Monday, November 12, 2018

দিকশূন্যপুরের রাস্তায় - The Road to Nowhere (৭ম পর্ব)

দুপাশে চাপড়ামারির জঙ্গল ফেলে রেখে কালো কুচকুচে পিচ ঢালা কুমানি রোড চলে গেছে সাম্তালেখোলার দিকে। দু চোখ যদি খোলা রাখেন, পাশের জঙ্গলে হঠাৎ করে হরিণ দেখে ফেলতেই পারেন। আর পাখি তো অগুণতি, তেমন তাদের রকমারি ডাক। কলকাতা স্টাইলে জানলা বন্ধ করে এসি চালিয়ে গাড়ি চালালে এসব কিছুই মিস করে যাবেন - তাই জানলা খুলে গাড়ি আস্তে চালান - পরিষ্কার হাওয়ার সাথে জঙ্গলের গন্ধ নাকে এসে ঢুকবে। গাড়ির স্টিরিওটাও বন্ধ রাখুন - বরং এই জঙ্গলের গান শুনুন - হরেক রকমের পাখির ডাক, অন্ততঃ তিন চার রকমের ঝিঁঝিঁর ডাক, হাওয়ার ধাক্কায় লম্বা গাছের পাতার ঝিরিঝিরি আওয়াজ...

সিপচু শহীদ বলিদান পার্ক ছাড়িয়ে আরো কিছুটা এগোলে পড়বে খুনিয়া মোড় - একটা তেমাথা। ডানদিকের রাস্তা চলে গেছে ঝালং এর দিকে, আপনি ঘুরবেন বাঁদিকে - নয়া বস্তির দিকে। নয়া বস্তিতে পড়েই দেখবেন জিটিএ এলাকায় এসে গেছেন। আর একটু এগিয়ে একটা তেমাথায় প্রায় হেয়ারপিন বেন্ড (রাস্তা প্রায় ভাঙাই এখানে) ঘুরে নেমে যাবেন মূর্তি নদীর দিকে। একটা সরু ব্রীজের ওপর দিয়ে নদী পেরিয়ে শুরু ডুয়ার্স অঞ্চলের চা-বাগান - এইটাই সামসিং। সরু রাস্তা চা-বাগানের মধ্যে ঘুরে ঘুরে অল্প ওপরের দিকে উঠে গেছে - রাস্তার দুপাশে একটু কালচে সবুজ পাতাওয়ালা চা-গাছ (দেশের যাবতীয় সিটিসি চা সাপ্লাই যায় ডুয়ার্সের এইরকম চা-বাগানগুলো থেকেই), আর ইতস্ততঃ ছড়িয়ে আছে প্রচূর পাথর - সম্ভবতঃ মূর্তি নদীর সাথে বয়ে এসেছিলো কোনোকালে। শুনলাম খুব সকালে এখানে আসতে পারলে অল্প দূরে ভুটান পাহাড়ের পিছন থেকে অসামান্য সূর্য্যোদয় দেখা যায় - যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে। আর থাকে নানা রকমের পাখি - যদি আপনার পাখির ছবি তোলার শখ থাকে...



সামসিং চা বাগান পেরিয়ে পর পর কয়েকটা ছোট গ্রামের মধ্যে দিয়ে ঘুরে ঘুরে রাস্তা চলে গেছে সান্তালেখোলার দিকে - চেনা না থাকলে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর, তাই মাঝে মাঝেই মোড়ের মাথায় জিগ্গেস করে নিতে হচ্ছিলো - বিশেষ করে এক দুই জায়গায় রাস্তার কাজের জন্যে ডাইভার্শন থাকায় - এবং তার ফলে বার দুয়েক অফরোডিং ও করতে হল। দেবাশিসের ছোট গাড়িতে চারজন ছিলো বলে এক জায়গায় তিনজনকে নেমে গাড়ির ওজন কমিয়ে গাড়ি পার করতে হল। একটু বেশি গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স হওয়ার দরুণ আমরা বেঁচে গেলাম।

কিছুদূর এগোতেই পড়বে ফাড়ি বস্তি - ছোট্ট একটা গ্রাম। রাস্তা এখানেই শেষ - মানে বাইরে থেকে আসা এমনি গাড়ির। সামনে একটা গেট রয়েছে যেটা পেরোতে হলে আপনার কাছে হয় সান্তালেখোলা রিভার ক্যাম্প বা মৌচুকি ফরেস্ট বাংলোর বুকিং থাকতে হবে। যদি নদীর ধারে পিকনিকে যেতে চান, বা পাহাড়ের পথে হাইকিং করতে চান - হেঁটে যেতে পারেন, অথবা ওখানে কিছু মারুতি ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে - তাদের ভাড়ায় নিতে পারেন। গাড়ি নিয়ে গেট পেরোতে গেলে আপনার কাছে কাগজ থাকতেই হবে।

তখন প্রায় বারোটা বাজে বলে একটা ছোট দোকানে বসে আমরা একটু মোমো আর চা খেলাম। আর একটা দোকান নজরে পড়লো - যার সামনে বড় ফ্লেক্স লাগানো - ছবিসহ - কবে যেন "তিনি" এখানে এসে মোমো আর চা খেয়ে দাম দিয়েছিলেন!!!

দেবাশিসদের টাটা করে রওনা দিলাম ফরেস্ট বাংলোর দিকে - ওরা ফিরবে জলপাইগুড়ি। আমরা যেদিন মেন্ডাবাড়ি যাবো, সেদিন আবার ওদের সাথে দেখা হবে।

গেট পেরিয়ে রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে নীচে - নদীর ধারে রিভার ক্যাম্পের দিকে, আর একটা সরু ইঁট পাতা রাস্তা উঠে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে - সেইটাই ধরতে হবে আমাদের।

এখানে আগে একটা ডিসক্লেমার দিয়ে রাখি। সান্তালেখোলা রিভার ক্যাম্প বুক না করে মৌচুকি বুক করার ছোট একটা কারণ আছে। আগে, বহুদিন ধরে বহুবার বিলেতের লেক ডিস্ট্রিক্ট বা স্কটিশ হাইল্যান্ডস বা আমেরিকায় রকি মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্কের পাহাড়ি রাস্তা গাড়ি নিয়ে চষে ফেলেছিলাম, এমনকি আমেরিকায় যেটাকে হায়েস্ট মোটোরেবল রোড বলে - রকি মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্কে - প্রায় সাড়ে বারো হাজার ফুট উঁচু - তাও। কিন্তু এই গাড়ি নিয়ে পাহাড়ে যাবো শুনলেই চেনাজানা প্রায় সকলেই হাঁ হাঁ করে ওঠেন - পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানো কী মুখের কথা ইত্যাদি বলে - তাঁদের কাছে লেক ডিস্ট্রিক্ট/স্কটিশ হাইল্যান্ডসের রাস্তা কলকেই পায় না একেবারে। তা হাত মকশো করার জন্যে (বরং বলা ভালো হাত যে মকশো যে করাই আছে সেটা দেখানোর জন্যেই) মৌচুকি যাওয়া, রিভার ক্যাম্পে না গিয়ে। একটুখানি অফরোডিং। একটুখানি প্রমাণ।

পাহাড়টা বিশেষ উঁচু নয়, পাশে গভীর খাদও নেই। যেটা আছে সেটা হল না-থাকা একটা রাস্তা। গুগুল ম্যাপে এখনো যদি দেখেন, দেখবেন ফাড়ি বস্তি থেকে একটা ডটেড লাইন উঠে গেছে মৌচুকি অবধি। কিছুদিন আগে অবধিও এই পথে গাড়ি যেত না। ইদানিং পাথর ফেলে একটা রাস্তা বানানো হয়েছে - চড়াইটাও মন্দ নয় - জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে এই পাথর ফেলা পথ উঠে গেছে প্রায় সাত কিলোমিটার। গাড়ি চলবে দুলে দুলে, ঝড়ের নদীতে নৌকোর মত। সামান্য অসাবধান হলেই হয় চাকা পাথরে ঠেকবে, বা গাড়ির তলায় জানান দেবে - মোবিল ট্যাঙ্ক ফেটে গেলেই চিত্তির। পথে বিশেষ অসুবিধা আর কিছু নেই - মুশকিলটা হল ওটাই রাস্তা কিনা সেইটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ওই গ্রেডিয়েন্টে আর অসমান পাথরের মধ্যে ফার্স্ট গিয়ারের ওপরে গাড়ি উঠবে না, আর কাজেই যেতে হচ্ছে বেজায় আস্তে - মানে সাত কিলোমিটার পেরোতে ঢের সময় লাগবে। কাউকে জিগ্গেস করার উপায় নেই, কারণ কেউ কোত্থাও নেই, আর মোবাইলও মৃত। বেশ খানিকটা ওঠার পর (ততক্ষণে গাড়ির মধ্যে পিনড্রপ সাইলেন্স - শুধু বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই - দুটি চ্যাটারবক্সই একেবারে সুইচড অফ) একটা দুটো বাড়ি চোখে পড়লো - রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে এখানে। নেমে গিয়ে ডাকাডাকি করে একজনকে পেলাম - জানতে পারলাম রাস্তা ঠিকই আছে, আরো কিছুটা ওপরে উঠতে হবে, মানে প্রায় পাহাড়টার মাথায়। নিশ্চিন্ত হয়ে এগোতে এগোতে দুটো বাঁক পেরোতেই দেখি একটা গেট (মানে ওই লেভেল ক্রসিং এর গেটের মত) আর তাতে তালা বন্ধ। আর ওপর দিকে দেখা যাচ্ছে সবুজ কাঠের দোতলা একটা বাড়ি - ওইটাই ফরেস্ট বাংলো।

খেয়েছে। এবার আবার কাকে ডেকে তালা খোলাতে হবে? একটু এপাশ ওপাশ ঘুরে কাউকে না দেখে বাধ্য হয়ে বার দুই তিন হর্ন বাজালাম। সাথে সাথেই বাংলোর একটা কোণা থেকে দুটো মুন্ডু বেরিয়ে এলো। অত দূরে চেঁচালে শোনা যাবে না মোটে, তাই হাত নাড়িয়ে ইশারা করাতে একজন মিনিট কয়েকের মধ্যে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে চলে এলো। বুকিং রয়েছে জানাতেই খুল যা সিম সিম...আর খান তিনেক মোড় ঘুরতেই একটা ফাঁকা জায়গা, তার মধ্যে সবুজ দোতলা কাঠের বাড়িটা।

(ফিরে আসার পরে একটা জিনিস খেয়াল করলাম - মৌচুকি ফরেস্ট বাংলো বলে একটা সিনেমাও আছে। অজানা একটা জঙ্গলে তিনটে ছেলের প্যারানর্মাল অভিজ্ঞতা নিয়ে - সেটা নাকি একটা কুড়িয়ে পাওয়া হ্যান্ডি-ক্যাম থেকে বের করা। টুক করে সিনেমাটা দেখে ফেলতে পারেন। মৌচুকির গল্পে পরে আসবো।

https://www.imdb.com/title/tt7855306/)


No comments:

Post a Comment