ব্রিটিশরা চেরাপুঞ্জির নাম দিয়েছিলো "স্কটল্যান্ড অব দ্য ইস্ট'। কেন দিয়েছিলো সেটা বুঝতে চেরাপুঞ্জি না গিয়ে উপায় নেই। বেশিরভাগ লোকে শিলং যায়, আর এক দিনের জন্যে চেরাপুঞ্জি (সোহরা) টাউন অবধি গিয়ে আশেপাশে কয়েকটা জলপ্রপাত দেখে ফিরে চলে আসে। ওভাবে নয়। চেরাপুঞ্জিতে থাকতে হবে - দুদিন, কিংবা পারলে আরো বেশি। পাহাড়ের গায়ে সরু রাস্তা ধরে হেঁটে বেড়াতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে মেঘের মধ্যে হারিয়ে যেতে হবে। বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। বৃষ্টি থামার পর ফার্নের পাতা থেকে ঝরে পড়া জলের ফোঁটার দিকে তাকাতে হবে। তবে চেরাপুঞ্জি দেখা যায়। নইলে শুধু ঘোরাই হয়, দেখা হয় না।
৩/৬/২০১০
=======
রাতদুপুরে ঘুম থেকে উঠে তৈরী হয়ে বেরনোটাই যা কষ্টের। চারটের সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে এয়ারপোর্ট, তাপ্পর প্লেনে গৌহাটি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় আটটা। গৌহাটি থেকে ট্যাক্সিতে শিলং। মাঝে রাস্তা তৈরী হচ্ছে বলে জোরাবাট (আসাম-মেঘালয় বর্ডারে) অবধি প্রচণ্ড জ্যাম। সেখান থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে ৪০, শিলং ছাড়িয়ে আরো দূর অবধি গেছে। এই রাস্তাটা সুন্দর, প্রথম দিকে দুপাশে অসংখ্য সুপারি গাছ (গুয়া থেকে গুয়াহাটি), ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়। শিলঙের ঠিক আগে বড়াপানি - এক্ষুণি জল নেই খুব বেশি, তবে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখা যায়। শিলং পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় একটা, তারপর সেখান থেকে আরেকটা ট্যাক্সি নিয়ে চেরাপুঞ্জির দিকে রওনা দিলুম।
শিলং থেকে চেরাপুঞ্জির রাস্তার তুলনা একমাত্র হাইল্যান্ডসের সাথে করতে পারি। দুপাশে ফাঁকা উঁচুনীচু জমি, পাহাড়, মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝরনা, আর একদম সবুজ। মাঝে মাঝেই পাহাড়ের গা বেয়ে ছোট ছোট ঝরনা নেমে এসেছে জলপ্রপাত হয়ে। একটা ছোট ব্রীজ (চেরাপুঞ্জির কোনো এক রাজার নামে) পেরনোর পরেই চোখ আটকায় রাস্তার বাঁদিকে বহুদূর অবধি গড়িয়ে যাওয়া Dympep ভ্যালী। রাস্তা থেকে অনেক নীচে মেঘ, মাঝে মাঝে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে আসছে। এই ডিম্পেপ ভ্যালী আর গ্রীন ক্যানিয়ন পেরনোর পরেই চেরাপুঞ্জি টাউন।
আমরা যাচ্ছিলাম আরো পনেরো কিলোমিটার এগিয়ে LaitkynSiew গ্রামে চেরাপুঞ্জি হলিডে রিসর্টে। সরু পাহাড়ি রাস্তা, একপাশে বেশ গভীর খাদ, অন্যপাশে পাহাড়-জঙ্গল-ঝরনা, আর প্র্যাক্টিক্যালি নো-ম্যান্স ল্যাণ্ড। সোহ্রা টাউন পেরনোর পর এই পথে আর লোক দেখা যায় না রিসর্টে পৌঁছনোর আগে অবধি। আর রিসর্ট? ভারতের শেষ পাহাড়ের মাথায়, ইন দ্য মিড্ল অব নো-হোয়্যার মেঘের মধ্যে একটা ছোট বাড়ি। সামনেই গভীর উপত্যকা, আরো ঢেউ খেলানো পাহাড়, উল্টোদিকে পাহাড়ের নীচেই বাংলাদেশ - সিলেট। তখন সদ্য এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে - পথের ধারে ফার্নের পাতাগুলো থেকে টুপ্টাপ্ করে জলের ফোঁটা পড়ছে, একটা ছোট সেমেটারিতে কয়েকটা বট্লব্রাশ ফুল ফুটে রয়েছে, আর গ্রামের রাস্তার এক পাশ দিয়ে ছোট্ট একটা নদীর মত জল বইছে।
৪/৬/২০১০
======
ভোর পাঁচটায় অ্যালার্ম দিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম - যদি সূর্য দেখা যায়। দেখা গেলো না। চারদিকে শুধুই মেঘ আর মেঘ। অন্য কোনো জায়গা (যেমন লোলেগাঁও বা রিষপ) হলে এতে রাগ হত - এখানে হল না। কারণ মেঘ আর বৃষ্টির খোঁজেই তো আসা। সাড়ে পাঁচটা থেকে বৃষ্টি নামলো। ছটা নাগাদ সবাইকে ঘুম থেকে তুলে বর্ষাতি চাপিয়ে বেরনো হল বৃষ্টি দেখতে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা, দুপাশে ছোট ছোট বাড়ি, অল্প কিছু লোকজন, তার মধ্যে দিয়ে বর্ষাতি চাপিয়ে চারমূর্তি। রাস্তার ওপর দিয়ে জল বইছে - ঋক নাম দিলো "ছোটাপানি' - ঋক আর ঋতি দুজনে মিলে জলের ওপর ছপাত্ ছপাত্ করে লাফ। কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে এলুম - সবার জুতো-মোজা ভিজে একসা - যদিও অ্যাপারেন্টলি সব ওয়াটারপ্রুফ জুতো। এবার চিন্তা হল এর পরের ঘোরাগুলো কি করে হবে ...
রিসর্টের মালিক ডেভিড (একজন তামিল ভদ্রলোক, ওখানেই সেট্ল করেছেন, রিসর্ট চালান, আর ঐ রিসর্টের ফলে ঐ এলাকার তিন-চারটে গ্রামের ইকনমি চলে) বল্লেন বারোটা নাগাদ বৃষ্টি ধরে যাবে। ঠিক হল দুপুরে লাঞ্চ সেরে আমরা কাছের লিভিং রুট ব্রীজটা দেখতে যাবো। রিসর্ট থেকে আড়াই কিলোমিটার মতন, ঘন্টা চারেক লাগে ঘুরে আসতে। একটা নাগাদ বেরোলাম, কিছুদূর গিয়েই গ্রামগুলো ছাড়িয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে নামা শুরু। দুপাশে জঙ্গল, মাঝখান দিয়ে সরু খাড়াই পাথুরে সিঁড়ি, বেশ অসমান, আর শ্যাওলায় ঢাকা। সদ্য বৃষ্টি হওয়ায় আরো পিছল। অল্প যেতেই জুতো পিছলে যেতে শুরু করলো - সিঁড়িগুলো সরু বলে পুরো পা-টা রাখা যাচ্ছে না, আর উডল্যান্ডস যাই বলুক না কেন, ওদের ওয়াকিং জুতোগুলো মোটেও all-terrain নয়। বেশ কয়েকবার পা পিছলে গেলো, ওদিকে অত খাড়াই সিঁড়ি নামতেও কষ্ট হচ্ছে - হাঁটুর প্রবলেমের জন্যে। ডাক্তারের ভয় দেখানোতে কনফিডেন্স লেভেলটাও হয়তো একটু কম ছিলো - বার দুই আছাড় খেলুম। ভাগ্য ভালো সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে যাই নি, তাহলে ওখানেই ফেলে আসতে হত। শুরুর দিকে অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছিলো বলে গায়ে বর্ষাতি ছিলো - কিন্তু তাতে আরো অসুবিধাই হচ্ছিলো। সেগুলো গা থেকে নামিয়ে দেখি ঘামে জামা জুব্জুবে ভিজে। বর্ষাতি সব রুকস্যাকে ভরে হাঁটতে গিয়ে দেখা গেলো প্রতি পদে পা পিছলোচ্ছে। শেষে জুতূ খুলে রুকস্যাকের সাথে খুলিয়ে নিলুম। শুধু মোজা পরে চলা অনেক সোজা, যদিও পায়ের তলায় খোঁচা লাগা শুরু হল। ওদিকে ঋক হালকা বলে কি না কে জানে, বা জুতো ফ্লেক্সিবল বলে কি না কে জানে, টপাটপ নামছে, ঋতি গাইড ছেলেটির কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে, অসুবিধা শুধু আমাদের দুজনেরই। দুজনেই আল্টিমেটলি জুতো খুলে নামতে শুরু করলুম। নামছি তো নামছিই, পা আর টানছে না ... আলো কম, মেঘের মধ্যে চারদিক আবছা দেখেছি। শেষমেষ প্রায় আড়াই হাজার সিঁড়ি টপকে ব্রীজ অবধি পৌঁছনো গেলো। মানে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর ওপরতলা থেকে নীচে নামা হল আর কি। আরো একটু বেশিই হয়তো হবে - কারণ এখানে ধাপগুলো বেশ উঁচুই ছিলো।
লিভিং রুট ব্রীজটা সত্যিই অসাধারণ। আরো অসাধারণ ওর নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট ঝরনাটা। খানিকক্ষণ সেখানে বসে ফের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডি-ংএর ওপরতলায় ফিরে যাওয়ার শুরু। কিভাবে ওপরে উঠেছি জানি না, মাঝে মাঝে বুঝতে পারছিলাম যে হাঁটু টাল খাচ্ছে, নিজের ওজন, প্লাস ভারী রুকস্যাক, মেঘ, ভেজা শ্যাওলায় ঢাকা খাড়া সিঁড়ি, খালি পা - খতরনাক কম্বিনেশন হয়ে গেছিলো। কিন্তু এক্সপিরিয়েন্সটা মনে থাকার মত - দৃশ্য, আবহাওয়া, পরিবেশ - সব মিলিয়ে এ জিনিস আগে দেখিনি।
আফটার এফেক্ট - সিঁড়ি-আতঙ্ক। দু দিন পর এখনো হাঁটুর ওপরদিকটা ধরে আছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে awkward লাগছে। কিন্তু জায়গাটা এমনই হয়তো আবার চলে যাবো একদিন।
৫/৬/২০১০
======
সকালে ঘুম থেকে উঠেই টের পেলুম পায়ের কি অবস্থা। কাজেই ভোরের হাঁটাটা বাদ গেলো। এদিন আবার চেরাপুঞ্জি থেকে শিলং ফেরার দিন। রিসর্ট থেকে একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা হল যেটা চেরাপুঞ্জির আশেপাশের সাইট-সিয়িং করিয়ে শিল-ংএ পৌঁছে দিয়ে আসবে। ব্রেকফাস্ট সেরে দেখি বৃষ্টি নেমে গেছে। ভয় হচ্ছিলো হয়তো কোথাঐ কিছু দেখতে পাবো না। দশটা নাগাদ বৃষ্টি একটু কমলো, আর আমরাও দুগ্গা বলে বেরিয়ে পড়লুম।
এই প্রসঙ্গে রিসর্টটা নিয়ে একটু বলে রাখি। ফ্যামিলি-ওনড রিসর্ট। ভদ্রলোক, ওঁর স্ত্রী আর মেয়ে - এই তিনজন দেখাশোনা করেন। আশেপাশের গ্রামের কয়েকটি মেয়ে কাজ করে - রান্নাবান্না, ঘরদোর পরিষ্কার ইত্যাদির। ঐ সব গ্রামেরই কিছু ছেলে গাইডের কাজ করে। যে ছেলেটি আমাদের লিভিং রুট ব্রীজে নিয়ে গেছিলো সে ক্লাস টেন-এ পড়ে। পড়ার ফাঁকে গাইডের কাজ করে। ঐ রিসর্ট থেকেই যা কাজ পাওয়া যায় আর কি। ওটা ছাড়া আর কোনো থাকার জায়গা নেই ঐ অঞ্চলে (মানে সোহ্রা টাউন ছাড়িয়ে ওদিকে গেলে)। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা গ্রামেরই কিছু ছেলে রিসর্টে এসে গানবাজনা করে - খাসি গান, কখনো ইংরিজী/হিন্দিও - এ থেকেও ওদের কিছু আয় হয়। ডেভিড চেরাপুঞ্জির ট্যুরিজম প্রোমোট করার জন্যে অনেক কিছু করছেন - মেঘালয় সরকারের সাথে। ইনফ্যাক্ট, উনি ওখানে ঐ রিসর্টটা চালু করার পরই লোকজন যাচ্ছে ওদিকে। নয়তো সবাই শিলং থেকে এক বেলার জন্যে আসতো। যেটা সবচেয়ে ভালো লাগে সেটা হল একটা পার্সোনাল টাচ্ - যেটার কথা চৌরঙ্গীতে মার্কো সম্ভবত: বলেছিলেন। প্রত্যেকের খাওয়ার সময় খোঁজ নেওয়া, এমনি সময়ে এসে কিছুক্ষণ গল্প করা, যাওয়ার সময় প্রত্যেকের সাথে আলাদা করে কথা বলা ... হোটেলগুলোতে সাধারণত: এসব আর দেখা যায় না। খাওয়াদাওয়ার খরচ হয়তো একটু বেশি - কিন্তু ঐ অঞ্চলে (ইন দ্য মিড্ল অব নো-হোয়্যার) খুব কম হওয়ার কথাও নয় মনে হয়।
যাই হোক - ট্যাক্সিতে আশেপাশের ভিউপয়েন্টগুলো ঘুরলাম। জলপ্রপাত, পাহাড়, পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে নীচের সিলেট, ফুল - আর সর্বক্ষণের সঙ্গী মেঘ। কিন্তু অদ্ভুতভাবে একটা ভিউপয়েন্টও মিস্ হয়নি - যেখানেই গেছি শুরুতে হয়তো মেঘ আর বৃষ্টি পেয়েছি - মিনিট দশেক পরেই যেন শুধু আমাদের জন্যেই আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। রাস্তা খারাপ বলে শুধু Dainthlen falls -এ যেতে পারিনি - বাদবাকি সবই ঘুরেছি। একমাত্র Nohkalikai falls -এ গিয়ে মনে হচ্ছিলো কিছু দেখাই যাবে না - শুধু আওয়াজ শুনেই ফেরত যেতে হবে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে যখন ফিরে গাড়ির দিকে আসছি, টিকিট কাউন্টারের মেয়েটি চেঁচিয়ে ডাকলো - দৌড়ে গিয়ে দেখি আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে - মিনিট দুয়েকের মধ্যে প্রপাতটা দেখা যেতে শুরু করলো। তারপর একদম পরিষ্কার। কিন্তু মিনিট দশেকের জন্যে। দেখা আর ছবি তোলা শেষ করে ট্যাক্সিতে উঠছি - আবার পুরো মেঘে ঢেকে গেলো চারদিক।
এর পর সোজা শিল-ংএর রাস্তায়। এবার আর Dympep valley -র কিছু দেখা গেলো না, শুধু মেঘ আর মেঘ। পাহাড়ের দিকের ছোট ঝরনাগুলো অবশ্য আরো সুন্দর লাগছিলো। শিলং পৌঁছনোর আগে এলিফ্যান্ট ফল্সটাও দেখে নিলুম। তাপ্পর সোজা পাইনউড হোটেল। হোটেলটা এমনিতে বেশ সুন্দর দেখতে, অনেক পুরনো - ব্রিটিশ আমলের। পুলিশবাজারের পাশেই, অথচ হল্লাগুল্লা নেই। কিন্তু এত সুন্দর একটা হোটেল শুধুমাত্র দেখাশোনার অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘরগুলো ভাঙা ভাঙা, অপরিষ্কার, ইলেক্টিকের তার বেরিয়ে রয়েছে, রিসেপশনের লোকজনকে দেখে মনে হচ্ছে কেন এখানে বসে আছে সে জানেই না ... তবে খাবারটা বেশ ভালো। পা তখনো পাশবালিশ হয়ে ছিলো বলে বাইরে খেতে যেতে সাহস হয়নি।
৬/৬/২০১০
=======
বিশেষ কিছু লেখার নেই। সকালে হোটেল থেকে চেক-আউট করে গেলাম শিলং পীক। খুব আহামরি কিছু লাগলো না - কমন দৃশ্য। বীডন আর বিশপ ফল্স দেখলাম - মোটামুটি। হাতে সময় থাকলে ডন বস্কো মিউজিয়ামটা দেখতাম, কিন্তু সময় ছিলো না। তাপ্পর সোজা গৌহাটি এয়ারপোর্ট। বাড়ি ফেরা রাত্তির প্রায় এগারোটার সময় ...
পিকাসাতে চেরাপুঞ্জি
এই পোস্টটা পড়া গেলো না। ei bloge arO kichhu kichhu poRa zaachchhe na. Help Please
ReplyDelete