Friday, May 11, 2012

শহর থেকে শহরে - ৩

কলেজ জীবন, বিশেষ করে বি ই কলেজ জীবন নিয়ে লিখতে গেলে সেটা একটা মহাভারত ইন ইটসেল্ফ। মিশনারী বয়েজ ইস্কুলের গুডি গুডি বয় কী করে বি ই কলেজের (অনেকের মনে) "টেরর" হয়ে উঠলো, আর মেয়ে দেখলে দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদ-সুজ্জির দিকে তাকানো পাবলিক কী করে ফার্স্ট ইয়ারেই লট্‌কে গেলো। পরে কখনো লিখবো। তার আগে, কলকাতা থেকে বেরোই - প্রথমবার, একা একটা অন্য শহরে - দিল্লী।

হিন্দুস্তাঁ কা দিল্‌ হ্যায় ইয়ে দিল্লী
================

বি ই কলেজের ফোর্থ ইয়ারে চাকরি জুটে গেলো, পোস্টিং দিল্লী। আবার এদিকে যাদবপুরে মাস্টার্স করার সুযোগও জুটে গেলো। মরতে দিল্লী কেন যাবো ভেবে যাদবপুরেই ঢুকে গেলাম। গেরোর ফের - সেখানেও যে চাকরিটা জুটলো (সেই একই কোম্পানি, ওই সময়েই মোটামুটি লরি নিয়ে কলেজে এসে ছেলেপুলে নিয়ে যাওয়া শুরু) সেও সেই দিল্লী। বউ (তখনও আন-অফিসিয়ালি) চাট্টি সেন্টু দিলো - এঁকলা ফেঁলে রেঁখে দিঁল্লী যাঁচ্ছো; তাকে বোঝালুম- ওরে পাগলী, দিল্লী না গেলে বে-টা করবো কী করে?

সাতানব্বই সালের এপ্রিলের কোনো একটা শুক্রবার যাদবপুরের মাস্টার্স ক্লাসের তিনজন বন্ধু চড়ে পড়লুম রাজধানী এক্সপ্রেসে। সঙ্গে একটা সুটকেস আর একটা ঢোল (ব্যাগ)। বাকি দুজন হিসেবী, আগে থেকে বাড়ির বন্দোবস্ত করে যাচ্ছে, এবং অন্য চাকরির ব্যবস্থাও রয়েছে - এই চাকরি যদি পছন্দ না হয়। দিল্লীতে আমার চেনা কেউ নেই, শুধু বড়মামার পরিচিতিতে অশোক রোডের কাছে কোথাও সি আই টি ইউ-এর একটি অফিসে যেতে হবে এইটুকু জানি। তারপর কী হবে, কোথায় থাকবো, কী খাবো - সেখানে গিয়ে দেখা যাবে। আর হ্যাঁ - মায়ের ছোটকাকার খুড়শ্বশুরের ভাইয়ের (মানে সেরকমই কাছের আর কী) কারো একটা বাড়ি আছে পশ্চিম দিল্লীর কোথাও, তাঁর সাথে দেখা করলে হয়তো একটা ব্যবস্থা হতেও পারে। টেনশন - আছে, সঙ্গে সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় যাওয়ার উত্তেজনাও। হোস্টেলে থাকার অভ্যাসে বাড়ি থেকে দূরে যাওয়া নিয়ে ততটা কষ্ট নেই, তবে অন্য কষ্টটা আছে - ট্রেন ছাড়ার সময়ে মেয়েটার মুখটা সেই যে পিছু নিলো, আর ছাড়তেই চায় না।

দিল্লীতে আস্তানা খুঁজে বের করা একটা আস্ত গল্প। সেও ব্যবস্থা হল। কিন্তু সেই দিন, রাতে একটা হোটেলে খেয়ে ঘরে ফেরার সময় প্রথমবার মনে হল - এত বড় শহরটাতে আমি সম্পূর্ণ একা। আমি কাউকে চিনি না। এখানে আমার খোঁজ করার কেউ নেই। অথচ, দু হাজার সালে যখন দিল্লী ছাড়ি, তখন গলার কাছে একটা দলা পাকিয়ে উঠেছিলো। মাত্র সাড়ে তিন বছরেই। হয়তো দিল্লীর প্রতিটা রাস্তায় ছড়ানো ইতিহাস, হয়তো দিল্লীর খাবারদাবার, হয়তো দিল্লীতে বসানো প্রথম সংসার, হয়তো সবকিছু মিশিয়ে তৈরী হওয়া একটা অনুভূতি। তবে সবচেয়ে বেশি যেটা মনে থেকে গেছে সেটা হল প্রতিটা বাক্যের শুরু এবং শেষে খিস্তি আওড়ানো তথাকথিত কাঠখোট্টা এবং "ঘুটনোপে অকল্‌ওয়ালা" জাঠ আর সর্দারজীদের বন্ধুত্ব। বাসে ট্রামে সবাই আপনার সাথে ওই ভাষাতেই কথা বলবে - প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে আপনাকেও ওই ভাষাতেই উত্তর দিতে হবে - আঁতেল বাঙালীর কাছে কালচারাল শক্‌বিশেষ। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখতে পাবেন যে ওরা আপনার জন্যে জান কবুল করবে। "দোস্তি" ওদের কাছে ঈশ্বরের সমান, বা হয়তো তার চেয়েও বড়।

দিল্‌ওয়ালোঁ কা শহর হ্যায় ইয়ে দিল্লী। এর গল্পই বলবো।

No comments:

Post a Comment