Monday, October 02, 2006

আমার পুজো, ঋকের পুজো

গুরুচণ্ডা৯ থেকে একটা লেখা -

"শেষ কবে কলকাতার পুজো দেখেছি? বছর কুড়ি আগে বোধহয়৷ পুজো দেখার গপ্পো সকলে জানে, আর সকলের মতনই ছোটবেলায় কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, মণ্ডপে যাওয়া - পারোলিনের পুজোর সঙ্গে আমার ছোটবেলার পুজোর কোন তফাৎ প্রায় নেই-ই৷ আরো পরে পুজো আর টানতো না - ভিড়, শব্দ, আলো থেকে দূরে নিজের দশ ফুট বাই দশ ফুটের রাজ্যে একটা বই, বা বেহালা, বা টেপরেকর্ডার - এই নিয়ে সময় কাটতো৷ লাল চশমা পরা আমি পুজো থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করতুম৷ রাস্তায় যেতে-আসতে যেটুকু চোখে পড়ে সেটুকু ছাড়া বাকিটা পুজো না-দেখা বললেই চলে৷ তারপর শুরু যাযাবরের জীবন, এঘাট সেঘাটের জল খাওয়া, লাল চশমার ওপর বাস্তবের প্রলেপ পড়া - তখন পুজোর মানে পুজা-অর্চনা থেকে বদলে হয় নিছক আড্ডা - শুণ্য আর এক, এই দুটো সংখ্যার বাইরে একটা গেট-টুগেদার...

নিউক্যাসলে পুজো হয় - ফেনহ্যামে "হিন্দু মন্দিরে" - একদম দিনক্ষণ-তিথিনক্ষত্র মেনে, আয়োজক "নীবপা" - নর্থ ইস্ট অব ইংল্যাণ্ড বেঙ্গলি পুজা অ্যাসোসিয়েশন৷ বাক্স থেকে বের করে নতুন করে সাজানো মুর্তি নয়, প্রতি বছর কুমোরটুলি থেকে অর্ডার দিয়ে আনানো ছোট্ট মুর্তি৷ গোটা দিন শুণ্য আর এক ঘেঁটে সন্ধ্যেবেলা ফুলবাবুটি (মাইনাস ধুতি) সেজে সপরিবারে আমরা পুজো দেখতে যাই৷ লাল চশমা এখনও আছে, তাই পুজো থেকে একটু দূরে আমরা - আমি, সনাতনদা, জলদিন্দু, অংশুডাক্তার, আরো কয়েকজন৷ ফুলবিবিরাও থাকেন৷ আর কুচোকাঁচাগুলো এখানে সেখানে দৌড়ে বেড়ায়৷ আশেপাশে ইউনিভার্সিটিতে সদ্য ভর্তি হওয়া কিছু বাঙালী অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে, কারো বিলিতি বন্ধু ধুতি পরে, কারো বিলিতি বান্ধবী শাড়ি পরে৷ এরা বাস্তববাদি - প্রতি শনি-রবিবার নিয়ম করে মন্দিরে আসে, শুধু দুই দিনের ভক্তিরসে সিক্ত হয়ে - রান্নার মেহনতটা বেঁচে যায় আরকি৷ দোতলায় নবরাত্রির গরবা হয়, সেখানে প্রচুর ভিড় - ইউনিভারসিটি ছাত্র-ছাত্রীদের৷ সেই ভিড়ে চোখে-চোখে কিছু কথার খেলাও চলে - ইশারা খেটে গেলে টুক করে সটকে আশেপাশের কোন পাবে চলে যাওয়া৷ আলাদা ভিড় পাকাপাকি থেকে যাওয়া লোকেদের - অধিকাংশই ডাক্তার - তাঁদের কাছে আমাদের ওজন নেই, অন্য ডাক্তারদের ওজন থাকলেও সেটা বাড়ে কমে কত বছর ধরে এখানকার বাসিন্দা তার ওপর - সাময়িক হলে আমাদের মতনই ওজনহীন৷

দোতলা থেকে কেউ একটা ঢোল নিয়ে আসেন - আমরা তারস্বরে গান ধরি৷ ওদিকে "শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরী" চলে, এদিকে জন হেনরী, পল রোবসন থেকে আমায় ডুবাইলি রে৷ একজন দুজন ধার্মিক ওই পাকাপাকি থেকে যাওয়াদের ভীড় থেকে এদিকে একটু কটমট করে তাকালেও অঞ্জলির দিক থেকে ভিড় ক্রমশ পাতলা হয়ে এদিকে সরে আসে৷ "মনের কথা হয়না বলা, বলতে লাগে ভয়, গলায় দড়ি দিয়ে গিন্নী ডুবে মরতে কয়" শুনে বিবিরা খিলখিল করে হেসে ওঠে...সন্ধ্যে থেকে রাত হয়, অনভ্যাসে গলা ভাঙতে থাকে, ঢোল পিটিয়ে হাতে টান ধরতে থাকে, তবু চলে মেহফিল...আর অপেক্ষা...কয়েকজন নজর রাখেন খাবার ঘরের দিকে - টেবিলে বড় গামলাগুলো চড়লেই সেখানে লাইন লেগে যায়৷

এর পর একটা কোথাও বিজয়ার গেট টুগেদারের কথা প্ল্যান করে যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিই৷ রাতে ঘুমনোর সময় ঋককে দুর্গার গল্প বলি - গণেশ আর সিংহ তার সবচেয়ে প্রিয়৷ পরের দিন কতগুলো এক আর শুণ্য ঘাঁটতে হবে সে কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমনোর চেষ্টা করি৷

সুর্মা আমিন৷

কোথায় কাশফুলের রোমান্টিকতা? কোথায় ঢাকের বাজনা? দশমীর দধিকর্মা? লাইন দিয়ে মহম্মদ আলি পার্কের প্যাণ্ডেল দেখতে যাওয়া, বা কলেজ স্কোয়্যারের আলো? বিজয়গড় ভারতমাতার মাঠের অনুষ্ঠান? গড়িয়ায় নবদুর্গা দেখতে গিয়ে দশের মধ্যে দশটা বেলুন ফাটানো? মধ্যতিরিশেই নস্টালজিক আমি বিশ বছর আগের অরবিন্দ পার্কে ফিরে যাই - ঢাকে কাঠি পড়েছে, হাফ প্যান্ট পরে মিতুল দৌড়চ্ছে পুজো প্যাণ্ডেলের দিকে, কোমরে গোঁজা একটা ক্যাপ ফাটানোর রুপোলি পিস্তল, পকেটে রোল ক্যাপের দুটো প্যাকেট...কোথায় যাচ্ছিস, দাঁড়া, দাঁড়া...মিতুল ঘুরে দাঁড়িয়ে এক গাল হাসে, ওর মুখটা আস্তে আস্তে পাল্টায়...দেখি ঋক দাঁড়িয়ে আছে, স্যান্ডিফোর্ডে৷ এখানে সেই পিস্তলগুলো পাওয়া যায় না - ঢাকে কাঠি পড়ে না - সেই পুজোটাকে ঋক চেনেই না..."

গুরুচণ্ডা৯তে পুজো স্পেশ্যালের বাকি লেখাগুলো পাবেন এখানে

No comments:

Post a Comment