Monday, October 15, 2007

একটা রহস্য গল্প, বা গল্প নয়

আমি কখনো পোর্তুগাল যাই নি৷ আমার কোন পোর্তুগীজ বন্ধু নেই৷ পোর্তুগীজ বলতে চিনি শুধু ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আর জোসে মোরিনহোকে৷ পোর্তুগীজ খাবার বলতে "নন্দুজ"-এর মুরগী ভাজা ছাড়া আর কিছু খাই নি৷ আমি পোর্তুগীজ ভাষার অ-আ-ক-খ - মানে তার পোর্তুগীজ ইকুইভ্যালেন্ট কি জানি না৷ কিন্তু আমি arguido মানে জানি৷ শুধু আমি নই, গোটা যুক্তরাজ্যের মানুষ যাঁরা খবরের কাগজ পড়েন, টিভি দেখেন, গুজব শোনেন, তাঁরা জানেন৷ এবং সম্ভবত গোটা দুনিয়ার এক বিরাট সংখ্যক মানুষ যাঁদের হাতের কাছে আন্তর্জাল আছে, তাঁরা জানেন৷ শুধু জানেন না, ন্যাচারাল পোর্তুগীজ অ্যাকসেন্টে কথাটা বলতেও পারেন - পাবে বা রেস্তোরাঁতে ওয়েটারকে ধন্যবাদ জানাতে ছোট্ট করে "ওব্রিগাদো" বলতে না পারলেও - আমার কথা নয় - দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে ম্যাথু নর্ম্যানের কথা৷

শুরুর কথাটা বলে নেওয়া দরকার৷

৩রা মে, ২০০৭ - পোর্তুগালের প্রায়া দ্য ল্যুজ রিসর্ট থেকে হারিয়ে যায় চার বছরের ম্যাডেলিন ম্যাক্কান৷ ম্যাডির বাবা-মা - জেরি আর কেট - দুজনেই লেস্টারশায়ারে ডাক্তারি করেন - কেট একজন জিপি, জেরি হার্ট স্পেশ্যালিস্ট - তখন রিসর্টের কাছে একটি ট্যাপাস বারে রাতের খাওয়া সারছিলেন বন্ধুবান্ধবের সাথে৷ রিসর্টে ম্যাডি আর ম্যাডির ছোট ভাইবোন ঘুমোচ্ছিলো৷ কেট, জেরি এবং কয়েকজন বন্ধু পালা করে দেখে আসছিলেন যে বাচ্চাগুলো ঠিক আছে কি না৷ ন'টা নাগাদ জেরি দেখে আসেন৷ সাড়ে ন'টায় ম্যাথু ওল্ডফিল্ড ঘরের বাইরে কান পেতে শুনে আসেন৷ রাত্তির দশটায় কেট দেখতে যান, এবং আতঙ্কিত অবস্থায় চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে আসেন - "ওরা ওকে নিয়ে গেছে, ওরা ওকে নিয়ে গেছে৷" ম্যাডির প্রিয় সফট টয় "কাড্ল ক্যাট" - যেটা নিয়ে সে ঘুমতো, যেটা এর পরের কয়েকদিনের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে ওঠে - পড়ে আছে বিছানার এক কোণে৷ ম্যাক্কানরা বলেন রিসর্টের একতলার কোন জানলা দিয়ে কেউ নিশ্চয় ঢুকেছিলো, মার্ক ওয়ার্নার হলিডে গ্রুপ জানায় "ফোর্সড এনট্রি"-র কোন লক্ষণ নেই৷ ম্যাক্কান পরিবারের এক বন্ধু - জেন ট্যানার - একটু দেরীতে ডিনারে এসেছিলেন - তিনি জানান রাত সওয়া ন'টা নাগাদ তিনি কাউকে দেখেছিলেন - রিসর্টের কাছাকাছি - একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে যেতে - কিন্তু তখন কোন সন্দেহ হয়নি তাঁর৷ আশেপাশের অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা এক মহিলা জানান যে তিনি কোন এক রাতে ম্যাডিকে তার বাবা-মায়ের জন্যে কাঁদতে শুনেছেন, কিন্তু সঠিকভাবে তারিখ বলতে পারেননি৷

পোর্তুগীজ পুলিশ তল্লাশি শুরু করে - দিনের পর দিন গোটা অঞ্চল খুঁজেও হদিশ মেলে না৷ পোর্তুগীজ আইন অনুযায়ী সেখানকার পুলিশকে অনুসন্ধান চলাকালীন গোপনীয়তা বজায় রাখতে হয়, কাজেই পুলিশের কাছ থেকে মিডিয়া কোন খবর পায় না৷ ওদিকে সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশ প্রথমে রবার্ট মুরাট নামে এক ব্রিটিশ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে - ভদ্রলোক ঐ অঞ্চলেই থাকেন - ব্রিটিশ অরিজিন হলেও এখন পোর্তুগালের বাসিন্দা - তাঁকে পুলিশের মনে হয়েছিলো "ওভার-এন্থুসিয়াস্টিক" - মুরাটের বক্তব্য তিনি কেট এবং জেরিকে সাহায্য করছিলেন পুলিশের সাথে কথোপকথনে - ঐ অঞ্চলের বাসিন্দা হিসেবে, এবং ইংরিজী-পোর্তুগীজ দুটৈ জানার সুবাদে৷

টিভি-রেডিও-ইন্টারনেটে অ্যাপীল হয় - দেশে-বিদেশে ম্যাডিকে দেখা যেতে থাকে - কখনো স্পেনে, কখনো মরক্কোয়৷৷৷ কিন্তু মেয়েটার খোঁজ পাওয়া যায় না৷ দিন যায় - সপ্তাহ, মাস৷৷৷ অ্যাপীলের পরিধি ক্রমশ: বাড়ে - আরো বিখ্যাত ব্যক্তিরা নামেন - ডেভিড বেকহ্যাম, রিয়াল মাদ্রিদের অন্যান্য তারকারা টিভিতে অ্যাপীল করেন৷ ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের কিছু খেলার আগে খেলোয়াড়দের গায়ে "ব্রিং ম্যাডি হোম" সম্বলিত টিশার্ট দেখা যায়৷ ফাইণ্ডম্যাডেলিন বলে ওয়েব সাইট তৈরী হয়, ফাণ্ড রেইজিং চলে৷৷৷ কেট এবং জেরি ব্লগ লেখেন৷৷৷ এই অবিশ্বাস্য PR ক্যামপেন পীকে ওঠে যখন কেট এবং জেরি পোপের সঙ্গে দেখা করেন - ম্যাডির ছবিতে হাত রেখে পোপ বেনেডিক্ট বলেন যে তিনি ম্যাডির জন্য প্রার্থনা করবেন৷

শুরুর পরের কথা - দিন কাটে, ম্যাডির "সাইটিং" চলতেই থাকে বিভিন্ন দেশে, কিন্তু ম্যাডি নিখোঁজই থাকে৷ পোর্তুগীজ পুলিশ ব্রিটিশ ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের সাহায্য নেয় - ব্রিটিশ পুলিশ সাথে শিক্ষিত কুকুর নিয়ে প্রায়া দ্য ল্যুজে পৌঁছয় তদন্তের জন্যে৷ বার্মিংহ্যামের ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা শুরু হয়৷ তদন্তে কি হচ্ছে কেউ জানতে পারে না - অথচ খবর তো চাই - মিডিয়া প্রায়া দ্য ল্যুজে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে - খবরের আশায়৷ ম্যাক্কানরা কি করছেন, কোন চার্চে যাচ্ছেন সেগুলৈ ট্যাবলয়েডে জায়গা পেতে থাকে৷ এবং আস্তে আস্তে এর মধ্যে জায়গা করে নেয় গসিপ৷ কিছু পোর্তুগীজ মিডিয়ার কল্যাণে, কিছু এদেশীয় ডেইলি মেইল বা ডেইলি মিরর জাতীয়দের কল্যাণে৷

ফরেনসিক পরীক্ষার পুঙ্খানুপুঙ্খ রেজাল্ট জানা না গেলেও আকারে ইঙ্গিতে বেশ কিছু "ডিস্টার্বিং" খবর বেরোতে শুরু করে৷ দুটি কুকুরের মধ্যে একটি - যেটি রক্ত এবং "বডি ফ্লুইড"-এর গন্ধ পায় - সেটি ম্যাক্কান পরিবারের ভাড়া করা রেনো সীনিকের বুটের সামনে অতিরিক্ত অ্যাক্টিভ হয়ে ওঠে৷ আরেকটি, যেটি মৃতদেহের গন্ধ চিনতে পারে, সেটি কেট ম্যাক্কানের শরীরে গন্ধ পায় বলে জানা যায়৷ সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হল এই রেনো সীনিকটি ম্যাক্কান পরিবার ভাড়া করেন ম্যাডেলিন হারিয়ে যাওয়ার পঁচিশদিন পর৷ এই সমস্ত মেটিরিয়াল পরীক্ষা হয় বার্মিংহ্যামে, পুরো ফলাফল পোর্তুগীজ পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়৷ ব্রিটিশ মিডিয়ায় কেট ম্যাক্কান আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে পুলিশ কেট এবং জেরিকে ফাঁসাতে চাইছে৷ দিন দুয়েকের মধ্যে পোর্তুগীজ পুলিশ কেটকে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে - প্রায় দশ ঘন্টা ধরে - শেষে অফিসিয়ালি কেট এবং জেরিকে "arguido" - অর্থাৎ "অফিসিয়াল সাসপেক্ট" হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷ "arguido"- যে শব্দটার কথা লিখেছিলাম শুরুতেই৷

২২১বি বেকার স্ট্রীট তো এদেশেই৷ কাজেই টিভির পর্দায় খবর শুনে আর ট্যাবলয়েডের প্রথম পাতায় লেখা পড়ে দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষের মধ্যের সুপ্ত শার্লক হোমস জেগে ওঠে৷ ধোঁয়া দেয় ট্যাবলয়েড৷ সিডেটিভের ওভারডোজ, বেশি ডোজের ক্যালপল - ইত্যাদি নানারকম হেডলাইন দেখেছি ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডের প্রথম পাতায় - সকলের খবরই নির্ভরযোগ্য সুত্রে পাওয়া৷ কেট ম্যাক্কানের ডায়েরী একটা বহুচর্চিত বিষয় হয়ে ওঠে - কেট সেখানে ম্যাডেলিনকে নিয়ে নানা রকম সমস্যার কথা নাকি লিখেছেন - লিখেছেন তিনি একা ম্যাডেলিনকে সামলাতেন, ম্যাডেলিন অনেক সময়েই কথা শুনতো না, ঘরের কাজে জেরি বিন্দুমাত্র সাহায্য করতেন না - ইত্যাদি৷ সেনসেশন তৈরীতে পিছিয়ে থাকা সম্ভব নয় - সেনসেশনই কাগজের বিক্রী বাড়ায় - একদিন নিউজএজেন্টের তাকগুলো ছেয়ে গেলো "ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড"-এর বিশাল সাইজের হেডিংএ - "Police Framing Maddy Mother"- জনৈক লিওনার্ডো সিলভা পোর্তুগীজ পুলিশের হাতে তাঁর স্ত্রীর হ্যারাসমেন্টের কথা বলেছেন - ওঁর স্ত্রীকে নাকি তাঁদের মেয়েদের খুন করার অভিযোগে জেলে পাঠানো হয়েছে - এবং সেই একই ডিটেকটিভ ম্যাডেলিনের কেসেও তদন্ত করছেন৷ লিওনার্ডোর বক্তব্য ওঁর স্ত্রীর ওপর অত্যাচার করে তাঁকে দিয়ে স্বীকারোক্তি বানানো হয়েছিলো, ওঁর ভয় কেট ম্যাক্কানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে৷ আরো খবর বেরোয়৷ পোর্তুগীজ পুলিশকে ভিলেন বানিয়ে, ম্যাক্কানদের ভিলেন বানিয়ে, ফরেনসিক সায়েন্সকে ভিলেন বানিয়ে - রাতারাতি গোটা যুক্তরাজ্যের লোকে পোর্তুগীজ আইন এবং ফরেনসিক সায়েন্সে এক্সপার্ট হয়ে ওঠে৷ খবর বেরোতে থাকে৷ ম্যাক্কানরা পোর্তুগাল ছেড়ে লেস্টারে ফিরে আসেন৷ PR ক্যাম্পেন চালু থাকে - প্রাক্তন বিবিসি রিপোর্টার ক্ল্যারেন্স মিচেল ম্যাক্কানদের অফিসিয়াল স্পোকসম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেন - ফরেন অফিসের চাকরি ছেড়ে৷ ভার্জিন মিডিয়ার বস স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন থেকে শুরু করে আরো কিছু নামকরা লোক ম্যাডেলিন ক্যাম্পেনের পিছনে দাঁড়ান৷

ম্যাডেলিনকে এখনো পাওয়া যায়নি৷ পোর্তুগীজ পুলিশ সমস্ত ডকুমেন্ট তুলে দিয়েছিলো এক ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নীর হাতে, সেখান থেকে সব পৌঁছয় এক জাজের হাতে - কেট এবং জেরিকে চার্জশীট দেওয়া হবে কিনা - তার জন্যে৷ জাজের সিদ্ধান্তে এই মুহুর্তে চার্জশীট দেওয়া হয় না, তদন্ত চলতে থাকে৷ ম্যাডেলিন নিখোঁজ আজ ১৬১ দিন৷

=========================================================

হয়তো কোনদিনই মেয়েটাকে পাওয়া যাবে না৷ হয়তো বা সেই অন্য মেয়েটার মতন বেশ কিছু বছর বাদে ফিরে আসবে সে৷ হয়তো ম্যাডেলিন মারাই গেছে - হয়তো সিডেটিভের ওভারডোজেই - বা হয়তো কোথাও লুকিয়ে থাকা কোন পিডোফাইল তুলে নিয়ে গেছে৷৷৷কি হল ম্যাডেলিনের তা হয়তো জানা যাবে না - হয়তো যাবে৷ কিন্তু ট্যাবলয়েডে বেরনো কোন খবরই আর অতটা চাঞ্চল্যকর নয় যতটা চাঞ্চল্যকর আর ডিস্টার্বিং এই গোটা ঘটনায় ট্যাবলয়েড মিডিয়ার রিয়্যাকশন বা ব্রিটিশ পাবলিকের গণহিস্টিরিয়া৷ এব ংআমার অনভ্যস্ত চোখে এই অবিশ্বাস্য বড়মাপের PR ক্যামপেন৷৷৷ বেকহ্যাম, জিদান, রাউলের মতন ফুটবল দুনিয়ার মহাতারকারা, স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন, স্বয়ং পোপ বেনেডিক্ট৷৷৷

দশই অক্টোবর ২০০৭-এর খবর - প্রতি বছর প্রায় লাখ খানেক হারিয়ে যাওয়া বাচ্চার ছবি যুক্তরাজ্যের সমস্ত মেডিক্যাল সেন্টার, জিপি ক্লিনিক, সার্জারীর ওয়েটিং রুমের টিভি স্ক্রীণে দেখানো হবে৷ এরা বা এদের পরিবারের কেউই সেলিব্রিটি হয়ে উঠতে পারেনি৷ এদের কজনের জন্যেই বা বেকহ্যামের মতন তারকা অ্যাপীল করেন৷৷৷

মূল লেখা গুরুচণ্ডা৯তে।