Friday, January 30, 2009

কলকাতা থেকে চিলিকা - ট্র্যাভেলগ

২৩শে জানুয়ারী, ২০০৯


আগের দিন প্রায় সাড়ে আটটায় বাড়ি ফিরে জলদি জলদি ব্যাগ গুছিয়ে বিছানা নিতে নিতে প্রায় একটা৷ আর ব্যাগ তো কম নয় - আমাদের দুজনের না হয় একটা একটা করে জামা কাপড়, কিন্তু আণ্ডা-বাচ্চাদের জন্যে স্যুটকেস ভর্তি৷ তায় ন্যাপি, খাবার, জল, থালা-বাটি-গেলাস (ন্যাশনাল ট্রাস্টের বেড়ানো স্পেশ্যাল ব্যাগে), দুখানা ক্যামেরার ব্যাগ ... গাড়ির ডিকি ভর্তি, সামনের সীট ভর্তি, পিছনের সীট সুমনা, ঋতি আর ঋককে নিয়ে ছটা নাগাদ রওনা দিলুম৷ তখনও ঘুম পাচ্ছে - চারটের সময় উঠেছি বলে৷ গাড়ির ট্যাঙ্ক ভর্তি করে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে বম্বে রোড ধরতে প্রায় সওয়া সাতটা৷ তখনও ট্যুরিস্টের দল বেরোয়নি, রাস্তা প্রায় ফাঁকা - এক ঘন্টার কম সময়ে কোলাঘাট পৌঁছে প্রথম দাঁড়াতে হল৷ একটা ওয়ানওয়ে ব্রীজ বলে দুদিকের গাড়ি দাঁড় করিয়ে একদিক একদিক করে ছাড়ে৷ এবং রীতিমতন চা-সিঙাড়া-ঝালমুড়ি-ভেলপুরির বাজার বসে গেছে ওখানে৷ ওখানেই চা খেলুম৷ সকাল বলে আধ ঘন্টার বেশি দাঁড়াতে হয়নি৷ কোলাঘাট পেরিয়ে ফের ফাঁকা রাস্তা৷ খড়গপুর থেকে এনএইচ-৬০ ধরে বালেশ্বরের দিকে - সেও ফাঁকাই৷ এবং বিদেশের মতন কংক্রীট রাস্তা৷ নটা নাগাদ বেলদা পৌঁছে একটা ধাবায় (তারা তখনও সামনের দালান ধুচ্ছে) ব্রেকফাস্ট হল - পুরি/তরকারি৷ বেলদা থেকে বেরিয়ে দাঁতন পেরোলে উড়িষ্যা শুরু, প্রথম হল্ট জলেশ্বর - সেখানে একটা ট্যাক্স গুমটি আছে - যেখানে উড়িষ্যা সরকার "ডাকাতি" করে৷ প্রাইভেট গাড়ির একমাসের কম সময়ে কোথাও গেলে রোড ট্যাক্স দেওয়ার কথা নয়৷ কিন্তু উড়িষ্যা সরকার তিন/চার দিনের জন্যে গেলেও ছয় মাসের ট্যাক্স নেয়৷ টিম-বিএইচপি তে এর উল্লেখ দেখে আমিও অনেকক্ষণ বাওয়াল দিলাম - সাথে পশ্চিম বঙ্গ থেকে যাওয়া আরো অনেক গাড়ির লোক৷ কিন্তু OMVD -র লোকটা বেশ পোক্ত লোক - কন্টিনিউয়াস খিস্তি খেয়েও দিব্যি ঠাণ্ডা মাথায় হেসে হেসে বলে গেলো "নহি, ইয়ে রুল হ্যায়, আপকো দেনা হ্যায" এটসেটরা এটসেটরা৷ আস্তে আস্তে সবাই দিতে শুরু করলো বলে আমাকেও দিতে হল - কিন্তু আমি ওদের রুলের কপি নিয়ে এসেছি, লোকটার নাম/ডেজিগনেশন সহ - ভাবছি একটা পিআইএল ফাইল করবো৷ যাই হোক - ওখানে বাওয়াল দিতে গিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক নষ্ট হল৷ জলেশ্বর থেকে বেরোতে বেরোতে এগারোটা৷ বালেশ্বর থেকে খারাপ রাস্তা শুরু - তবে খুব খারাপ নয় - যশোর রোডে গাড়ি চালানো অভ্যেস থাকলে বালেশ্বর থেকে ভদ্রকের ষাট কিমি রাস্তা এমন কিছু খারাপ মনে হবে না - শুধু খান তিরিশেক ডাইভার্সন আছে৷ এবং গোটা উড়িষ্যায় ফোর-লেন হাইওয়ে দেখলে মনে হবে দুটো দুই লেনের রাস্তা পাশাপাশি চলছে - দুদিকেই আপ-ডাউন গাড়ি চলছে নিয়মের তোয়াক্কা না করে৷ ভদ্রক ছাড়িয়ে ভালো রাস্তা পেয়ে ফের দৌড় - পানিকৈলি পৌঁছলাম প্রায় দুটোর সময়৷ একটা রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাওয়া হল - আলুর পরোটা আর কড়াই পনীর৷ ছেলেমেয়ে খাইয়ে বেরোতে বেরোতে সওয়া তিনটে - তখনও কটক আরো প্রায় ৪০ কিমি, তাপ্পর ভুবনেশ্বর, সেখান থেকে আরো শ-খানেক কিলোমিটার৷

এর মাঝে গাড়িতে প্রবল চিল্লামিল্লি - ঋক যে খেলনা নেবে বা বই পড়বে সেটাই ঋতির চাই, এবং উল্টোটাও৷ না পেলে ঋতি ওর পেটেন্ট চিল চিত্কারটি ছাড়ে - শুনলে কানে তালা লেগে যায়৷ একজন ঘুমোলে অন্যজনের আপত্তি - ঋক ঘুমোলে ঋতি ওর ঘাড়ের ওপর চড়ে ওকে ডাকে - ঈঈঈঈঈঈঈঈক ঈঈঈঈঈঈঈঈক করে - আর ঋতি ঘুমোলে ঋক ও কেন ঘুমোচ্ছে কখন উঠবে বলে বায়না করে৷ আর দুটো জেগে থাকলেই চেঁচায়৷ তো কটক পেরোনোর পর দুজনেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমলো - গাড়ি জুড়লো - আমার কানও৷ সুমনাও তখন প্রায় ঘুমিয়ে৷ ভুবনেশ্বর ছাড়িয়ে একটা জায়গায় দাঁড়ালাম সাড়ে পাঁচটার সময় - চা খেতে৷ সবাই তখনো ঘুমোচ্ছে৷ চা-টা খেয়ে ফের রওনা দিলাম ছটা নাগাদ, তখনও ৯০ কিমি বাকি রম্ভা পৌঁছতে, এবং বালুগাঁওয়ের পর দুই লেনের রাস্তা৷ এই জায়গাটায় কিছু পাহাড় টাহাড় পেরোতে হয় - সন্ধ্যের আলোয় দেখে মন্দ লাগলো না, কিন্তু দাঁড়ানোর সময় ছিলো না৷ বালুগাঁও পৌঁছতে পুরো অন্ধকার৷ উল্টোদিক থেকে গাড়ি/লরি/বাস আসছে পুরো হাই বিমে আলো জ্বালিয়ে - অন্যদের যে অসুবিধা হয় সেটা কেউ বোঝে না (খোদ কলকাতাতেও কেউ বোঝে না)৷ এইরকম কেসে নিজের হেডলাইটটা অল্প ফ্লিক করলে ভালো ড্রাইভার তার হেডলাইট নামিয়ে নেয়, কিন্তু সেরকম লোকের সংখ্যা খুব কম৷ একটা ট্রাক ওরকম ভাবে আসছিলো - ফ্লিক করলাম - তো পুরো মাঝখানে এসে চেপে দিলো৷ পাশ দিতে গিয়ে আমাদের চাকা রাস্তা থেকে ইঞ্চি ছয়েক নেমে গিয়ে তলায় বেশ জোরে ঘষা খেলো - আরো নীচু হলে উল্টেই যেত হয়তো৷ যাই হোক - ঐ রাস্তায় সাবধানে চালিয়ে রম্ভা পৌঁছলাম পৌনে আটটায়৷ সব মিলিয়ে পৌনে চোদ্দ ঘন্টা, মাঝে চার ঘন্টাটাক দাঁড়িয়ে, টোটাল দূরত্ব ৫৯০ কিমি৷

রম্ভার পান্থনিবাসটা বেশ ভালো - লোকজন ভালো, পরিস্কার ঘর, বেশ বড় বারান্দা লেক সাইডে৷ বেশি এন্থু ছিলো না, খেয়েদেয়েই ঘুম - সবাই মিলে৷

২৪শে জানুয়ারী, ২০০৯

মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে শুয়েছিলুম - সানরাইজ দেখবো বলে৷ ছটার সময় পিছনে সায়টিকার ব্যথা নিয়ে উঠলুম - তখন আকাশ একটু একটু পরিস্কার হয়েছে বটে, কিন্তু বেশ কুয়াশা৷ বউ নিজের ক্যামেরা নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো, আমি গেলুম লেকসাইডে৷ কিছুক্ষণ পর সূর্য উঠতে শুরু করলো৷ পান্থনিবাস থেকে সোয়েটার-মাফলার-বাঁদরটুপি পরা (তখনই অবশ্য বেশ গরম - ২০/২২ ডিগ্রী তো হবেই) বাবুরাও বেরিয়ে এলেন এবং ফ্ল্যাশবাল্ব জ্বালিয়ে সানরাইজের যথেচ্ছ ছবি তুললেন৷ এইবার প্রথম আমি ক্যামেরায় raw মোড সেট করেছিলুম, ছবিগুলো মন্দ হয়নি৷

ঘরে ফিরে চান-টান সেরে ডিম-রুটি-মাখন-জ্যাম-চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট৷ তাপ্পর গেলুম নৌকোর খোঁজ নিতে - জানা গেলো নৌকো করে ওখান থেকে পাঁচটা স্পট দেখায় - এবং কার্ডের চল নেই৷ বেলা বেড়ে গেছে বলে নৌকো চড়ে পাখি দেখতে যেতে ইচ্ছে করলো না - তাই সেটা পরের দিনের জন্যে রাখলুম৷ প্ল্যান হল রম্ভা থেকে সতপড়া চলে যাবো - সেখান থেকে নৌকো করে ডলফিন স্পট৷ আগে একবার বালুগাঁও যেতে হল ক্যাশ তোলার জন্যে - তাপ্পর সতপড়ার দিকে যেতে যেতে এগারোটা - বালুগাঁও গিয়ে ফিরতে ফিরতে প্রায় দেড় ঘন্টা নষ্ট৷

এনএইচ-৫ থেকে একটা ছোট রাস্তা চলে গেছে সতপড়ার দিকে - পালুর জাংশন বলে একটা জায়গা থেকে৷ সেই রাস্তায় ঢুকে কিছুদূর এগোতে শুরু হল গ্রাম - আর সে কি গ্রাম - সেই ছোট্টবেলায় বীরভূমের রামনগরের পর এমন গ্রাম দেখিনি৷ সেই গ্রামের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে ... গাড়ি টাড়ি ঐ রাস্তায় খুব একটা মনে হয় যায় না - কারণ লোকজন বেশ অবাক চোখে তাকাচ্ছিলো৷ অনেক এঁকেবেঁকে অনেক লোককে জিগিয়ে রাস্তার শেষ প্রান্তে পৌঁছনো গেলো - সেখান থেকে সতপড়া পাঁচ কিলোমিটার - কিন্তু জলপথে৷ কাজেই আর কিছু করার নেই৷ গাড়ি পার হবার নৌকো আসবে ফের দু ঘন্টা পর৷ তাই একটা লোকাল নৌকো করে কিছুক্ষণ ঘোরার প্ল্যান হল৷ সেই মাঝির আবার কার সাথে "ডিসপিউট" আছে (মাঝির ভাষায়) - বেসিক্যালি ঝগড়া আছে - তাই উল্টোদিকে "রাজহংস" বলে একটা দ্বীপে নিয়ে গেলো - সেখানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা বাংলো আছে - আর একটা নির্জন বীচ - সেখানে একটা কাগজের টুকরোও কেউ দেখতে পাবে না এত পরিস্কার - এমন ফাঁকা বীচ আমি কখনো দেখিনি - শুধু আমরা সাড়ে তিনজন লোক, আর শুধু হলুদ বালি, আর হলুদ হলুদ কাঁকড়া - সেগুলো আবার প্রচণ্ড লাজুক - পায়ের আওয়াজ পায় কিনা জানি না, কুড়ি ফুটের মধ্যে গেলেই দুদ্দুড় করে পালায়৷ একটা ঢেউ এসে ঋকের জুতো-প্যান্ট ভিজিয়ে দিয়ে গেলো, আর ঢেউ দেখে ঋতি জুড়লো কান্না - সম্ভবত: জলটা ওর দিকে আসছে বলে৷ মায়ের কোল থেকে তাকে কিছুতেই নামানো গেলো না৷

ওখানে কিছুক্ষণ থেকে ফের নৌকো করে ফেরা - সূর্যাস্তও দেখলুম নৌকো থেকে৷ প্রথমদিনে চিল্কায় দেখার মতন মিললো শুধু সূর্য - আর কিচ্ছু না - মাঠের মধ্যে হাঁটুজল ছাড়া৷ আর রাজহংসের ঐ নির্জন বীচটা ছাড়া৷ অন্ধকারের মধ্যে ঐ প্যাঁচানো রাস্তা পেরিয়ে পান্থনিবাস ফিরতে ফিরতে রাত আটটা - তারপর রুটি, আলুভাজা, ডাল আর মাছের কারি দিয়ে ডিনার সেরে ঘুম - পরেরদিন সকালে ছোট্ট করে নৌকোয় পাখি দেখে কোনারকে চলে যাবার প্ল্যান করে৷

ঋতি বেশ পেটুক হয়েছে (আমার মতন)৷ বালুগাঁওয়ে একটা দোকান থেকে কিছু বালুসাই কিনেছিলুম, দুপুরে খাবার জন্যে - ঋতি একটা পুরো খেয়ে বল্ল "দেএএএএ' - মানে আরেকটু চাই৷ তখন তো শেষ হয়ে গেছে - সেটা বলতে মাথা দুলিয়ে বল্ল "আন্নেইইইই' - মানে আর নেই, কিন্তু আরেকটু পেলে বেশ হত৷

২৫শে জানুয়ারী, ২০০৯

এদিনও ভোরে উঠে আগে চান-টান করে সবাই রেডি হল৷ ডিম-রুটি-মাখন-চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে একটা স্পীডবোটে করে বেরোন হল কাছাকাছির স্পটগুলো দেখার জন্যে৷ স্পীডবোটটাকে প্রথমে লগি দিয়ে ঠেলে বেশ কিছুটা নিয়ে যেতে হয় - নইলে জলের নীচে মাটিতে প্রপেলার ঠেকে যাবে৷ তারপরেও জলটা আদৌ গভীর নয় - দিব্যি তলা দেখা যায়, তবে কোমর, বড়জোর বুক সমান জল বলে স্পীডবোট চলতে পারে৷ ব্রেকফাস্ট আইল্যাণ্ড - রাজামহারাজাদের প্রাতরাশের জন্যে একটা ছোট্ট বাড়ির মতন, জলের মধ্যে৷ একটা দ্বীপের মধ্যে কিছু গুহা, তাতে ঠাকুর-টাকুরও আছে৷ তাপ্পন বার্ড-আইল্যাণ্ড, সেখানে একটাও পাখি নেই৷ জলের মধ্যে কিছু পাখি দেখা গেলো, স্পীডবোটের আওয়াজে সব হুশ হুশ করে উড়ে যাচ্ছিলো৷ স্পীডবোটের লাফানির চোটে ভালো করে ক্যামেরাও ধরা যাচ্ছিলো না৷ পাখি দেখার জন্যে চিল্কা যাওয়ার কোনো মানে হয় না - ভরতপুর ইত্যাদিতে মনে হয় ঢের বেশি পাখি আসে৷ নিউক্যাসলে থাকাকালীন সী-হাউজেজ আর ফার্ন আইল্যাণ্ডে আমরা এমন পাখি দেখেছি যে সেখানে দ্বীপের মাটি পুরো ঢেকে থাকে নানারকম পাখির ভীড়ে - এখানে কিছু সীগাল আর অন্য কি একটা টাইপের পাখি৷

স্পীডবোট থেকে নেমে তাড়াতাড়ি ঘর খালি করে সাড়ে নটা নাগাদ রওনা দিলাম কোনারকের দিকে৷ প্ল্যান ছিলো খুরদা রোড থেকে পুরী/কোনারকের রাস্তা নেবো - কিন্তু পান্থনিবাসের লোকে বল্ল খুরদা রোডের আগেই একটা বাইপাস আছে, সেটা দিয়ে যাওয়া যায়৷ সেখানে লোকজনও বল্ল ঐ পথে পুরী/কোনারক যাওয়া যায় - কিন্তু কি কুক্ষণেই যে ঐ পথে গেছিলুম ...

রাস্তা বলতে সেখানে কিছু নেই৷ আছে শুধু গর্ত, অধিকাংশই ফুটখানেক গভীর, আর গর্তের মাঝে মাঝে অল্প পীচ - কখনো পীচের রাস্তা ছিলো সেটা জানানোর জন্যে৷ মুজতবাকে শেখ আহমদ আলী কেন পাগড়ি বেঁধে দিয়েছিলেন তার ফার্স্ট হ্যাণ্ড এক্সপিরিয়েন্স হল আর কি - পাগড়িটাই শুধু ছিলো না৷ ঘন্টায় বিশ কিলোমিটারের বেশি যাবার উপায় নেই, যেটুকু যাবে সেটুকুও নৌকোর মতন দুলতে দুলতে, কখনো প্রায় একদিকে কাত হয়ে ... এইরকম করে প্রায় ৬০ কিলোমিটার৷ তারপর পুরীর রাস্তাটা পাওয়া যায় যেটা খুরদা রোড থেকে পিপিলি হয়ে আসছে৷ সেই পথে পুরীর অল্প আগে থেকে কোনারকের দিকের মেরিন ড্রাইভটা ধরা যায় - সেদিক দিয়ে গিয়ে কোনারক পৌঁছলাম প্রায় সাড়ে তিনটের সময়৷

কি অসম্ভব ভীড় কোনারকে - আমি অনেক ছোটবেলায় গেছিলাম, ক্লাস ফোরে পড়ার সময় - যদ্দুর মনে আছে বেশ ফাঁকাই ছিলো৷ কিন্তু এখন পুরো কালিঘাটের মতন ভীড়৷ শান্তিতে একটা ছবি তোলার উপায় নেই, কেউ না কেউ এসে যাচ্ছে৷ তিন ঘন্টা ধরে অ্যাটেম্পট নিয়েও সূর্যমূর্তিটার ছবি তুলতে পারিনি৷ একজন গাইড নেওয়া হয়েছিলো - কোনো দরকার ছিলো না তাও - সে তো আমাকে আলাদা করে ডেকে বিশেষ কিছু মূর্তি দেখাতেই ব্যস্ত ছিলো, আর বার দুয়েক বল্ল তেনাকে এক্সপ্লেইন করে দিতে৷ আর ঋতি আর ঋক - দুজনে একটু দৌড়বার মতন ডাঙা পেয়ে কি দৌড় করালো আমাদের দুজনকে ...

কোনারকের যাত্রীনিবাসটা অতীব যাচ্ছেতাই৷ ঘরগুলো বেশ নোংরা, অথচ রম্ভার পান্থনিবাসের দ্বিগুণ ভাড়া৷ বাথরুমে সব কিছু ভেঙে পড়তে পারে যেকোনো সময়ে৷ দুকাপ চা বল্লাম, সে ভুল করে অন্য ঘরে চলে গেলো না কি হল - পাওয়া গেলো না৷ নটার সময় রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাবার অর্ডার দিলাম, কুড়ি মিনিটের জায়গায় সেই খাবার এলো দশটার সময় - ততক্ষণে ঋতি ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ঋককে জাগিয়ে রাখার জন্যে রেস্তোরাঁর টিভিতে কার্টুন নেটওয়ার্কে হ্যারি পটার দেখাচ্ছিলাম - এক বাঙালী বাবুবিবি এসে অতগুলো বাচ্চা হ্যারি পটার দেখছে দেখেও গম্ভীরভাবে স্টারপ্লাসে একটা কিছু অ্যাওয়ার্ড সেরিমনি দেখতে শুরু করলেন৷ ওর মধ্যেই খেয়ে দেয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে প্রায় এগারোটা৷ পরের দিন বাড়ি ফেরা - প্ল্যান হল সকাল সকাল বেরোতে পারলে ভুবনেশ্বরে লিঙ্গরাজ মন্দির দেখে ফিরবো৷

২৬শে জানুয়ারী, ২০০৯

যাত্রীনিবাস ছাড়ার আগে কমেন্ট বুকে সব পুওর দিতে রিসেপশনের লোক জিগ্গেস করলো - তাকে একচোট ঝেড়ে সব গুছিয়ে বেরোতে বেরোতে আটটা৷ ফেরার পথে সেরকম কিছু বলার নেই তেল নিয়ে গোলমাল ছাড়া৷ ন্যাশনাল হলিডে বলে রীতিমতন বড় নোটিশ লাগিয়ে সব পেট্রোল পাম্প বন্ধ করে দিয়েছে, অথচ পাম্পের সামনে পুলিশের চোখের সামনে বোতল/জেরিক্যানে ভরে পেট্রোল বিক্রি হচ্ছে - অনেক বেশি দামে, এবং লোকে বাধ্য হয়ে কিনছে৷ অথচ এটা নাকি এমার্জেন্সী সার্ভিস - তাই ন্যায্য দাবিতে লোকে স্ট্রাইক করলে এসমা দিয়ে স্ট্রাইক ভাঙা হয়, অথচ ন্যাশনাল হলিডেতে পাম্প বন্ধ রেখে তেল ব্ল্যাক করাকে তোল্লাই দেওয়া হয়৷

৬০ কিমির মধ্যে এসি বন্ধ রেখে গাড়ি চালিয়ে ভুবনেশ্বর পৌঁছলাম পৌনে দশটা নাগাদ৷ লিঙ্গরাজ মন্দিরে ক্যামেরা, মোবাইল কোনো কিছু নিয়ে যাবার নিয়ম নেই৷ কাজেই ছবি তোলা হয়নি - অথচ অসাধারণ কিছু মূর্তি রয়েছে৷ চোখে দেখেই চলে আসতে হল৷ বেরিয়ে আসার সময় সেই নোটিশটা চোখে পড়লো - অহিন্দুদের মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ - ওখানেই বেশ রেসিস্ট ইত্যাদি বলে দিলুম বলে লোকজন বেশ তাকালো৷ তারপর ঐভাবেই আসতে আসতে কটক ছাড়িয়ে আরো এগিয়ে দেখলাম কিছু পাম্পে তেল দিতে শুরু করেছে - সম্ভবত ন্যাশনাল হাইওয়ে বলেই৷ সেরকমই একটা পাম্প থেকে তেল নিয়ে পুরোদমে ফের চলা শুরু৷ সেই গাড়ির মধ্যে চেঁচামেচি, ঈঈঈঈঈঈঈক ইত্যাদি, একটু আধটু কান্নাও - ঐ করতে করতে সন্ধ্যেবেলা সাতটা নাগাদ কোলাঘাটে পৌঁছে পেল্লায় জ্যাম - প্রায় ঘন্টাখানেক৷ সেখান থেকে বেরিয়ে একটা ধাবায় দাঁড়িয়ে রুটি-তরকা খেয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে নটা৷ নিশ্চিন্ত৷ টোটাল ট্রিপ - ১৪৬৭ কিলোমিটার, পরের ট্রিপ কোথায় ভাবতে হবে৷