Friday, May 11, 2012

শহর থেকে শহরে - ১

কলকাতা শহরতলি - মাঝে কয়েক বছরের জন্যে শিবপুর, দিল্লী, হেলসিঙ্কি, কলোরাডো স্প্রিঙস, সিলভার স্প্রিঙ-গেথার্সবার্গ থেকে বিলেতের নিউক্যাসল আপন টাইন হয়ে ফের এই কলকাতা শহরতলিতে এসে পুরো বৃত্ত সম্পূর্ণ। এই বৃত্তের গল্পই লিখবো - শহরগুলোর গল্প। কোনোটা ভালো, কোনোটা লাগেনি, কোথাও মনে হয়েছে কলকাতাতেই আছি। কোনোটা মনে পড়ে না, ইচ্ছেও হয় না মনে করার, কোনোটা এখনও টানে। সেই শহরগুলোর গল্প। আজ কলকাতা শহরতলির গল্প।

যখন ছোট ছিলাম, তখন সেটা কলকাতা ছিলো না, ছিলো পূর্ব পুটিয়ারী, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। আবছা আবছা মনে পড়ে আশেপাশে নিজেদের বাড়িটা নিয়ে সাকুল্যে তিনটে বাড়ি - বাপিদের আর বুয়াইদের (এই দুজন আমার সেই বয়সের বন্ধু) - আর ধু ধু মাঠ, বাড়ির সামনে বাঁশবাহান, সন্ধে হলেই সেখানে শেয়ালের ডাক। সবচেয়ে কাছের বাসরাস্তা হেঁটে মিনিট কুড়ি। লোডশেডিং হলে একতলা বাড়িতে লন্ঠনের আলোয় বাবা, মা, ঠাকুমা, দিদি আর আমি বসে থাকতুম। প্রচুর পুকুর ছিলো, লক্ষ্মীপিসীরা একটু দূরে থাকতো, দিনের বেলাটা আমি প্রায়সই ওদের বাড়িতে থাকতুম, কারণ দাদু তখন পুরোপুরি বিছানায়, ঠাকুমা অসুস্থ, মা ঘর সামলে, দাদুকে সামলে আর আমাকে দেখে উঠতে পারতো না - লক্ষ্মীপিসী তাই আমাকে নিয়ে যেত। এই লক্ষ্মীপিসীই আমাকে সাঁতার শিখিয়েছিলো - তখন দু বছর বয়স মোটে - আমাদের ক্লাসিক গ্রাম স্টাইলে শেখা সাঁতার - মানে পুকুরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া।

সত্তরের দশকের অনেক গল্প শুনি - আবছা মনে আছে বাঁশবাগানের ওপারে দুম দুম আওয়াজ, আর একটু পরেই রক্ত মেখে একজনের টলতে টলতে বাঁশবাগান থেকে বেরিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া। একদিন পুলিশ এসেছিলো বাড়িতে, সার্চ করতে - জবরদস্তি লফ্‌ট থেকে প্যাকিংবাক্স নামিয়ে খুলে ফেলেছিলো, আর চড়াই পাখিস বাসাগুলো ভেঙে সারা ঘরে ছড়িয়ে গেছিলো...বাচ্চা চড়াইগুলোর চিঁ চিঁ, আর বড়গুলোর সারা ঘরে উR্হে বেড়ানো...পুলিশ অবিশ্যি ক্ষমা-টমা চেয়ে সেই ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে যায়...

এখানেই চব্বিশ বছর - কুড়ি মিনিট হেঁটে বাসরাস্তায় পৌঁছে বাস ধরে ইস্কুলে যাওয়া, পরে সাইকেলে যাদবপুর...বাড়ি একতলা থেকে দোতলা হয়, আশেপাশের সব মাঠ নতুন নতুন বাড়িতে ভর্তি হয়ে যায়, নিশ্চুপ নিঃঝুম অরবিন্দ পার্ক অনেকটা নেতাজীনগরের চেহারা নিয়ে নেয়। পুকুরগুলো একটাও আর নেই, বাঁশবাগানও নেই, নতুন নতুন লোক - এখন সকলকে চিনিও না - সেই লক্ষ্মীপিসী কোথায় জানি না, বাপি রেলে কাটা পড়েছে, বুয়াইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই - ব্যস্ত হাউজিং এস্টেটের মতন অবস্থা যেখানে পাশের ফ্ল্যাটের লোককেও অনেকে চেনে না। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে কলকাতা হয়ে গেছে, পিন কোড ৭০০০৯৩।

বাসরাস্তাটা শুধু সেখানেই রয়ে গেছে।

No comments:

Post a Comment