Friday, May 11, 2012

শহর থেকে শহরে - ৬

ইন লাভ উইথ Delhi
===========

ন্যাবা, মানে অর্ণব চ্যাটার্জী, সত্যিই ন্যাবা। নইলে বেকুবের মতন কেউ বলে যে দিল্লী অতি খাজা জায়গা? জয়িতা শুধু "দিল্লী ইজ সুপার" বলে ছেড়ে দিয়েছিলো - ভালো মেয়ে, তাই। আমার সামনে বললে না...

দিল্লীতে তখন প্রাণান্তকর গরম আর লোডশেডিং, গুরগাঁওএর অবস্থা আরো ভয়ানক। দুপুরে অফিস থেকে বেরোলে মনে হত মরুভূমির মধ্যে হাফ প্যান্ট পরিয়ে খালি পায়ে কেউ দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তার ওপর অফিসের গোয়ালের ট্রেনিং - বিরক্তিকর বোকা বোকা - বিভিন্ন প্রোজেক্ট থেকে যারা ক্লাস নিতে আসতো তাদের দেওয়া সেই ট্রেনিং-এর নমুনা দেখে নানা রকম কার্টুনের কথা মনে হত সবার আগে। ট্রেনিং আবার হত শিফ্‌টে। কিছুদিন ভোরবেলা, কিছুদিন ভরদুপুরের শিফ্‌টে - কারণ জায়গার অভাব। তো রোজ দিল্লী-গুরগাঁও ঠেঙিয়ে অফিস করে আর তার ফাঁকে রাজিন্দার নগর, করোলবাগ, কনট প্লেস - এই সব চত্ত্বরের রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে আমার ধারণা হয়েছিলো দিল্লী নির্ঘাৎ মেয়ে। নইলে ছেলেদের মনে জায়গা বানাতে হলে পেটের মধ্যে দিয়ে ঢুকতে হয় - এই চিরন্তন সত্য দিল্লীর পক্ষে জানা সম্ভব ছিলো না।

এর মধ্যে একদিন কোনো কারণে অটোয় করে ধওলাকুঁয়া থেকে রাজিন্দর নগর আসতে হয়েছিলো - রিজ্‌ (Ridge) রোড ধরে। দিল্লীর অত কাছে, বলা ভালো দিল্লীতেই, পাহাড়ী রাস্তার মত অত সুন্দর রাস্তা দেখে চমক লেগেছিলো। তার পর, মাঝে মাঝে শনি-রবিবার কিছু করার না থাকলে একা একা শঙ্কর রোড ধরে কিছুটা উজিয়ে ওই রাস্তা ধরে হাঁটতুম। একদিকে পাহাড়ি এলাকা, বেশ ঘন জঙ্গল, অন্য দিকে খাদ, রাস্তা দিয়ে প্রচণ্ড স্পীডে ছুটে যাওয়া গাড়ি। আরাবল্লির এক্সটেনশন এই দিল্লী রিজ্‌। দৃশ্য এতই সুন্দর, যে অন্য কোনো বিপদ যে থাকতে পারে সে কথা কখনো মনে আসেনি। এরকম এক বিকেলে, তখন আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নামছে - আমি আবার ওইদিকে ঘুরতে গেছিলুম। হেঁটে ফিরছি, শঙ্কর রোড ধরতে তখনো মিনিট কুড়ি তো হবেই - একটা গাড়ি পাশে এসে থামলো - এক বৃদ্ধ সর্দারজী গাড়ি থেকে নেমে - তু আব্‌হি ইসি ওয়াক্ত গাড়ি মে বৈঠ - বলে টেনে গাড়িতে বসালেন। কিডন্যাপিং ভেবে ভয় পাবো কিনা ভাবছি - ভুল ভাঙলো। বেটা তু পাগল হ্যায় কেয়া - তেরে ঘরমে মা-বাপ নহি হ্যায় - বলে সেই সর্দারজী পিঠে হাত রাখলেন - এই রাস্তায় এই সময়ে কেউ একলা একলা ঘোরে? শুনলাম চুরি-ডাকাতি ওই রাস্তায় খুবই সাধারণ ঘটনা। ওই সর্দারজী এবং ওঁর স্ত্রী সেদিনের আগেও এক দুই দিন আমাকে হাঁটতে দেখেছেন। সেদিন সন্ধ্যে হয়ে আসছিলো বলে ওঁর স্ত্রী ওঁকে বলেন আমাকে গাড়িতে তুলে নিতে, আর একটু ধমকাতে। আমি মুজতবা, বৃদ্ধ সর্দারজী হলেন মুইন-উস-সুলতানে, আর ওঁর স্ত্রী - কাওকাব। সাতানব্বই সালের কোনো এক সময়ে দিল্লীর পথ হয়েছিলো কাবুল - আমার কাছে।

আনজান শহর দিল্লীতে সাধারণ মানুষকে চেনা সেই শুরু।

এর পরের পরিচয় এক চায়ে-ওয়ালি মওসির সঙ্গে। তখন দুপুরের শিফ্‌ট। প্রচন্ড রোদে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি - বাস দেরী করছে। সেই বাস তখন সকালের শিফ্‌টের ছেলেমেয়েদের নামিয়ে দুপুরের শিফ্‌টের লোকদের তুলে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝেই দেরী হয়। কিন্তু সেদিন একটু বেশিই দেরী হচ্ছে। রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কেমন অস্বস্তি শুরু হল, কপাল টিপ্‌টিপ্‌ করছে, দাঁড়াতে পারছি না। উল্টোদিকের চায়ের দোকানের বুড়ি অনেকক্ষণ ধরে আমাকে লক্ষ্য করছিলো। রাস্তা পেরিয়ে এপারে এসে আমাকে প্রায় হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলো নিজের দোকানে। খাটিয়ায় বসিয়ে বললো - পরের দিন থেকে আমি যেন আর রোদে না দাঁড়িয়ে থাকি - তেরেকো কুছ খরিদনেকা জরুরৎ নহি হ্যায়, সির্ফ ইঁহা বৈঠ। তার পর আর বেশিদিন দুপুরের শিফ্‌ট করতে হয়নি - কারণ এর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ট্রেনিং শেষ করে পার্মানেন্ট প্রোজেক্ট পেয়ে যাই - কিন্তু ওই কয়েকদিন আর রোদে দাঁড়াতে হয়নি।

এর পরের তিন-সাড়ে তিন বছরে অনেকবার দেখেছি - অটোওয়ালা, বা ডিটিসির কন্ডাক্টর, বা রাস্তার ধারের লস্যিওয়ালা - কতবার এভাবে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ বাইরে থেকে এরা কাঠখোট্টা, রসকষহীন, সবাই বলে রূঢ়। কিন্তু এরকম দু চারটে ঘটনা আমাকে কলকাতার কথা মনে পড়িয়ে দিত।

এর মাঝে একদিন বন্ধুরা মিলে গেলাম পুরনো দিল্লী ঘুরতে। ঘরে গান শোনার মত কিছু ছিলো না - লক্ষ্য চাঁদনী থেকে শস্তায় একটি টেপ-রেকর্ডার কেনা আর একই সাথে পুরনো দিল্লী ঘুরে আসা। কনট প্লেস থেকে তখন ভটভটি যেত পুরনো দিল্লী অবধি - সেই ভটভটি চেপে দিল্লী গেট পেরিয়ে পুরনো দিল্লীতে জামা মসজিদের সামনে। মোগল স্থাপত্যের সাথে প্রথম পরিচয় সেখানে। প্রথমে জামা মসজিদ - এদিক ওদিক ঘুরে দেখলাম কোনের দিকে একটা ছোট কাউন্টারে টিকিট কেটে লোকে কোথাও একটা যাচ্ছে। আমরাও গেলাম। অন্ধকার সরু সিঁড়ে বেয়ে উঠছি তো উঠছিই - বেশ কিছুক্ষণ পর বেরোলাম জামা মসজিদের একটা তোরণের মাথায়। সেখানে দাঁড়ালে সামনেই চোখে পড়ে শাহজাহান-আওরঙ্গজেবের দিল্লী, আরো দূরে পূবদিকে যমুনা, আর দূরে দক্ষিণদিকে সার এডুইন লুটিয়েন্স এবং সার হার্বার্ট বেকারের তৈরী নতুন দিল্লী - অষ্টম দিল্লী।

দুপুরের খাওয়া - আসল অথেন্টিক মোগলাই খাওয়া হবে। খোঁজ কোথায় করিম্‌স। জামা মসজিদের পাশের গলির মধ্যে তস্য গলি - গলি কবাবিঞা - সেই গোলকধাঁধার মধ্যে এক কোণে করিম্‌স - বাহাদুর শাহ জাফরের রাঁধুনীর বংশের রেস্তোরাঁ। বাইরে থেকে দেখলে যতটা অভক্তি আসবে, ভিতরে একবার খেলে সেই অভক্তি কোথায় চলে গিয়ে আসবে তার দশ-বিশ-পঞ্চাশগুণ ভক্তি। আহা সে কি স্বাদ। তার বর্ণনা দেওয়া আমার অক্ষম কলমে সম্ভব নয় - কিন্তু কেউ কখনো দিল্লী যাচ্ছে শুনলে তাকে অন্ততঃ একটা টিপ্‌স দেওয়াটা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।

তারপর একবার চৌরি বাজারের বইয়ের দোকান, আরো এগিয়ে ঘন্টেওয়ালার মিষ্টির দোকান ঘুরে ঢুকলাম লালকেল্লায়। তখনো দুটাকা করে টিকিট। ভিতরটা প্রথম দর্শনে অত ইমপ্রেসিভ লাগে না, তবে দেওয়ান-ই-আম বা দেওয়ান-ই-খাস তার যৌবনকালে কী ছিলো সেটা আজ তার বার্ধক্যেও দেখলে আন্দাজ করা যায়। মোতি মসজিদও। কিন্তু যে জিনিসটা আমাকে পাকাপাকিভাবে দিল্লীর প্রেমে পড়িয়ে দিলো - সেটা হল লালকেল্লার সন-এ-লুমিয়ের। লাইট অ্যাণ্ড সাউন্ড শো আগেও দেখেছি, পরেও আরো দেখবো। দিল্লীতেই আজ শুনেছি পুরানা কিল্লায় নতুন সন-এ-লুমিয়ের শুরু হয়েছে - আরো হাইটেক। কিন্তু দিল্লী নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম যে লাইনটা দিয়ে - যুদ্ধ-রক্ত-প্রতিহিংসা-প্রেম-যৌনতা-বিলাস থেকে ট্র্যাজেডির শহর দিল্লী - সেই দিল্লীকে প্রথম চেনালো লালকেল্লার এই লাইট-অ্যাণ্ড-সাউন্ড। আমি চোখের সামনে দেখলাম দিল্লীর পত্তন, জহান-আরার তৈরী সন্ধ্যে বেলায় আলো ঝলমল মীনা বাজারের হসি-কলোরোল, শুনলাম মোতি মসজিদের গায়ে ফেলা আলোর মধ্যে ভেসে আসা আওরঙ্গজবের শেষ প্রার্থনা - ক্ষমা করো মরাঠা - ক্ষমা করো রাজপুত। দেখলাম খোলা তরোয়াল হাতে নাদির শাহকে রঙ মহলের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে যখন দিল্লীতে চলছে উন্মত্ত হত্যালীলা, লক্ষ্ণৌ থেকে আসা বিদ্রোহী সেপাইদের সামনে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফর, আর তারপর হুমায়ুনের সমাধিতে নিরস্ত্র বাহাদুর শাহ-এর ছেলেদের নৃশংস হত্যা...

And I fell in love - for the second time.

No comments:

Post a Comment