Friday, May 11, 2012

শহর থেকে শহরে - ৭

দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়লাম - দিল্লীর। যে দিল্লীকে চিনেছিলাম অন্যের চোখ দিয়ে, সেই দিল্লী তার সমস্ত রহস্য নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ততদিনে। একদিকে দিল্লীর অলিতে গলিতে ছড়ানো আগের সাতটা দিল্লীর গল্প, অন্যদিকে আস্তে আস্তে পরিচয় হতে থাকা দিল্লীর লোকজন, আর তার সাথে নাহারি - পায়া - তাওয়া চিকেন - বাটার চিকেনের দিল্লী। পাশাপাশি, স্ট্যান্ডার্ডে গেলে ইতিউতি ব্লাডি মেরি বা স্ক্রু ড্রাইভারের সাথে চিকেন স্ট্রোগানফ। রসিকজনের দিল্লী।

এর মধ্যে ফুটবলও জুটে গেলো। অফিসের কেউই ফুটবল নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। অগত্যা যাদবপুরেরই আরেক পাবলিকের সঙ্গে আমি যাওয়া শুরু করলাম আম্বেদকর স্টেডিয়ামে। অমল মিত্র তখন মোহনবাগানের কোচ - ডায়মন্ড ফর্মেশনে মোহনবাগান তখন দুরন্ত খেলছে। অফিস থেকে ক্যাজুয়াল লীভ নিয়ে আমরা চলে যেতুম আম্বেদকর স্টেডিয়ামে - ডিসিএম, ডুরান্ডের খেলা দেখতে। অন্যেরা আওয়াজ দিত - কেয়া পাগলপন হ্যায় ইয়ার - বংগালী লোগ - ম্যাচ দেখনে কে লিয়ে ছুট্টি লেতা হ্যায়। আমরা বলতুম - তোরা কি বুঝবি রে ব্যাটা, দেখিস তো শুধু ওভারহাইপড ডাংগুলি। এগারোটা ছেলে যখন বল নিয়ে মাঠে দৌড়য়, তার মজা আর তোরা কি বুঝবি। এই আম্বেদকর স্টেডিয়ামে একজন মজাদার লোকের সাথে আলাপ হয়েছিলো - আরেক সর্দারজী - ফুটবলপাগল একটা চরিত্র। খেলা শুরু হওয়ার আধ ঘন্টা আগে তিনি মাঠে ঢুকতেন - ট্রেডমার্ক দুটো ভেঁপু নিয়ে - সে যার খেলাই হোক না কেন। মাঠের রেগুলার দর্শকেরা সকলেই এঁকে চিনতো - ডাকাডাকি করতো। ইনি মাঠের লম্বালম্বি গ্যালারীর মাঝামাঝি একটা জায়গায় রোজ এসে বসতেন - এবং যতক্ষণ খেলা চলতো ততক্ষণ ভেঁপু বাজিয়ে জমিয়ে রাখতেন - সে মোহনবাগান গোল করলেও, বা জেসিটি গোল করলেও।

মন্টু সিং-এর বাড়িতেই থাকি। মাঝে একবার বন্ধুরা মিলে ভাবনাচিন্তা করলুম যে নিজেরা বাড়ি ভাড়া নেবো, রান্না করে খাবো। ঐক্যমত্য হল না। কারণ মণিময়। সে নাকি আরবিট খাবার খেলে মরেই যাবে। তাকে বোঝানোর চেষ্টা চলতে চলতেই মণিময় আর কিশোর অন্য চাকরি পেয়ে পাত্তারি গুটিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেলো এই অফিস আর তার বন্ডকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। আমিও একটা চান্স পেলাম, কিন্তু বন্ডের ভয়টা কাটাতে না পেরে ভরসা পেলাম না। আর তাছাড়া কথাবার্তা যখন বেশ খানিকটা এগিয়েছে তখন জানা গেলো সেই কোম্পানির সাথে সুখরামের কিছু একটা যোগাযোগ আছে - এবং সুখরাম তখন কেলেংকারীতে অলরেডি গলা অবধি ডুবে - কাজেই বাবাগো-মাগো বলে সেই কোম্পানিকে পিছু ছাড়াতে হল।

সাতানব্বইয়েরই পুজোর সময় সম্ভবতঃ একদিন মন্টুদা ফিস্টি দিলেন - অষ্টমীর দিনই মনে হয় - রাতে রুটি আর মাংস। এমনিতে প্রকাশজীর রান্না খেয়ে খেয়ে বোর হয়ে গেলেও সেদিন ব্যাপারটা স্পেশ্যাল ছিলো। অতএব খাওয়া শুরু, খেতে খেতে খাওয়ার কম্পিটিশন শুরু। সাতজনার টেবিলে রুটি আসছে আর উড়ে যাচ্ছে। খান দশেক গড়ে মনে হয় সকলেই খেয়েছিলো, তারপর বাকিরা রিটায়ার করা সত্ত্বেও আমি আর দীপান তখনও ব্যাটিং। দুজনের সতেরো-সতেরো টাই চলছে যখন, প্রকাশজী আর একটি রুটি হাতে কাঁদো কাঁদো মুখে এসে বললেন - আটা শেষ, এবং একশোরও বেশি রুটি বানানোর পর আর তিনি টানতে পারছেন না। সেই শেষ রুটিটা দুভাগ করে খেয়ে আমি আর দীপান ম্যাচ টাই করে হাত মেলালুম। প্রকাশজীর সেই মুখটা এখনও পনে পড়ে - হাসিও পায়, বেচারার জন্যে দুঃখও হয়।

আটানব্বই সাল এলো, দিল্লীতে এক বছরও পেরিয়ে গেলো সেই এপ্রিলে। ততদিনে অন্য একটা চাপ শুরু হয়েছে - কলকাতায় তাঁর আর ভালো লাগছে না, যাদবপুরের মাস্টার্সও তাঁর শেষের পথে। তখনও আমার ভাঁড়ার ঢু ঢু। এই সময় প্রোজেক্টের ইমপ্লিমেন্টেশনের জন্যে ফিনল্যান্ড যাওয়ার অফার এলো - দেখলাম ভাঁড়ারের অবস্থা সম্মানজনক করতে এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ নেই, কাজেই অফিসে হ্যাঁ বলে দিলুম। নতুন বাক্স কেনা, চশমা করানো (এসবের জন্যে অফিস থেকে টাকা দিত), ভিসা করানো - এই সবে কিছুদিন দৌড়ঝাঁপ গেলো। একটা বাক্সে বাড়তি কিছু জিনিস আর অন্য দুটি সম্পত্তি - সবেধন নীলমণি বেহালাটা আর ক্যাসেট প্লেয়ারটা মন্টুদার জিম্মায় রেখে একদিন লুফৎহান্‌সায় চেপে রওনা দিলুম ফ্র্যাঙ্কফুর্ট হয়ে হেলেসিঙ্কির দিকে।

আমার প্রথম প্লেনে চাপা, সেও অত দূরে।

No comments:

Post a Comment