Thursday, April 23, 2009

ছাঁটা ফুলের আসন - দময়ন্তী

দমুকে বললাম দেখ নিজের জীবন থেকে একটা কিছু লিখতে হবে, যা কোনোদিন কাউকে বলা হয় নি ৷ দমু বলল লিখে ফেলো, সমস্যা কি? আমি বললাম না মানে --- না বলা কথা ৷ দমু বলল তাতেই বা সমস্যা কি? খুকীর গল্প লিখে দাও না ৷ ও গল্প তো কেউ জানে না ৷ আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোন খুকী? দমু বললঃ খুকীটা আমি-খুকী হতে পারে, তুমি-খুকী হতে পারে , অথবা সেই-খুকীও হতে পারে ৷ আসলে আমাদের এখানে তো আমি-খুকী, তুমি-খুকী বা সেই-খুকীর গল্পগুলো উল্টেপাল্টে এরটা তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেও খুব একটা ভুল হয় না ৷ কোথায়ও না কোথায়ও গিয়ে সব খুকীদের গল্পগুলৈ একইরকম হয়ে যায়৷ঠিকই তো ৷৷৷৷

মনে পড়ল, খুকী যখন ছোট্ট ছিল, তখন একটু ট্যালা ছিল ৷ মানে একটু হাবলিমত আর কি ৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷ খুকীর দিদা ভারী সুন্দর আসন সেলাই করতেন ৷ কিছু ছিল এমনি দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য, চটের ওপরে ক্রচেট সুতোয় ফুল লতাপাতা আঁকা ৷ আর কিছু ছিল তোলা-আসন ৷ এগুলো ছিল ছাঁটা ফুলের আসন ৷ ঐ চটের ওপরেই বোনা হত উল দিয়ে ৷ তারপর আবার সেই নকশার ওপর কাঁচি দিয়ে কেটে কেটে দেওয়া হত ৷ ফলে আসনের ওপরটা পুরো একটা গালিচার মত চেহারা নিত ৷ তাতে কিন্তু সেলাই আলগা হয়ে খুলে যেত না ৷ ঐ ক্রসস্টীচে বুনে তারপর ওপরটা ছেঁটে দিয়ে ফাইনাল নকশা ফোটানো হত ৷ সবটা শেষ হলে পেছনটা লাল টুকটুকে শালু দিয়ে মুড়ে দেওয়া হত ৷ খুকীর ভারী পছন্দ ছিল এই আসনগুলো ৷ ওকে কেউ ওতে বসতে দিত না বলেই ওর আরো বেশী বেশী পছন্দ ছিল ৷ ভাইফোঁটার দিনে মামারা সব, দাদাভাই আর খোকা বসত লাইন দিয়ে , প্রত্যেকে একেকটা আসনে ৷ মা, মাসিমনি, ছোটদি আর খুকী মাটিতে হাঁটুমুড়ে বসে ফোঁটা দিত ৷

আজ হল গিয়ে জ্যৈষ্ঠমাসের ষষ্ঠীপুজো ৷ কাগজে লেখে জামাইষষ্ঠী ৷ খুকীদের বাড়ী বলে অরণ্যষষ্ঠী ৷ আজকে মা, মামীরা, মাসিরা, দিদিরা, খুকীরাও আসনে বসে ষষ্ঠী নেবে ৷ মা, মাসিমনি, বড়মামা, বড়মামী, মেজমামা, মেজমামীকে ষষ্ঠী দেবে দিদা ৷ ছোটদি, দাদাভাই, খোকা, খুকীকে ষষ্ঠী দেবে মা, মাসিমনি, মামীরা ৷ খুকী মনে মনে ভারী খুশী হয় ৷ আজ তো আসনে বসার দিন ৷ আজকে ও-ও ঐ গালিচার মত নরম সুন্দর ঝলমলে রঙের আসনগুলোতে বসবে ৷ বেগুণী, গোলাপী, নীল দিয়ে নকশা করা যেটা, ঐটা নেবে খুকী বসতে ৷ খুকী ওটার দিকে এগোতেই দিদার ধমক - "আরে ধরিস না , ধরিস না -- ঐটা ছুঁইস না, ঐটায় বাচ্চু বইব' ৷ খুকী একটু মন খারাপ করে ৷ "ছোটমামা বসবে ওটায়, কেন বাবা আমি একদিন বসলে কি এমন অসুবিধে হত ছোটমামার! এইটাই তো সবচেয়ে সুন্দর' ৷ কিন্তু সুন্দর কিম্বা অসুন্দর কোন ছাঁটা ফুলের আসনেই ওকে বসতে দেওয়া হয় না ৷ ওদের জন্য আছে তো ক্রসস্টীচে নকশাকরা চটের আসন ৷ মা, মামীরা, মাসিমনি মাটিতেই বসে, খুকী আর দিদিরা কেউ কেউ ঐ চটের আসনে ৷খুকী ভাবে গালচের মত আসন মাত্র অল্প কয়েকটা তো, তাই ওদের বসতে দেওয়া হয় না ৷ দিদা তো আরো বানাচ্ছে ৷ সেগুলো শেষ হলেই এক এক করে ওরা বসতে পাবে ৷ দিদা বানিয়ে চলে আর বিড়বিড় করে "অহন আর ভাল দেহি না চক্ষে -- কতটি বাকী আসে অহনও ---- বাচ্চুর বিয়া আইতাসে -- অর লাইগ্যা একটা বানানি লাগব --- মুন্নিরও বিয়ার বয়স হইসে --- অর জামাইয়ের লাইগ্যাও একখান লাগব -- রাজার লাইগ্যা একটা বানানি লাগে ---- খোকাও বড় হইতাসে ------ ' দিদার বকবকানি চলতে থাকে ৷ খুকী শুনতে থাকে ---- শুনতেই থাকে ৷ না : ওর নাম উচ্চারিত হয় না --- এক আধবার অবশ্য ওর "বর' নামক এক অনির্দিষ্ট কারো কথা শোনা যায় ---- আবার "সে অনেক দেরী' বলে চাপা পড়ে যায় ৷

খুকী দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে --- শুনতে থাকে --- বুঝতে থাকে---- খুকী নেই ---- কোত্থাও নেই ----- ঐ সুন্দর রঙচঙে গালিচার মত দেখতে আসনগুলোর জীবনচক্রে খুকী নেই ৷ খুকীর ভেতরটা হঠাত খালি খালি লাগতে থাকে ৷ ঠিক মন খারাপ নয় কিন্তু ৷ দুঃখ, রাগ ষষ্ঠীর দিন যেমন হয়েছিল, সেসব কিচ্ছু নয় ৷ শুদ্ধু ফাঁকা লাগে ৷

খুকী আর খোকা খেতে বসেছে ৷ দিদার সঙ্গে বড়মামী আসে একটা ছোট্ট খুরিতে দই আর চামচ নিয়ে ৷ দাঁড়িয়ে থাকে ৷ মা খোকাকে খাইয়ে দিচ্ছে ৷ খোকার ভারী বায়না, মাছ খেতে চায় না কিছুতে ৷ মা ভুলিয়েভালিয়ে খাওয়াচ্ছে ৷ খুকী এমনিতেই চটপট খায় ৷ শেষ করে থালাটা হাত দিয়ে চেটে পরিস্কার করে বড়মামীর দিকে তাকায় ৷ কিন্তু বড়মামী তো ওর দিকে তাকাচ্ছেই না ৷ খুকী তাই বলে "হ্যাঁ এইবারে দাও' ৷ বড়মামীমা হঠাতই কিরকম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ৷ মা বলে "আরে ওটা তোর জন্য নয়' ৷ খুকী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে ওঠে "আমি তো দই খুব ভালোবাসি' ৷ বড়মামীমা অপ্রস্তুতভাবেই "আচ্ছা আচ্ছা' বলে ওর পাতে 1 চামচ দই তুলে দেয় ৷ মা খোকার পাতের পাশে জায়গা করে বলে "তুই আর কতক্ষণ দাঁড়াবি বৌদি! এইখানে দিয়া যা গা '৷ বড়মামী বাকী সমস্ত দইটা খোকার পাতে দিয়ে বাড়ী চলে যায় ৷ পাশাপাশিই বাড়ী ওদের ৷ দিদা কটমট করে খুকীর দিকে তাকিয়ে বলে "এত লোভ কেন তোর?"

খুকী অবাক হয়ে যায় --- ভীষণ অবাক হয়, "অপমানবোধ' নামক অনুভুতিটার সাথে তখনও চেনাজানা হয় নি, তাই বুঝতে পারেনা এরকম লাগছে কেন? কিরকম যেন একটা লাগে ৷৷৷৷৷৷ কানগাল সব গরম, হাত পা ছুঁড়তে ইচ্ছে করছে আবার হাতপা নাড়াতে ইচ্ছে করছে না ৷ এক্ষুণি এখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে, অথচ উঠে গিয়ে আঁচাতেও ইচ্ছে করছে না ৷ খুকীর ভিতরটা হঠাত্ই আবার খালি হয়ে যায় ৷ ফাঁকা হয়ে যায় ৷

খুকী বড় হতে থাকে আর খুকীর পিঠে একটা ডানা গজিয়ে যায় পাতলা ফিনফিনে জলরঙের ডানা, তাতে সোনালী রুপোলি ফুল ------ খুকী একদিন মস্তবড় হয়ে যায় ---- বড় হয়ে ডানা মেলে উড়ে যায় ৷ "সে' চলতে থাকে ------ চলতেই থাকে ---- পথ শেষ হয় না --- ঠ্যাঙাড়ে হীরুরায়ের বটতলা পেরিয়ে, সোনাডাঙার মাঠ ছাড়িয়ে যে রাস্তাটা চলে এসেছিল -- সে রাস্তার তো শেষ নেই -- শেষ থাকতে নেই তার --- আমি-খুকী, তুমি-খুকী , সেই-খুকীরা সেই পথ ধরেই চলতে থাকে, যতদিন না তাদের একজোড়া ফিনফিনে পাতলা ডানা গজায় ৷ খুকীরা জানে, নিজেনিজেই জেনে যায়, যে জায়গা ছেড়ে আসা যায়, সেখানে আর কখনও, কক্ষণো "ফেরা' যায় না ৷ সেখানে আবার যাওয়া যায়, কিন্তু "ফেরা' যায় না ৷

ছাদে ইজিচেয়ারে কফি আর বই নিয়ে আয়েস করে বসে সামনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে ---- সেই-খুকী কোনোদিনই আর ছাঁটা ফুলের আসনে বসে নি, কি এক প্রবল অনীহায় এই আসনবোনার বিশেষ পদ্ধতিটা শেখার চেষ্টাও করে নি ৷ কোন দুঃখও নেই তার জন্য ৷ খোকার জন্য বানানো আসনটা আছে মায়ের কাছে, ভাইফোঁটার দিন ভাইয়ের জন্য পেতে দেয় মা ৷ একদিন সেটার ছবি তুলে অর্কুটে লাগালো, এক বন্ধু একেবারে মুগ্ধ ; জানতে চায় আসনবোনার পদ্ধতি ৷ সেই-খুকী চীত্কার করতে চায় "জানিনা , জানিনা , জানিনা, জানতে চাইও না' , বলা যায় না ৷ ভদ্রভাবে বলে "জানি না' ৷ বন্ধু খুব দুঃখ করে আগেকার এইসব শিল্পসৃষ্টি সব হারিয়ে যাচ্ছে বলে ৷ সেই-খুকী হাসে ৷ এখন ও জানে, টের পায়, ওকে আসনে বসতে দেয় নি যে, সে নিজেও কোনোদিন বসে নি নিজের সৃষ্ট ঐ রূপকথার টুকরোগুলোয় ৷ অল্প অল্প হাসি পায় ---- আসনের চেয়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকতে আরাম অনেক বেশী ৷ করুণা হয়, মায়া হয় দিদার জন্য ৷ তাও কোথায় যেন একটা তেতো স্বাদও লেগে থাকে --- বলা হয়নি ---- "তুমি জানতেই পারনি, টেরও পাও নি, কত্তদিন আগে ঐ ছোট্ট লোভগুলো টুপ টুপ করে মরে গেছে, সাথে নিয়ে গেছে তোমার জন্য রাখা ভালবাসাটুকুও' ৷

* লেখাটি সচলায়তন ডট কম প্রকাশিত "কাঠগড়ায় গল্প' নামক ন- বুক-এ ছাপা হয়েছিল৷ আর পাওয়া যাবে গুরুচণ্ডা৯তে

No comments:

Post a Comment