কলকাতা শহরতলী - মাঝে কয়েক বছরের জন্যে শিবপুর, দিল্লী, হেলসিঙ্কি, কলোরাডো স্প্রিঙস, সিলভার স্প্রিঙ-গেথার্সবার্গ হয়ে নিউক্যাসল আপন টাইন - এই আমার পথ এখনো৷ পুরো বৃত্ত তৈরী হবে যেদিন আবার সেই কলকাতা শহরতলীতে ফিরে যাবো৷
যখন ছোট ছিলাম, তখন সেটা কলকাতা ছিলো না, পূর্ব পুটিয়ারী, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা৷ আবছা আবছা মনে পড়ে আশেপাশে নিজেদের বাড়িটা নিয়ে সাকুল্যে তিনটে বাড়ি - বাপিদের আর বুয়াইদের (এই দুজন আমার সেই বয়সের বন্ধু) - আর ধু ধু মাঠ, বাড়ি সামনে বাঁশবাগান, সেখানে সন্ধ্যে হলেই শেয়াল ডাকতো৷ সবচেয়ে কাছের বাসরাস্তা হেঁটে মিনিট কুড়ি৷ লোডশেডিং হলে একতলা বাড়িতে লন্ঠনের আলোয় বাবা, মা, ঠাকুমা, দিদি আর আমি বসে থাকতুম৷ প্রচুর পুকুর ছিলো, লক্ষ্মীপিসীরা একটু দূরে থাকতো, আমি দিনের বেলাটা প্রায়সই ওখানে থাকতুম, কারণ দাদু তখন পুরোপুরি বিছানায়, ঠাকুমা অসুস্থ, মা ঘর সামলে, দাদুকে সামলে আর আমাকে দেখে উঠতে পারতো না - লক্ষ্মীপিসী তাই আমাকে নিয়ে যেত৷ এই লক্ষ্মীপিসীই আমাকে সাঁতার শিখিয়েছিলো - তখন দু বছর বয়স মোটে ... আর যেদিন দাদু মারা গেলো, সেদিন আমাকে কোলে নিয়ে সাহাপাড়ার দিকে ঘুরতে চলে গিয়েছিলো, আমি বাড়ি ফিরে কেঁদেছিলাম - "দাদুকে কোথায় নিয়ে গেলো?"
সত্তরের দশকের অনেক গল্প শুনি - আবছা মনে আছে বাঁশবাগানের ওপারে দুম দুম আওয়াজ, আর একটু পরেই রক্ত মেখে এক জনের টলতে টলতে বাঁশবাগান থেকে বেরিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া৷ একদিন পুলিশ এসেছিলো বাড়িতে, সার্চ করতে - জবরদস্তি লফট থেকে প্যাকিংবাক্স নামিয়ে খুলে ফেলেছিলো, আর চড়াই পাখির বাসাগুলো ভেঙে সারা ঘরে ছড়িয়ে গেছিলো ... বাচ্চা চড়াইগুলোর চিঁচিঁ, আর বড়গুলোর সারা ঘরে উড়ে বেড়ানো ... পুলিশ অবিশ্যি ক্ষমা-টমা চেয়ে সেই ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে যায় ...
এখানেই চব্বিশ বছর - কুড়ি মিনিট হেঁটে বাসরাস্তায় পৌঁছে বাস ধরে ইস্কুলে যাওয়া, পরে সাইকেলে যাদবপুর ... বাড়ি একতলা থেকে দোতলা হয়, আশেপাশের সব মাঠ নতুন নতুন বাড়িতে ভর্তি হয়ে যায়, নিশ্চুপ নি:ঝুম অরবিন্দ পার্ক অনেকটা নেতাজীনগরের চেহারা নিয়ে নেয়, পুকুরগুলো আর নেই, বাঁশবাগানও নেই, নতুন নতুন লোক - এখন সকলকে চিনিও না - সেই লক্ষ্মীপিসী, বাপি, বুয়াইদের সঙ্গে যোগাযোগও আর নেই - ব্যস্ত হাউজিং এস্টেটের মতন অবস্থা যেখানে পাশের বাড়ির লোককেও অনেকে চেনে না - দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে কলকাতা হয়ে যায়, পিন কোড ৭০০০৯৩৷
বাসরাস্তাটা শুধু সেখানেই রয়ে গেছে৷
No comments:
Post a Comment