোগিতাটা এখন বড়ই অস্বাস্থকর - বিনিয়োগ টানার জন্যে কে কতদূর ছাড় দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা৷ If a debt-ridden government spends so much money on wooing investors, how can it afford to pay proper compensation to those who are losing their land and livelihood?...the crux of the matter is that the government of West Bengal is too concerned about the investors and too little about the displaced. This is morally wrong. But more important, as a long-term industrial strategy, this is untenable." - Development and Displacement, Abhirup Sarkar, Economic and Political Weekly, 21st April, 2007

পালাতে চাই যত, সে আসে আমার পিছু পিছু

এগারো বছরের অনভ্যাসের পর চোখদুটো টাটিয়ে উঠলো দুই রাজনৈতিক শিবিরের তর্জা দেখে - দুই শিবিরের তথাকথিত "বুদ্ধিজীবি'-দের ভূমিকা দেখে - "গণতান্ত্রিক' শাসনব্যবস্থার মুখে "আমরা ২৩৫, ওরা ৩৫" শুনে - আর "গণতান্ত্রিক' আন্দোলনের মুখে ভায়োলেন্স হলে ভায়োলিন বাজানোর উক্তি শুনে৷ নন্দীগ্রাম এপিসোড মনে পড়িয়েছিলো মরিচঝাঁপির ঘটনা৷ এবং তারপর মানুষের মধ্যে মেরুকরণ মনে করিয়েছিলো জর্জ বুশের কুখ্যাত মন্তব্য - "ইফ ইউ আর নট উইথ আস, ইউ আর এগেইনস্ট আস'৷ সিঙ্গুর কাপের ঘটনাপ্রবাহ এই মনে হওয়াটাকে গভীরভাবে খোদাই করে দিয়েছে৷ আরো বেশি করে, কারণ এই কনফিউজড বাঙালী তার কনফিউজনগুলো যখন প্রকাশ্যে আনে, তখন যুযুধান দুই পক্ষের একপক্ষের কাছে সে প্রতিক্রিয়াশীল, অপরপক্ষের কাছে সে অন্য পক্ষের দালাল..."ইফ ইউ আর নট উইথ আস, ইউ আর এগেইনস্ট আস" - হয়তো একে বলে "বুশায়ন" - বিশ্বায়নের মতন এও গোটা দুনিয়াকে নিজের কবলে এনে ফেলেছে - হয়তো৷

দেখে দেখে এগারো বছর পর আরো একটা নতুন কনফিউজন তৈরী হয় - কাকে বিশ্বাস করবো?

"লজ্জা ঘৃণা রাগের পরে এটাই বুঝি থাকে,
এটাই দেবো তোমায়, আর এই শহরটাকে৷"

কি দেবো তোমায়, কলকাতা? অবিশ্বাস?

(মূল লেখা এখানে)