Wednesday, October 31, 2018

দিকশূন্যপুরের রাস্তায় - The Road to Nowhere (৩য় পর্ব)

১৩ তারিখ সকাল থেকে অল্প টেনশন ছিলো - একেবারে ছিলো না বলা যাবে না। কারণটা মূলতঃ অনেক দিন পরে লঙ ড্রাইভে বেরোনো। সেই ২০১৩ সালের পর। এর মধ্যে বয়স বেড়েছে, রিফ্লেক্স কমে থাকতেই পারে। আর যেটা হয়েছে সেটা হল প্রোগ্রেসিভ লেন্স - মানে চালশেও ধরেছে আর কী। রোজ দুবেলা নেতাজীনগর - নিউটাউন গাড়ি ঠ্যাঙালেও, হাইওয়েতে যাওয়াআসা নিয়ে দেড় হাজার কিলোমিটার একটু অন্য জিনিস। তবে সে বেশিক্ষণ থাকেনি - হাইওয়েতে পড়তেই আবার সেই চেনা অনুভূতিটা ফিরে এলো - কালো পিচঢালা রাস্তায় দৌড় দৌড় দৌড়...

সেদিন মনে হয় পঞ্চমী ছিলো। এই প্রায় মহালয়া থেকে পুজো উদ্বোধন শুরু করে কী রেটে যে হাল বেহাল হয়েছে সেটা কলকাতায় না থাকলে বোঝা অসম্ভব। মোটামুটি দ্বিতীয়া থেকেই রাস্তায় কুলকুলিয়ে লোক নেমে গেছে, বাকিরা দেখে ফেলার আগেই ঠাকুর দেখতে হবে এরকম কিছু মানসিকতা নিয়ে মনে হয়। মহালয়ার দিন উত্তর থেকে ফেরার সময় সন্ধ্যেবেলা দেখেছি মণি স্কোয়্যার থেকে লেক টাউন অবধি জ্যাম - তা পঞ্চমীর দিন কী হতে পারে বুঝতেই পারছেন। ওই দুপুরবেলাতেও লর্ডস মোড় পেরোতে কান্নাকাটির অবস্থা। এর মধ্যে দুটো চল্লিশ বেজেও গেছে, ছেলে স্কুল থেকে বেরিয়ে তিনবার ফোনও করে ফেলেছে। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে পৌঁছে তাকে তুলতে তুলতেই তিনটে বেজে গেলো। তারপর আবার ডোভার রোড ঘুরে বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে এসে জ্যাম। গুরুসদয় দত্ত রোডে জ্যাম। থিয়েটার রোডে জ্যাম। তো সেসব পেরিয়ে এজেসি বোস রোড ফ্লাইওভারে উঠতেই সাড়ে তিনটে। সেকেন্ড ব্রীজ পেরোতে প্রায় চারটে। ওদিকে সিউড়ি যেতেই লাগবে ঘন্টা পাঁচেক - মানে সাড়ে আটটা - ন'টার আগে কোনোভাবেই পৌঁছনো যাবে না।

এবার সেকেন্ড হুগলী ব্রীজ পেরিয়েই দেখি কোণা এক্সপ্রেসওয়ে পুরো জ্যাম। জানলাম পুজোর সময় শহরে ট্রাক ঢোকার উপর রেসট্রিকশন রয়েছে, যেগুলো ঢুকেছিলো সেগুলো তখন বেরিয়ে যাচ্ছে, কাজেই রাস্তার হাল খারাপ। সে জ্যাম চললো সাঁতরাগাছি ব্রীজ অবধি। তারপরেও রেহাই নেই - ডানকুনিতেও বাজে জ্যাম। ওই অবধি পৌঁছতেই জ্যামে জ্যামে হাল বেহাল।

ডানকুনি পেরোনোর পরে হাইওয়ে ফাঁকা পেলাম - বর্ধমান অবধি কোনো চাপ নেই। বর্ধমান থেকে দুটো উপায়ে সিউড়ি যাওয়া যায় - এক) গুশকরা - সুরুল হয়ে, দূরত্ব ২০৫ কিমি - রাস্তাটা ন্যাশনাল হাইওয়ে হলেও দুটো লেনের; আর দুই) দুর্গাপুর/অন্ডাল হয়ে - দূরত্ব একটু বেশি, রাস্তাও চওড়া, কিন্তু সময় বেশি লাগছে - অর্থাৎ, গুশকরা-সুরুলের রাস্তা সরু হলেও, অসুবিধাজনক নয় বলেই মনে হয়।


বর্ধমান পৌঁছে ডানদিকে ঘুরে ন্যাশনাল হাইওয়ে ১১৪ (সেকমপুর-সাহাপুর রোড) - সোজা চলে গেছে গুশকরার দিকে। এই রাস্তাটা ওই প্রায় জিটি রোডের মত - একটা যাওয়ার লেন, একটা আসার লেন, মাঝে কোথাও কোথাও মিডিয়ান মার্ক করা আছে, কোথাও নেই। আর প্রপার গ্রামবাংলার মধ্যে দিয়ে রাস্তা। দুদিকে ক্ষেত, রাস্তার ধারে কাশবনের ছড়াছড়ি, আর, সন্ধ্যের মুখে সেসব ক্ষেতে আর মাঠে হু হা কুয়াশা। মাঝে মাঝে এক একটা গ্রামে তখনো প্যান্ডেল বাঁধার কাজ চলছে (ওদিকে কলকাতায় পুজোর অর্ধেক হয়ে গেছে সেটা মনে রাখবেন)। উল্টোদিক থেকে গাড়ি ধেয়ে আসছে ডিপারের তোয়াক্কা না করে - সেই সময়টুকু চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া ছাড়া এই রাস্তাটা নির্ঝঞ্ঝাট বলাই যায়। শুধু মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় কুয়াশা রাস্তা ঢেকে দেয় - গাড়ির উইন্ডশিল্ডের ওপর হইহই করে ধেয়ে আসে - গাড়ির হেডলাইট হাই-বীমে দিলে আরোই বরং বেশি জ্বলজ্বল করে ওঠে, চোখ ধাঁধায়। কোথাও কোথাও রাস্তার ধারের গাছগুলো দুপাশ থেকে বেঁকে এসে টানেলের মত তৈরী করে দিয়েছে - গাড়ি থেকে দেখলে মনে হয় পাতামোড়া একটা টানেলের মধ্যে দিয়ে হু হু করে এগিয়ে যাচ্ছি - ওই দূরে টানেলের মুখ, সেখান দিয়ে বেরোলেই একটা নতুন কিছু দেখতে পাবো...

এই রাস্তাটা গুশকরা পেরিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে সুরুল অবধি। সেখানে শান্তিনিকেতনকে ডানদিকে ফেলে রেখে আপনি সিউড়ি-বোলপুর রোড ধরে আরো এগিয়ে যাবেন। আশেপাশে শান্তিনিকেতন অঞ্চলের চেনা কিছু নামের বোর্ড দেখতে পাবেন - প্রান্তিক যেমন একটা। আরো এগিয়ে অবশেষে সিউড়ি। বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে অল্প এগোলেই বাঁদিকে হোটেল সাগর।

গাড়ি পার্ক করে রাতের জন্যে দরকারি ব্যাগ, আর ক্যামেরা ব্যাগ নিয়ে চেকইন করলুম। প্রথম প্রশ্ন - "আপনারা কি তারাপীঠ যাবেন?" কে জানে, সিউড়িতে যারাই যায় তারা তারাপীঠ যায় কিনা। যাই হোক, ঘরগুলো ভালোই (তবে এক একটা ঘরে দুজন করেই - তাই আমাদের চারজনের জন্যে দুটো ঘর নিতে হয়েছিলো)। ছেলেমেয়ে বায়না করলো বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, বাড়ির মত ভাত-ডাল-রুটি খাবো না, এলোমেলো খাবো। এবার এদের এলোমেলো মানে পিজ্জা/বার্গার - সে আর কোথায় পাওয়া যাবে - চাউমিন আর চিলি চিকেনই সই। খেয়েদেয়ে চটপট ঘুমিয়ে পড়ার কথা, কারণ পরের দিন অনেকটা পথ চালাতে হবে - প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার, কাজেই ভোরে বেরোতে হোবে। টার্গেট দিলাম সাড়ে চারটে, আর সাড়ে তিনটেতে অ্যালার্ম দিয়ে সেদিনের মত গুডনাইট।

পরের দিনের গন্তব্য লাটাগুড়ি পেরিয়ে টিলাবাড়ি টুরিস্ট কমপ্লেক্স।

(চলবে)

(আগের কথা)

No comments:

Post a Comment