পুজোর সময় এই তল্লাটে থাকবো না সেটা আগস্টেই ঠিক করেছিলাম। কিন্তু কলকাতার বাকি লোকজন একই সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে ফেলায় ট্রেনের টিকিট হল ওয়েটিং লিস্ট। প্রথমে প্ল্যান ছিলো অরুণাচল যাবো - তাওয়াং, ভালুকপং ইত্যাদি। ট্রেনের টিকিটও সেই হিসেবে কাটা - ১৫ই অক্টোবর কাঞ্চনজঙ্ঘায় শেয়ালদা-গৌহাটি আর ২২ তারিখ ঐ ট্রেনেই ফেরা।
কিন্তু অরুণাচলের গুড়ে বালি, কারণ কোত্থাও থাকার ব্যবস্থা করা গেলো না। একবার ভাবলুম ভূটান, কিন্তু সে এমন খরচের ব্যাপার যে শেষে সিকিম ঠিক হল। গ্যাংটক হয়ে গুরুদংমার, ইয়ুমথাং আর ফেরার আগে পেলিং। নেট ঘেঁটে ফরচুনা বলে এক ট্যুর অপারেটরের খোঁজ পাওয়া গেলো, যাদের লাচেন এবং লাচুংএ হোটেল আছে, গ্যাংটক-লাচেন-গুরুদংমার-চোপতা ভ্যালী-লাচুং-কাটাও-ইয়ুমথাং-জিরো পয়েন্ট-গ্যাংটক (২ রাত, ৩ দিন) ট্যুরের ব্যবস্থা এরা করে - থাকা/খাওয়া/পারমিট/যাতায়াত সবই এদের দায়িত্ব - গ্যাংটকে পৌঁছে এদের হাতে নিজেদের সঁপে দিলেই নিশ্চিন্ত, এবং খরচও রিজনেবল (অন্তত: কলকাতার কিছু চেনা ট্র্যাভেল এজেন্ট যা হাঁকছিলো তার তুলনায়)। সাথে দময়ন্তীও জুটে গেলো - গাড়ির খরচটা ভাগাভাগি করা যাবে। এদের ট্যুরটাই বুক করা হল। এই করতে করতে পুজো এসে গেলো, যাওয়ার টিকিট তখনও ওয়েটিং লিস্ট।
জয়দাদার (ভলভো সার্ভিস) টিকিট কাটা ছিলো, কিন্তু তাও তেরো তারিখ তৎকালের একটা চেষ্টা করলুম - কপাল ভালো - কাঞ্চনকন্যাতে পাওয়া গেলো - পনেরো তারিখেরই, রাতের ট্রেন। ভাগ্যিস গেলো, নইলে দিনের বেলা কাঞ্চনজঙ্ঘায় গেলে সেই যে মেজাজ বিগড়োত তাতে পুরো ট্রিপটাই বাজে কাটতো (কেন, সে পরে আসছি)।
পনেরো তারিখ - অষ্টমীর বাজার। তার আগের তিন দিন ধরে আনন্দবাজার এবং স্টারানন্দে কলকাতার তুমুল জ্যামের গুচ্ছ গুচ্ছ খবর বেরোচ্ছে। গুচ্ছের লোকজন নাকি প্লেন/ট্রেন মিস্ করছে। রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা আটক থাকছে। ভয় টয় পেয়ে বাড়ি থেকে রওনা দিলুম পাঁচটা নাগাদ - ট্রেনের সময় সাড়ে আটটা (যদিও শুরুতে আমার প্ল্যান ছিলো সাড়ে তিনটে-চারটের সময় বেরোব - ভাগ্যিস সেটা করিনি)। কোথায় জ্যাম, কোথায় কি। এমনি দিনে বাড়ি থেকে শেয়ালদা লাগে ঘন্টাখানেক, সেদিন মোটামুটি আধ ঘন্টা/পঁয়ত্রিশ মিনিটে শেয়ালদা পৌঁছে গেলুম। ওয়েটিং রুমে তুমুল ভিড়, কারণ আরো অনেক সাবধানী লোক আছে - যাদের অনেকে সাড়ে দশটায় দার্জিলিং মেল ধরবে বলে পাঁচটায় বেরিয়ে পড়েছে। মানে, ভিড়ভর্তি ওয়েটিং রুমে তিন ঘন্টা কাটানো - সাথে দুজন পায়ে চরকি লাগানো পাবলিক। ধৈর্য্যের নোবেল থাকলে সেটা আমাদের পাওয়া উচিত।
ট্রেনে উঠে প্রথম সাক্ষাত একটি ইঁদুরের সঙ্গে - সহযাত্রীদের আগেই। সাইড বার্থের সীটে ব্যাগ রাখতেই দুদ্দুর করে সীটের তলা থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক একটু দৌড়োদৌড়ি করে ফের সীটের তলায় কোথায় ঢুকে গেলো (কদিন আগে বাবা-মা ভ্যালী অব ফ্লাওয়ার্স গেছিলো - সেই ট্রেনেও একই দৃশ্য ছিলো - তবে সেই ইঁদুরটা একটু কুঁড়ে ছিলো মনে হয়, কারণ মা চটি দিয়ে সেটাকে মেরেছিলো - বাবা-মায়ের ছবির লিস্টে সেটাও আছে)। মোদ্দা ব্যাপারটা হল সীটের নীচে ব্যাগ রাখা গেলো না, পেল্লায় রুকস্যাকগুলোকে বাংকে তুলতে হল - রাতে ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার চান্স সত্বেও।
কাঞ্চনকন্যায় প্যান্ট্রি-কার নেই, তাই বাড়ি থেকে প্যাক করে আনা লুচি-আলুমরিচ খেয়ে সেই রাত্তিরে ঘুমনো, পরের দিন সকালে নিউ জলপাইগুড়ি। ট্রেন আধ ঘন্টা লেট।
সকালে এনজেপি পৌঁছনোর পর প্রথম যুদ্ধ ট্যাক্সির জন্যে। প্রিপেইড বুথে একখানাও ট্যাক্সি নেই - কারণ প্রিপেইডের রেট হল সতেরোশো চল্লিশ, আর সেটা ঠিক হয়েছে ২০০৫ সালে। তারপর তেলের দাম বহুবার বেড়েছে। এখন কোনো গাড়িওয়ালা প্রিপেইড বুথে গাড়ি দেয় না। তায় পুজোর ছুটির মরসুম, পীক্ ট্যুরিস্ট সীজন - আড়াইয়ের কমে কেউ কথাই বলে না। তাও একটু দরদাম করে বাইশশো করা গেলো। ট্যাক্সি বিনে গতি নাই, আর শেয়ারে যাওয়াও মুশকিল, অতএব ...
রাম্বি বাজারে উপোস ভেঙে গ্যাংটক পৌঁছতে দুপুর দুটো। সেবক রোড গত বছরেও দেখেছি দিব্যি সুন্দর - এখন মহানন্দা স্যাংচুয়ারি পেরনোর পরই পুরো নৌকোযাত্রা। ড্রাইভার বললো - "এ আর কি দেখছেন, যেখানে যাচ্ছেন সেখানে যে কি আসছে তা তো জানেন না ... "
দুপুরে গ্যাংটক পৌঁছে কিছু খেয়ে এক লোকাল ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে এদিক ওদিক ঘোরা হল - একটা স্তুপ আছে কাছেই, তার পাশে টিবেটোলজি মিউজিয়াম - অবিশ্যি এটাতে ঢুকতে পারলাম না, কারণ হাতে বেশি সময় ছিলো না। সেখান থেকে গেলুম "বন ঝকরি ফলস অ্যাণ্ড এনার্জি পার্ক" - জলপ্রপাতটা মন্দ নয় (তবে সিকিমে প্রতি মোড়ে একখানা দেখতে পাওয়া যায়, আর নামীদামীগুলোর চেয়ে অনামা প্রপাতগুলো কোনো অংশে কম নয় - ইন ফ্যাক্ট "ফলস অব সিকিম" বলে অনায়াসে একখান ছবির বই বের করা যায়)। কি ভিড় এখানে - আর ৯৯% পাবলিকই বাঙালী। তারা সবাই একের পর এক লাইন দিয়ে প্রপাতের সামনে পোজ দিয়ে দাঁড়ায় আর সঙ্গীসাথীরা ছবি তোলে। অনেকের আবার একটাতে সখ মেটে না, বিভিন্ন পোজে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায়। বাদবাকি কারো ছবি তোলার কোনো দরকার নেই কিনা ... আর সবচেয়ে জ্বলে যখন শাটার টেপার মুহুর্তে কেউ হুড়মুড়িয়ে সামনে এসে যায় ... হিসেব কষে শাটার স্পীড/এক্সপোজার সেট করার পর এরকম ঘটলে ইচ্ছে করে এদের কানে কাঠপিঁপড়ে ছেড়ে দিই।
বন ঝকরি থেকে গেলুম রঙ্কা মনাস্টেরি। রুমটেক একটু দূর, সেদিনই যাওয়ার সময় ছিলো না, তাই এই নতুন মনাস্টেরিটাই দেখতে গেছিলুম। মন্দ নয়, বেশ বড়সড়, তবে বড় হলেই কি আর রুমটেক হয় - রুমটেকের ঐতিহ্যই অন্য ... তাও নেহাত ফেলনা নয়, ভিতরের মূর্তিগুলো বেশ সুন্দর। আর ফেরার পথে রাস্তায় এক জায়গা থেকে উল্টোদিকের পাহাড়ে পুরো গ্যাংটক শহরটা দেখা যায়।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা লিখি - সিকিমে দেখা বুদ্ধমূর্তি বা জাতকমূর্তিগুলো নিয়ে। বেশিরভাগই দেখতে বেশ হিংস্রগোছের। তার একটা কারণ আছে। তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে যে কয়েকজনের নাম সবার প্রথমে আসে তাঁরা হলেন আচার্য শান্তরক্ষিত, পদ্মসম্ভব এবং অতীশা বা অতীশ দীপঙ্কর। তিব্বতের রাজা প্রথম ডেকে নিয়ে যান শান্তরক্ষিতকে। শান্তরক্ষিত প্রথমবার কিছুদিন থাকার পর কিছু রাজকর্মচারী ওঁর নামে অপপ্রচার শুরু করে - ঝড়/মড়ক ইত্যাদি ঘটনা ওঁর জন্যে হচ্ছে বলে। শান্তরক্ষিত তখন ফিরে আসেন। কয়েক বছর পর রাজা ফের ওঁকে ডেকে নিয়ে যান। এই দ্বিতীয় ফেজে শান্তরক্ষিত কোনো কারণে তিব্বতী দেবদেবী/ভূত ইত্যাদিদের ভয় পেতে শুরু করেন, এবং রাজাকে অনুরোধ করেন আচার্য পদ্মসম্ভবকে নিয়ে যেতে। পদ্মসম্ভব উড়িষ্যার কোনো মঠের আচার্য ছিলেন, এবং তন্ত্রে (বৌদ্ধধর্মেরই) পারদর্শী ছিলেন। কথিত আছে যে পদ্মসম্ভব তিব্বতে গিয়ে তন্ত্র দিয়ে তিব্বতী দেবদেবী/ভূত ইত্যাদিদের হারিয়ে দেন আর বৌদ্ধধর্ম প্রচারে সাহায্যের আশ্বাস দিতে বাধ্য করেন। এর পরেই শান্তরক্ষিত গোটা তিব্বতে মঠ প্রতিষ্ঠা করেন, বই অনুবাদ করে, বই লেখেন। পদ্মসম্ভব তিব্বতে গুরু রিম্পোচে নামেও পরিচিত। যে কোনো তিব্বতী মঠে দেখবে এই গুরু রিম্পোচের মূর্তি রয়েছে। এবং যেহেতু তিব্বতী buddhism অনেকটাই তন্ত্রঘেঁষা, তাই ঐ দেবদেবী/ভূত/তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদি মিস্টিক্যাল ব্যাপারের ছাপ অনেক বেশি (সিংহলী buddhism -এর তুলনায়)। পরবর্তীকালে অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে গেছিলেন - সেই সময় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কিছুটা কমে আসছিলো। এবং দীপঙ্কর নিজেও তন্ত্রে আগ্রহী ছিলেন। কাজেই সেই ছাপটাও কিছুটা পড়েছিলো।
এটুকু ঘুরে সেদিনের মতন ট্যুর শেষ। হোটেলে ফিরে আসার পর ফরচুনার লোক এলো - পরের দিন সকাল দশটায় তারা আমাদের হোটেল থেকে তুলে নেবে কথা হল। সেই মতন দময়ন্তীকে জানিয়ে দিলুম।
১৭ই অক্টোবর, যুদ্ধ শুরু
এ যুদ্ধ যে কি যুদ্ধ, তার কোনো ধারণাই ছিলো না।
দশটার সময় ফরচুনা থেকে লোক আসবে বলে সাতসকালে খেয়েদেয়ে তৈরী হতে গিয়ে দেখতে পেলুম অত গোছানোর মধ্যে ঋতির কোনো জামা আসেনি! বাকি সব এসেছে - সোয়েটার, ওয়াটারপ্রুফ, কট্সউলের গেঞ্জি - বাট্ নো জামা। ভাগ্যক্রমে ফরচুনা থেকে ফোন করে জানালো যে দশটা নয়, ওরা এগারোটায় আসবে। দময়ন্তীকে সেটা জানিয়ে আমি হাঁটা লাগালুম গ্যাংটকের এমজি মার্গের দিকে - কোনো দোকান থেকে কিছু জামা কিনতে হবে। জামা কিনে ওপরে টিবেট রোডে উঠতে গিয়ে প্রায় দম বেরিয়ে যায় আর কি - হোটেলে ঢোকার মুখে দেখি দময়ন্তী এসে গেছে। এগারোটা বাজলে চেক-আউট করে লবিতে বসে আছি তো বসেই আছি। ফরচুনাকে ফোন করলে বলে - এই আসছি, পাঁচ মিনিটমে পঁওছ যায়েঙ্গে - কিন্তু কেউ আর আসে না - সাড়ে এগারোটা বাজতে চললো। তখন ফের ফোন করাতে বলে কিনা ট্যাক্সি পাচ্ছি না। হতভাগা - আমরা আগের দিন থেকে জানি যে দশমীর দিক ট্যাক্সি পাওয়া মুশকিল হবে - নেপালীদের দশেরা মানে কেউ রাস্তায় নামবে না - আর এখানকার ট্র্যাভেল অপারেটর, তারা কিনা সে খবর রাখে না? প্রায় পৌনে বারোটা নাগাদ একজন এলো একখানি অল্টো নিয়ে (নর্থ সিকিমের গাড়িগুলোকে সকাল আটটার পর গ্যাংটক শহরের ভিতরে আসতে দেয় না, লাচেন স্ট্যান্ড অবধি ট্যাক্সি নিয়ে যেতে হয়)। পাঁচজন লোক (একটা না হয় কোলে যাবে, কিন্তু তার পরেও চারজন) প্লাস লাগেজ - আর একখান অল্টো!!! ঠিক হল দুবারে যাবো। প্রথমবার কিছু লাগেজ নিয়ে আমি আর ঋক, পরের বার বাকিরা। লাগেজ তুলতে গিয়ে ট্যাক্সির জানলার ওপরের প্লাস্টিকের শেড্ ভাঙলো (ট্যাক্সি ড্রাইভার আর ফরচুনা তারপর সেটা কিভাবে অ্যাডজাস্ট করলো সে খবর আমরা জানি না), ব্যাগদুটোকে ছাতের ওপর বাঁধেনি বলে রাস্তায় একটু এগোতেই একখানা ধড়াম করে পড়লো - সেগুলোকে তুলে ভিতরে চালান করা হল। লাচেন স্ট্যান্ডে পৌঁছে বাকিদের ফোন করে শুনি নর্থ সিকিমের গাড়িটাই নাকি তখনো আসেনি। তবে পরের ট্রিপে সুমনা, ঋতি আর দময়ন্তী আসার পরেই সেই গাড়ি চলে এলো - একখান নতুন বোলেরো - তখনও টেম্পোরারি পারমিট লাগানো।
সেই গাড়িতে রওনা তো দিলুম। গ্যাংটক শহর ছাড়ার পরই বুঝলুম শিলিগুড়ির ট্যাক্সিওয়ালা কি বলতে চেয়েছিলো ... নর্থ সিকিম হাইওয়েতে রাস্তা বলতে কিছু নেই। ওটা "নেই-রাস্তা"। পাথর, বোল্ডার, কাদা - এই দেখা যায় শুধু। পিচ? কারে কয়? পাশের পাহাড় থেকে হুড়মুড়িয়ে ঝরণা নেমে আসছে রাস্তার ওপর, তলায় বোল্ডার, তার ওপরেই গাড়ি চলছে। কোথাও ষাট ডিগ্রীতে নীচে নামছে, কোথাও উঠছে। প্রতি উঁচুনীচু ভাঙা জায়গায় ড্রাইভারে মুখ পুরো চূণ। জানা গেলো সে (মানে পাসাং) শিলিগুড়ি-গ্যাংটক রুটে ট্রাক চালায়, এই পথে কখনো আসেনি, রাস্তাও চেনে না, কোথায় কি করতে হবে তাও জানে না। গাড়ির শর্টেজ ছিলো বলে ফরচুনা ওকে অন্য একটা হোটেল থেকে তুলে এনে ভিড়িয়ে দিয়েছে। সে গাড়ি চালাবে না কপাল চাপড়াবে সেটাই ঠিক করতে পারছিলো না। ফরচুনার আরেকটা জীপকে সামনে রেখে সে যাচ্ছে।
দুপুরে খাওয়ার কথা ফোডোং বলে একটা জায়গায়। ওদিকে সেভেন সিস্টার্স (ফলস) দেখার পর সামনের সেই জীপ হাওয়া। ফোডোংএ তাকে কোথাও দেখা গেলো না, পাসাং জানেও না কোথায় কি পাওয়া যাবে - ওদিকে ক্ষিদে পেতে শুরু করেছে। বেশ কিছু দূর গিয়ে একটা "ঘাট" (সরু রাস্তা যেখানে একটা একটা করে গাড়ি পাস করে। আর এই ঘাটটা বেসিক্যালি পাঁকে ভর্তি - ফুটখানেক গভীর কাদা, একবারে গাড়িটাকে সেই কাদাভর্তি হাফ কিলোমিটারের বেশি পেরোতে হবে। দাঁড়িয়ে পড়লেই মুশকিল - চাকা আর এগোবে না) ছিলো - সেখানে দাঁড়িয়ে ঠিক করা হল এখানেই যা পাওয়া যাবে খেয়ে নেওয়া যাক - লঙ্কা আর বেগুনের তরকারি, আর চিকেনের ঝোল - খেতে খেতে সেই সবুজ জীপ এসে হাজির - তারা ফোডোং-এ কোনো এক হোটেলে দাঁড়িয়ে খেয়েছে - এমনই বেয়াক্কেলে যে নতুন ড্রাইভারকে এগুলো যে জানিয়ে দিতে হয়, সেই বুদ্ধি নেই।
তো এই রকম ভয়ানক রাস্তা দিয়ে চুংথাং পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেলো। পথে পেরোলাম মঙ্গন, রঙ্গরঙ্গ বলে ছোট ছোট কয়েকটা জায়গা। অ্যাজ ইউজুয়াল অতীব সুন্দর দৃশ্য - কিন্তু পথের অবস্থা জাস্ট ভয়াবহ।
চুংথাং থেকে রাস্তা দুভাগ হয়েছে। একদিকে লাচেন চু নদীর ধার ধরে লাচেন, অন্যদিকে লাচুং চু-র ধার দিয়ে লাচুং। আমরা যাবো লাচেনের দিকে।
একদিকে অনেক নীচে লাচেন চু ঝড়ের মত ছুটছে, ফুঁসছে (গোটা সিকিমে এই নদীর গর্জনটা কমন - যেখানেই যাও না কেন - হয় তিস্তা, নয় কালী নদী, নয় রঙ্গিত, নয়তো এদিকে লাচেন চু বা লাচুং চু), অন্যদিকে পাথুরে পাহাড়, এর মাঝে অসংখ্য হেয়ারপিন বেন্ড। এরকম ভাঙা রাস্তা না হলে বলতুম "এই পথে গাড়ি চালিয়ে থ্রিল আছে" - এরকম পাহাড়ি পাকদন্ডী রাস্তাতেই গাড়ি চালাতে আমার বহুত ভালো লাগে - হাইল্যান্ড্স বা লেক ডিস্ট্রিক্ট বা ইয়র্কশায়ারে এমনটাই - কিন্তু সেখানে এরকম ভাঙা রাস্তা নয়। অনেকটা জায়গা জুড়ে "ব্যাক-কাটিং" চলছে - মানে পাহাড়ের গায়ে ব্লাস্টিং - রাস্তা চওড়া করার জন্যে - আর সেই জন্যে রাস্তার অবস্থা এরকম ভয়ানক।
চুংথাং পেরনোর পর মোটামুটি একটা কনভয় টাইপ হয়ে গেলো - প্রায় বারোখানা গাড়ি পর পর চলছে - সবাই লাচেনের দিকে। মাঝে মাঝে মিলিটারি লরি বা জীপ যাচ্ছে। দুলতে দুলতে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে লাচেন পৌঁছলুম প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ। সন্ধ্যে থেকেই বৃষ্টিও চলছে, সাথে ঠান্ডা হাওয়া।
হোটেলে ঢুকে আরেক ধাক্কা। ভেজা ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে ঘর, টিম টিম করে আলো জ্বলছে, বাথরুমে জল নেই কো, গীজারে আলো জ্বলে কিন্তু তাতে জল গরম হয় না। আমাদের ঘরে দু পিস কম্বল, তাতে সকলের হবে না বলে আরেকখান চাইলাম। এক্সট্রা কম্বল মনে হয় ঐ এক পিস্ই ছিলো - কারণ তার পর দময়ন্তী একটা চেয়েছিলো - পায়নি। ব্লো হীটারও মনে হয় এক পিস্ই ছিলো - সেও একটা ঘরে দেওয়াতে আর কেউ পায়নি। অথচ ফরচুনার ওয়েবসাইতে বড় বড় অনেক কিছু লেখা আছে - ঘরে অমুক আছে, তমুক আছে ... আদতে কিসুই নেই। জল কখন আসবে জিগ্গেস করলে বলে "আ যায়েগা"। গরম জল চাইলে বলে "আভি দে রাহে হ্যায়"। ঐ অবধিই। পাওয়া কিছুই যায় না। দশ মিনিটে খাবার দেবে বলে প্রায় ঘন্টাখানেক লাগিয়ে দেয়। শুনলাম ওদের নাকি একটা গোটা দিন ধরে টাওয়ার (মোবাইল) ছিলো না বলে কজন আসছে কখন আসছে কোনো খবরই পায়নি। আমরা পৌঁছনোর পর রান্নাবান্নার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু তাতেও বাকি ব্যাপারগুলো - যেমন জল নেই, গীজার চলে না, কম্বল নেই ইত্যাদির কোনো এক্সকিউজ হয় না। দময়ন্তী তো ওদের ধরে পেল্লায় ধমক দিলো বেশ কিছুক্ষণ ধরে ...
ঠান্ডা যদিও সেরকম কিছু ছিলো না, তবে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরণার জলে কাজকম্মো করা সম্ভব নয়। গায়ে তখনো ঠান্ডা লাগেনি - মানে ওরকম ঠান্ডায় আমি অভ্যস্ত (ছিলুম), আর সেই অভ্যেস ভুলিনি এখনো। আমি গেছি একখান জামার ওপর একটা সামার জ্যাকেট (হাত কাটা, অনেকগুলো পকেটওয়ালা - ক্যামেরার লেন্স ইত্যাদি রাখার পক্ষে খুব উপযোগী) পরে, সুমনাও একটা সামার জ্যাকেট গায়ে, দমুরও তাই। কুচেগুলোকে অবশ্য সোয়েটার পরানো হয়েছে। আমাদের দেখে বাকি বাঙালী গ্রুপগুলো বেশ অবাকই হয়েছিলো।
১৮ই অক্টোবর, ২০১০ - গুরুদংমারের দিকে
রাতেই ড্রাইভারসকল জানিয়ে দিয়েছিলো যে একদম ভোরে বেরোতে হবে। হিমালয়ের খুব কমন ফিচার - দুপুর বারোটার পর আবহাওয়া আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে পড়ে, হাওয়া দেয়, বৃষ্টি পড়ে। যারা পাহাড়ে চড়ে তারা সকলেই ভোরে বেরিয়ে বারোটার আগে ক্যাম্পে ফিরে আসার চেষ্টা করে। এখানেও তাই। ইন ফ্যাক্ট, গুরুদংমারের আগে মিলিটারি চেকপয়েন্টে বেলা ন'টার পরে আর ঢুকতে দেয় না। কাজেই সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরোনোর প্ল্যান হল।
সাড়ে চারটের সময় উঠে দেখলুম গীজারে জল নেই। জলের কল থেকে আধ বালতি জল বেরিয়ে বন্ধ হয়ে গেলো। আর একদম বরফগলা জল। মুখ ধুতে গিয়ে মনে হল দাঁতগুলো খুলে হাতে চলে এসেছে। গরম জল চাইলাম - সেই একই "আভি দে রাহে হ্যায়"। আধা ঘন্টারও বেশি পরে আধ বালতি গরম জল পাওয়া গেলো - চারজনে সেটাই ভাগ করে চালালুম। ব্রেকফাস্ট? রাস্তায় হবে। বেরোতে বেরোতে পৌনে ছটা।
লাচেন নদীর ধার দিয়ে গাড়ি চললো - দুলকি চালে। এই ওঠে, এই নামে, এই দোলে, গাড্ডায় পড়ে ... তখন অল্প অল্প আলো ফুটছে, আর দূরে প্রথম বরফঢাকা চূড়াগুলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আগের রাতে বৃষ্টির পর আকাশ ঝকঝকে নীল, মাঝে সাদা মেঘ, আর সামনের সবুজ পাহাড়গুলোর পিছনেই বরফঢাকা চূড়া। মোড় ঘুরলেই ঝরণা বয়ে যাচ্ছে, রাস্তার ওপর দিয়েই। বোল্ডারের ওপর দিয়ে গাড়িগুলো এক এক করে পার হয়। আর দেখলাম "ইন্ডিয়ান ফল কালার্স'"- এক একটা জায়গায় পাহাড়ের গায়ে গাছগুলো লাল-হলুদ হয়ে রয়েছে। ছবি তুলতে গেলে একটু সময় দিয়ে তুলতে হত - সেই সময় ছিলো না, আর গাড়ির ঝাঁকুনিতে চলন্ত গাড়ি থেকে তোলাও সম্ভব ছিলো না। আস্তে আস্তে ওপরে উঠছি - গাছ কমতে কমতে শুধু পাথুরে পাহাড়ী এলাকা - স্নো লাইন ক্রমশ: কাছে আসছে, বরফঢাকা চূড়াগুলোও। মাঝে মাঝে দু একটা মিলিটারি ক্যাম্প, আর আমাদের কয়েকটা গাড়ি ছাড়া রাস্তায় শুধু মিলিটারি লরি। চোদ্দ হাজার ফুটে একটা ক্যাম্পে পাস দেখাতে হল, সেটা পেরনোর পরেই থাংগু বলে একটা ছোট গ্রাম - সাড়ে চোদ্দ হাজার ফুট। গ্রামে ঢোকার মুখেই একটা ছোট ব্রীজ, নীচ দিয়ে লাচেন চু বয়ে যাচ্ছে ঝড়ের মতন। থাংগুতে চা খেলুম, সঙ্গে পপকর্ন - ঐ উচ্চতায় কম অক্সিজেন লেভেলে পপকর্ন নাকি উপকারী। ব্রেকফাস্টের জন্যে দোকানী মেয়েটি একটা পাত্রে কিছু মোমো প্যাক করে দিলো - বললো ফেরার পথে পাত্রটা দিয়ে যেতে, "নেহি তো পাপা মারেগি"। একটা ছোট বোতল ব্র্যান্ডিও কিনে নিলুম - যদি দরকার পড়ে।
থাংগুর পর পুরোপুরি স্নো-লাইনের ওপর। রাস্তার ধারে আর গাছ নেই, কিছু কিছু জায়গায় অনেকটা হেদারের (heather) মতন লাল লাল ফুল টাইপের হয়ে রয়েছে। বাকি শুধু পাথর, বোল্ডার আর ব্যারেন ল্যান্ড, এদিক ওদিক বরফ। আস্তে আস্তে আরো ওপরে ওঠার সাথে সাথে বরফের পরিমাণ বাড়তে শুরু করলো। তারই মধ্যে একটার পর একটা মিলিটারি ব্যারাক। একটা আর্টিলারি ইউনিট রয়েছে, আশেপাশে প্রচুর বাঙ্কার, কোথাও বোর্ডে লেখা "এক গোলি, এক দুশমন", কোথাও বা "রেসপেক্ট অল, সাসপেক্ট অল"। এই সব পেরোতে পেরোতে পৌঁছলুম ষোল হাজার ফুটের কাছাকাছি। আরেকটা মিলিটারি ক্যাম্প আর আবার পাস দেখানো। পাসাং গেলো পাস দেখাতে, আমরা গাড়িতে বসে রইলুম। সামনে যতদূর চোখ যায়, শুধু একটা বরফের মরুভূমি শুয়ে রয়েছে।
জানলায় টকটক শুনে দেখি এক আপাদমস্তক গরম কাপড়ে ঢাকা চোখে ঢাউস গগল্স পরা এক মিলিটারি "আফ্সার" আমায় ডাকছেন। জানলা খুলতে ঋতিকে দেখিয়ে জিগ্গেস করলেন "এই বাচ্চাটার বয়স কত?" - আমি বল্লুম তিন। তখন তিনি বল্লেন - "আপনাদের একটা রিকোয়েস্ট করছি - এটা মেডিক্যাল অ্যাডভাইস। আপনারা এই বাচ্চাটাকে নিয়ে ওপরে যাবেন না। এখান থেকে গুরুদংমার আরো ষোল কিলোমিটার, আর প্রায় আরো দু হাজার ফুট উঁচু। সেখানে অক্সিজেন লেভেল ভীষণই কম। প্রায় সমস্ত বাচ্চাদের সমস্যা হয়। আমরা পাঁচ বছরের কম বয়সী বাচ্চা আর বয়স্কদের যেতে বারণ করি।"
আমি বল্লুম যে এই মেয়ে তো জুংফ্রাউয়ে বারো হাজার ফুট অবধি ঘুরে এসেছে, এখানেও এতদূর এসেছে, কোনো সমস্যা হয়নি তো। তো তিনি বল্লেন - "আপনারা যেতেই পারেন, তবে আপনাদের রিস্কে। যদি কিছু হয়, আমাদের এখানে কোনো মেডিক্যাল ফেসিলিটি নেই যে দরকারে আপনাদের সাহায্য করবো। আমাদের এক্সট্রা গাড়িও নেই যে আপনাদের তাতে করে হাসপাতাল পাঠাবো। বাকি ট্যুরিস্ট গাড়িগুলোকেই বড়জোর অনুরোধ করতে পারি, আর এই রাস্তায় পাঁচ-দশ কিলোমিটার স্পীডে কখন হাসপাতালে পৌঁছবেন সেটা তো বুঝতেই পারছেন।"
সেদিনই নাকি আরেকটি বাচ্চার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিলো, এবং কিচ্ছু করতে না পেরে তার বাপ-মা ওখানে কেঁদে ভাসিয়েছে। ঋতি তখনও অবধি ঘুমোচ্ছিলো - অনেক ভোরে উঠেছে, আর ওর এখনও পাহাড়/বরফ দেখে আনন্দ পাবার বয়স হয়নি। আমরা একটু ঘাবড়ে গিয়ে ওকে ডাকলুম - জিগ্গেস করা হল যে শরীর খারাপ লাগছে কি না। ঋতি প্রথম কথাই বললো যে মাথায় ব্যথা করছে। হাতে-পায়ে-গলায়-কানে নয়, সোজা মাথায় ব্যথা - যেটা হল কম অক্সিজেন লেভেলের প্রথম সিম্টম। ঋকও বললো মাথায় ব্যথা করছে। ওদিকে আমাদের বাকি কারোরই কোনো প্রবলেম হচ্ছে না।
তখন একবার ভাবলুম যে ফরচুনার তো তিনটে গাড়ি এসেছে, আর অন্য দুটো গাড়িতেই ছোট বাচ্চা আছে। তাহলে একটা গাড়িতে বাচ্চাগুলো আর একজন করে বড়দের যদি নীচে নামিয়ে দেওয়া হয় (ঐ ক্যাম্পেও বসে থাকা যাবে না বলেছিলো মিলিটারি), তাহলে বাকি দুটো গাড়িতে বড়রা যারা যেতে পারবে তারা গুরুদংমার অবধি গিয়ে আবার নেমে আসবে। আরেকটা গ্রুপের সাথে সেই মত কথাও হল, কিন্তু শেষমেষ প্ল্যানটা লাগলো না (কেন, সেটা বুঝেছিলুম আরো পরে) - আর ঐ ষোল হাজার ফুট থেকেই গুরুদংমারকে টা-টা করে নীচে নেমে আসতে হল।
দু:খ রয়ে গেলো - অতদূর গিয়েও খালি হাতে ফিরতে হল বলে। আর একটা বোকামি করলুম - ঐ ক্যাম্পে ছবি তোলা বারণ, কিন্তু ওখান থেকে আর কিলোমিটারখানেক গেলেই ঐ বরফের মরুভূমির ছবিগুলো অন্তত তুলে আনা যেত ...
ফেরার পথে দু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুল্লুম। চোপতা ভ্যালীর দিকে এক চক্কর দিয়ে আসা হল। চোপতা ভ্যালী আসলে পাহাড়ের নীচে প্রায় মার্শল্যান্ড বলা যায় - একটা জোলো জায়গা, তার মাঝে মাঝে কয়েকটা বাড়ি নিয়ে একটা গ্রাম। ওপরদিকে একটা স্নো-পিক বেশ কাছেই, ঋক তার নাম দিলো "ভ্যানিলা অ্যাণ্ড চকোলেট আইসক্রীম"।
লাচেনের অল্প আগে ফরচুনার একটি গাড়ি বিগড়ে গেল। তাকে ঠিক করার জন্যে বাকি সমস্ত গাড়ির ড্রাইভারেরা লেগে পড়লো। এদের এই ইউনিটিটা দেখার মতন। একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লে সকলে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে। অবিশ্যি এতে স্বার্থও রয়েছে, কারণ একটা গাড়ি খারাপ হয়ে রাস্তা আটকে রাখলে সকলেরই অসুবিধা। সেই গাড়ি ঠিক হওয়া অবধি আমরা দাঁড়িয়ে রইলুম। শেষে লাচেন অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বেলা দুটো। জলের ক্রাইসিস তখনো রয়েছে - অন্য বাড়ি থেকে জল এনে দিচ্ছে বালতি করে। এরকম কিছু জল যোগাড় করে কাজকম্মো সারা হল। চান তো তার আগের দিন থেকেই বন্ধ ...
দুপুরে খাওয়া মিটিয়ে আবার সেখান থেকে রওনা দিলুম লাচুংএর দিকে। প্রথমে লাচেন চু-র ধার দিয়ে দিয়ে চুংথাম অবধি, আর সেখানে বাঁদিকে বেঁকে লাচুং চু-র ধার দিয়ে দিয়ে লাচুং অবধি। এই রাস্তাটা তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো। চুংথাম থেকে লাচুংএর দূরত্ব ২১ কিলোমিটার, আর রাস্তা ভালো বলে পৌঁছতে বেশি সময় লাগে না।
পথে পড়লো "ভীম নালা' বলে একটা জলপ্রপাত, সেখানে কিছু ছবি তুলে বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমরা হাজির হলাম লাচুংএ। ফরচুনা লাচেনের হালত দেখে ধরে নিয়েছিলুম যে লাচুংএও অমনই কিছু একটা হবে, কিন্তু না - ফরচুনা লাচুং লাচেনের থেকে ঢের ভালো। গ্যাংটকের সোনম-ডে-লেক না হতে পারে, কিন্তু ঐ চত্বরে যা দেখেছি তার চেয়ে ঢের ভালো। গীজার চলে, তাতে গরম জল পাওয়া যায়, এবং ঘরে আলো-টালো জলে, দরজায় চাবিও আছে (লাচেনে আবার চাবি ছিলো না)। সন্ধ্যেয় একটু চা টা খেয়ে ল্যাদ খেতে শুয়ে পড়লুম সকলে। পরের দিন ফের ভোরে উঠে কাটাও-ইয়ুমথাং-জিরো পয়েন্ট ঘোরা।
সিকিমের রাস্তার ধারের গ্রামগুলো মোটামুটি টিপিক্যাল। দুটো কমন জিনিস লিখছি।
এক নম্বর - গ্রামের আশেপাশে প্রচুর পতাকা টাঙানো দেখা যায়, হয় সারি সারি সাদা পতাকা, নয়তো পর পর লাল-নীল-হলুদ-সবুজ কিছু পতাকা। সবগুলোতেই মন্ত্র লেখা (ঐ "ওঁ মণিপদ্মে হুম" জাতীয়)। এই দুই ধরণের পতাকার আলাদা মানে আছে। সাদা পতাকা হল যারা মারা গেছে তাদের আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে টাঙানো, বা ভূত তাড়ানোর জন্যে টাঙানো। আর রঙীন পতাকাগুলো গ্রামের শান্তিকল্যানের জন্য - যাতে ফসল ভালো হয়, পাহাড়ে ধ্বস না নামে ইত্যাদি। পতাকাগুলোর আরেকটা উপকারিতা আছে - দূর থেকে দেখলে কাছাকাছি জনবসতির খোঁজ পাওয়া যায়।
দুই নম্বর - প্রায় সমস্ত গ্রামেই একটা জলচালিত ধর্মচক্র দেখা যায়। ধর্মচক্র অর্থাৎ জপযন্ত্র, কিন্তু পেল্লায় সাইজের। রাহুল সাংকৃত্যায়ন "তিব্বতে সওয়া বছর" বইতে তিব্বতের গ্রামগুলোর যা বর্ণনা দিয়েছেন, একেবারে সেই জিনিস। ঐ বইতে এগুলোকে বলা হয়েছে "মাণী", সিকিমে বলে "ধর্মচক্র"। এর ভিতরেই সেই কাগজে লেখা "ওঁ মণিপদ্মে হুম" মন্ত্রটি থাকে, এবং জলের শক্তিতে এটা ঘুরতেই থাকে, ঘুরতেই থাকে - কখনও না থেমে। প্রতিবার ঘোরায় এক একটা পাপ ধুয়ে যায়। গ্রামের সকলের নিখরচায় পূণ্য অর্জন হয় এই ধর্মচক্র ঘোরার ফলে। কোথাও এর সাথে একটা ঘন্টাও লাগানো থাকে, প্রতিবার ঘোরার সময় টুং করে একটা আওয়াজ হয়।
১৯শে অক্টোবর: কাটাও, ইয়ুমথাং, জিরো পয়েন্ট হয়ে গ্যাংটক
ফরচুনা আরো যে দু নম্বরিটা করেছিলো সেটা হল নিষ্পাপ মুখে প্যাকেজে কাটাও রাখা। হোটেলের লোক এবং ড্রাইভারেরা সকলেই এক বাক্যে বললো যে কাটাও তো যেতে দেয় না - মিলিটারি আটকে দেয়। তাও যেহেতু প্যাকেজে আছে, তাই চেষ্টা করা হবে। সকালে বেরিয়ে আগে কাটাও। ফিরে এসে ব্রেকফাস্ট খেয়ে ইয়ুমথাং/জিরো পয়েন্ট। জিরো পয়েন্ট প্যাকেজে নেই, তাই ওর বাড়তি পয়সাটা ড্রাইভারকে দিয়ে দিলেই হবে। পাসাং ছেলেটা বেশ ভালো - মুখ থেকে হাসি যায় না, আর কোনো কিছুতে অরাজী হয় না। তার ওপর ঋক আর ঋতির সাথে জবরদস্ত দোস্তি হয়ে গেছে।
ভোর পাঁচটা থেকে আমরা সবাই রেডি, কিন্তু পাসাংএর পাত্তা নেই। শেষে যখন এলো তখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। তড়িঘড়ি কাটাওয়ের দিকে রওনা দিলাম। কাটাও যেতে হয় লাচুং থেকে অল্প কিছুটা নেমে এসে নদী পেরিয়ে অন্য একটা রাস্তা দিয়ে। তুলনামূলকভাবে ভালো রাস্তা (লাচেন-এর চেয়ে অনেকগুণে ভালো), কিন্তু বেজায় প্যাঁচালো আর চড়াই - এবং সরু। ভাগ্য ভালো ঐ রাস্তায় গাড়ি প্রায় নেই বল্লেই চলে - তাই কোথাঐ আটকায়নি - ঘুরতে ঘুরতে উঠতে উঠতে অনেক উঁচুতে উঠে যাচ্ছিলাম। নীচের দিকে তাকালে অবাক লাগে - যে ঐ রাস্তা দিয়ে আমরা উঠে এসেছি।
নর্থ সিকিমের গোটা সময়টাতে সকালের দিকে আমরা অবিশ্বাস্য ভালো আবহাওয়া পেয়েছি। পুরো ঝকঝকে নীল আকাশ, সাদা মেঘ, আর দূরে বরফে ঢাকা চূড়া - একদম ক্যালেন্ডারের ফটো। হিমালয়ে এসে এত ভালো আকাশ না পেলে মন খুঁতখুঁত করে, ছবিগুলোতে আকাশ কেমন ঘোলাটে থাকে (লাভা/লোলেগাঁওতে যা পেয়েছিলুম) - ভাল্লাগে না। এইবার, লাচেন থেকে গুরুদংমার যাওয়ার সময় এবং লাচুংএও, আবহাওয়ার কারণে ছবিগুলো ব্যাপক উঠেছে। তবে এই সময়েই যে পশ্চিম হিমালয়ে আবহাওয়া ঘোঁট পাকাচ্ছে সে খবর জানা ছিলো না। নর্থ সিকিমে বিএসএনএল ছাড়া আর কারও সিগন্যাল পাওয়া যায় না বলে বাইরের সাথে যোগাযোগ ছিলো না যে এসব খবর পাবো।
ঘন্টাখানেক ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে ওঠার পর একটা মিলিটারি ক্যাম্প - এবং সেখানে আটকে গেলাম। গত এক বছরের কিছু বেশি সময় ধরে নাকি কাটাও যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এবারে আরে মেডিক্যাল অ্যাডভাইস নয়, পরিষ্কার "অর্ডার নেহি হ্যায়"। তবে এখানে ছবি নিতে আটকালো না - ক্যাম্পের ছবি না তুললেই হল। ক্যাম্পের ছবি তোলার কোনো দরকারও ছিলো না - কারণ উল্টোদিকে সোজা তাকালে ঝকঝকে আকাশে বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আমি আগে কখনো কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখিনি - লোলেগাঁও আর রিশপে মেঘের জন্যে দেখা যায়নি - কাজেই ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দূরে কাঁচনজঙ্ঘা, তার অল্প আগে বরফে ঢাকা আরেকটা চূড়া - মিলিটারির ভদ্রলোক নামটা বলতে পারলেন না। ছবি তুলতে তুলতে কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘে ঢাকতে শুরু করলো - আজনবি মুসাফিরকে মুখ দেখিয়েই সম্রাজ্ঞী মুখ ঢাকলেন। কিছুক্ষণ মিলিটারীর ঐ দুজনের সাথে গেঁজিয়ে, গরম জল খেয়ে (চা-ও খাওয়াতে চাইছিলেন, মনে হল লোকের মুখ দেখতে পেলে এঁরা ভারী খুশী হন) আবার ঘুরতে ঘুরতে নামা।
লাচুংএ ফিরে শুনলাম বাকি সবকটা গাড়ি অনেকক্ষণ রওনা দিয়েছে ইয়ুমথাংএর দিকে। কেউই আর কাটাও যায়নি। আমরাও আর না দাঁড়িয়ে ব্রেকফাস্টের প্যাকেট সঙ্গে নিয়ে ইয়ুমথাংএর দিকে রওনা দিলাম।
লাচুং থেকে ইয়ুমথাং খুব দূর নয়, এবং প্রথমদিকটা রাস্তাও মন্দ নয়। দু একটা গ্রাম, মিলিটারি ক্যাম্প পার হয়ে যেতে হয়। এবং অল্প দূর যাওয়ার পরেই দুদিকে ক্যালেন্ডারের ছবির মতন দৃশ্য শুরু হয়ে যায় - নীল আকাশ, সাদা মেঘ, মাঝে বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া। ইয়ুমথাংএর কয়েক কিলোমিটার আগে একটা রডোডেনড্রনের বন পার হতে হয়। রাস্তার দুপাশে যতদূর চোখ যায় নানা রকম রডোডেনড্রন গাছ। মাঝে মাঝে বোর্ড লাগানো - গাছের হিসেব দিয়ে। কিন্তু অক্টোবর মাস - আধখানা ফুলও কোথাও ফুটে নেই। তবে গাছের সংখ্যা দেখে আন্দাজ করা যায় মার্চ-এপ্রিলে জায়গাটার কি চেহারা দাঁড়াতে পারে।
রডোডেনড্রন উপত্যকা পার হওয়ার পরেই ইয়ুমথাং। যদিও এই উপত্যকা পার হতে হতে কোমর ভাঙার বড়সড় সম্ভাবনা রয়েছে। পাহাড় থেকে একটা ঝরনা নেমেছে, সাথে অসংখ্য বোল্ডার। রাস্তাটা ঘুরে ঘুরে বার বার ঐ ঝরনার ওপর দিয়ে চলেছে, নৌকোর মতন দুলতে দুলতে - পাথরের নদী নয়, উহাই পথ। রডোডেনড্রন উপত্যকার মধ্যে দিয়ে হাঁটা পথও রয়েছে - আর আমার ধারণা মার্চ-এপ্রিলে হাঁটা পথটাই ভালো। ফুলও দেখা যাবে একদম সামনে থেকে, আর কোমরও আস্ত থাকবে।
ইয়ুমথাংএ ঢোকার মুখে সারি দিয়ে দোকান, এবং প্রচুর লোকের ভিড়। এখানে দাঁড়াবেন না, আরেকটু এগিয়ে যান। সামনে পড়বে একটা বিরাট উপত্যকা, দুপাশে সারি দিয়ে উঁচু পাহাড়, আর দূরে, যেখানে দুদিকের পাহাড় মাঝখানে এসে মিলছে, সেখানে একটা মেঘে ঢাকা পাহাড়চূড়া। মেঘ এসে তার চূড়াটাকে এমনভাবে দেখেছে যে দেখলে মনে হয় একটা আগ্নেয়গিরি দাঁড়িয়ে রয়েছে - যার মাথা থেকে সাদা ধোঁয়া বেরোচ্ছে। উপত্যকার এক পাশ দিয়ে লাচুং চু বয়ে চলেছে, তার ওধারে ঘন পাইনের জঙ্গল। রাস্তা থেকে নেমে এগিয়ে যান নদীর দিকে - হাঁটাপথের দুধারে দেখবেন গাদা গাদা ইয়াক্ ঘুরছে। সবুজ ঘাস থেকে একটু নেমে যান পাথরের ওপর, জল ছুঁতে পারেন। বা একটু বসে থাকতে পারেন পাথরের ওপর, মিঠে রোদ্দুরকে পিঠে নিয়ে। বসে বসে দূরে ঐ আগ্নেয়গিরির মতন চূড়াটাকে দেখুন ... চারিদিকে বাকি পাহাড়গুলোর মাথার ওপর মেঘ পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে, কিন্তু দূরের ঐ পাহাড়টা ঠিক তেমনি ভাবেই মাথার ওপর সাদা ধোঁয়ার মতন মেঘ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ইয়ুমথাংএ কিছুক্ষণ কাটিয়ে এগোলাম জিরো পয়েন্টের দিকে - ইয়ুমথাং থেকে ঘন্টাখানেক দূরত্বে। এবার ক্রমশ: ওপরে উঠতে থাকা, সরু আর প্যাঁচালো রাস্তা। লাচুং নদী আস্তে আস্তে নীচের দিকে নামতে থাকলো। রাস্তার দুপাশে গাছের সংখ্যাও কমতে শুরু করলো। এর মাঝে এক একটা জায়গায় দেখলাম পাথরের গায়ে লালচে রঙের শেওলা। লাচুং চু-এর ধারে পাথরে এমনভাবে শেওলা ধরে রয়েছে যে রিভারবেডটা অবধি লালচে দেখায়।
রাস্তার দুপাশে গাছ কমতে কমতে শূণ্যতে এসে ঠেকলো, শুরু হল দুপাশে যতদূর চোখ যায় ততদূর অবধি পাথুরে বন্ধ্যা জমি। এই পথে একটা মিলিটারী ক্যাম্প চোখে পড়ে, কিন্তু তারপর আর কিছু নেই। দু এক জায়গায় আশেপাশে দেখে মনে হল কিছু বাঙ্কার রয়েছে, কিন্তু ক্যাম্প বা কোনো লোকজন (ট্যুরিস্ট ছাড়া) চোখে পড়লো না। তাও এক সময়ে এমন অবস্থা যে যতদূর চোখ যায়, ঐ পথে যাচ্ছে এমন একটা গাড়িও চোখে পড়ে না। ফিরছে অনেক গাড়ি, কিন্তু কেউই যাচ্ছে না। আমরা ভাবছিলুম দেরী হয়ে গেলো কি? কেউ তো আর যাচ্ছে না, সবাই ফিরছে। শেষে বেশ খানিকক্ষণ পর পিছনে আর একটা গাড়ি দেখে নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো - যে না, লোকে এখনও যাচ্ছে। চলতে চলতে এক জায়গায় রাস্তা শেষ। তারপর আর কিছুই নেই - পাথুরে জমি, আর দূরে কিছু বরফে ঢাকা পাহাড় ছাড়া। এই হল জিরো পয়েন্ট।
এবং এখানেও প্রচুর গাড়ি আর লোকের ভিড়। অল্প কিছু দোকান যেখানে তুমুল শস্তায় রাম/হুইস্কির বোতল বিক্রি হচ্ছে। অনেকে লাইন দিয়ে কিনছে। অ্যাজ ইউজুয়াল হুল্লোড়ও চলছে - একটা গ্রুপ থেকে তারস্বরে "হিপ হিপ হুররে"-ও শুনলাম। বুঝি না, লোকে এসব জায়গায় কি করতে যায় ... আমার তো এখানে চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে, অনেকক্ষণ। ঐ পাহাড়গুলোকে দেখলে নিজেকে কেমন যেন পিঁপড়ের মতন মনে হয়। সেখানে "হিপ হিপ হুররে" কেমন বেমানান লাগে।
এই সময়ে হঠাৎ দু এক পশলা হালকা বৃষ্টি নামলো - ঠাণ্ডায় বৃষ্টির জল জমে ছোট ছোট দু চারটে স্নো-ফ্লেক হয়ে পড়তেই আবার একচোট হুল্লোড়। ছাপোষা বাঙালী ট্যুরিস্টদের "তুষারপাত" দেখার শখও মিটে গেল (হুল্লোড় শুনে যা বুঝলুম)। পোলারাইজার লাগিয়ে ছবি তুলছিলুম, সেটা লেন্স থেকে খোলার সময় একজনের কনুইয়ের গুঁতোয় সেটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে কাঁচ চটে গেলো ...
জিরো পয়েন্ট থেকে ফেরার পথে আর কোথাও দাঁড়ানো নয় - সেই আঁকাবাঁকা পথে নামতে নামতে, ঝরনার বয়ে আনা পাথরে ওপর দুলতে দুলতে বেলা দুটো নাগাদ লাচুং।
গাড়ি থেকে নেমে দেখি হোটেলের সামনে বেশ ভিড় - কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। এগিয়ে গিয়ে শুনি সেই যে গ্রুপটার গাড়ি বারকয়েক খারাপ হচ্ছিলো, সেটা ইয়ুমথাং যাওয়া-আসার পথে নয় নয় করে বার দশেক বিগড়েছে। শেষে ঐ গ্রুপটা প্রায় দশ কিলোমিটার হেঁটে লাচুং পৌঁছেছে। সে গাড়ি আর যাবে না, আর ওখানে গাড়ি সারানো বা অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করাও সম্ভব নয়। মানে ঐ গাড়িতে যে কজন লোক ছিলো তাদের আর তাদের মালপত্র অন্য দুটো গাড়িতে ভাগাভাগি করে গ্যাংটক অবধি নিয়ে যেতে হবে। উপায় নেই, এসব সিচুয়েশনে কাউকে ঐ অবস্থায় ফেলে আসা সম্ভব নয় - কাজেই ঠিক হল অন্য গাড়িটাতে ওঁদের গ্রুপের দুজন আর বাচ্চাটা যাবে, আর আমাদের গাড়িতে বাকি তিনজন। অন্য গাড়িটার মাথায় কেরিয়ার নেই, কাজেই মালপত্র যা যাবে সব আমাদের গাড়ির মাথায় তুলতে হবে - ইনক্লুডিং আমাদের মালপত্র।
পরে মনে হয়েছে ভাগ্যিস আমাদের কপালে ঐ গাড়িটা পড়েনি - পড়লে কি করতুম জানি না। অন্য গাড়িটার ড্রাইভার খুবই যুক্তিসঙ্গতভাবে কেরিয়ার নেই বলে মালপত্র নিতে রাজী হল না বলে ঐ গ্রুপের একজনের মুখে "হাতি কাদায় পড়লে ব্যাঙেও লাথি মারে" শুনে মনে হয়েছিলো আমরা বিপদে পড়লে ওঁদের কাছ থেকে সাহায্য পেতাম কি?
খুব তাড়াতাড়ি করে দুপুরের খাওয়া সেরে সমস্ত মালপত্র গাড়ির মাথায় তুলে প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে বেঁধে রওনা দিতে দিতে আড়াইটে বেজে গেলো। লাচুং থেকে চুংথাং আসতে বেশি সময় লাগলো না। চুংথাংএর পর থেকে সেই ভয়ংকর ব্যাককাটিংওয়ালা রাস্তা শুরু। একটা জায়গায় ওপরে পাহাড় রাস্তার ওপরে এসে পড়েছে, নীচে খানাখন্দ, আর তারও নীচে, মানে রাস্তার তলায় মরচে ধরা লোহার বিম দিয়ে আটকানো। রাস্তাটা দেখে আমার একটাই কমেন্ট ছিলো - "এখান দিয়ে আমরা গেছি?" যাওয়ার সময় অন্ধকার ছিলো বলে বোঝা যায়নি, কিন্তু দিনের বেলা ঐ অংশটা পার হতে যে কোনো লোকের হার্ট প্যালপিটেশন হবে। ওটা পেরনোর কিছুক্ষণ পর গাড়িটা উল্টোদিকের পাহাড়ে চলে গেলো - তখন দূর থেকে ঐ অংশটা দেখা যাচ্ছিলো - আর আমরা এই কথাগুলোই বলাবলি করছিলুম।
চুংথাং ছাড়িয়ে গ্যাংটকের দিকে অল্প কিছুদূর গিয়েই আটকে গেলুম। লাইন দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে। শোনা গেল একখানি লরি নাকি উল্টে গেছিলো, সেখানাকে তোলার চেষ্টা চলছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে গেলুম - প্রায় দেড় কিলোমিটার ধরে হাঁটছি তো হাঁটছিই - গাড়ির লাইন আর শেষ হয় না - শেষে এক জায়গায় গিয়ে দেখলুম মূর্তিমান লরিটি মাথা উঁচু করে খাদে গড়িয়েছেন, তখন নাকটা রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছে, আর একটি টো-ট্রাক তাকে তোলার চেষ্টা করছে। গাড়ির কাছে ফিরে এলুম। উল্টোদিকে মেঘের আড়ালে একখানা বরফঢাকা চূড়া মুখ দেখাচ্ছে - তার ছবি তুল্লুম - সময় কাটাতে হবে তো। শুনছি আর আধ ঘন্টা লাগবে, তারপর শুনলাম আরো আধ ঘন্টা লাগবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল। রাস্তার ধারের ঝোপে ঝাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকতে শুরু করলো। রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িগুলো কয়েকটা অল্প আলো জ্বালিয়েছে, তাছাড়া আর কোনো আলো নেই। গাড়িতে জলের আকাল। খাবারের আকাল। সঙ্গী অন্য তিনজনের কাছ থেকে বাচ্চাদুটোর জন্যে একটু জল পাওয়া গেলো। সাড়ে চারটে থেকে আস্তে আস্তে সাড়ে ছটা, শোনা গেলো লরিবাবাজী উঠেছেন, এক্ষুনি গাড়ি ছাড়তে শুরু করবে। সাতটা নাগাদ গাড়ি নড়লো - কিন্তু কিছুদূর এগিয়েই আবার আটক। সামনে একটা গাড়ি রাস্তার বাঁদিকের নালায় চাকা আটকে ফেলেছে। ততক্ষণে উল্টোদিকের গাড়িও এসে গেছে - পাশ কাটানোর জায়গা নেই - অতএব ফের বসে থাকো। বৃষ্টি নেমেছে, নীচে নামার উপায় নেই, জায়গাও নেই। এরই মধ্যে সিকিমের কিছু পুলিশ দৌড়োদৌড়ি করে কিছু গাড়িকে একটা চওড়া জায়গায় ঢোকানোর ব্যবস্থা করলো যাতে নালায় পড়া গাড়িটাকে পাশ কাটানোর জায়গা হয়। সে গাড়ি পার হওয়ার পরেও জ্যাম আর কাটে না - এবার সামনে একটি মারুতি অমনি ট্যাক্সি, যার ব্রেক কাজ করে না ... এই সব নানা ঝক্কি কাটিয়ে গাড়ি যখন ফাইনালি চলতে শুরু করলো তখন সাড়ে সাতটা। পাক্কা তিন ঘন্টা পরে।
এর মধ্যে মোবাইলে সিগন্যাল এসেছে। ওয়ান পিস আছি সেই খবরটা বাড়িতে দিয়ে হোটেলে ফোন করলাম যাতে রাতের জন্যে কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে রাখে - কারণ ডিনার টাইমের ঢের পরে গ্যাংটক পৌঁছবো। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জল আর বিস্কুট কিনে দে দৌড় - ঐ রাস্তায় যতটা তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। পথে সেই পাঁকে ভর্তি অংশটুকু - বৃষ্টি হয়ে অবস্থা আরো খারাপ - একটা একটা করে গাড়ি এগোচ্ছে। আমাদের দুটো গাড়ি আগে একটা গাড়ি অর্ধেক উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো - আর টানতে পারছে না। একবার নয়, বার তিনেক। শেষে নেমে এসে কয়েকজন লোক নামিয়ে ওজন কমিয়ে সে পাঁক পার হল - লোকগুলো ঐ পাঁক হেঁটে পেরিয়ে ফের গাড়িতে উঠলো।
গ্যাংটকে ঢুকলাম তখন দশটা বেজে গেছে। আমাদের হোটেলে নামিয়ে গাড়ি বাকিদের নামাতে চলে গেলো। সেই সতেরো তারিখে শেষ চান করেছি - ভেবেছিলাম গ্যাংটক পৌঁছে চান করবো। কিন্তু এন্থু শেষ। কোনোরকমে ঘুমন্ত ছেলেমেয়েদুটোকে খাইয়ে নিজেরা খেয়ে সোজা বিছানায়।
২০শে অক্টোবর, গ্যাংটক থেকে পেলিং
গায়ে গতরে ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙলো। তখন সবে দিনের আলো ফুটছে। বাকি সবাই তখনো গভীর ঘুমে। জানলার পর্দা সরাতেই দূরে একটা বরফে ঢাকা পাহাড় চোখে পড়লো। নামধাম জানি না - গোটা ট্রিপে আরো অনেক পাহাড়ের মতই। এই আরেকটা জিনিস বাইরের কোনো দেশে হলে করে ফেলতো - কাটাও বা জিরো পয়েন্টে একখানা বোর্ড লাগাতো, তাতে কোনটে কোন peak সেই ইনফরমেশনটা লেখা থাকতো ছবিসহ। এরকম ছবি কিনতে পাওয়া যায়, কিন্তু ভিউপয়েন্টে এই ইনফরমেশনটা খুব হেল্পফুল।
যাওয়ার সময় গ্যাংটকে ছিলাম সোনম-ডেলেক বলে একটা হোটেলে। নর্থ সিকিম থেকে ফিরে উঠেছিলাম মিন্টোক্লিং গেস্ট হাউজে। দুটোই স্বচ্ছন্দে সকলকে রেকমেন্ড করবো। সোনম-ডেলেক হল এমজি মার্গ থেকে ওপরদিকে উঠে বাঁদিকে ঘুরে টিবেট রোডের মাথার কাছে। এমজি মার্গের হইহট্টগোল নেই, অথচ রাস্তাটা খুবই কাছে। হোটেলটাও পরিষ্কার। হোটেল পরিষ্কার কিনা সেটা এক ঝলকে বুঝবেন জানলায় ঝোলানো পর্দা দেখে। বাজেট হোটেলের মধ্যে খুব কমই পাবেন যেখানে ঝকঝকে সাদা পর্দা ঝোলে। মিন্টোক্লিং আরো একটু ওপরে, সেক্রেটারিয়াট রোডে, খুব চুপচাপ একটা জায়গায় - ফ্যামিলি-রান গেস্টহাউজ। খাবার খুব ভালো, এবং ব্যবহারও। এবং এই হোটেলটাও খুব পরিচ্ছন্ন। কেউ গ্যাংটক গেলে এই দুটো হোটেলের নাম মাথায় রাখতে পারেন।
দশটা-এগারোটা নাগাদ পেলিংএর দিকে রওনা দেবার ইচ্ছে ছিলো। হোটেলে ট্যাক্সির খোঁজ করতে গিয়ে প্রথমে বেশ বড়সড় রেট শুনলাম। তারপর দময়ন্তী শুনলাম তার প্রায় অর্ধেক রেটে ট্যাক্সি পেয়েছে - ওয়াগন-আর। ওকে বল্লাম তাহলে ওটাতেই মাথায় জিনিসপত্র তুলে একসাথে পেলিং চলে যাই। সেই মতন কথাও হল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দময়ন্তী ফোন করে জানালো ওয়াগন-আর নয়, একখান অল্টো পাঠিয়েছে, যার মাথায় কেরিয়ারও নেই। কাজেই আগের প্ল্যান বাতিল করে এমজি রোডের দিকে হাঁটা দিলুম ট্যাক্সির খোঁজে। হোটেল থেকে ট্যাক্সির যা রেট বলেছিলো তার চেয়ে অনেক কমে, ইনফ্যাক্ট দময়ন্তীকে যা রেট দিয়েছিলো তার চেয়েও কমে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলুম - অল্টোই, তবে চারজন + মালপত্র অনায়াসে চলে যাবে। ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে এসে জিনিসপত্র তুলে বেরোতে বেরোতে পৌনে বারোটা। পেলিং গ্যাংটক থেকে প্রায় পাঁচ ঘন্টার রাস্তা। অনেকটা নেমে সিংথাম হয়ে সাউথ সিকিমের রাবংলা পেরিয়ে পেলিং (ওয়েস্ট সিকিম) যেতে হয়।
হোটেলে বেশ ভারি ব্রেকফাস্ট করা ছিলো। তাও ছেলেমেয়ের দুপুর একটা বাজলেই ক্ষিদে পায় - কাজেই সিংথামে দাঁড়িয়ে দুপুরের খাওয়া মেটানো হল। সিংথাম থেকে গাড়ি গ্যাংটক-শিলিগুড়ির রাস্তা ছেড়ে একটা অন্য রাস্তা ধরে সাউথ সিকিমে ঢোকার জন্যে। এবং নর্থ সিকিমের তুলনায় এই রাস্তাটা ঢের ভালো। এদিকটা একটু বেশি সবুজ। আশেপাশে প্রচুর ছোট ছোট গ্রাম পড়ে। রাবংলা ছাড়িয়ে আরো খানিকটা গিয়ে রঙ্গিতের ওপর একটা ব্রীজ পেরিয়ে ওয়েস্ট সিকিম শুরু হয়। নতুন করে বর্ণনা দেবো না - সেই উঁচু পাহাড়, ঢালু খাদ, তলায় রঙ্গিত ফুঁসছে, ছোট ছোট গ্রাম, গ্রামের সামনে জল-চালিত ধর্মচক্র, আর লাল-নীল-হলুদ-সবুজ পতাকার সারি ... এসবের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে প্রথমে পড়ে গেজিং। গেজিং ছাড়িয়ে আরো একটু এগিয়ে পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট শহর পেলিং।
ছোট্ট, কিন্তু ঘিঞ্জি। শুনলাম কয়েক বছর আগেও লোকে পেলিং বেড়াতে যেত না খুব একটা। তখন অল্প কিছু বাড়ি ছিলো - আর বাড়ির মালিকেরা একটা দুটো ঘর ভাড়া দিত। থাকার ব্যবস্থা শুধু ঐটুকুই ছিলো। এখন পেলিংএ লাইন দিয়ে হোটেল। আপার পেলিং, মিড্ল পেলিং, লোয়ার পেলিং - যেখানেই যান, রাস্তার দুপাশে সারি দিয়ে শুধু হোটেল আর হোটেল। আর থিকথিক করছে লোক। ৯৯ . ৯৯% বাঙালী। একজনও অবাঙালী ট্যুরিস্ট দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
আমাদের হোটেলটা ছিলো লোয়ার পেলিংএ। উল্টোদিকেই Aryan Regency আর Newa Regency - যে দুটো হোটেলের নাম ট্র্যাভেলগুরু বা মেকমাইট্রিপে সবার আগে আসে। আমরা উঠলাম এদের সামনে হিমালয়ান হাইডঅ্যাওয়ে-তে। ছোট হোটেল, কিন্তু পরিষ্কার। সবচেয়ে বড় অ্যাট্রাকশন হল ঘরে বড় বড় জানলা, এবং ঐদিকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। পেলিংএর চেয়ে ভালোভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা নাকি আর কোথাও দেখা যায় না। উল্টোদিকের Aryan আর Newa Regency-তে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে গেলে বাইরে করিডরে এসে দাঁড়াতে হবে। আমরা বিছানায় শুয়ে শুয়েই দেখতে পাবো। মানে পরদিন সকালে। তখন বিকেল হয়ে এসেছে, আকাশেও মেঘ। তখন কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে হাঁটতে বেরোলাম - গ্যাংটকে সময়াভাবে "শপিং" হয়নি, সঙ্গের বিগ-শপারের মনে ভারি দুষ্কু - তাই পেলিংএর রাস্তায় দেখতে বেরোলুম কি পাওয়া যায়। লোকজনের জন্যে কিছু নিয়ে যেতে হবে, আর আমার একটা জপযন্ত্রের ভারী শখ - সেখানা দেখতে হবে। আর যদি থাংকা আর তিব্বতী মুখোশ পাওয়া যায় ...
সিকিমযাত্রীদের জন্যে টিপস -যা কিছু মেমেন্টো কেনার, গ্যাংটকে কিনে রাখুন। পেলিংএ মাত্র দুটো কি তিনটে দোকান আছে - এবং তার সামনে রেশন দোকানের লাইনের মতন ভিড় হয়। জপযন্ত্র পাওয়া যায়, ছোট সাইজের মুখোশ (যেগুলোকে ওয়াল হ্যাঙ্গিং হিসেবে ব্যবহার করা যায়) পাবেন, তবে থাংকা মোটেও ভালো পাওয়া যায় না। আর পাওয়া যায় রাশান ডলের মতন কনসেপ্টের ফ্যামিলি পার্স: মানে একটা পার্স, তার মধ্যে আরেকটা পার্স, পার্সের মধ্যে পার্স - পাঁচটা মনে হয় থাকে সব মিলিয়ে।
হোটেলের রিসেপশনে বললো পেলিং ঘোরার দুটো স্কীম আছে - হাফ ডে আর ফুল ডে। হাফ-ডে-তে আপনাকে সকালবেলা নিয়ে যাবে রিম্বি ফলস, খেচিপেড়ি (khecheopalri) লেক, রিম্বি পাওয়ার প্রজেক্ট অ্যাণ্ড রক গার্ডেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস। দুপুরে ফিরে খেয়ে দেয়ে আবার বেরোতে পারেন - ফুল-ডে ট্রিপ থাকলে - তখন যাবেন ছাগে ফলস, শিংশোর ব্রীজ আর পেমিয়াংচি মনাস্টেরি। হাফ-ডে হলে ষোলশ, ফুল ডে হলে আড়াই হাজার (রিজার্ভ গাড়ি)। বুক করবো কিনা ভাবছি, এমন সময় জিংমি (যার গাড়িতে গ্যাংটক থেকে এসেছি) ফোন করে বললো ও তখন আর গ্যাংটক ফিরতে পারবে না (সন্ধ্যে হয়ে গেছে, অন্ধকারে ফেরা রিস্কি) আর কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছে না। আমরা যদি ওর গাড়িতে পরের দিন পেলিং ঘুরি তাহলে ও কোনোভাবে থেকে যাবে, আর ঐ আমাদের এনজেপি-ও পৌঁছে দেবে। অল্পবয়সী ছেলে - এমন করে বললো যে আমি রাজী হয়ে গেলাম। হোটেলের বলা রেটের চেয়ে বেশি পড়েনি, হয়তো বাইরের রেটের চেয়ে একটু বেশি পড়লেও পড়ে থাকতে পারে। কিন্তু ছেলেটাকে ভালো লেগেছিলো বলে আর কোথাও খুঁজতে যাইনি।
২১শে অক্টোবর, পেলিংএর আশেপাশে
রাতে বৃষ্টি হচ্ছিলো। তখনও বাইরের খবর খুব একটা রাখছিলাম না বলে জানতাম না পশ্চিম হিমালয়ে আবহাওয়া কি খেলা দেখানো শুরু করেছে। ভোর চারটে থেকে জেগে শুয়ে - সূর্যের প্রথম আলো কখন কাঞ্চনজঙ্ঘায় পড়ে সোনালী রং দেখাবে। ভোর থেকে সকাল হল - কিন্তু আকাশ পরিষ্কার হল না। সেই ঘোলাটে মেঘলাই থেকে গেলো। কাঞ্চনজঙ্ঘার টিকি অবধি দেখা গেলো না।
অগত্যা সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোনর জন্যে তৈরী হতে লাগলুম। পেলিংএ বেশ লোডশেডিং হয়। আমি চান করে বেরোতে বেরোতেই লোডশেডিং - কাজেই গীজার বন্ধ - কাজেই আর কারো চান হল না। ঠিক হল দুপুরে ফিরে এসে সেসব সারা হবে'খন। জিংমি এলো সওয়া আটটা নাগাদ - সাড়ে আটটার সময় আমরা বেরিয়ে পরলুম।
লোয়ার পেলিং থেকেই নীচের দিকে নামতে নামতে প্রথমে রিম্বি ফলস। এই প্রপাতটা ভারি সুন্দর। প্রচন্ড তোড়ে জল নামে না বটে, কিন্তু পাহাড়ের গা বেয়ে ঝিরঝির করে এমনভাবে নামে যে দাঁড়িয়ে দেখার মতন।
রিম্বি ফল্স ছাড়িয়ে আরো এগিয়ে রঙ্গিতের ধারে রিম্বি পাওয়ার প্রজেক্ট আর রক্ গার্ডেন। দশ টাকার টিকিট কেটে ঢুকতে হয়, কিন্তু রক্ গার্ডেনটা অতিশয় ফালতু। কিছুই নেই - একটা পার্কের মতন, পাশ দিয়ে রঙ্গিত বইছে। কোটি কোটি লোকের ভিড়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখি দময়ন্তী নামছে। ও সিকিম ট্যুরিজমের একটা ট্রিপ বুক করেছিলো। সাবধান করে দিলুম - যে - যেও না, কিছুই নাই শুধু কোটি কোটি লোক ছাড়া। আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে এগোলাম খেচিপেড়ি লেকের দিকে।
সেও এক অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স। লেক বলতে আমার চোখে ভাসে লেক ডিস্ট্রিক্টের উইন্ডারমেয়ার বা গ্রাসমেয়ার, আর নয়তো লক্ নেস। খেচিপেড়ি লেক আদতে একটা কাদাগোলা ডোবার চেয়ে বেশি কিছু নয়। গেটের বাইরে গাড়ি রেখে মিনিট পাঁচেক একটা ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে গিয়ে প্রথমে ভাবলাম এটা মনে হয় রাস্তার পাশে একটা পুকুর। তারপর ওটাই লেক শুনে আর কাছে গিয়ে দেখার ইচ্ছে ছিলো না। তাও ছেলেমেয়েকে নিয়ে যেতে হবে বলে গেলাম। কিছুই না, শুধু কাদাগোলা জল, তারমধ্যে প্রচুর মাছ ঘুরছে। এটা নাকি পবিত্র লেক, তাই লোকে দেখতে আসে। আদৌ দর্শনীয় কিছু নয়। লেকের ধারে কিছু ফুলটুল ফুটে রয়েছে, কিছু অর্কিড দেখা যায়, আর অসংখ্য পতাকা - পতাকা টাঙিয়ে লোকে "উইশ" করে। পতাকার আড়ালে লেকটা প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে।
খেচিপেড়ি থেকে বেরিয়ে বেশ খানিকদূর গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস। এখানে দুটো প্রপাত আছে - একটা খেচিপেড়ি লেকের জল এসে পড়ছে, আরেকটা মেইন ফলস - যেটা বেশ তোড়ের সঙ্গে নামছে। আমার ঐ তোড়ের সাথে নামা বড় প্রপাতটার চেয়ে পাশে ঝিরঝিরিয়ে নামা খেচিপেড়ির জলের ধারাটাই অনেক বেশি ভালো লাগলো। আশেপাশে বাজার বসে গেছে - সেখানে সেই ছোটবেলার সিলিন্ডারের মতন পাঁপড় টাইপের জিনিস, কচুভাজার প্যাকেট, পেয়ারা ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। ঋক ঐ পাঁপড়টা খেতে চাইলো, আমি অনেকদিন কচুভাজা খাইনি বলে একখান প্যাকেট কিনলাম, আর কিছু পেয়ারা কেনা হল। সেসব খেতে খেতে প্রচুর রাস্তা পরিয়ে পেলিংএ ফিরলাম বেলা দুটো নাগাদ। দুপুরে খেয়ে বেরোব শিংশোর ব্রীজ আর পেমিয়াংচি দেখতে।
দুপুরে থুক্পা আর মোমো খেয়ে বেরোলুম শিংশোর ব্রীজ আর পেমিয়াংচির উদ্দেশ্যে। শিংশোর ব্রীজ পেলিং থেকে বেশ কিছুটা দূর - ঘন্টাখানেক তো হবেই। একটা cable-stayed ব্রীজ, এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম ব্রীজ। সেই ঘুরতে ঘুরতে, উঠতে নামতে বহুদূর গিয়ে ব্রীজটা চোখে পড়ে। ব্রীজের ওপর দাঁড়ালে দুলুনি টের পাওয়া যায়।
এখানে ব্রীজের আগে একটা ছোট পার্ক মতন আছে। তার পিছনে একটা ফল্স। সেটা দেখবো বলে যখন ঢুকছি তখন জীন্স পরা এক ছোকরা ঢুকলো - পকেটে হাত দিয়ে - জীন্সের তলাটা প্রায় ছয় ইঞ্চি ফোল্ড করা। হাবভাবটা বেশ হাইফাই। ঢুকে পার্কের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে ব্রীজের ওপর (প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরে) দাঁড়ানো তার বাবাকে তারস্বরে ইনস্ট্রাকশন দিতে লাগলো (তার ছবিটা তোলার জন্যে) - "পুরো জুম করে তোলো"। মানে ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর লাগলো বলে লিখলুম এখানে।
ফেরার পথে সন্ধ্যে হয়ে এসেছিলো। পেমিয়াংচি (পেলিং থেকে অল্প দূরেই) পৌঁছে দেখি বন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই পেলিং ফিরে এলুম। হোটেলে ফিরে আর কিছু করার নেই বসে থাকা আর টিভি দেখা ছাড়া।
২২শে অক্টোবর, পেলিং থেকে শিলিগুড়ি
সকালে উঠে রেডি হয়ে বেরোলাম। মেঘলা আকাশ বলে এদিনও কাঞ্চনজঙ্ঘা কিছুই দেখা গেলো না। মাঝে কয়েক মিনিটের জন্যে ইঞ্চিখানেক একটা টিকি দেখা গেছিলো - তবে সেটা পাশের একটা সামিট, কাঞ্চনজঙ্ঘা সামিটটা নয়।
কপাল খারাপ। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া পেলিং বলতে গেলে আর কিছুই নেই, আর সেটাও দেখা হল না। কাজেই আর কিছু করার নেই, পেমিয়াংচি ঘুরে সোজা শিলিগুড়ি চলে যাবো। পেমিয়াংচি পৌঁছলাম যখন তখনও বেশ কুয়াশা। কুয়াশার মধ্যে হলুদ পতাকার সারিটা ব্যাপক লাগছিলো - পুরো যেন কলাবন। অতি প্রাচীন গোমফা, ভিতরে সুন্দর ছবি আর মূর্তির কালেকশন রয়েছে। কিন্তু মনাস্টেরির ভিতরে ছবি তুলতে দেয় না - নইলে তিনতলায় একটা বিরাট প্যাগোডার মতন স্ট্রাকচার আমার ভয়ানক পছন্দ হয়েছিলো। তিব্বতী/চীনা ট্র্যাডিশনে সম্ভবত: গরুড় জাতীয় কোনো জন্তু (আধা পাখি, আধা জন্তু, মুখে সাপ) আছে - প্যাগোডাটার পাশে এরকম একটা মূর্তি দেখে মনে হল।
পেমিয়াংচি দেখা শেষ মানে আমাদের সিকিম ঘোরা শেষ। ওখান থেকে সোজা নামতে শুরু করলাম শিলিগুড়ির দিকে। ততক্ষণে ঐ চত্ত্বরেও ভালো বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। রাস্তাও পিছল। তার মধ্যেই নামতে নামতে রিনচেমপং পেরোলাম - পেলিংএর আগে এখানেই যাবো ভেবেছিলাম, কিন্তু জায়গা পাইনি বলে পেলিং। তারপর রংপো হয়ে শিলিগুড়ি।
সকালের কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরার ছিলো বলে শিলিগুড়ি টাউনে না থেকে ভাবলাম এনজেপিতে থাকবো। সে কি হোটেল রে ভাই। সমস্ত সন্ধ্যে বিছানায় উঠে বসে রইলাম - যত কম মাটিতে নামতে হয় আর কি। চান-টানও হল না, সেদিন তো নয়ই, পরের দিন সকালেও নয় - কারণ যা বাথরুমের ছিরি তাতে চান করতে ইচ্ছে করলো না।
পরের দিন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস আরেক যন্ত্রণা। এনজেপি এলো নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট আগে। মালদা টাউন পৌঁছলো ঠিক সময়ে। তারপরেই ট্রেনের ইঞ্জিন বদলে মনে হয় কয়েকটা গরু লাগিয়ে দিয়েছিলো। ঢিকির ঢিকির করে ট্রেন চললো, ছোটখাটো স্টেশন, হল্ট স্টেশনে তো বটেই, মাঠেঘাটেও দাঁড়িয়ে পড়ছিলো। বর্ধমানে ভাবলুম নেমে গিয়ে লোকাল ধরি, কিন্তু আবার সব জিনিস নিয়ে নেমে লোকালে উঠতে হবে ভেবে থেকে গেলুম। বর্ধমানের পর চন্দনপুর বলে একটা স্টেশনে ঢোকার মুখে পাক্কা চল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে রইলো - পাশ দিয়ে দুখানা ডাউন লোকাল চলে গেলো, কিন্তু নামার জন্যে প্ল্যাটফর্ম ছিলো না বলে কিছু করা গেলো না। শেয়ালদা ঢোকার মুখে ফের মিনিট কুড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে। আসলে সন্ধ্যের সময় শেয়ালদা স্টেশনটা ওভারলোডেড হয়ে থাকে। উত্তরবঙ্গেরই তো প্রায় চারখানা ট্রেন ছাড়ে আধ ঘন্টা পর পর। তার ওপর লোকাল। এই ম্যানেজমেন্টটা যদ্দিন না ঠিক হবে তদ্দিন এরকম দুর্ভোগ পোয়াতেই হবে - আর লজিক্যালি এটা হ্যান্ডল করার ধক কারো নেই। ট্রেন শেয়ালদা ঢুকলো রাত্তির এগারোটা - সাড়ে সাতটার জায়গায়। তারপর ট্যাক্সি ধরা - ভাগ্যক্রমে একজন রাজী হয়ে গেলো, এবং বেশি না হেঁকেই। বাড়ি ফিরলুম রাত্তির বারোটার সময়।
সিকিম ভ্রমণেচ্ছুক সকলের জন্যে কিছু টিপস:
(১) নর্থ সিকিম গেলে উইলটা অন্তত: করে যাবেন।
(২) ছোট বাচ্চা নিয়ে গুরুদংমারের দিকে যাবেন না, মিলিটারি আটকে দেবে।
(৩) ফরচুনা নামক ট্যুর অপারেটরের থেকে দূরে থাকবেন।
(৪) পেলিং না যাওয়ারই চেষ্টা করুন। কিছুই নাই, কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া। নেহাত যদি যেতেই হয়, আগে থেকে ওয়েদারের খবর নিয়ে এক রাতের জন্যে যান। কপালে থাকলে সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবেন, তারপর ডে ট্রিপটা কাস্টমাইজ করে নিন - রিম্বি ফলস, কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস, পেমিয়াংচি ছাড়া আর কিসুই দেখার নেই।
(৫) দিনের ট্রেনে কক্ষণো এনজেপি থেকে ফিরবেন না। কাঁদিয়ে দেবে।
(৬) ভুলেও এনজেপিতে থাকার কথা ভাববেন না। শিলিগুড়ি টাউনে থাকবেন।
তবে একটা কথা বলি - রাস্তার ছবি দেখে আর বর্ণনা শুনে ঘাবড়ে গিয়ে যদি না যান, সারা জীবন আফশোস করবেন। প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিক থেকে সুইস আল্পস বা স্কটিশ হাইল্যান্ডসের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। শুধু আমাদের সাথে বাইরের তফাত হল সুইজারল্যান্ড বা স্কটল্যান্ডে প্রতিটা রাস্তা মসৃণ - দুর্গম হলেও। আর সুইজারল্যান্ড হলে এই লাচুং থেকে কাটাও অবধি হয়তো একখানা কেবল কার বানিয়ে দিত। তবে ঐ উচ্চতায় (গুরুদংমার ১৭৮০০ ফুট, কাটাও এবং জিরো পয়েন্ট পনেরো-ষোল হাজার মতন) মোটরেবল রোড - সে যতই ভাঙা হোক না কেন - সম্ভবত: পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আমি রকি মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্কে গেছি - গাড়ি নিয়েই - সর্বোচ্চ পয়েন্ট ছিলো ১১ হাজার ফুট মতন - অ্যাপারেন্টলি হাইয়েস্ট মোটরেবল রোড ইন দ্য ইউএস।
একটু দুর্গম, অফবীট রাস্তায় যেতেই আমার আনন্দ। আগেরবার চেরাপুঞ্জি যাওয়ার আগে ট্র্যাভেল এজেন্ট প্রচুর অ্যান্টিপুরকি দিয়েছিলো - কি করবেন, ওখানে কিছু নেই, বরং শিলঙে থেকে একটা ডে-ট্রিপ মেরে আসুন। ওর কথা শুনে চললে ঠকতাম। আজ অবধি ঘোরা সেরা জায়গার লিস্ট বানাতে বসলে হাইল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, নর্থ সিকিম আর চেরাপুঞ্জি তাতে ওপরের চারটে নাম হবে।
নর্থ সিকিমকে আমার নিজের অনেকটা হাইল্যান্ডসের মত লেগেছে। সুইজারল্যান্ড সুন্দর। রাদার, অসম্ভব সুন্দর। কিন্তু আমার একটু বেশি ছবি-ছবি মনে হয়। বড় সাজানো। হাইল্যান্ডস অনেক বেশি ডাউন টু আর্থ। ন্যাচারাল। এক এক সময়ে হাইল্যান্ডস এক এক রূপ দেখিয়েছে।
শীতের সময়ে গেছি - ইনভারনেস ছাড়িয়ে আলাপুলের দিকে চারদিক সাদা, বরফে ঢাকা, কুয়াশা ...
শীত শেষের ঠিক পরে গেছি - বরফ গলে যাওয়ার পর ম্যাড়ম্যাড়ে জমি, সবে ঘাস গজাতে শুরু করেছে।
একটু গরমে গেছি - চারদিক উজ্জ্বল সবুজ, ব্লু-বেলসে ছেয়ে গেছে সমস্ত জমি। আর বৃষ্টির পর সেই সবুজ কয়েকগুণ চোখ ধাঁধানো হয়ে এসেছে।
বছরে একবার অন্তত: হাইল্যান্ডস না গেলে মন কেমন করতো। কেয়ার্নগর্মের পাশে লক্ লাগানের ধারে পাহাড়ের গায়ে একখান ট্র্যাডিশনাল স্কটিশ পাথরে তৈরী বাড়ি দেখে বউকে বলেছিলুম - পারলে এই বাড়িটাতে থেকে যেতুম। লক্ লাগানের ধারে বালির ওপর ঘোড়ায় চড়তুম, আর ঐ বাড়িতে থেকে ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম (মানে ইজিচেয়ারে শুয়ে বই পড়া আর কি) ...
নর্থ সিকিম অনেকটাই এই রকম। মনে হয় এও বার বার টানবে।
কিন্তু অরুণাচলের গুড়ে বালি, কারণ কোত্থাও থাকার ব্যবস্থা করা গেলো না। একবার ভাবলুম ভূটান, কিন্তু সে এমন খরচের ব্যাপার যে শেষে সিকিম ঠিক হল। গ্যাংটক হয়ে গুরুদংমার, ইয়ুমথাং আর ফেরার আগে পেলিং। নেট ঘেঁটে ফরচুনা বলে এক ট্যুর অপারেটরের খোঁজ পাওয়া গেলো, যাদের লাচেন এবং লাচুংএ হোটেল আছে, গ্যাংটক-লাচেন-গুরুদংমার-চোপতা ভ্যালী-লাচুং-কাটাও-ইয়ুমথাং-জিরো পয়েন্ট-গ্যাংটক (২ রাত, ৩ দিন) ট্যুরের ব্যবস্থা এরা করে - থাকা/খাওয়া/পারমিট/যাতায়াত সবই এদের দায়িত্ব - গ্যাংটকে পৌঁছে এদের হাতে নিজেদের সঁপে দিলেই নিশ্চিন্ত, এবং খরচও রিজনেবল (অন্তত: কলকাতার কিছু চেনা ট্র্যাভেল এজেন্ট যা হাঁকছিলো তার তুলনায়)। সাথে দময়ন্তীও জুটে গেলো - গাড়ির খরচটা ভাগাভাগি করা যাবে। এদের ট্যুরটাই বুক করা হল। এই করতে করতে পুজো এসে গেলো, যাওয়ার টিকিট তখনও ওয়েটিং লিস্ট।
জয়দাদার (ভলভো সার্ভিস) টিকিট কাটা ছিলো, কিন্তু তাও তেরো তারিখ তৎকালের একটা চেষ্টা করলুম - কপাল ভালো - কাঞ্চনকন্যাতে পাওয়া গেলো - পনেরো তারিখেরই, রাতের ট্রেন। ভাগ্যিস গেলো, নইলে দিনের বেলা কাঞ্চনজঙ্ঘায় গেলে সেই যে মেজাজ বিগড়োত তাতে পুরো ট্রিপটাই বাজে কাটতো (কেন, সে পরে আসছি)।
পনেরো তারিখ - অষ্টমীর বাজার। তার আগের তিন দিন ধরে আনন্দবাজার এবং স্টারানন্দে কলকাতার তুমুল জ্যামের গুচ্ছ গুচ্ছ খবর বেরোচ্ছে। গুচ্ছের লোকজন নাকি প্লেন/ট্রেন মিস্ করছে। রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা আটক থাকছে। ভয় টয় পেয়ে বাড়ি থেকে রওনা দিলুম পাঁচটা নাগাদ - ট্রেনের সময় সাড়ে আটটা (যদিও শুরুতে আমার প্ল্যান ছিলো সাড়ে তিনটে-চারটের সময় বেরোব - ভাগ্যিস সেটা করিনি)। কোথায় জ্যাম, কোথায় কি। এমনি দিনে বাড়ি থেকে শেয়ালদা লাগে ঘন্টাখানেক, সেদিন মোটামুটি আধ ঘন্টা/পঁয়ত্রিশ মিনিটে শেয়ালদা পৌঁছে গেলুম। ওয়েটিং রুমে তুমুল ভিড়, কারণ আরো অনেক সাবধানী লোক আছে - যাদের অনেকে সাড়ে দশটায় দার্জিলিং মেল ধরবে বলে পাঁচটায় বেরিয়ে পড়েছে। মানে, ভিড়ভর্তি ওয়েটিং রুমে তিন ঘন্টা কাটানো - সাথে দুজন পায়ে চরকি লাগানো পাবলিক। ধৈর্য্যের নোবেল থাকলে সেটা আমাদের পাওয়া উচিত।
ট্রেনে উঠে প্রথম সাক্ষাত একটি ইঁদুরের সঙ্গে - সহযাত্রীদের আগেই। সাইড বার্থের সীটে ব্যাগ রাখতেই দুদ্দুর করে সীটের তলা থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক একটু দৌড়োদৌড়ি করে ফের সীটের তলায় কোথায় ঢুকে গেলো (কদিন আগে বাবা-মা ভ্যালী অব ফ্লাওয়ার্স গেছিলো - সেই ট্রেনেও একই দৃশ্য ছিলো - তবে সেই ইঁদুরটা একটু কুঁড়ে ছিলো মনে হয়, কারণ মা চটি দিয়ে সেটাকে মেরেছিলো - বাবা-মায়ের ছবির লিস্টে সেটাও আছে)। মোদ্দা ব্যাপারটা হল সীটের নীচে ব্যাগ রাখা গেলো না, পেল্লায় রুকস্যাকগুলোকে বাংকে তুলতে হল - রাতে ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার চান্স সত্বেও।
কাঞ্চনকন্যায় প্যান্ট্রি-কার নেই, তাই বাড়ি থেকে প্যাক করে আনা লুচি-আলুমরিচ খেয়ে সেই রাত্তিরে ঘুমনো, পরের দিন সকালে নিউ জলপাইগুড়ি। ট্রেন আধ ঘন্টা লেট।
সকালে এনজেপি পৌঁছনোর পর প্রথম যুদ্ধ ট্যাক্সির জন্যে। প্রিপেইড বুথে একখানাও ট্যাক্সি নেই - কারণ প্রিপেইডের রেট হল সতেরোশো চল্লিশ, আর সেটা ঠিক হয়েছে ২০০৫ সালে। তারপর তেলের দাম বহুবার বেড়েছে। এখন কোনো গাড়িওয়ালা প্রিপেইড বুথে গাড়ি দেয় না। তায় পুজোর ছুটির মরসুম, পীক্ ট্যুরিস্ট সীজন - আড়াইয়ের কমে কেউ কথাই বলে না। তাও একটু দরদাম করে বাইশশো করা গেলো। ট্যাক্সি বিনে গতি নাই, আর শেয়ারে যাওয়াও মুশকিল, অতএব ...
রাম্বি বাজারে উপোস ভেঙে গ্যাংটক পৌঁছতে দুপুর দুটো। সেবক রোড গত বছরেও দেখেছি দিব্যি সুন্দর - এখন মহানন্দা স্যাংচুয়ারি পেরনোর পরই পুরো নৌকোযাত্রা। ড্রাইভার বললো - "এ আর কি দেখছেন, যেখানে যাচ্ছেন সেখানে যে কি আসছে তা তো জানেন না ... "
দুপুরে গ্যাংটক পৌঁছে কিছু খেয়ে এক লোকাল ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে এদিক ওদিক ঘোরা হল - একটা স্তুপ আছে কাছেই, তার পাশে টিবেটোলজি মিউজিয়াম - অবিশ্যি এটাতে ঢুকতে পারলাম না, কারণ হাতে বেশি সময় ছিলো না। সেখান থেকে গেলুম "বন ঝকরি ফলস অ্যাণ্ড এনার্জি পার্ক" - জলপ্রপাতটা মন্দ নয় (তবে সিকিমে প্রতি মোড়ে একখানা দেখতে পাওয়া যায়, আর নামীদামীগুলোর চেয়ে অনামা প্রপাতগুলো কোনো অংশে কম নয় - ইন ফ্যাক্ট "ফলস অব সিকিম" বলে অনায়াসে একখান ছবির বই বের করা যায়)। কি ভিড় এখানে - আর ৯৯% পাবলিকই বাঙালী। তারা সবাই একের পর এক লাইন দিয়ে প্রপাতের সামনে পোজ দিয়ে দাঁড়ায় আর সঙ্গীসাথীরা ছবি তোলে। অনেকের আবার একটাতে সখ মেটে না, বিভিন্ন পোজে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায়। বাদবাকি কারো ছবি তোলার কোনো দরকার নেই কিনা ... আর সবচেয়ে জ্বলে যখন শাটার টেপার মুহুর্তে কেউ হুড়মুড়িয়ে সামনে এসে যায় ... হিসেব কষে শাটার স্পীড/এক্সপোজার সেট করার পর এরকম ঘটলে ইচ্ছে করে এদের কানে কাঠপিঁপড়ে ছেড়ে দিই।
বন ঝকরি থেকে গেলুম রঙ্কা মনাস্টেরি। রুমটেক একটু দূর, সেদিনই যাওয়ার সময় ছিলো না, তাই এই নতুন মনাস্টেরিটাই দেখতে গেছিলুম। মন্দ নয়, বেশ বড়সড়, তবে বড় হলেই কি আর রুমটেক হয় - রুমটেকের ঐতিহ্যই অন্য ... তাও নেহাত ফেলনা নয়, ভিতরের মূর্তিগুলো বেশ সুন্দর। আর ফেরার পথে রাস্তায় এক জায়গা থেকে উল্টোদিকের পাহাড়ে পুরো গ্যাংটক শহরটা দেখা যায়।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা লিখি - সিকিমে দেখা বুদ্ধমূর্তি বা জাতকমূর্তিগুলো নিয়ে। বেশিরভাগই দেখতে বেশ হিংস্রগোছের। তার একটা কারণ আছে। তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে যে কয়েকজনের নাম সবার প্রথমে আসে তাঁরা হলেন আচার্য শান্তরক্ষিত, পদ্মসম্ভব এবং অতীশা বা অতীশ দীপঙ্কর। তিব্বতের রাজা প্রথম ডেকে নিয়ে যান শান্তরক্ষিতকে। শান্তরক্ষিত প্রথমবার কিছুদিন থাকার পর কিছু রাজকর্মচারী ওঁর নামে অপপ্রচার শুরু করে - ঝড়/মড়ক ইত্যাদি ঘটনা ওঁর জন্যে হচ্ছে বলে। শান্তরক্ষিত তখন ফিরে আসেন। কয়েক বছর পর রাজা ফের ওঁকে ডেকে নিয়ে যান। এই দ্বিতীয় ফেজে শান্তরক্ষিত কোনো কারণে তিব্বতী দেবদেবী/ভূত ইত্যাদিদের ভয় পেতে শুরু করেন, এবং রাজাকে অনুরোধ করেন আচার্য পদ্মসম্ভবকে নিয়ে যেতে। পদ্মসম্ভব উড়িষ্যার কোনো মঠের আচার্য ছিলেন, এবং তন্ত্রে (বৌদ্ধধর্মেরই) পারদর্শী ছিলেন। কথিত আছে যে পদ্মসম্ভব তিব্বতে গিয়ে তন্ত্র দিয়ে তিব্বতী দেবদেবী/ভূত ইত্যাদিদের হারিয়ে দেন আর বৌদ্ধধর্ম প্রচারে সাহায্যের আশ্বাস দিতে বাধ্য করেন। এর পরেই শান্তরক্ষিত গোটা তিব্বতে মঠ প্রতিষ্ঠা করেন, বই অনুবাদ করে, বই লেখেন। পদ্মসম্ভব তিব্বতে গুরু রিম্পোচে নামেও পরিচিত। যে কোনো তিব্বতী মঠে দেখবে এই গুরু রিম্পোচের মূর্তি রয়েছে। এবং যেহেতু তিব্বতী buddhism অনেকটাই তন্ত্রঘেঁষা, তাই ঐ দেবদেবী/ভূত/তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদি মিস্টিক্যাল ব্যাপারের ছাপ অনেক বেশি (সিংহলী buddhism -এর তুলনায়)। পরবর্তীকালে অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে গেছিলেন - সেই সময় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব কিছুটা কমে আসছিলো। এবং দীপঙ্কর নিজেও তন্ত্রে আগ্রহী ছিলেন। কাজেই সেই ছাপটাও কিছুটা পড়েছিলো।
এটুকু ঘুরে সেদিনের মতন ট্যুর শেষ। হোটেলে ফিরে আসার পর ফরচুনার লোক এলো - পরের দিন সকাল দশটায় তারা আমাদের হোটেল থেকে তুলে নেবে কথা হল। সেই মতন দময়ন্তীকে জানিয়ে দিলুম।
১৭ই অক্টোবর, যুদ্ধ শুরু
এ যুদ্ধ যে কি যুদ্ধ, তার কোনো ধারণাই ছিলো না।
দশটার সময় ফরচুনা থেকে লোক আসবে বলে সাতসকালে খেয়েদেয়ে তৈরী হতে গিয়ে দেখতে পেলুম অত গোছানোর মধ্যে ঋতির কোনো জামা আসেনি! বাকি সব এসেছে - সোয়েটার, ওয়াটারপ্রুফ, কট্সউলের গেঞ্জি - বাট্ নো জামা। ভাগ্যক্রমে ফরচুনা থেকে ফোন করে জানালো যে দশটা নয়, ওরা এগারোটায় আসবে। দময়ন্তীকে সেটা জানিয়ে আমি হাঁটা লাগালুম গ্যাংটকের এমজি মার্গের দিকে - কোনো দোকান থেকে কিছু জামা কিনতে হবে। জামা কিনে ওপরে টিবেট রোডে উঠতে গিয়ে প্রায় দম বেরিয়ে যায় আর কি - হোটেলে ঢোকার মুখে দেখি দময়ন্তী এসে গেছে। এগারোটা বাজলে চেক-আউট করে লবিতে বসে আছি তো বসেই আছি। ফরচুনাকে ফোন করলে বলে - এই আসছি, পাঁচ মিনিটমে পঁওছ যায়েঙ্গে - কিন্তু কেউ আর আসে না - সাড়ে এগারোটা বাজতে চললো। তখন ফের ফোন করাতে বলে কিনা ট্যাক্সি পাচ্ছি না। হতভাগা - আমরা আগের দিন থেকে জানি যে দশমীর দিক ট্যাক্সি পাওয়া মুশকিল হবে - নেপালীদের দশেরা মানে কেউ রাস্তায় নামবে না - আর এখানকার ট্র্যাভেল অপারেটর, তারা কিনা সে খবর রাখে না? প্রায় পৌনে বারোটা নাগাদ একজন এলো একখানি অল্টো নিয়ে (নর্থ সিকিমের গাড়িগুলোকে সকাল আটটার পর গ্যাংটক শহরের ভিতরে আসতে দেয় না, লাচেন স্ট্যান্ড অবধি ট্যাক্সি নিয়ে যেতে হয়)। পাঁচজন লোক (একটা না হয় কোলে যাবে, কিন্তু তার পরেও চারজন) প্লাস লাগেজ - আর একখান অল্টো!!! ঠিক হল দুবারে যাবো। প্রথমবার কিছু লাগেজ নিয়ে আমি আর ঋক, পরের বার বাকিরা। লাগেজ তুলতে গিয়ে ট্যাক্সির জানলার ওপরের প্লাস্টিকের শেড্ ভাঙলো (ট্যাক্সি ড্রাইভার আর ফরচুনা তারপর সেটা কিভাবে অ্যাডজাস্ট করলো সে খবর আমরা জানি না), ব্যাগদুটোকে ছাতের ওপর বাঁধেনি বলে রাস্তায় একটু এগোতেই একখানা ধড়াম করে পড়লো - সেগুলোকে তুলে ভিতরে চালান করা হল। লাচেন স্ট্যান্ডে পৌঁছে বাকিদের ফোন করে শুনি নর্থ সিকিমের গাড়িটাই নাকি তখনো আসেনি। তবে পরের ট্রিপে সুমনা, ঋতি আর দময়ন্তী আসার পরেই সেই গাড়ি চলে এলো - একখান নতুন বোলেরো - তখনও টেম্পোরারি পারমিট লাগানো।
সেই গাড়িতে রওনা তো দিলুম। গ্যাংটক শহর ছাড়ার পরই বুঝলুম শিলিগুড়ির ট্যাক্সিওয়ালা কি বলতে চেয়েছিলো ... নর্থ সিকিম হাইওয়েতে রাস্তা বলতে কিছু নেই। ওটা "নেই-রাস্তা"। পাথর, বোল্ডার, কাদা - এই দেখা যায় শুধু। পিচ? কারে কয়? পাশের পাহাড় থেকে হুড়মুড়িয়ে ঝরণা নেমে আসছে রাস্তার ওপর, তলায় বোল্ডার, তার ওপরেই গাড়ি চলছে। কোথাও ষাট ডিগ্রীতে নীচে নামছে, কোথাও উঠছে। প্রতি উঁচুনীচু ভাঙা জায়গায় ড্রাইভারে মুখ পুরো চূণ। জানা গেলো সে (মানে পাসাং) শিলিগুড়ি-গ্যাংটক রুটে ট্রাক চালায়, এই পথে কখনো আসেনি, রাস্তাও চেনে না, কোথায় কি করতে হবে তাও জানে না। গাড়ির শর্টেজ ছিলো বলে ফরচুনা ওকে অন্য একটা হোটেল থেকে তুলে এনে ভিড়িয়ে দিয়েছে। সে গাড়ি চালাবে না কপাল চাপড়াবে সেটাই ঠিক করতে পারছিলো না। ফরচুনার আরেকটা জীপকে সামনে রেখে সে যাচ্ছে।
দুপুরে খাওয়ার কথা ফোডোং বলে একটা জায়গায়। ওদিকে সেভেন সিস্টার্স (ফলস) দেখার পর সামনের সেই জীপ হাওয়া। ফোডোংএ তাকে কোথাও দেখা গেলো না, পাসাং জানেও না কোথায় কি পাওয়া যাবে - ওদিকে ক্ষিদে পেতে শুরু করেছে। বেশ কিছু দূর গিয়ে একটা "ঘাট" (সরু রাস্তা যেখানে একটা একটা করে গাড়ি পাস করে। আর এই ঘাটটা বেসিক্যালি পাঁকে ভর্তি - ফুটখানেক গভীর কাদা, একবারে গাড়িটাকে সেই কাদাভর্তি হাফ কিলোমিটারের বেশি পেরোতে হবে। দাঁড়িয়ে পড়লেই মুশকিল - চাকা আর এগোবে না) ছিলো - সেখানে দাঁড়িয়ে ঠিক করা হল এখানেই যা পাওয়া যাবে খেয়ে নেওয়া যাক - লঙ্কা আর বেগুনের তরকারি, আর চিকেনের ঝোল - খেতে খেতে সেই সবুজ জীপ এসে হাজির - তারা ফোডোং-এ কোনো এক হোটেলে দাঁড়িয়ে খেয়েছে - এমনই বেয়াক্কেলে যে নতুন ড্রাইভারকে এগুলো যে জানিয়ে দিতে হয়, সেই বুদ্ধি নেই।
তো এই রকম ভয়ানক রাস্তা দিয়ে চুংথাং পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে গেলো। পথে পেরোলাম মঙ্গন, রঙ্গরঙ্গ বলে ছোট ছোট কয়েকটা জায়গা। অ্যাজ ইউজুয়াল অতীব সুন্দর দৃশ্য - কিন্তু পথের অবস্থা জাস্ট ভয়াবহ।
চুংথাং থেকে রাস্তা দুভাগ হয়েছে। একদিকে লাচেন চু নদীর ধার ধরে লাচেন, অন্যদিকে লাচুং চু-র ধার দিয়ে লাচুং। আমরা যাবো লাচেনের দিকে।
একদিকে অনেক নীচে লাচেন চু ঝড়ের মত ছুটছে, ফুঁসছে (গোটা সিকিমে এই নদীর গর্জনটা কমন - যেখানেই যাও না কেন - হয় তিস্তা, নয় কালী নদী, নয় রঙ্গিত, নয়তো এদিকে লাচেন চু বা লাচুং চু), অন্যদিকে পাথুরে পাহাড়, এর মাঝে অসংখ্য হেয়ারপিন বেন্ড। এরকম ভাঙা রাস্তা না হলে বলতুম "এই পথে গাড়ি চালিয়ে থ্রিল আছে" - এরকম পাহাড়ি পাকদন্ডী রাস্তাতেই গাড়ি চালাতে আমার বহুত ভালো লাগে - হাইল্যান্ড্স বা লেক ডিস্ট্রিক্ট বা ইয়র্কশায়ারে এমনটাই - কিন্তু সেখানে এরকম ভাঙা রাস্তা নয়। অনেকটা জায়গা জুড়ে "ব্যাক-কাটিং" চলছে - মানে পাহাড়ের গায়ে ব্লাস্টিং - রাস্তা চওড়া করার জন্যে - আর সেই জন্যে রাস্তার অবস্থা এরকম ভয়ানক।
চুংথাং পেরনোর পর মোটামুটি একটা কনভয় টাইপ হয়ে গেলো - প্রায় বারোখানা গাড়ি পর পর চলছে - সবাই লাচেনের দিকে। মাঝে মাঝে মিলিটারি লরি বা জীপ যাচ্ছে। দুলতে দুলতে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে লাচেন পৌঁছলুম প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ। সন্ধ্যে থেকেই বৃষ্টিও চলছে, সাথে ঠান্ডা হাওয়া।
হোটেলে ঢুকে আরেক ধাক্কা। ভেজা ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে ঘর, টিম টিম করে আলো জ্বলছে, বাথরুমে জল নেই কো, গীজারে আলো জ্বলে কিন্তু তাতে জল গরম হয় না। আমাদের ঘরে দু পিস কম্বল, তাতে সকলের হবে না বলে আরেকখান চাইলাম। এক্সট্রা কম্বল মনে হয় ঐ এক পিস্ই ছিলো - কারণ তার পর দময়ন্তী একটা চেয়েছিলো - পায়নি। ব্লো হীটারও মনে হয় এক পিস্ই ছিলো - সেও একটা ঘরে দেওয়াতে আর কেউ পায়নি। অথচ ফরচুনার ওয়েবসাইতে বড় বড় অনেক কিছু লেখা আছে - ঘরে অমুক আছে, তমুক আছে ... আদতে কিসুই নেই। জল কখন আসবে জিগ্গেস করলে বলে "আ যায়েগা"। গরম জল চাইলে বলে "আভি দে রাহে হ্যায়"। ঐ অবধিই। পাওয়া কিছুই যায় না। দশ মিনিটে খাবার দেবে বলে প্রায় ঘন্টাখানেক লাগিয়ে দেয়। শুনলাম ওদের নাকি একটা গোটা দিন ধরে টাওয়ার (মোবাইল) ছিলো না বলে কজন আসছে কখন আসছে কোনো খবরই পায়নি। আমরা পৌঁছনোর পর রান্নাবান্নার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু তাতেও বাকি ব্যাপারগুলো - যেমন জল নেই, গীজার চলে না, কম্বল নেই ইত্যাদির কোনো এক্সকিউজ হয় না। দময়ন্তী তো ওদের ধরে পেল্লায় ধমক দিলো বেশ কিছুক্ষণ ধরে ...
ঠান্ডা যদিও সেরকম কিছু ছিলো না, তবে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরণার জলে কাজকম্মো করা সম্ভব নয়। গায়ে তখনো ঠান্ডা লাগেনি - মানে ওরকম ঠান্ডায় আমি অভ্যস্ত (ছিলুম), আর সেই অভ্যেস ভুলিনি এখনো। আমি গেছি একখান জামার ওপর একটা সামার জ্যাকেট (হাত কাটা, অনেকগুলো পকেটওয়ালা - ক্যামেরার লেন্স ইত্যাদি রাখার পক্ষে খুব উপযোগী) পরে, সুমনাও একটা সামার জ্যাকেট গায়ে, দমুরও তাই। কুচেগুলোকে অবশ্য সোয়েটার পরানো হয়েছে। আমাদের দেখে বাকি বাঙালী গ্রুপগুলো বেশ অবাকই হয়েছিলো।
১৮ই অক্টোবর, ২০১০ - গুরুদংমারের দিকে
রাতেই ড্রাইভারসকল জানিয়ে দিয়েছিলো যে একদম ভোরে বেরোতে হবে। হিমালয়ের খুব কমন ফিচার - দুপুর বারোটার পর আবহাওয়া আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে পড়ে, হাওয়া দেয়, বৃষ্টি পড়ে। যারা পাহাড়ে চড়ে তারা সকলেই ভোরে বেরিয়ে বারোটার আগে ক্যাম্পে ফিরে আসার চেষ্টা করে। এখানেও তাই। ইন ফ্যাক্ট, গুরুদংমারের আগে মিলিটারি চেকপয়েন্টে বেলা ন'টার পরে আর ঢুকতে দেয় না। কাজেই সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরোনোর প্ল্যান হল।
সাড়ে চারটের সময় উঠে দেখলুম গীজারে জল নেই। জলের কল থেকে আধ বালতি জল বেরিয়ে বন্ধ হয়ে গেলো। আর একদম বরফগলা জল। মুখ ধুতে গিয়ে মনে হল দাঁতগুলো খুলে হাতে চলে এসেছে। গরম জল চাইলাম - সেই একই "আভি দে রাহে হ্যায়"। আধা ঘন্টারও বেশি পরে আধ বালতি গরম জল পাওয়া গেলো - চারজনে সেটাই ভাগ করে চালালুম। ব্রেকফাস্ট? রাস্তায় হবে। বেরোতে বেরোতে পৌনে ছটা।
লাচেন নদীর ধার দিয়ে গাড়ি চললো - দুলকি চালে। এই ওঠে, এই নামে, এই দোলে, গাড্ডায় পড়ে ... তখন অল্প অল্প আলো ফুটছে, আর দূরে প্রথম বরফঢাকা চূড়াগুলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আগের রাতে বৃষ্টির পর আকাশ ঝকঝকে নীল, মাঝে সাদা মেঘ, আর সামনের সবুজ পাহাড়গুলোর পিছনেই বরফঢাকা চূড়া। মোড় ঘুরলেই ঝরণা বয়ে যাচ্ছে, রাস্তার ওপর দিয়েই। বোল্ডারের ওপর দিয়ে গাড়িগুলো এক এক করে পার হয়। আর দেখলাম "ইন্ডিয়ান ফল কালার্স'"- এক একটা জায়গায় পাহাড়ের গায়ে গাছগুলো লাল-হলুদ হয়ে রয়েছে। ছবি তুলতে গেলে একটু সময় দিয়ে তুলতে হত - সেই সময় ছিলো না, আর গাড়ির ঝাঁকুনিতে চলন্ত গাড়ি থেকে তোলাও সম্ভব ছিলো না। আস্তে আস্তে ওপরে উঠছি - গাছ কমতে কমতে শুধু পাথুরে পাহাড়ী এলাকা - স্নো লাইন ক্রমশ: কাছে আসছে, বরফঢাকা চূড়াগুলোও। মাঝে মাঝে দু একটা মিলিটারি ক্যাম্প, আর আমাদের কয়েকটা গাড়ি ছাড়া রাস্তায় শুধু মিলিটারি লরি। চোদ্দ হাজার ফুটে একটা ক্যাম্পে পাস দেখাতে হল, সেটা পেরনোর পরেই থাংগু বলে একটা ছোট গ্রাম - সাড়ে চোদ্দ হাজার ফুট। গ্রামে ঢোকার মুখেই একটা ছোট ব্রীজ, নীচ দিয়ে লাচেন চু বয়ে যাচ্ছে ঝড়ের মতন। থাংগুতে চা খেলুম, সঙ্গে পপকর্ন - ঐ উচ্চতায় কম অক্সিজেন লেভেলে পপকর্ন নাকি উপকারী। ব্রেকফাস্টের জন্যে দোকানী মেয়েটি একটা পাত্রে কিছু মোমো প্যাক করে দিলো - বললো ফেরার পথে পাত্রটা দিয়ে যেতে, "নেহি তো পাপা মারেগি"। একটা ছোট বোতল ব্র্যান্ডিও কিনে নিলুম - যদি দরকার পড়ে।
থাংগুর পর পুরোপুরি স্নো-লাইনের ওপর। রাস্তার ধারে আর গাছ নেই, কিছু কিছু জায়গায় অনেকটা হেদারের (heather) মতন লাল লাল ফুল টাইপের হয়ে রয়েছে। বাকি শুধু পাথর, বোল্ডার আর ব্যারেন ল্যান্ড, এদিক ওদিক বরফ। আস্তে আস্তে আরো ওপরে ওঠার সাথে সাথে বরফের পরিমাণ বাড়তে শুরু করলো। তারই মধ্যে একটার পর একটা মিলিটারি ব্যারাক। একটা আর্টিলারি ইউনিট রয়েছে, আশেপাশে প্রচুর বাঙ্কার, কোথাও বোর্ডে লেখা "এক গোলি, এক দুশমন", কোথাও বা "রেসপেক্ট অল, সাসপেক্ট অল"। এই সব পেরোতে পেরোতে পৌঁছলুম ষোল হাজার ফুটের কাছাকাছি। আরেকটা মিলিটারি ক্যাম্প আর আবার পাস দেখানো। পাসাং গেলো পাস দেখাতে, আমরা গাড়িতে বসে রইলুম। সামনে যতদূর চোখ যায়, শুধু একটা বরফের মরুভূমি শুয়ে রয়েছে।
জানলায় টকটক শুনে দেখি এক আপাদমস্তক গরম কাপড়ে ঢাকা চোখে ঢাউস গগল্স পরা এক মিলিটারি "আফ্সার" আমায় ডাকছেন। জানলা খুলতে ঋতিকে দেখিয়ে জিগ্গেস করলেন "এই বাচ্চাটার বয়স কত?" - আমি বল্লুম তিন। তখন তিনি বল্লেন - "আপনাদের একটা রিকোয়েস্ট করছি - এটা মেডিক্যাল অ্যাডভাইস। আপনারা এই বাচ্চাটাকে নিয়ে ওপরে যাবেন না। এখান থেকে গুরুদংমার আরো ষোল কিলোমিটার, আর প্রায় আরো দু হাজার ফুট উঁচু। সেখানে অক্সিজেন লেভেল ভীষণই কম। প্রায় সমস্ত বাচ্চাদের সমস্যা হয়। আমরা পাঁচ বছরের কম বয়সী বাচ্চা আর বয়স্কদের যেতে বারণ করি।"
আমি বল্লুম যে এই মেয়ে তো জুংফ্রাউয়ে বারো হাজার ফুট অবধি ঘুরে এসেছে, এখানেও এতদূর এসেছে, কোনো সমস্যা হয়নি তো। তো তিনি বল্লেন - "আপনারা যেতেই পারেন, তবে আপনাদের রিস্কে। যদি কিছু হয়, আমাদের এখানে কোনো মেডিক্যাল ফেসিলিটি নেই যে দরকারে আপনাদের সাহায্য করবো। আমাদের এক্সট্রা গাড়িও নেই যে আপনাদের তাতে করে হাসপাতাল পাঠাবো। বাকি ট্যুরিস্ট গাড়িগুলোকেই বড়জোর অনুরোধ করতে পারি, আর এই রাস্তায় পাঁচ-দশ কিলোমিটার স্পীডে কখন হাসপাতালে পৌঁছবেন সেটা তো বুঝতেই পারছেন।"
সেদিনই নাকি আরেকটি বাচ্চার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিলো, এবং কিচ্ছু করতে না পেরে তার বাপ-মা ওখানে কেঁদে ভাসিয়েছে। ঋতি তখনও অবধি ঘুমোচ্ছিলো - অনেক ভোরে উঠেছে, আর ওর এখনও পাহাড়/বরফ দেখে আনন্দ পাবার বয়স হয়নি। আমরা একটু ঘাবড়ে গিয়ে ওকে ডাকলুম - জিগ্গেস করা হল যে শরীর খারাপ লাগছে কি না। ঋতি প্রথম কথাই বললো যে মাথায় ব্যথা করছে। হাতে-পায়ে-গলায়-কানে নয়, সোজা মাথায় ব্যথা - যেটা হল কম অক্সিজেন লেভেলের প্রথম সিম্টম। ঋকও বললো মাথায় ব্যথা করছে। ওদিকে আমাদের বাকি কারোরই কোনো প্রবলেম হচ্ছে না।
তখন একবার ভাবলুম যে ফরচুনার তো তিনটে গাড়ি এসেছে, আর অন্য দুটো গাড়িতেই ছোট বাচ্চা আছে। তাহলে একটা গাড়িতে বাচ্চাগুলো আর একজন করে বড়দের যদি নীচে নামিয়ে দেওয়া হয় (ঐ ক্যাম্পেও বসে থাকা যাবে না বলেছিলো মিলিটারি), তাহলে বাকি দুটো গাড়িতে বড়রা যারা যেতে পারবে তারা গুরুদংমার অবধি গিয়ে আবার নেমে আসবে। আরেকটা গ্রুপের সাথে সেই মত কথাও হল, কিন্তু শেষমেষ প্ল্যানটা লাগলো না (কেন, সেটা বুঝেছিলুম আরো পরে) - আর ঐ ষোল হাজার ফুট থেকেই গুরুদংমারকে টা-টা করে নীচে নেমে আসতে হল।
দু:খ রয়ে গেলো - অতদূর গিয়েও খালি হাতে ফিরতে হল বলে। আর একটা বোকামি করলুম - ঐ ক্যাম্পে ছবি তোলা বারণ, কিন্তু ওখান থেকে আর কিলোমিটারখানেক গেলেই ঐ বরফের মরুভূমির ছবিগুলো অন্তত তুলে আনা যেত ...
ফেরার পথে দু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুল্লুম। চোপতা ভ্যালীর দিকে এক চক্কর দিয়ে আসা হল। চোপতা ভ্যালী আসলে পাহাড়ের নীচে প্রায় মার্শল্যান্ড বলা যায় - একটা জোলো জায়গা, তার মাঝে মাঝে কয়েকটা বাড়ি নিয়ে একটা গ্রাম। ওপরদিকে একটা স্নো-পিক বেশ কাছেই, ঋক তার নাম দিলো "ভ্যানিলা অ্যাণ্ড চকোলেট আইসক্রীম"।
লাচেনের অল্প আগে ফরচুনার একটি গাড়ি বিগড়ে গেল। তাকে ঠিক করার জন্যে বাকি সমস্ত গাড়ির ড্রাইভারেরা লেগে পড়লো। এদের এই ইউনিটিটা দেখার মতন। একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লে সকলে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে। অবিশ্যি এতে স্বার্থও রয়েছে, কারণ একটা গাড়ি খারাপ হয়ে রাস্তা আটকে রাখলে সকলেরই অসুবিধা। সেই গাড়ি ঠিক হওয়া অবধি আমরা দাঁড়িয়ে রইলুম। শেষে লাচেন অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বেলা দুটো। জলের ক্রাইসিস তখনো রয়েছে - অন্য বাড়ি থেকে জল এনে দিচ্ছে বালতি করে। এরকম কিছু জল যোগাড় করে কাজকম্মো সারা হল। চান তো তার আগের দিন থেকেই বন্ধ ...
দুপুরে খাওয়া মিটিয়ে আবার সেখান থেকে রওনা দিলুম লাচুংএর দিকে। প্রথমে লাচেন চু-র ধার দিয়ে দিয়ে চুংথাম অবধি, আর সেখানে বাঁদিকে বেঁকে লাচুং চু-র ধার দিয়ে দিয়ে লাচুং অবধি। এই রাস্তাটা তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো। চুংথাম থেকে লাচুংএর দূরত্ব ২১ কিলোমিটার, আর রাস্তা ভালো বলে পৌঁছতে বেশি সময় লাগে না।
পথে পড়লো "ভীম নালা' বলে একটা জলপ্রপাত, সেখানে কিছু ছবি তুলে বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমরা হাজির হলাম লাচুংএ। ফরচুনা লাচেনের হালত দেখে ধরে নিয়েছিলুম যে লাচুংএও অমনই কিছু একটা হবে, কিন্তু না - ফরচুনা লাচুং লাচেনের থেকে ঢের ভালো। গ্যাংটকের সোনম-ডে-লেক না হতে পারে, কিন্তু ঐ চত্বরে যা দেখেছি তার চেয়ে ঢের ভালো। গীজার চলে, তাতে গরম জল পাওয়া যায়, এবং ঘরে আলো-টালো জলে, দরজায় চাবিও আছে (লাচেনে আবার চাবি ছিলো না)। সন্ধ্যেয় একটু চা টা খেয়ে ল্যাদ খেতে শুয়ে পড়লুম সকলে। পরের দিন ফের ভোরে উঠে কাটাও-ইয়ুমথাং-জিরো পয়েন্ট ঘোরা।
সিকিমের রাস্তার ধারের গ্রামগুলো মোটামুটি টিপিক্যাল। দুটো কমন জিনিস লিখছি।
এক নম্বর - গ্রামের আশেপাশে প্রচুর পতাকা টাঙানো দেখা যায়, হয় সারি সারি সাদা পতাকা, নয়তো পর পর লাল-নীল-হলুদ-সবুজ কিছু পতাকা। সবগুলোতেই মন্ত্র লেখা (ঐ "ওঁ মণিপদ্মে হুম" জাতীয়)। এই দুই ধরণের পতাকার আলাদা মানে আছে। সাদা পতাকা হল যারা মারা গেছে তাদের আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে টাঙানো, বা ভূত তাড়ানোর জন্যে টাঙানো। আর রঙীন পতাকাগুলো গ্রামের শান্তিকল্যানের জন্য - যাতে ফসল ভালো হয়, পাহাড়ে ধ্বস না নামে ইত্যাদি। পতাকাগুলোর আরেকটা উপকারিতা আছে - দূর থেকে দেখলে কাছাকাছি জনবসতির খোঁজ পাওয়া যায়।
দুই নম্বর - প্রায় সমস্ত গ্রামেই একটা জলচালিত ধর্মচক্র দেখা যায়। ধর্মচক্র অর্থাৎ জপযন্ত্র, কিন্তু পেল্লায় সাইজের। রাহুল সাংকৃত্যায়ন "তিব্বতে সওয়া বছর" বইতে তিব্বতের গ্রামগুলোর যা বর্ণনা দিয়েছেন, একেবারে সেই জিনিস। ঐ বইতে এগুলোকে বলা হয়েছে "মাণী", সিকিমে বলে "ধর্মচক্র"। এর ভিতরেই সেই কাগজে লেখা "ওঁ মণিপদ্মে হুম" মন্ত্রটি থাকে, এবং জলের শক্তিতে এটা ঘুরতেই থাকে, ঘুরতেই থাকে - কখনও না থেমে। প্রতিবার ঘোরায় এক একটা পাপ ধুয়ে যায়। গ্রামের সকলের নিখরচায় পূণ্য অর্জন হয় এই ধর্মচক্র ঘোরার ফলে। কোথাও এর সাথে একটা ঘন্টাও লাগানো থাকে, প্রতিবার ঘোরার সময় টুং করে একটা আওয়াজ হয়।
১৯শে অক্টোবর: কাটাও, ইয়ুমথাং, জিরো পয়েন্ট হয়ে গ্যাংটক
ফরচুনা আরো যে দু নম্বরিটা করেছিলো সেটা হল নিষ্পাপ মুখে প্যাকেজে কাটাও রাখা। হোটেলের লোক এবং ড্রাইভারেরা সকলেই এক বাক্যে বললো যে কাটাও তো যেতে দেয় না - মিলিটারি আটকে দেয়। তাও যেহেতু প্যাকেজে আছে, তাই চেষ্টা করা হবে। সকালে বেরিয়ে আগে কাটাও। ফিরে এসে ব্রেকফাস্ট খেয়ে ইয়ুমথাং/জিরো পয়েন্ট। জিরো পয়েন্ট প্যাকেজে নেই, তাই ওর বাড়তি পয়সাটা ড্রাইভারকে দিয়ে দিলেই হবে। পাসাং ছেলেটা বেশ ভালো - মুখ থেকে হাসি যায় না, আর কোনো কিছুতে অরাজী হয় না। তার ওপর ঋক আর ঋতির সাথে জবরদস্ত দোস্তি হয়ে গেছে।
ভোর পাঁচটা থেকে আমরা সবাই রেডি, কিন্তু পাসাংএর পাত্তা নেই। শেষে যখন এলো তখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। তড়িঘড়ি কাটাওয়ের দিকে রওনা দিলাম। কাটাও যেতে হয় লাচুং থেকে অল্প কিছুটা নেমে এসে নদী পেরিয়ে অন্য একটা রাস্তা দিয়ে। তুলনামূলকভাবে ভালো রাস্তা (লাচেন-এর চেয়ে অনেকগুণে ভালো), কিন্তু বেজায় প্যাঁচালো আর চড়াই - এবং সরু। ভাগ্য ভালো ঐ রাস্তায় গাড়ি প্রায় নেই বল্লেই চলে - তাই কোথাঐ আটকায়নি - ঘুরতে ঘুরতে উঠতে উঠতে অনেক উঁচুতে উঠে যাচ্ছিলাম। নীচের দিকে তাকালে অবাক লাগে - যে ঐ রাস্তা দিয়ে আমরা উঠে এসেছি।
নর্থ সিকিমের গোটা সময়টাতে সকালের দিকে আমরা অবিশ্বাস্য ভালো আবহাওয়া পেয়েছি। পুরো ঝকঝকে নীল আকাশ, সাদা মেঘ, আর দূরে বরফে ঢাকা চূড়া - একদম ক্যালেন্ডারের ফটো। হিমালয়ে এসে এত ভালো আকাশ না পেলে মন খুঁতখুঁত করে, ছবিগুলোতে আকাশ কেমন ঘোলাটে থাকে (লাভা/লোলেগাঁওতে যা পেয়েছিলুম) - ভাল্লাগে না। এইবার, লাচেন থেকে গুরুদংমার যাওয়ার সময় এবং লাচুংএও, আবহাওয়ার কারণে ছবিগুলো ব্যাপক উঠেছে। তবে এই সময়েই যে পশ্চিম হিমালয়ে আবহাওয়া ঘোঁট পাকাচ্ছে সে খবর জানা ছিলো না। নর্থ সিকিমে বিএসএনএল ছাড়া আর কারও সিগন্যাল পাওয়া যায় না বলে বাইরের সাথে যোগাযোগ ছিলো না যে এসব খবর পাবো।
ঘন্টাখানেক ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে ওঠার পর একটা মিলিটারি ক্যাম্প - এবং সেখানে আটকে গেলাম। গত এক বছরের কিছু বেশি সময় ধরে নাকি কাটাও যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এবারে আরে মেডিক্যাল অ্যাডভাইস নয়, পরিষ্কার "অর্ডার নেহি হ্যায়"। তবে এখানে ছবি নিতে আটকালো না - ক্যাম্পের ছবি না তুললেই হল। ক্যাম্পের ছবি তোলার কোনো দরকারও ছিলো না - কারণ উল্টোদিকে সোজা তাকালে ঝকঝকে আকাশে বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আমি আগে কখনো কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখিনি - লোলেগাঁও আর রিশপে মেঘের জন্যে দেখা যায়নি - কাজেই ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দূরে কাঁচনজঙ্ঘা, তার অল্প আগে বরফে ঢাকা আরেকটা চূড়া - মিলিটারির ভদ্রলোক নামটা বলতে পারলেন না। ছবি তুলতে তুলতে কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘে ঢাকতে শুরু করলো - আজনবি মুসাফিরকে মুখ দেখিয়েই সম্রাজ্ঞী মুখ ঢাকলেন। কিছুক্ষণ মিলিটারীর ঐ দুজনের সাথে গেঁজিয়ে, গরম জল খেয়ে (চা-ও খাওয়াতে চাইছিলেন, মনে হল লোকের মুখ দেখতে পেলে এঁরা ভারী খুশী হন) আবার ঘুরতে ঘুরতে নামা।
লাচুংএ ফিরে শুনলাম বাকি সবকটা গাড়ি অনেকক্ষণ রওনা দিয়েছে ইয়ুমথাংএর দিকে। কেউই আর কাটাও যায়নি। আমরাও আর না দাঁড়িয়ে ব্রেকফাস্টের প্যাকেট সঙ্গে নিয়ে ইয়ুমথাংএর দিকে রওনা দিলাম।
লাচুং থেকে ইয়ুমথাং খুব দূর নয়, এবং প্রথমদিকটা রাস্তাও মন্দ নয়। দু একটা গ্রাম, মিলিটারি ক্যাম্প পার হয়ে যেতে হয়। এবং অল্প দূর যাওয়ার পরেই দুদিকে ক্যালেন্ডারের ছবির মতন দৃশ্য শুরু হয়ে যায় - নীল আকাশ, সাদা মেঘ, মাঝে বরফে ঢাকা পাহাড়ের চূড়া। ইয়ুমথাংএর কয়েক কিলোমিটার আগে একটা রডোডেনড্রনের বন পার হতে হয়। রাস্তার দুপাশে যতদূর চোখ যায় নানা রকম রডোডেনড্রন গাছ। মাঝে মাঝে বোর্ড লাগানো - গাছের হিসেব দিয়ে। কিন্তু অক্টোবর মাস - আধখানা ফুলও কোথাও ফুটে নেই। তবে গাছের সংখ্যা দেখে আন্দাজ করা যায় মার্চ-এপ্রিলে জায়গাটার কি চেহারা দাঁড়াতে পারে।
রডোডেনড্রন উপত্যকা পার হওয়ার পরেই ইয়ুমথাং। যদিও এই উপত্যকা পার হতে হতে কোমর ভাঙার বড়সড় সম্ভাবনা রয়েছে। পাহাড় থেকে একটা ঝরনা নেমেছে, সাথে অসংখ্য বোল্ডার। রাস্তাটা ঘুরে ঘুরে বার বার ঐ ঝরনার ওপর দিয়ে চলেছে, নৌকোর মতন দুলতে দুলতে - পাথরের নদী নয়, উহাই পথ। রডোডেনড্রন উপত্যকার মধ্যে দিয়ে হাঁটা পথও রয়েছে - আর আমার ধারণা মার্চ-এপ্রিলে হাঁটা পথটাই ভালো। ফুলও দেখা যাবে একদম সামনে থেকে, আর কোমরও আস্ত থাকবে।
ইয়ুমথাংএ ঢোকার মুখে সারি দিয়ে দোকান, এবং প্রচুর লোকের ভিড়। এখানে দাঁড়াবেন না, আরেকটু এগিয়ে যান। সামনে পড়বে একটা বিরাট উপত্যকা, দুপাশে সারি দিয়ে উঁচু পাহাড়, আর দূরে, যেখানে দুদিকের পাহাড় মাঝখানে এসে মিলছে, সেখানে একটা মেঘে ঢাকা পাহাড়চূড়া। মেঘ এসে তার চূড়াটাকে এমনভাবে দেখেছে যে দেখলে মনে হয় একটা আগ্নেয়গিরি দাঁড়িয়ে রয়েছে - যার মাথা থেকে সাদা ধোঁয়া বেরোচ্ছে। উপত্যকার এক পাশ দিয়ে লাচুং চু বয়ে চলেছে, তার ওধারে ঘন পাইনের জঙ্গল। রাস্তা থেকে নেমে এগিয়ে যান নদীর দিকে - হাঁটাপথের দুধারে দেখবেন গাদা গাদা ইয়াক্ ঘুরছে। সবুজ ঘাস থেকে একটু নেমে যান পাথরের ওপর, জল ছুঁতে পারেন। বা একটু বসে থাকতে পারেন পাথরের ওপর, মিঠে রোদ্দুরকে পিঠে নিয়ে। বসে বসে দূরে ঐ আগ্নেয়গিরির মতন চূড়াটাকে দেখুন ... চারিদিকে বাকি পাহাড়গুলোর মাথার ওপর মেঘ পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে, কিন্তু দূরের ঐ পাহাড়টা ঠিক তেমনি ভাবেই মাথার ওপর সাদা ধোঁয়ার মতন মেঘ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ইয়ুমথাংএ কিছুক্ষণ কাটিয়ে এগোলাম জিরো পয়েন্টের দিকে - ইয়ুমথাং থেকে ঘন্টাখানেক দূরত্বে। এবার ক্রমশ: ওপরে উঠতে থাকা, সরু আর প্যাঁচালো রাস্তা। লাচুং নদী আস্তে আস্তে নীচের দিকে নামতে থাকলো। রাস্তার দুপাশে গাছের সংখ্যাও কমতে শুরু করলো। এর মাঝে এক একটা জায়গায় দেখলাম পাথরের গায়ে লালচে রঙের শেওলা। লাচুং চু-এর ধারে পাথরে এমনভাবে শেওলা ধরে রয়েছে যে রিভারবেডটা অবধি লালচে দেখায়।
রাস্তার দুপাশে গাছ কমতে কমতে শূণ্যতে এসে ঠেকলো, শুরু হল দুপাশে যতদূর চোখ যায় ততদূর অবধি পাথুরে বন্ধ্যা জমি। এই পথে একটা মিলিটারী ক্যাম্প চোখে পড়ে, কিন্তু তারপর আর কিছু নেই। দু এক জায়গায় আশেপাশে দেখে মনে হল কিছু বাঙ্কার রয়েছে, কিন্তু ক্যাম্প বা কোনো লোকজন (ট্যুরিস্ট ছাড়া) চোখে পড়লো না। তাও এক সময়ে এমন অবস্থা যে যতদূর চোখ যায়, ঐ পথে যাচ্ছে এমন একটা গাড়িও চোখে পড়ে না। ফিরছে অনেক গাড়ি, কিন্তু কেউই যাচ্ছে না। আমরা ভাবছিলুম দেরী হয়ে গেলো কি? কেউ তো আর যাচ্ছে না, সবাই ফিরছে। শেষে বেশ খানিকক্ষণ পর পিছনে আর একটা গাড়ি দেখে নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো - যে না, লোকে এখনও যাচ্ছে। চলতে চলতে এক জায়গায় রাস্তা শেষ। তারপর আর কিছুই নেই - পাথুরে জমি, আর দূরে কিছু বরফে ঢাকা পাহাড় ছাড়া। এই হল জিরো পয়েন্ট।
এবং এখানেও প্রচুর গাড়ি আর লোকের ভিড়। অল্প কিছু দোকান যেখানে তুমুল শস্তায় রাম/হুইস্কির বোতল বিক্রি হচ্ছে। অনেকে লাইন দিয়ে কিনছে। অ্যাজ ইউজুয়াল হুল্লোড়ও চলছে - একটা গ্রুপ থেকে তারস্বরে "হিপ হিপ হুররে"-ও শুনলাম। বুঝি না, লোকে এসব জায়গায় কি করতে যায় ... আমার তো এখানে চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে, অনেকক্ষণ। ঐ পাহাড়গুলোকে দেখলে নিজেকে কেমন যেন পিঁপড়ের মতন মনে হয়। সেখানে "হিপ হিপ হুররে" কেমন বেমানান লাগে।
এই সময়ে হঠাৎ দু এক পশলা হালকা বৃষ্টি নামলো - ঠাণ্ডায় বৃষ্টির জল জমে ছোট ছোট দু চারটে স্নো-ফ্লেক হয়ে পড়তেই আবার একচোট হুল্লোড়। ছাপোষা বাঙালী ট্যুরিস্টদের "তুষারপাত" দেখার শখও মিটে গেল (হুল্লোড় শুনে যা বুঝলুম)। পোলারাইজার লাগিয়ে ছবি তুলছিলুম, সেটা লেন্স থেকে খোলার সময় একজনের কনুইয়ের গুঁতোয় সেটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে কাঁচ চটে গেলো ...
জিরো পয়েন্ট থেকে ফেরার পথে আর কোথাও দাঁড়ানো নয় - সেই আঁকাবাঁকা পথে নামতে নামতে, ঝরনার বয়ে আনা পাথরে ওপর দুলতে দুলতে বেলা দুটো নাগাদ লাচুং।
গাড়ি থেকে নেমে দেখি হোটেলের সামনে বেশ ভিড় - কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। এগিয়ে গিয়ে শুনি সেই যে গ্রুপটার গাড়ি বারকয়েক খারাপ হচ্ছিলো, সেটা ইয়ুমথাং যাওয়া-আসার পথে নয় নয় করে বার দশেক বিগড়েছে। শেষে ঐ গ্রুপটা প্রায় দশ কিলোমিটার হেঁটে লাচুং পৌঁছেছে। সে গাড়ি আর যাবে না, আর ওখানে গাড়ি সারানো বা অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করাও সম্ভব নয়। মানে ঐ গাড়িতে যে কজন লোক ছিলো তাদের আর তাদের মালপত্র অন্য দুটো গাড়িতে ভাগাভাগি করে গ্যাংটক অবধি নিয়ে যেতে হবে। উপায় নেই, এসব সিচুয়েশনে কাউকে ঐ অবস্থায় ফেলে আসা সম্ভব নয় - কাজেই ঠিক হল অন্য গাড়িটাতে ওঁদের গ্রুপের দুজন আর বাচ্চাটা যাবে, আর আমাদের গাড়িতে বাকি তিনজন। অন্য গাড়িটার মাথায় কেরিয়ার নেই, কাজেই মালপত্র যা যাবে সব আমাদের গাড়ির মাথায় তুলতে হবে - ইনক্লুডিং আমাদের মালপত্র।
পরে মনে হয়েছে ভাগ্যিস আমাদের কপালে ঐ গাড়িটা পড়েনি - পড়লে কি করতুম জানি না। অন্য গাড়িটার ড্রাইভার খুবই যুক্তিসঙ্গতভাবে কেরিয়ার নেই বলে মালপত্র নিতে রাজী হল না বলে ঐ গ্রুপের একজনের মুখে "হাতি কাদায় পড়লে ব্যাঙেও লাথি মারে" শুনে মনে হয়েছিলো আমরা বিপদে পড়লে ওঁদের কাছ থেকে সাহায্য পেতাম কি?
খুব তাড়াতাড়ি করে দুপুরের খাওয়া সেরে সমস্ত মালপত্র গাড়ির মাথায় তুলে প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে বেঁধে রওনা দিতে দিতে আড়াইটে বেজে গেলো। লাচুং থেকে চুংথাং আসতে বেশি সময় লাগলো না। চুংথাংএর পর থেকে সেই ভয়ংকর ব্যাককাটিংওয়ালা রাস্তা শুরু। একটা জায়গায় ওপরে পাহাড় রাস্তার ওপরে এসে পড়েছে, নীচে খানাখন্দ, আর তারও নীচে, মানে রাস্তার তলায় মরচে ধরা লোহার বিম দিয়ে আটকানো। রাস্তাটা দেখে আমার একটাই কমেন্ট ছিলো - "এখান দিয়ে আমরা গেছি?" যাওয়ার সময় অন্ধকার ছিলো বলে বোঝা যায়নি, কিন্তু দিনের বেলা ঐ অংশটা পার হতে যে কোনো লোকের হার্ট প্যালপিটেশন হবে। ওটা পেরনোর কিছুক্ষণ পর গাড়িটা উল্টোদিকের পাহাড়ে চলে গেলো - তখন দূর থেকে ঐ অংশটা দেখা যাচ্ছিলো - আর আমরা এই কথাগুলোই বলাবলি করছিলুম।
চুংথাং ছাড়িয়ে গ্যাংটকের দিকে অল্প কিছুদূর গিয়েই আটকে গেলুম। লাইন দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে। শোনা গেল একখানি লরি নাকি উল্টে গেছিলো, সেখানাকে তোলার চেষ্টা চলছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে গেলুম - প্রায় দেড় কিলোমিটার ধরে হাঁটছি তো হাঁটছিই - গাড়ির লাইন আর শেষ হয় না - শেষে এক জায়গায় গিয়ে দেখলুম মূর্তিমান লরিটি মাথা উঁচু করে খাদে গড়িয়েছেন, তখন নাকটা রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছে, আর একটি টো-ট্রাক তাকে তোলার চেষ্টা করছে। গাড়ির কাছে ফিরে এলুম। উল্টোদিকে মেঘের আড়ালে একখানা বরফঢাকা চূড়া মুখ দেখাচ্ছে - তার ছবি তুল্লুম - সময় কাটাতে হবে তো। শুনছি আর আধ ঘন্টা লাগবে, তারপর শুনলাম আরো আধ ঘন্টা লাগবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল। রাস্তার ধারের ঝোপে ঝাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকতে শুরু করলো। রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়িগুলো কয়েকটা অল্প আলো জ্বালিয়েছে, তাছাড়া আর কোনো আলো নেই। গাড়িতে জলের আকাল। খাবারের আকাল। সঙ্গী অন্য তিনজনের কাছ থেকে বাচ্চাদুটোর জন্যে একটু জল পাওয়া গেলো। সাড়ে চারটে থেকে আস্তে আস্তে সাড়ে ছটা, শোনা গেলো লরিবাবাজী উঠেছেন, এক্ষুনি গাড়ি ছাড়তে শুরু করবে। সাতটা নাগাদ গাড়ি নড়লো - কিন্তু কিছুদূর এগিয়েই আবার আটক। সামনে একটা গাড়ি রাস্তার বাঁদিকের নালায় চাকা আটকে ফেলেছে। ততক্ষণে উল্টোদিকের গাড়িও এসে গেছে - পাশ কাটানোর জায়গা নেই - অতএব ফের বসে থাকো। বৃষ্টি নেমেছে, নীচে নামার উপায় নেই, জায়গাও নেই। এরই মধ্যে সিকিমের কিছু পুলিশ দৌড়োদৌড়ি করে কিছু গাড়িকে একটা চওড়া জায়গায় ঢোকানোর ব্যবস্থা করলো যাতে নালায় পড়া গাড়িটাকে পাশ কাটানোর জায়গা হয়। সে গাড়ি পার হওয়ার পরেও জ্যাম আর কাটে না - এবার সামনে একটি মারুতি অমনি ট্যাক্সি, যার ব্রেক কাজ করে না ... এই সব নানা ঝক্কি কাটিয়ে গাড়ি যখন ফাইনালি চলতে শুরু করলো তখন সাড়ে সাতটা। পাক্কা তিন ঘন্টা পরে।
এর মধ্যে মোবাইলে সিগন্যাল এসেছে। ওয়ান পিস আছি সেই খবরটা বাড়িতে দিয়ে হোটেলে ফোন করলাম যাতে রাতের জন্যে কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে রাখে - কারণ ডিনার টাইমের ঢের পরে গ্যাংটক পৌঁছবো। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জল আর বিস্কুট কিনে দে দৌড় - ঐ রাস্তায় যতটা তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। পথে সেই পাঁকে ভর্তি অংশটুকু - বৃষ্টি হয়ে অবস্থা আরো খারাপ - একটা একটা করে গাড়ি এগোচ্ছে। আমাদের দুটো গাড়ি আগে একটা গাড়ি অর্ধেক উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো - আর টানতে পারছে না। একবার নয়, বার তিনেক। শেষে নেমে এসে কয়েকজন লোক নামিয়ে ওজন কমিয়ে সে পাঁক পার হল - লোকগুলো ঐ পাঁক হেঁটে পেরিয়ে ফের গাড়িতে উঠলো।
গ্যাংটকে ঢুকলাম তখন দশটা বেজে গেছে। আমাদের হোটেলে নামিয়ে গাড়ি বাকিদের নামাতে চলে গেলো। সেই সতেরো তারিখে শেষ চান করেছি - ভেবেছিলাম গ্যাংটক পৌঁছে চান করবো। কিন্তু এন্থু শেষ। কোনোরকমে ঘুমন্ত ছেলেমেয়েদুটোকে খাইয়ে নিজেরা খেয়ে সোজা বিছানায়।
২০শে অক্টোবর, গ্যাংটক থেকে পেলিং
গায়ে গতরে ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙলো। তখন সবে দিনের আলো ফুটছে। বাকি সবাই তখনো গভীর ঘুমে। জানলার পর্দা সরাতেই দূরে একটা বরফে ঢাকা পাহাড় চোখে পড়লো। নামধাম জানি না - গোটা ট্রিপে আরো অনেক পাহাড়ের মতই। এই আরেকটা জিনিস বাইরের কোনো দেশে হলে করে ফেলতো - কাটাও বা জিরো পয়েন্টে একখানা বোর্ড লাগাতো, তাতে কোনটে কোন peak সেই ইনফরমেশনটা লেখা থাকতো ছবিসহ। এরকম ছবি কিনতে পাওয়া যায়, কিন্তু ভিউপয়েন্টে এই ইনফরমেশনটা খুব হেল্পফুল।
যাওয়ার সময় গ্যাংটকে ছিলাম সোনম-ডেলেক বলে একটা হোটেলে। নর্থ সিকিম থেকে ফিরে উঠেছিলাম মিন্টোক্লিং গেস্ট হাউজে। দুটোই স্বচ্ছন্দে সকলকে রেকমেন্ড করবো। সোনম-ডেলেক হল এমজি মার্গ থেকে ওপরদিকে উঠে বাঁদিকে ঘুরে টিবেট রোডের মাথার কাছে। এমজি মার্গের হইহট্টগোল নেই, অথচ রাস্তাটা খুবই কাছে। হোটেলটাও পরিষ্কার। হোটেল পরিষ্কার কিনা সেটা এক ঝলকে বুঝবেন জানলায় ঝোলানো পর্দা দেখে। বাজেট হোটেলের মধ্যে খুব কমই পাবেন যেখানে ঝকঝকে সাদা পর্দা ঝোলে। মিন্টোক্লিং আরো একটু ওপরে, সেক্রেটারিয়াট রোডে, খুব চুপচাপ একটা জায়গায় - ফ্যামিলি-রান গেস্টহাউজ। খাবার খুব ভালো, এবং ব্যবহারও। এবং এই হোটেলটাও খুব পরিচ্ছন্ন। কেউ গ্যাংটক গেলে এই দুটো হোটেলের নাম মাথায় রাখতে পারেন।
দশটা-এগারোটা নাগাদ পেলিংএর দিকে রওনা দেবার ইচ্ছে ছিলো। হোটেলে ট্যাক্সির খোঁজ করতে গিয়ে প্রথমে বেশ বড়সড় রেট শুনলাম। তারপর দময়ন্তী শুনলাম তার প্রায় অর্ধেক রেটে ট্যাক্সি পেয়েছে - ওয়াগন-আর। ওকে বল্লাম তাহলে ওটাতেই মাথায় জিনিসপত্র তুলে একসাথে পেলিং চলে যাই। সেই মতন কথাও হল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দময়ন্তী ফোন করে জানালো ওয়াগন-আর নয়, একখান অল্টো পাঠিয়েছে, যার মাথায় কেরিয়ারও নেই। কাজেই আগের প্ল্যান বাতিল করে এমজি রোডের দিকে হাঁটা দিলুম ট্যাক্সির খোঁজে। হোটেল থেকে ট্যাক্সির যা রেট বলেছিলো তার চেয়ে অনেক কমে, ইনফ্যাক্ট দময়ন্তীকে যা রেট দিয়েছিলো তার চেয়েও কমে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলুম - অল্টোই, তবে চারজন + মালপত্র অনায়াসে চলে যাবে। ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে এসে জিনিসপত্র তুলে বেরোতে বেরোতে পৌনে বারোটা। পেলিং গ্যাংটক থেকে প্রায় পাঁচ ঘন্টার রাস্তা। অনেকটা নেমে সিংথাম হয়ে সাউথ সিকিমের রাবংলা পেরিয়ে পেলিং (ওয়েস্ট সিকিম) যেতে হয়।
হোটেলে বেশ ভারি ব্রেকফাস্ট করা ছিলো। তাও ছেলেমেয়ের দুপুর একটা বাজলেই ক্ষিদে পায় - কাজেই সিংথামে দাঁড়িয়ে দুপুরের খাওয়া মেটানো হল। সিংথাম থেকে গাড়ি গ্যাংটক-শিলিগুড়ির রাস্তা ছেড়ে একটা অন্য রাস্তা ধরে সাউথ সিকিমে ঢোকার জন্যে। এবং নর্থ সিকিমের তুলনায় এই রাস্তাটা ঢের ভালো। এদিকটা একটু বেশি সবুজ। আশেপাশে প্রচুর ছোট ছোট গ্রাম পড়ে। রাবংলা ছাড়িয়ে আরো খানিকটা গিয়ে রঙ্গিতের ওপর একটা ব্রীজ পেরিয়ে ওয়েস্ট সিকিম শুরু হয়। নতুন করে বর্ণনা দেবো না - সেই উঁচু পাহাড়, ঢালু খাদ, তলায় রঙ্গিত ফুঁসছে, ছোট ছোট গ্রাম, গ্রামের সামনে জল-চালিত ধর্মচক্র, আর লাল-নীল-হলুদ-সবুজ পতাকার সারি ... এসবের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে প্রথমে পড়ে গেজিং। গেজিং ছাড়িয়ে আরো একটু এগিয়ে পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট শহর পেলিং।
ছোট্ট, কিন্তু ঘিঞ্জি। শুনলাম কয়েক বছর আগেও লোকে পেলিং বেড়াতে যেত না খুব একটা। তখন অল্প কিছু বাড়ি ছিলো - আর বাড়ির মালিকেরা একটা দুটো ঘর ভাড়া দিত। থাকার ব্যবস্থা শুধু ঐটুকুই ছিলো। এখন পেলিংএ লাইন দিয়ে হোটেল। আপার পেলিং, মিড্ল পেলিং, লোয়ার পেলিং - যেখানেই যান, রাস্তার দুপাশে সারি দিয়ে শুধু হোটেল আর হোটেল। আর থিকথিক করছে লোক। ৯৯ . ৯৯% বাঙালী। একজনও অবাঙালী ট্যুরিস্ট দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
আমাদের হোটেলটা ছিলো লোয়ার পেলিংএ। উল্টোদিকেই Aryan Regency আর Newa Regency - যে দুটো হোটেলের নাম ট্র্যাভেলগুরু বা মেকমাইট্রিপে সবার আগে আসে। আমরা উঠলাম এদের সামনে হিমালয়ান হাইডঅ্যাওয়ে-তে। ছোট হোটেল, কিন্তু পরিষ্কার। সবচেয়ে বড় অ্যাট্রাকশন হল ঘরে বড় বড় জানলা, এবং ঐদিকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। পেলিংএর চেয়ে ভালোভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা নাকি আর কোথাও দেখা যায় না। উল্টোদিকের Aryan আর Newa Regency-তে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে গেলে বাইরে করিডরে এসে দাঁড়াতে হবে। আমরা বিছানায় শুয়ে শুয়েই দেখতে পাবো। মানে পরদিন সকালে। তখন বিকেল হয়ে এসেছে, আকাশেও মেঘ। তখন কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে হাঁটতে বেরোলাম - গ্যাংটকে সময়াভাবে "শপিং" হয়নি, সঙ্গের বিগ-শপারের মনে ভারি দুষ্কু - তাই পেলিংএর রাস্তায় দেখতে বেরোলুম কি পাওয়া যায়। লোকজনের জন্যে কিছু নিয়ে যেতে হবে, আর আমার একটা জপযন্ত্রের ভারী শখ - সেখানা দেখতে হবে। আর যদি থাংকা আর তিব্বতী মুখোশ পাওয়া যায় ...
সিকিমযাত্রীদের জন্যে টিপস -যা কিছু মেমেন্টো কেনার, গ্যাংটকে কিনে রাখুন। পেলিংএ মাত্র দুটো কি তিনটে দোকান আছে - এবং তার সামনে রেশন দোকানের লাইনের মতন ভিড় হয়। জপযন্ত্র পাওয়া যায়, ছোট সাইজের মুখোশ (যেগুলোকে ওয়াল হ্যাঙ্গিং হিসেবে ব্যবহার করা যায়) পাবেন, তবে থাংকা মোটেও ভালো পাওয়া যায় না। আর পাওয়া যায় রাশান ডলের মতন কনসেপ্টের ফ্যামিলি পার্স: মানে একটা পার্স, তার মধ্যে আরেকটা পার্স, পার্সের মধ্যে পার্স - পাঁচটা মনে হয় থাকে সব মিলিয়ে।
হোটেলের রিসেপশনে বললো পেলিং ঘোরার দুটো স্কীম আছে - হাফ ডে আর ফুল ডে। হাফ-ডে-তে আপনাকে সকালবেলা নিয়ে যাবে রিম্বি ফলস, খেচিপেড়ি (khecheopalri) লেক, রিম্বি পাওয়ার প্রজেক্ট অ্যাণ্ড রক গার্ডেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস। দুপুরে ফিরে খেয়ে দেয়ে আবার বেরোতে পারেন - ফুল-ডে ট্রিপ থাকলে - তখন যাবেন ছাগে ফলস, শিংশোর ব্রীজ আর পেমিয়াংচি মনাস্টেরি। হাফ-ডে হলে ষোলশ, ফুল ডে হলে আড়াই হাজার (রিজার্ভ গাড়ি)। বুক করবো কিনা ভাবছি, এমন সময় জিংমি (যার গাড়িতে গ্যাংটক থেকে এসেছি) ফোন করে বললো ও তখন আর গ্যাংটক ফিরতে পারবে না (সন্ধ্যে হয়ে গেছে, অন্ধকারে ফেরা রিস্কি) আর কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছে না। আমরা যদি ওর গাড়িতে পরের দিন পেলিং ঘুরি তাহলে ও কোনোভাবে থেকে যাবে, আর ঐ আমাদের এনজেপি-ও পৌঁছে দেবে। অল্পবয়সী ছেলে - এমন করে বললো যে আমি রাজী হয়ে গেলাম। হোটেলের বলা রেটের চেয়ে বেশি পড়েনি, হয়তো বাইরের রেটের চেয়ে একটু বেশি পড়লেও পড়ে থাকতে পারে। কিন্তু ছেলেটাকে ভালো লেগেছিলো বলে আর কোথাও খুঁজতে যাইনি।
২১শে অক্টোবর, পেলিংএর আশেপাশে
রাতে বৃষ্টি হচ্ছিলো। তখনও বাইরের খবর খুব একটা রাখছিলাম না বলে জানতাম না পশ্চিম হিমালয়ে আবহাওয়া কি খেলা দেখানো শুরু করেছে। ভোর চারটে থেকে জেগে শুয়ে - সূর্যের প্রথম আলো কখন কাঞ্চনজঙ্ঘায় পড়ে সোনালী রং দেখাবে। ভোর থেকে সকাল হল - কিন্তু আকাশ পরিষ্কার হল না। সেই ঘোলাটে মেঘলাই থেকে গেলো। কাঞ্চনজঙ্ঘার টিকি অবধি দেখা গেলো না।
অগত্যা সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোনর জন্যে তৈরী হতে লাগলুম। পেলিংএ বেশ লোডশেডিং হয়। আমি চান করে বেরোতে বেরোতেই লোডশেডিং - কাজেই গীজার বন্ধ - কাজেই আর কারো চান হল না। ঠিক হল দুপুরে ফিরে এসে সেসব সারা হবে'খন। জিংমি এলো সওয়া আটটা নাগাদ - সাড়ে আটটার সময় আমরা বেরিয়ে পরলুম।
লোয়ার পেলিং থেকেই নীচের দিকে নামতে নামতে প্রথমে রিম্বি ফলস। এই প্রপাতটা ভারি সুন্দর। প্রচন্ড তোড়ে জল নামে না বটে, কিন্তু পাহাড়ের গা বেয়ে ঝিরঝির করে এমনভাবে নামে যে দাঁড়িয়ে দেখার মতন।
রিম্বি ফল্স ছাড়িয়ে আরো এগিয়ে রঙ্গিতের ধারে রিম্বি পাওয়ার প্রজেক্ট আর রক্ গার্ডেন। দশ টাকার টিকিট কেটে ঢুকতে হয়, কিন্তু রক্ গার্ডেনটা অতিশয় ফালতু। কিছুই নেই - একটা পার্কের মতন, পাশ দিয়ে রঙ্গিত বইছে। কোটি কোটি লোকের ভিড়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখি দময়ন্তী নামছে। ও সিকিম ট্যুরিজমের একটা ট্রিপ বুক করেছিলো। সাবধান করে দিলুম - যে - যেও না, কিছুই নাই শুধু কোটি কোটি লোক ছাড়া। আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে এগোলাম খেচিপেড়ি লেকের দিকে।
সেও এক অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স। লেক বলতে আমার চোখে ভাসে লেক ডিস্ট্রিক্টের উইন্ডারমেয়ার বা গ্রাসমেয়ার, আর নয়তো লক্ নেস। খেচিপেড়ি লেক আদতে একটা কাদাগোলা ডোবার চেয়ে বেশি কিছু নয়। গেটের বাইরে গাড়ি রেখে মিনিট পাঁচেক একটা ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে গিয়ে প্রথমে ভাবলাম এটা মনে হয় রাস্তার পাশে একটা পুকুর। তারপর ওটাই লেক শুনে আর কাছে গিয়ে দেখার ইচ্ছে ছিলো না। তাও ছেলেমেয়েকে নিয়ে যেতে হবে বলে গেলাম। কিছুই না, শুধু কাদাগোলা জল, তারমধ্যে প্রচুর মাছ ঘুরছে। এটা নাকি পবিত্র লেক, তাই লোকে দেখতে আসে। আদৌ দর্শনীয় কিছু নয়। লেকের ধারে কিছু ফুলটুল ফুটে রয়েছে, কিছু অর্কিড দেখা যায়, আর অসংখ্য পতাকা - পতাকা টাঙিয়ে লোকে "উইশ" করে। পতাকার আড়ালে লেকটা প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে।
খেচিপেড়ি থেকে বেরিয়ে বেশ খানিকদূর গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস। এখানে দুটো প্রপাত আছে - একটা খেচিপেড়ি লেকের জল এসে পড়ছে, আরেকটা মেইন ফলস - যেটা বেশ তোড়ের সঙ্গে নামছে। আমার ঐ তোড়ের সাথে নামা বড় প্রপাতটার চেয়ে পাশে ঝিরঝিরিয়ে নামা খেচিপেড়ির জলের ধারাটাই অনেক বেশি ভালো লাগলো। আশেপাশে বাজার বসে গেছে - সেখানে সেই ছোটবেলার সিলিন্ডারের মতন পাঁপড় টাইপের জিনিস, কচুভাজার প্যাকেট, পেয়ারা ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। ঋক ঐ পাঁপড়টা খেতে চাইলো, আমি অনেকদিন কচুভাজা খাইনি বলে একখান প্যাকেট কিনলাম, আর কিছু পেয়ারা কেনা হল। সেসব খেতে খেতে প্রচুর রাস্তা পরিয়ে পেলিংএ ফিরলাম বেলা দুটো নাগাদ। দুপুরে খেয়ে বেরোব শিংশোর ব্রীজ আর পেমিয়াংচি দেখতে।
দুপুরে থুক্পা আর মোমো খেয়ে বেরোলুম শিংশোর ব্রীজ আর পেমিয়াংচির উদ্দেশ্যে। শিংশোর ব্রীজ পেলিং থেকে বেশ কিছুটা দূর - ঘন্টাখানেক তো হবেই। একটা cable-stayed ব্রীজ, এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম ব্রীজ। সেই ঘুরতে ঘুরতে, উঠতে নামতে বহুদূর গিয়ে ব্রীজটা চোখে পড়ে। ব্রীজের ওপর দাঁড়ালে দুলুনি টের পাওয়া যায়।
এখানে ব্রীজের আগে একটা ছোট পার্ক মতন আছে। তার পিছনে একটা ফল্স। সেটা দেখবো বলে যখন ঢুকছি তখন জীন্স পরা এক ছোকরা ঢুকলো - পকেটে হাত দিয়ে - জীন্সের তলাটা প্রায় ছয় ইঞ্চি ফোল্ড করা। হাবভাবটা বেশ হাইফাই। ঢুকে পার্কের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে ব্রীজের ওপর (প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরে) দাঁড়ানো তার বাবাকে তারস্বরে ইনস্ট্রাকশন দিতে লাগলো (তার ছবিটা তোলার জন্যে) - "পুরো জুম করে তোলো"। মানে ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর লাগলো বলে লিখলুম এখানে।
ফেরার পথে সন্ধ্যে হয়ে এসেছিলো। পেমিয়াংচি (পেলিং থেকে অল্প দূরেই) পৌঁছে দেখি বন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই পেলিং ফিরে এলুম। হোটেলে ফিরে আর কিছু করার নেই বসে থাকা আর টিভি দেখা ছাড়া।
২২শে অক্টোবর, পেলিং থেকে শিলিগুড়ি
সকালে উঠে রেডি হয়ে বেরোলাম। মেঘলা আকাশ বলে এদিনও কাঞ্চনজঙ্ঘা কিছুই দেখা গেলো না। মাঝে কয়েক মিনিটের জন্যে ইঞ্চিখানেক একটা টিকি দেখা গেছিলো - তবে সেটা পাশের একটা সামিট, কাঞ্চনজঙ্ঘা সামিটটা নয়।
কপাল খারাপ। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া পেলিং বলতে গেলে আর কিছুই নেই, আর সেটাও দেখা হল না। কাজেই আর কিছু করার নেই, পেমিয়াংচি ঘুরে সোজা শিলিগুড়ি চলে যাবো। পেমিয়াংচি পৌঁছলাম যখন তখনও বেশ কুয়াশা। কুয়াশার মধ্যে হলুদ পতাকার সারিটা ব্যাপক লাগছিলো - পুরো যেন কলাবন। অতি প্রাচীন গোমফা, ভিতরে সুন্দর ছবি আর মূর্তির কালেকশন রয়েছে। কিন্তু মনাস্টেরির ভিতরে ছবি তুলতে দেয় না - নইলে তিনতলায় একটা বিরাট প্যাগোডার মতন স্ট্রাকচার আমার ভয়ানক পছন্দ হয়েছিলো। তিব্বতী/চীনা ট্র্যাডিশনে সম্ভবত: গরুড় জাতীয় কোনো জন্তু (আধা পাখি, আধা জন্তু, মুখে সাপ) আছে - প্যাগোডাটার পাশে এরকম একটা মূর্তি দেখে মনে হল।
পেমিয়াংচি দেখা শেষ মানে আমাদের সিকিম ঘোরা শেষ। ওখান থেকে সোজা নামতে শুরু করলাম শিলিগুড়ির দিকে। ততক্ষণে ঐ চত্ত্বরেও ভালো বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। রাস্তাও পিছল। তার মধ্যেই নামতে নামতে রিনচেমপং পেরোলাম - পেলিংএর আগে এখানেই যাবো ভেবেছিলাম, কিন্তু জায়গা পাইনি বলে পেলিং। তারপর রংপো হয়ে শিলিগুড়ি।
সকালের কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরার ছিলো বলে শিলিগুড়ি টাউনে না থেকে ভাবলাম এনজেপিতে থাকবো। সে কি হোটেল রে ভাই। সমস্ত সন্ধ্যে বিছানায় উঠে বসে রইলাম - যত কম মাটিতে নামতে হয় আর কি। চান-টানও হল না, সেদিন তো নয়ই, পরের দিন সকালেও নয় - কারণ যা বাথরুমের ছিরি তাতে চান করতে ইচ্ছে করলো না।
পরের দিন কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস আরেক যন্ত্রণা। এনজেপি এলো নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট আগে। মালদা টাউন পৌঁছলো ঠিক সময়ে। তারপরেই ট্রেনের ইঞ্জিন বদলে মনে হয় কয়েকটা গরু লাগিয়ে দিয়েছিলো। ঢিকির ঢিকির করে ট্রেন চললো, ছোটখাটো স্টেশন, হল্ট স্টেশনে তো বটেই, মাঠেঘাটেও দাঁড়িয়ে পড়ছিলো। বর্ধমানে ভাবলুম নেমে গিয়ে লোকাল ধরি, কিন্তু আবার সব জিনিস নিয়ে নেমে লোকালে উঠতে হবে ভেবে থেকে গেলুম। বর্ধমানের পর চন্দনপুর বলে একটা স্টেশনে ঢোকার মুখে পাক্কা চল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে রইলো - পাশ দিয়ে দুখানা ডাউন লোকাল চলে গেলো, কিন্তু নামার জন্যে প্ল্যাটফর্ম ছিলো না বলে কিছু করা গেলো না। শেয়ালদা ঢোকার মুখে ফের মিনিট কুড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে। আসলে সন্ধ্যের সময় শেয়ালদা স্টেশনটা ওভারলোডেড হয়ে থাকে। উত্তরবঙ্গেরই তো প্রায় চারখানা ট্রেন ছাড়ে আধ ঘন্টা পর পর। তার ওপর লোকাল। এই ম্যানেজমেন্টটা যদ্দিন না ঠিক হবে তদ্দিন এরকম দুর্ভোগ পোয়াতেই হবে - আর লজিক্যালি এটা হ্যান্ডল করার ধক কারো নেই। ট্রেন শেয়ালদা ঢুকলো রাত্তির এগারোটা - সাড়ে সাতটার জায়গায়। তারপর ট্যাক্সি ধরা - ভাগ্যক্রমে একজন রাজী হয়ে গেলো, এবং বেশি না হেঁকেই। বাড়ি ফিরলুম রাত্তির বারোটার সময়।
সিকিম ভ্রমণেচ্ছুক সকলের জন্যে কিছু টিপস:
(১) নর্থ সিকিম গেলে উইলটা অন্তত: করে যাবেন।
(২) ছোট বাচ্চা নিয়ে গুরুদংমারের দিকে যাবেন না, মিলিটারি আটকে দেবে।
(৩) ফরচুনা নামক ট্যুর অপারেটরের থেকে দূরে থাকবেন।
(৪) পেলিং না যাওয়ারই চেষ্টা করুন। কিছুই নাই, কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া। নেহাত যদি যেতেই হয়, আগে থেকে ওয়েদারের খবর নিয়ে এক রাতের জন্যে যান। কপালে থাকলে সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবেন, তারপর ডে ট্রিপটা কাস্টমাইজ করে নিন - রিম্বি ফলস, কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস, পেমিয়াংচি ছাড়া আর কিসুই দেখার নেই।
(৫) দিনের ট্রেনে কক্ষণো এনজেপি থেকে ফিরবেন না। কাঁদিয়ে দেবে।
(৬) ভুলেও এনজেপিতে থাকার কথা ভাববেন না। শিলিগুড়ি টাউনে থাকবেন।
তবে একটা কথা বলি - রাস্তার ছবি দেখে আর বর্ণনা শুনে ঘাবড়ে গিয়ে যদি না যান, সারা জীবন আফশোস করবেন। প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিক থেকে সুইস আল্পস বা স্কটিশ হাইল্যান্ডসের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। শুধু আমাদের সাথে বাইরের তফাত হল সুইজারল্যান্ড বা স্কটল্যান্ডে প্রতিটা রাস্তা মসৃণ - দুর্গম হলেও। আর সুইজারল্যান্ড হলে এই লাচুং থেকে কাটাও অবধি হয়তো একখানা কেবল কার বানিয়ে দিত। তবে ঐ উচ্চতায় (গুরুদংমার ১৭৮০০ ফুট, কাটাও এবং জিরো পয়েন্ট পনেরো-ষোল হাজার মতন) মোটরেবল রোড - সে যতই ভাঙা হোক না কেন - সম্ভবত: পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আমি রকি মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্কে গেছি - গাড়ি নিয়েই - সর্বোচ্চ পয়েন্ট ছিলো ১১ হাজার ফুট মতন - অ্যাপারেন্টলি হাইয়েস্ট মোটরেবল রোড ইন দ্য ইউএস।
একটু দুর্গম, অফবীট রাস্তায় যেতেই আমার আনন্দ। আগেরবার চেরাপুঞ্জি যাওয়ার আগে ট্র্যাভেল এজেন্ট প্রচুর অ্যান্টিপুরকি দিয়েছিলো - কি করবেন, ওখানে কিছু নেই, বরং শিলঙে থেকে একটা ডে-ট্রিপ মেরে আসুন। ওর কথা শুনে চললে ঠকতাম। আজ অবধি ঘোরা সেরা জায়গার লিস্ট বানাতে বসলে হাইল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, নর্থ সিকিম আর চেরাপুঞ্জি তাতে ওপরের চারটে নাম হবে।
নর্থ সিকিমকে আমার নিজের অনেকটা হাইল্যান্ডসের মত লেগেছে। সুইজারল্যান্ড সুন্দর। রাদার, অসম্ভব সুন্দর। কিন্তু আমার একটু বেশি ছবি-ছবি মনে হয়। বড় সাজানো। হাইল্যান্ডস অনেক বেশি ডাউন টু আর্থ। ন্যাচারাল। এক এক সময়ে হাইল্যান্ডস এক এক রূপ দেখিয়েছে।
শীতের সময়ে গেছি - ইনভারনেস ছাড়িয়ে আলাপুলের দিকে চারদিক সাদা, বরফে ঢাকা, কুয়াশা ...
শীত শেষের ঠিক পরে গেছি - বরফ গলে যাওয়ার পর ম্যাড়ম্যাড়ে জমি, সবে ঘাস গজাতে শুরু করেছে।
একটু গরমে গেছি - চারদিক উজ্জ্বল সবুজ, ব্লু-বেলসে ছেয়ে গেছে সমস্ত জমি। আর বৃষ্টির পর সেই সবুজ কয়েকগুণ চোখ ধাঁধানো হয়ে এসেছে।
বছরে একবার অন্তত: হাইল্যান্ডস না গেলে মন কেমন করতো। কেয়ার্নগর্মের পাশে লক্ লাগানের ধারে পাহাড়ের গায়ে একখান ট্র্যাডিশনাল স্কটিশ পাথরে তৈরী বাড়ি দেখে বউকে বলেছিলুম - পারলে এই বাড়িটাতে থেকে যেতুম। লক্ লাগানের ধারে বালির ওপর ঘোড়ায় চড়তুম, আর ঐ বাড়িতে থেকে ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম (মানে ইজিচেয়ারে শুয়ে বই পড়া আর কি) ...
নর্থ সিকিম অনেকটাই এই রকম। মনে হয় এও বার বার টানবে।
arijit
ReplyDelete- superb, kichhu kathaa hobe naa, jemon barnon-tar saathe chhobi- ek somaye maathaao ghure uthechhilo jete-jete.
- superb.
himadree
arijeet
ReplyDelete-superb- jemon barnon-temni chhobi-- kono kathaa hobe na-just superb
ek somye mathaao ghurhe uthechhilo jete jete.
himadree
ভ্রমন কাহিনী আমার বরাবরই ভালো লাগে।আপনার বর্ণনা অসাধারন হয়েছে।
ReplyDeletearijitda, apnaar sundor vromon kahinita poralam. ektaa jinis jeta mone holo seta holo apnake dui ekta important information diye rakhle valo hoy.....hotel booking korun www.makemytrip.com theke. seta shudhu matro ekdiner jonno. hotel pouche jodi mone hoy je apnaar pochondo tobe booking extend korun nirdisto din onujayi.....noy to sedin beriye porunm asepaser hotel gulote nojor dite. hotel e uthe ese local trasport vara korun. spote ese transport vara korle onek subidha...dur theke karoke dayitto dile tate osubidhaa beshi.
ReplyDeleteaar apatoto kichu mone porche naa....oh haa jodigoa ghurte chan to amar blog e se sombondhe bistarito lekha aache ....pore dekhte paren.
khub vhalo legeche akhon e jete icche hocce
ReplyDeleteসম্প্রতি বেড়িয়ে এলাম সিকিম, তারপর আপনার লেখাটি পড়লাম সত্যি ছবির মতই বুঝিয়ে দিয়েছেন। প্রতিটি ছত্রে মনে হচ্ছিল নিজের মনে থাকা লেখাটি পড়ছি। তবে গুরুদোংমার যেতে না পারাটা দুঃখের। আমার সঙ্গেও একটি শিশু এবং দুজন বয়স্ক মানুশ ছিলেন তাদের একটু অসুবিধা হলেও ওই সৌন্দর্যের জন্য সে টুকু সমস্যা মেনে নেওয়াই যায়। ভালো থাকবেন। আবার এমন একটি সুবর্ণনামূলক লেখার আশায় থাকলাম। - পলাশ মুখোপাধ্যায়
ReplyDeleteঅসম্ভব সুন্দর লিখেছেন .ভীষণ ভালো লাগল.মে মাসে যাব .আপনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে.তবে এতো সময় গাড়িতে বাচ্ছারা বিরক্ত হবে না ?
ReplyDelete