Friday, May 11, 2012

শহর থেকে শহরে - ৯

আমি, আমরা আর সে (দিল্লী)
===============

জুলাইয়ের গরমে দিল্লী ফিরলাম। এসে উঠলাম সেই মন্টু সিং-এর বাড়িতেই। সেই বাড়িও অনেক বদলেছে তিন মাসে। আমাদের গোয়ালের কেউই আর নেই, কয়েকটা নতুন ছেলে উঠেছে, পড়তে এসেছে দিল্লীতে। ওখানে থেকেই বাড়ি খোঁজার পালা শুরু। রাজিন্দার নগরে ভাড়ার ফ্ল্যাট দরে পোষালো না। চিত্তরঞ্জন পার্কের কথা মনে হল - সেও নাগালের বাইরে। কালকাজীর ফ্ল্যাট, যেগুলো নাগালের মধ্যে, সেগুলো পছন্দ হল না। অবশেষে আরেক বন্ধুর মাধ্যমে মুনিরকা বাজারের পিছনে একটা ফ্ল্যাট পেলাম - চারতলায়, ছোট, কিন্তু চলে যায় - সবচেয়ে বড় কথা নাগালের মধ্যে। তারপর খাট, বিছানা, আলমারীর খোঁজে দিল্লী চক্কর কাটলাম - সেসব ব্যবস্থা করে ফ্ল্যাট যখন বাসযোগ্য হল তখন জুলাই শেষের মুখে। আগস্টের শুরুতে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে চলে গেলাম কলকাতা।

৯৮-এর আগস্টের কোনো এক দিন তল্পিতল্পা, লটবহর এবং আস্ত আরেকটা মানুষ - যার নাম সুমনা - তাকে সঙ্গে নিয়ে ফের দিল্লীতে পদার্পন। ট্যাক্সি নিয়ে সোজা মুনিরকার ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটের চেহারা দেখে তাঁর চক্ষুস্থির। আসলে যাওয়ার আগে তাড়াহুড়োয় ফ্ল্যাট পরিষ্কার করাতে পারিনি। এক পরিচিত পরিবারের কাছে চাবি দিয়ে এসেছিলাম - তারা বলেছিলো তাদের লোককে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে রাখবে - সে করায়নি আর। সুতরাং, নতুন সংসারে ঢুকেই দুজনের কাজ শুরু হল গোটা ফ্ল্যাট ঝেড়ে বালতি বালতি জল দিয়ে সে পরিষ্কার করা দিয়ে। অসাধারণ রোম্যান্টিক কোনো সন্দেহ নেই।

পরিষ্কার শেষে ভাবতে শুরু করলাম হাতের তিন দিনের ছুটিতে কোথায় যাওয়া যায় - রোম্যান্টিক কোনো জায়গা। সিমলা যাবো ভাবলাম। ওদিকে তখনো একটা প্রচন্ড জরুরী জিনিস কেনা হয়নি - একটা ফ্রীজ। সেটা কিনতে গেলে ভাঁড়ারে টান পড়ে, অথচ না কিনে উপায় নেই। পরের মাসে মাইনে পেতে আরো দিন দশেক। ফ্রীজ কেনার পর আমার ব্যাঙ্কে সাকুল্যে সাতশোটি টাকা। সেই টাকা, আর সুমনার আনা অল্প কিছুকে সম্বল করে রাতের বাসে সিমলা পৌঁছলাম। সিমলার সেই ছবিগুলোকে এখন উল্টে পাল্টে দেখি, আর ভাবি...কী ভাবি? থাক। বারো তেরো বছর পর সেই ভাবনাগুলো কমন ভাবনা;-)

দিন কাটতে লাগলো। অফিসে নতুন প্রোজেক্ট - সেই সময় গোটা কোম্পানিতে ওই টেকনোলজিতে প্রথম কাজ - মানে দিন রাত এক করে লেগে থাকতে হচ্ছে। সুমনা কয়েকদিন এদিক ওদিক ঘুরে নিজেও একটা চাকরি বাগিয়ে নিয়েছে। রোজ সকালে বেরোই দুজনে, সুমনা ফিরে আসে সাড়ে ছটা নাগাদ, আমার ফিরতে কোনোদিন দশটা, এগারোটা, কখনো কখনো আরো দেরী। রেগুলার রান্নাবান্নার পাট উঠেছে। একদিন রান্না করে দুই তিন দিন চালানো হয়, তারপর কোনো দোকান থেকে খাবার এনে। মুনিরকা বাজারে ছিলো পরাঠা পয়েন্ট - আলুর পরোটা, কপির পরোটা, মূলোর পরোটা তো আম ব্যাপার - আর কিসের পরোটা চান? টমেটো? ডিম? পনীর? সব পাওয়া যেত সেখানে।

মুনিরকায় দুটো সমস্যা ছিলো - এক তো লোডশেডিং। তায় যত না রেগুলার পাওয়ার কাট, তার চেয়ে বেশি লাইন চলে যাওয়া। তার কারণও ছিলো। গলিতে বেরিয়ে ওপরের দিকে তাকালে উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর ফাঁকে আকাশ দেখা যেত না। দেখা যেত তারের জঙ্গল। ল্যাম্পপোস্টগুলো দেখে মনে হত গাছ, ইলেক্ট্রিক তারের। তো সেখানে এর গায়ে ও লেগে লাইন যাবে সে আর আশ্চর্য কী? দ্বিতীয় সমস্যা - জল। স্টাও বেশিটা কারেন্ট না থাকার জন্যে। দিল্লীতে এমনিতেই জলকষ্ট - কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ করে বেশি। সেখানে কারেন্ট না থাকা মানে মাঝে মাঝে রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে একতলার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্যাঙ্ক থেকে বালতি করে চারতলায় জল তুলতে হত।

আরেকটা বড় সমস্যা এসে দাঁড়িয়েছিলো। নতুন এই প্রোজেক্টের কাজে আমাকে প্রায়ই কলোরাডো যেত হচ্ছিলো। আগস্টে কলকাতা থেকে ফিরে ডিসেম্বরে প্রথমবার। তিন মাসের মধ্যেই। অবস্থাটা ভাবুন। সেই বিরানব্বই সাল থেকে অপেক্ষা করে করে দুজনে এক ছাদের নীচে আসার তিনমাসের মধ্যেই কয়েক হাজার মাইল দূরে পাঠিয়ে দিলো অফিস থেকে। মাস তিনেক পরে ফিরলাম, আবার এক মাস পরেই যেতে হল। সেবার অবশ্য সুমনা কিছুদিনের জন্যে গেছিলো, কারণ আগেরবার আমি হাত ভেঙেছিলুম, তাই খেতে পাবো না বলে অফিস বউকে পাঠাতে রাজী হয়েছিলো। পুরো তিনমাস থাকেনি, কারণ নিজের চাকরি। কিন্তু এই ক্রমাগত যাওয়া-আসায় দুজনের ওপরই চাপ পড়ছিলো, বিশেষ করে মুনিরকার ওই ফ্ল্যাটে একা থাকতে অসুবিধাই হত।

বাড়ি পাল্টালাম। এবার ঠিকানা লাজপত নগর, অমর কলোনী। ততদিনে নিজেদের পাগুলো আরো একটু মজবুত হয়েছে বলে নাগালের বাইরে হাত বাড়ানোর সাহস হয়েছিলো। লাজপত নগরের বাড়িটা দেখেই খুব পছন্দ হল - বড় বড় ঘর, মার্বেলের মেঝে, একদম ওপরে নয় বলে ঠান্ডা থাকে। ভাড়া একটু বেশি বলে আর্জি জানালুম কম করার - ভদ্রলোক প্রথমে রাজী হচ্ছিলেন না। তারপর একবার ভিতর থেকে ঘুরে এসে রাজী হয়ে গেলেন। ওঁর স্ত্রীর নাকি আমাদের দুজনকে খুব পছন্দ হয়ে গেছে - উনি আমাদেরই দিতে চান, তাই একটু কমিয়ে ফেলতে অসুবিধা নেই। আমাদেরও ভালোই হল। এই আঙ্কল আর আন্টি পরেও আমাদের নিজেদের ছেলে-মেয়ের মত দেখতেন। এর পরেও আমি কলোরাডো গেছি - হয়তো মাস খানেক কি দু মাসের জন্য। আঙ্কল বা আন্টি কেউ না কেউ রোজ এসে সুমনার খোঁজ নিয়ে যেতেন - সে বাড়ি এসেছে কিনা, খেয়েছে কিনা...

অর্ণব - সর্দারজী বাড়িওয়ালার কথা বলছিলেন না? আমার দেখা একজন বাড়িওয়ালা এই আঙ্কল।

দিল্লী একটু রাফ - সন্দেহ নেই। এই আঙ্কল আর আন্টিও বাইরে থেকে হয়তো সেরকমই। কিন্তু কী করে ভুলি এঁদের? কী করে ভুলি - যে একদিন যখন জল আসেনি বলে বাড়িতে রান্না করারও জল ছিলো না তখন এঁরা দু তিনটে বালতি ভরে জল পাঠিয়ে দিয়েছেন আমাদের?

দিল্লী খুব একটা সেফ জায়গা নয় - মেয়েদের পক্ষে। কাগজে পড়ি। এখনো। নিজে যখন ছিলাম তখনো শুনেছি। লাজপত নগর থেকে দিল্লী আইআইটির দিকে যাওয়ার সময় ব্লু-লাইনে কেউ সুমনার কামিজের পিছনটা ফালি ফালি করে কেটে দিয়েছিলো। অথচ কী করে ভুলি সেই মধ্যবয়সী পাঞ্জাবী মহিলাকে যিনি নিজের ওড়না দিয়ে আড়াল করে ওকে অটোতে বসিয়ে দিয়েছিলেন যাতে ও বাড়ি ফিরে আসতে পারে?

এইভাবে কাটছিলো।

কখনো দিল্লীর অলিগলির গল্পগুলোকে খুঁজে বেরিয়ে - কুতব মিনারে, হুমায়ুনের সমাধিতে, পুরানা কিল্লায়...

কখনো দিল্লী থেকে বাইরের দিকে গিয়ে আগ্রা ফোর্ট বা ফতেপুর সিক্রিতে বা জয়পুরে...

কখনো দিল্লীর সিরি ফোর্টে রশিদ খাঁয়ের গানের সুরে...

বা প্রিয়া/পিভিআর-এ দেখা কোনো সিনেমায়...

বা পরাঠেওয়ালে গলিতে, দিল্লী হাটের মোমোয়, নাগপালের ছোলে-বটুরেতে...

তখনো আমার রাতে ফেরার কোনো ঠিক নেই। এগারোটা তো নর্মাল, কখনো দুটো-তিনটেও বাজে। একদিন সাড়ে তিনটে বেজে গেছিলো - পরের দিন সকালে আমাকে একজোড়া প্যান্ট-শার্ট ধরিয়ে দিয়ে বললো - আর বাড়ি আসতে হবে না, অফিসেই থাকো।

তখন ভাবতে হল - এভাবে তো চলবে না। হয় মাসের পর মাস বাইরে থাকি, আর যখন দিল্লীতে থাকি তখন দিনে ষোল ঘন্টা অফিসে। এর চেয়ে বাইরে যেখানে যেতে হয়, সেখানে গিয়ে থাকলেই তো হয়! আর সেখানে নিজের পড়াশোনাটাকেও যদি আরো একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়...অনেক বড় কোম্পানিই তো আছে যারা এই সুযোগটা দেয়। এইসব ভেবে খোঁজা শুরু...চাকরি একটা মিলেও গেলো ঠিক...বাকি ব্যবস্থা সেখানে পৌঁছে হবে ভেবে রাজী হয়ে গেলুম।

তারপর? প্রায় চার বছরে গেঁড়ে বসতে থাকা শিকড়টাকে উপড়ে ফেলার শুরু। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে, জিনিসপত্র যতটা সম্ভব বিক্রি করে (সুমনা পরে আমার মা'কে বলেছিলো - অরিজিৎ আমার সংসারটা ন হাজার টাকায় বিক্রি করে এসেছে), বাকি জিনিসের পোঁটলা বেঁধে একদিন আবার সেই রাজধানীতে চেপে কলকাতায় এসে নামলাম। অল্প কয়েকদিনের জন্যে। মেরিল্যান্ড যাওয়ার টিকিট/ভিসা সব রেডি।

ট্যাক্সিতে চড়ছি যখন, তখন আন্টি দরজার দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন।

No comments:

Post a Comment