চিরকাল মা একটু আপত্তি করতো - বাসরাস্তা থেকে এত দূরে বাড়ি বলে৷ আমার কিন্তু কখনো খারাপ লাগেনি, বাসের আওয়াজ নেই, গাড়ির আওয়াজ নেই - গরমকালের দুপুরে বড়জোর কাঁধে বাক্স ঝুলিয়ে রঙিন বরফ বিক্রি-করা ফেরিওয়ালার ডাক - "আ-ই-স-কি-রি-ম"৷ রোজ সকালে উঠে দৌড়দৌড়ি শুরু হত, আটটার মধ্যে বেরোতে হবে, ইস্কুলের বাস আসবে সাড়ে আটটায় - মঙ্গলদার রিক্সা করে রাণীকুঠি যেতে হত৷ পথে রাণীকুঠির বাড়িটা - শোনা কথা ওটা পুঁটুরাণীর বাড়ি - পুঁটুরাণী মানে সাবর্ণ রায়চৌধুরির মেয়ে - আদিগঙ্গা-পারের বিস্তীর্ণ এলাকা সেই মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দেওয়া হয়েছিলো - তাই "পুঁটুরাণী" থেকে বদলাতে বদলাতে "পুঁটিয়ারী"৷ বাড়িটা দেখে মনে হত ভুতের বাড়ি - পরে বড় হয়ে একদিন আঁকার ইস্কুল থেকে ফেরার সময় আমি আর বাপি সাহস করে ঢুকে পড়লুম - পোড়ো বাড়ি, তাও একদম বসবাসহীন নয় - কেউ কেউ ঝুপড়ি বানিয়ে রাস্তার ধারে থাকতো, কেউ ঐ বাড়িতে - পোড়ো হলে কি হয়েছে, বাড়ি তো৷ তাদের পছন্দ হয়নি আচমকা দুটো উটকো ছোঁড়া ঢুকে পড়াতে ... বেরিয়ে এসে এদিক সেদিক ঘুরে আবিস্কার করলুম পুঁটুরাণীর পরে এই বাড়িটার মালিকানা ছিলো "ইস্ট ইন্ডিয়া স্টুডিও"-র - একটা শুকিয়ে যাওয়া ফোয়ারায় তাদের নাম লেখা ...
প্রাইমারী ইস্কুল শেষ করে সেকেণ্ডারী ইস্কুলের সময় বাস ধরতে যেতে হত নেতাজীনগর - আরেকটু কাছে - আর মঙ্গলদার রিক্সা নয় - এবার থেকে হেঁটে৷ ইস্কুল বাস মিস করলে ধ্যাদ্ধেড়ে ৪১/১ ভরসা - সোজা ইস্কুলের সামনে - আর নইলে অন্য বাস ধরে হাজরা মোড়ে নেমে হন্টন৷ ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন, একদিন গড়িয়াহাটের কাছে ইস্কুলের বাস জবাব দিলো - পকেটে পয়সা নেই, কিন্তু কয়েকজন বন্ধু মিলে টুপ করে একটা এস১৫-এ চড়ে বসলুম - কনডাকটরও বুঝেছিলো ইস্কুলের ছেলে (বাসটাও তো ওখানেই দাঁড়িয়ে, আর ইউনিফর্মটা ছিলো ইউনিক) - অন্য প্যাসেঞ্জারেরা চাঁদা করে আমাদের টিকিট কেটে দিলো৷ এখন কেউ দেবে? সন্দেহ আছে৷
এর পর থেকেই আমাকে প্রতি মাসের শুরুতে দুটো করে টাকা দিত মা, এরকম ব্যাপার হলে যাতে বাসভাড়াটা দিতে পারি৷ সেই টাকাগুলো জমাতুম - দুর্গাপূজোর সময়ও অল্প কিছু জমাতুম, কালিপূজোর বাজি না পুড়িয়ে মা'র কাছ থেকে গোটা দশ-পনেরো টাকা নিয়ে জমাতুম - এই করে করে আস্তে আস্তে একটা ক্রিকেট ব্যাট, একটা হকি স্টিক কিনেছিলুম ...
ঐ সিক্সেই যখন পড়ি, তখন একদিন দুপুরবেলা সেকেণ্ডারী সেকশনের প্রিফেক্ট এসে বললেন - ইস্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, খবর এলো ইন্দিরা গান্ধীকে গুলি করা হয়েছে৷ রাস্তাঘাট বন্ধ, বাস যাবে না, আর বাড়িতে ফোনও নেই যে ফোন করে বলবো ... আর বল্লেই বা কে এসে নিয়ে যাবে? অগত্যা আমি, বৌদি (কৌশিক সেন - বারো বছর বেচারিকে লোকে বৌদি বলে ডেকে গেছিলো) আর আসিফ হাঁটা দিলাম৷ কোন মোড়ে গিয়ে দেখছি বাস জ্বলছে, কোথাও ঝুপড়ি ... তার মধ্যেই টুকটুক করে প্রায় দেড় ঘন্টা হেঁটে বাড়ি - মা চমকে উঠলো - তখনো খবরই শোনেনি কেউ৷
দিদি ঐসময় বি ই কলেজে চলে গেছে, বাড়িটা ফাঁকা, মারামারি করার কেউ নেই৷ সপ্তাহের শেষে বাড়ি আসতো, নানা রকম গল্প হত - ঐসময় দিদি পড়ালো "ইস্পাত"৷ মাথা বিগরোনোর সেই শুরু৷ দিদি কলেজে নাটক করতো, গানের গ্রুপে ছিলো - আমি বাড়িতে বসে সেই গণসঙ্গীতগুলো শিখতুম৷ সল্টলেকে দ্বাদশ পার্টি কংগ্রেসে একটা একজিবিশন হল, দিদিরা মডেল দিলো - তখন কম্পিউটার নিয়ে বাওয়ালি চলছে - দিদিরা কোথায় কেন কম্পিউটারের প্রয়োজন হতে পারে সেই নিয়ে ডেমো দিত৷ একদিন ডেমোর সময় একজন ধুতি-পাঞ্জাবী পরা, ছোটখাটো কিন্তু টকটকে চেহারার ভদ্রলোক এলেন, মন দিয়ে শুনলেন, এবং প্রচুর প্রশংসা করলেন - টিভিতে মুখ দেখে খুবই চেনা - জ্যোতি বসু৷ ঐসময়েই মনে হয় মাথায় কোনভাবে ঢুকে গেছিলো কম্পু নিয়ে পড়তে হবে, আর বি ই কলেজেই যেতে হবে:-)
টেনে পড়ি যখন তখন দিদির বিয়ে হয়ে গেলো (ঐ প্রথম নিজে পছন্দ করে বিয়ে দেখার সৌভাগ্য - অবিশ্যি পরে জেনেছি আমার দুই মামাও একই পথের পথিক - তবে তাদের বিয়ের সময় আমি বড়ই ছোট), দিদিরা বণ্ডেল গেটের কাছে একটা বাড়ি ভাড়া নিলো - রাইফেল রেঞ্জ রোড সম্ভবত রাস্তাটার নাম ছিলো৷ একদিন দিদি ওদের বাড়ি আমাকে নেমন্তন্ন করলো, রান্না করে খাওয়াবে৷ দিদির রান্না বলতে এতদিন ছিলো শুধু ভাইফোঁটার দিনগুলো৷ সেদিন আমার খেলা ছিলো, খেলা শেষ করে আমি বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কোয়ালিটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি - দিদি বা বিমানদা এসে নিয়ে যাবে - কারো পাত্তা নেই৷ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি রাইফেল রেঞ্জ রোডের দিকে হাঁটা দিলুম ... খুঁজে খুঁজে রাস্তাটা বের করে বাড়ির সামনে অবধি গেলুম - কিন্তু ঐ বাড়িতে ঢোকার রাস্তাটা দেখতে পেলুম না - বোকার মতন, বাড়ির পাশের গলিটা খেয়ালই করিনি৷ আসলে টাইব্রেকে সেদিন হেরে গিয়ে মনটাও খারাপ ছিলো৷ ফের সেই কোয়ালিটির সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম, কাউকে না দেখে বাড়ি৷ রাত দশটার সময় বাড়ির সামনে একটা ট্যাক্সি এলো - দেখি দিদি আর বিমানদা৷ দিদি এসেই জিগ্গেস করলো "মিতুল ফিরেছে" - উত্তর শুনে ওখানেই (মানে গেটের সামনে) বসে পড়ে হাউহাউ করে কান্না - বেচারি সন্ধ্যে থেকে রাত্তির অবধি টেনশন করেছে ...
এই সেদিন বাড়ি গেলুম - সুমনাকে এই ঘটনাটা বলে বলেছিলুম যে দিদি যেই শুনবে আমরা এসেছি, তক্ষুণি আসবে৷ সুমনা বল্ল - এখন কি আর আসবে? এখন একটা মেয়ে আছে, ঘর-সংসার সামলানো আছে - ফোন করবে, পরের দিন আসবে ... এখনো কিন্তু আমার কথাটাই ঠিক হল - দিদি যেই শুনলো আমরা এসেছি, সঙ্গে সঙ্গে হাজির ...
হায়ার সেকেণ্ডারীও একই ইস্কুলে - শুধু ক্লাস শুরু হত সকাল সাতটায়, বাড়ি থেকে বেরোতুম ভোর সাড়ে পাঁচটায়৷ শীতকালে আকাশে চাঁদ থাকতো৷ পাঁচটা পঞ্চাশের ৪১/১ ধরলে সাড়ে ছটা নাগাদ ইস্কুলে পৌঁছতুম৷ বারোটা অবধি ইস্কুল৷ তখন প্রায়সই আমরা হেঁটে ফিরতুম ... মাঝে মাঝে সাইকেলে ইস্কুল যেতুম - বাবার তিরিশ বছরের পুরনো হারকিউলিস - চট করে অন্য কেউ চালাতে পারতো না৷ প্রথম মিছিলে হাঁটা এই সময়েই - সংহতি মিছিল - এখন মনে নেই কি ব্যাপারে ছিলো, তবে অত লোকের মিছিলে হাঁটার সেই শুরু - এসপ্ল্যানেড থেকে পার্ক সার্কাস ময়দান৷ গলা খুলে স্লোগান দেওয়ার শুরুও ওখানেই৷
তার পরের চারটে বছর সম্ভবত সেরা সময়৷ গানে-স্লোগানে-মিছিলে হু হু করে কেটে যাওয়া ...
ভাল করেছ এখানে তুলে।
ReplyDeleteপড়তে ভাল্লাগছে।
পারলে কমেন্টের সময় ওয়ার্ড ভেরিফিকেশন অপশন টা বাদ দিয়ে দিও তো!
বাদ তো দেওয়াই যায় - তবে স্প্যাম খেতে হবে। ওটা থাকলে স্প্যাম প্রোগ্রামগুলো আটকে যাবে।
ReplyDelete