শ্মশানে চোদ্দটা মড়া, সেগুলোর ওপরে বসে জনাকয়েক তান্ত্রিক - হাতে মদের ভাঁড়, মড়াগুলোর চারদিকে ঘুরে ঘুরে নেচে বেড়ায় নন্দী-ভৃঙ্গি-ডাকিনী-যোগিনীরা - ঠিক এটাই গত কয়েকদিনের ইতিহাস৷ ১৪ই মার্চের নন্দীগ্রাম, ও অত:পর...
কি হয়েছিলো, কতজন পুলিশ ছিলো, কতজন গ্রামবাসী ছিলো, কজন মরেছে, কজন ঘায়েল, কজন নিখোঁজ - এসবের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব হাতুড়ি দিয়ে দিয়ে মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে আমাদের সেনসেশনাল মিডিয়া৷ অন্যদিকে গলা ফাটিয়ে শোনা গেছে গত আড়াই মাসের কাহিনী - ক'জন ঘরছাড়া, ক'জন ধর্ষিতা, ক'জন...আর একইসময় ওই মড়াগুলোর চারদিকে ঘুরতে দেখেছি আরো এক শ্রেণীর প্রাণীকে - দেখে মনে হয়েছে তারা অপেক্ষা করছে মড়াগুলো কখন গলতে শুরু করবে সেই জন্যে...অনেকগুলো মড়া...বিরাট ভোজ...
ঘটনার অল্পক্ষণ পরেই সিপিএম পলিটব্যুরো থেকে বিবৃতি দেওয়া হয় - "For two and a half months five gram panchayats in Block I of Nandigram have been out of bounds for the administration. Certain elements had resorted to violence and cut off roads and bridges in the area on the pretext of land acquisition.CPI(M) members and supporters were driven out of the area. Two thousand and five hundred people were driven out of the area. More than a thousand people are sheltering in relief camps outside the area. Even after the government categorically declared that no land is being acquired in Nandigram, the Trinamul, naxalite and other elements refused to allow the administration or police into the area. Those who did not go along with their disruptive activities were targeted. Only a few days ago a woman, Sumita Mandal, was raped and killed. The repeated efforts to have meetings so that peace can be resorted were rebuffed with these parties and elements refusing to attend the meetings. Finally, after an all-Party meeting, which was boycotted by the Trinamul Congress, a decision was taken that the administration must reestablish its authority and peace be resorted in the area. The police entered Nandigram to see that the roads, culverts and bridges are repaired and the administration restored. They were attacked by brickbatting, bombs and use of pipe guns. It is regrettable that lives have been lost in police firing. But the organised elements who utilised bombs and pipe guns on the police have to take the blame."
১৯৪৮-এও সেটা ছিলো বসন্তকাল৷ সেই মার্চমাস৷ সেই বাংলা, শুধু একটা দলের জায়গাটা উল্টে গেছে - receiving end-এ আর নয়৷ হাসি আর তাতা যখন ছোট ছোট হাতে রক্ত মোছে তখন রাজর্ষি আর বলেন না "আয় মা, আমিও মুছি" - বরং যুক্তি দেন কেন এই রক্তপাত - তিরিশ বছরটা অনেক সময় de-humanize হওয়ার জন্যে৷ অন্ধকারে পুলিশের বুটের আওয়াজের আড়ালে একটা সময় আরেকদল গুণ্ডা আসতো এলাকা দখল করতে - সেই সব দিনগুলোর কথা যখন আমি খুবই ছোট - শোনা কথা, পড়া কথা৷ তিরিশ বছর পর সেই দিনগুলোই ফিরিয়ে আনলাম? আজ আমার হাতেও রক্ত লাগলো?
এই প্রশ্নগুলো উঠতে উঠতেই চোখে পড়ে যায় ওই অন্য প্রাণীগুলোকে...চোদ্দটা মড়া ভোজসভায় কম পড়বে? তাই সংখ্যা বাড়তে শুরু করে...বিশ...চল্লিশ...একশো...দুশো...নিলামের দরের মতন৷ অবজেক্টিভিটিহীন "তথাকথিত" আঁখো-দেখা হাল চলতে থাকে - "পাশেই হরিপুর সাবডিভিশন যেটা নিউক্লিয়ার পাওয়ারপ্ল্যান্টের জন্যে চিহ্নিত৷ সেখানেও প্রতিবাদ হয়েছে৷ সেখানকার মানুষ মূলত: মাছ ধরে৷ তাদের মাছ ধরা এখন বন্ধ করতে হয়েছে দুটো কারণে৷ এক, খাঁড়ি আর সমুদ্র মৃতদেহে ভরে আছে৷ আর দুই, আরও খারাপ যেটা, হাঙর, কুমীর আর ঘড়িয়ালরা তাজা রক্তের লোভে সুন্দরবন থেকে এইদিকে চলে আসছে..."
হাঙর-কুমীর নয়, আমি স্পষ্ট দেখতে পাই ভোজসভায় যাতে মড়ার সংখ্যা কম না পড়ে, তার চেষ্টা...সজ্ঞানে৷
আর তার পর একটা তুমুল মেরুকরণ৷ জর্জ বুশের তত্ত্বটা যে আমাদের মধ্যে কতটা খাটে টের পেলাম৷ দুদিকেই দেখতে পাই তার ছাপ - "ইফ ইউ আর নট উইথ আস, ইউ আর এগেইনস্ট আস" - স্বাভাবিকভাবে জেগে ওঠা কিছু প্রশ্ন করলে বা জালিয়ানওয়ালাবাগ অথবা জেনারেল ডায়ারের সাথে তুলনাকে বাড়াবাড়ি বললে আপনি সিপিএমের দালাল, আর অন্যদিকে পুলিশি বাড়াবাড়ি, বা লাগামছাড়া কর্মীদের ইনভলভমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন করলে আপনি মাওবাদী বা তৃণমূল৷
এক বন্ধু বললো - মড়ার ওপর বসে তর্ক হয় না - তাই চুপ থাকতে চাইলাম - অন্তত বসন্তের এই দিনটা যাদের শেষ বসন্তের দিন হল, তারা একটু শান্তিতে থাক, একটু সম্মান পাক শেষ বসন্তের দিনটাতে৷ কিন্তু প্রশ্ন বন্ধ হয় না মনের মধ্যে - বিশেষ করে যখন দেখি শোকমিছিলের আড়ালে অঙ্ক কষা চলে - যখন দেখি গুজব ছড়ায়, যার কোন প্রমাণ হয়তো নেই - কবর খুঁড়ে আরেকটা নাম মনে আসে৷ স্বাভাবিক প্রশ্ন করলে উত্তর আসে - "মার শালাকে, ওটা কে? শালা দালাল, সব গুলিয়ে দিতে এসেছে"৷ শিউড়ে উঠি যখন দেখি নিহত অথবা ঘাতকদের পরিচয়ের ভিত্তিতে স্থির হয় এটা গণহত্যা না গণআন্দোলন - নন্দীগ্রামের ঘটনা যাঁদের কাছে গণহত্যা, তাঁদের অনেকের কাছেই হয়তো ওই একই সময়ে ছত্তিশগড়ের ঘটনা গণআন্দোলন...বা সিপিএম কর্মীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা হল মানুষের প্রতিবাদের নমুনা...
শ্মশানে মড়ার ওপর বসে আমরা তান্ত্রিকেরা হাতে মদের ভাঁড় নিয়ে নন্দী-ভৃঙ্গির নাচ দেখি...ক্লেম-কাউন্টার ক্লেমের খেলা চলতে থাকে৷
ক্রমশ সাতটা দিন পেরোয়...
ব্যাকড্রপে আর শ্মশান নেই - ব্যাকড্রপে ওয়াইড স্ক্রীনে ত্রিনিদাদের মাঠ, ভারত-শ্রীলঙ্কার খেলা৷ মড়ার ওপর বসে নেই, বসে নরম গদির ওপর৷ হাতে মদের ভাঁড় নয়, শ্যাম্পেনের পেয়ালা৷ তান্ত্রিক থেকে উত্তোরণ হয় ক্রিকেট-বোদ্ধায়৷
আমাদের সকলের৷
(মূল লেখা এখানে। গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতার নিরিখে এই লেখাটি তৈরী। বেশ কিছু শব্দ আর দৃশ্যকল্পের জন্য ঋণস্বীকার - বৈজয়ন্ত, ইন্দ্রাণী, দুর্গা, অঙ্গনা - এঁদের কাছে)
Monday, March 26, 2007
Wednesday, March 21, 2007
নন্দীগ্রামের অ্যান্টিথীসিস
Nandigram has a direct opposite in Pune
KG Narendranath
Times News Network
Tuesday, Marsh 20, 2007
NEW DELHI: Killings in Nandigram, attributed to “forced land acquisition” by the state for special economic zones (SEZs), have an antithesis in Maharashtra. The state government could overcome the apprehensions among farmers over a multi-product SEZ proposed to be developed by Bharat Forge near Pune. The land for the proposed SEZ, which expects Rs 10,000 crore investment, has almost been acquired as farmers who initially opposed the project have now become its enthusiasts.
Unlike the West Bengal government which sent ripples down the spine of a section of farmers (this opened room for unfair political plays by the disingenuous Opposition) by notifying SEZ before lands were assembled, the Maharashtra government had shown more patience and pragmatism through which it could convince farmers that SEZ could only improve their living conditions.
The result: as opposed to the initial plan to acquire 1,400 hectares of land, the state ended up taking possession of 1,900 hectares for the zone. The farmers’ representatives, during discussions with the state and the developer, had suggested that a larger area of arid land be acquired for the economic project instead of a smaller area of cultivable land.
These lands were then made available by the farmers’ organisations themselves who could convince the owners to transfer their ownership rights to the state for reasonable compensation. The norm that the state followed was to settle the price with the land owners before SEZ is notified.
To win the support of the people in the area for SEZ, the state also offered them employment guarantee for a section of the population whose land changed hands. Already, scores of youth in the region are being trained in two ITIs in the region to make them employable in SEZ. With the farmers’ consent, the state is now confident of notifying SEZ in June, according to official sources.
A commerce ministry official told ET that 63 SEZs notified in the last one year already generated investment of Rs 13,435 crore and created 18,457 new jobs. As these SEZs become fully operational in the next two years, they would have attracted investment of Rs 58,000 crore and created 15 lakh new jobs. This is as against 19 SEZs which created 1 lakh jobs with an investment of Rs 3,613 crore until 2006, the official noted.
Of the 171 SEZ applicants who have land ready, cases of 52 have already been vetted by the law ministry and ready to be notified, absence of political nod being the only stumbling block. If all the 234 SEZ proposals, including those which are yet to get the land, become operational, the total investment in them would be over Rs 1.3 lakh crore with new jobs of 40 lakh in the next four years, according to the commerce ministry’s estimate.
KG Narendranath
Times News Network
Tuesday, Marsh 20, 2007
NEW DELHI: Killings in Nandigram, attributed to “forced land acquisition” by the state for special economic zones (SEZs), have an antithesis in Maharashtra. The state government could overcome the apprehensions among farmers over a multi-product SEZ proposed to be developed by Bharat Forge near Pune. The land for the proposed SEZ, which expects Rs 10,000 crore investment, has almost been acquired as farmers who initially opposed the project have now become its enthusiasts.
Unlike the West Bengal government which sent ripples down the spine of a section of farmers (this opened room for unfair political plays by the disingenuous Opposition) by notifying SEZ before lands were assembled, the Maharashtra government had shown more patience and pragmatism through which it could convince farmers that SEZ could only improve their living conditions.
The result: as opposed to the initial plan to acquire 1,400 hectares of land, the state ended up taking possession of 1,900 hectares for the zone. The farmers’ representatives, during discussions with the state and the developer, had suggested that a larger area of arid land be acquired for the economic project instead of a smaller area of cultivable land.
These lands were then made available by the farmers’ organisations themselves who could convince the owners to transfer their ownership rights to the state for reasonable compensation. The norm that the state followed was to settle the price with the land owners before SEZ is notified.
To win the support of the people in the area for SEZ, the state also offered them employment guarantee for a section of the population whose land changed hands. Already, scores of youth in the region are being trained in two ITIs in the region to make them employable in SEZ. With the farmers’ consent, the state is now confident of notifying SEZ in June, according to official sources.
A commerce ministry official told ET that 63 SEZs notified in the last one year already generated investment of Rs 13,435 crore and created 18,457 new jobs. As these SEZs become fully operational in the next two years, they would have attracted investment of Rs 58,000 crore and created 15 lakh new jobs. This is as against 19 SEZs which created 1 lakh jobs with an investment of Rs 3,613 crore until 2006, the official noted.
Of the 171 SEZ applicants who have land ready, cases of 52 have already been vetted by the law ministry and ready to be notified, absence of political nod being the only stumbling block. If all the 234 SEZ proposals, including those which are yet to get the land, become operational, the total investment in them would be over Rs 1.3 lakh crore with new jobs of 40 lakh in the next four years, according to the commerce ministry’s estimate.
খবরাখবর
সেই নন্দীগ্রামেই।
দুটো খবর চোখে পড়লোঃ
(১) Nandigram: CBI report points to 'outsider' role
(২) No evidence of missing persons, weapons, rape: CBI
দুটো খবরের মধ্যে অনেক তফাৎ। বিশেষ করে একটা অংশ তুলে দিচ্ছি -
টাইমস অব ইন্ডিয়া - Crucial to this finding is the significant number of .315 bore bullets seized from Sonachura and Gokulnagar. Incidentally, the CBI also unearthed a significant number of such bullets along with other arms and ammunition from Ma Janani brick kiln on Day 2 of probe.
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস - He also categorically denied the reports of the recovery of huge number of weapons and .315 inch bullets from the spot. “We recovered only one cartridge of .315 inch bullet from the spot,” he said, terming it as the “only clue” to establish the involvement of some other party other than police.
মানে???
দুটো খবর চোখে পড়লোঃ
(১) Nandigram: CBI report points to 'outsider' role
(২) No evidence of missing persons, weapons, rape: CBI
দুটো খবরের মধ্যে অনেক তফাৎ। বিশেষ করে একটা অংশ তুলে দিচ্ছি -
টাইমস অব ইন্ডিয়া - Crucial to this finding is the significant number of .315 bore bullets seized from Sonachura and Gokulnagar. Incidentally, the CBI also unearthed a significant number of such bullets along with other arms and ammunition from Ma Janani brick kiln on Day 2 of probe.
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস - He also categorically denied the reports of the recovery of huge number of weapons and .315 inch bullets from the spot. “We recovered only one cartridge of .315 inch bullet from the spot,” he said, terming it as the “only clue” to establish the involvement of some other party other than police.
মানে???
Monday, March 19, 2007
জেনোসাইড
নন্দীগ্রামের সংগঠিত হত্যা আমাদের একটা অদ্ভুত পোলারাইজেশনের সামনে দাঁড় করিয়েছে। দুদিকেই জর্জ বুশ উবাচ "ইফ ইউ আর নট উইথ আস, ইউ আর এগেইনস্ট আস" - স্বাভাবিকভাবে জেগে ওঠা কিছু প্রশ্ন করলে, বা জালিয়ানওয়ালাবাগের বা জেনারেল ডায়ারের সাথে তুলনাকে বাড়াবাড়ি বললে আপনি সিপিএমের দালাল, আর অন্যদিকে পুলিশি বাড়াবাড়ি বা লাগামছাড়া পার্টিকর্মীদের ইনভলভমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন করলে আপনি মাওবাদি বা তৃণমূল।
স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই যে আমি আপাদমস্তক সিপিএম সমর্থক, একসময়ের কর্মীও। দূরে থাকার কারণে এই দ্বিতীয় সত্ত্বাটার অবলুপ্তি ঘটে গেছে। কিন্তু তা হলেও, ১৫ই মার্চের গণহত্যার নিন্দে করতে আমার কলম কাঁপে না, দোষীদের শাস্তি দাবি করতে ঠোঁট কাঁপে না, মৃতদের সম্মান জানাতে চুপ থাকতে চাই, সত্য উদ্ঘাটনের দাবি করতে এই মুহুর্তের দোষারোপ বন্ধ করতে চাই। কিন্তু অনেক প্রশ্ন ওঠে - বিশেষ করে যখন দেখি শোকমিছিলের আড়ালে প্রোপাগাণ্ডা চলে। গুজব ছড়ায় - যার কোন প্রমাণ হয়তো নেই - চম্পলা সর্দার মনে আসে। স্বাভাবিক প্রশ্ন করলে উত্তর আসে - "মার শালাকে, ওটা কে? শালা দালাল, সব গুলিয়ে দিতে এসেছে।" বমি পায় যখন দেখি হত্যাকারী বা ঘাতকদের পরিচয়ের ভিত্তিতে মনস্থির করতে হয় - যে এটা গণহত্যা, নাকি গণআন্দোলন...নন্দীগ্রামের ঘটনাকে যাঁরা গণহত্যা বলেন, তাঁদের অনেকেই ছত্তিশগড়ের ঘটনাকে বলেন গণআন্দোলন বা নন্দীগ্রামেই সিপিএমের কর্মীকে পুড়িয়ে মারার ঘটনাকে বলেন মানুষের প্রতিবাদের নমুনা...
মানুষ হিসেবে পুরো ঘটনার প্রতিবাদ করতে দ্বিধা করিনি। সেদিন করেছি, আজও করছি, কালও করবো। কিন্তু মানুষ হিসেবেই যে প্রশ্নগুলো উঠছে সেগুলোও করবো - তাতে যদি দালালের ছাপ নিতে হয় সেটাও নেবো। শোকমিছিলের আড়াল থেকে যখন প্রোপাগাণ্ডার গন্ধ ওঠে, তার প্রতিবাদও করবো। চম্পলা সর্দার প্রসঙ্গে হাড়ে কাঁপুনি ওঠে তাঁদেরই যাঁরা সেই মিথ্যের সঙ্গী ছিলেন - এখনও তাঁদের উষ্কানির বিরুদ্ধে কথা বলবো। এর জন্যে যাঁরা বলেন "ইফ ইউ আর নট উইথ আস..." তাঁদের বলবো আয়না দেখতে।
এই মুহুর্তে আমাদের অনেকের মনোভাব হয়তো বাংলালাইভের এই "শেষ বসন্তের ডায়েরী"-র সাথে মেলে...
আর বন্ধু বৈজয়ন্তের পাঠানো লিংকে জেনোসাইডাল সোসাইটির কথা পড়ে আমারও হাড়ে কাঁপুনি ধরে। আমরা কি এই পথেই?
স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই যে আমি আপাদমস্তক সিপিএম সমর্থক, একসময়ের কর্মীও। দূরে থাকার কারণে এই দ্বিতীয় সত্ত্বাটার অবলুপ্তি ঘটে গেছে। কিন্তু তা হলেও, ১৫ই মার্চের গণহত্যার নিন্দে করতে আমার কলম কাঁপে না, দোষীদের শাস্তি দাবি করতে ঠোঁট কাঁপে না, মৃতদের সম্মান জানাতে চুপ থাকতে চাই, সত্য উদ্ঘাটনের দাবি করতে এই মুহুর্তের দোষারোপ বন্ধ করতে চাই। কিন্তু অনেক প্রশ্ন ওঠে - বিশেষ করে যখন দেখি শোকমিছিলের আড়ালে প্রোপাগাণ্ডা চলে। গুজব ছড়ায় - যার কোন প্রমাণ হয়তো নেই - চম্পলা সর্দার মনে আসে। স্বাভাবিক প্রশ্ন করলে উত্তর আসে - "মার শালাকে, ওটা কে? শালা দালাল, সব গুলিয়ে দিতে এসেছে।" বমি পায় যখন দেখি হত্যাকারী বা ঘাতকদের পরিচয়ের ভিত্তিতে মনস্থির করতে হয় - যে এটা গণহত্যা, নাকি গণআন্দোলন...নন্দীগ্রামের ঘটনাকে যাঁরা গণহত্যা বলেন, তাঁদের অনেকেই ছত্তিশগড়ের ঘটনাকে বলেন গণআন্দোলন বা নন্দীগ্রামেই সিপিএমের কর্মীকে পুড়িয়ে মারার ঘটনাকে বলেন মানুষের প্রতিবাদের নমুনা...
মানুষ হিসেবে পুরো ঘটনার প্রতিবাদ করতে দ্বিধা করিনি। সেদিন করেছি, আজও করছি, কালও করবো। কিন্তু মানুষ হিসেবেই যে প্রশ্নগুলো উঠছে সেগুলোও করবো - তাতে যদি দালালের ছাপ নিতে হয় সেটাও নেবো। শোকমিছিলের আড়াল থেকে যখন প্রোপাগাণ্ডার গন্ধ ওঠে, তার প্রতিবাদও করবো। চম্পলা সর্দার প্রসঙ্গে হাড়ে কাঁপুনি ওঠে তাঁদেরই যাঁরা সেই মিথ্যের সঙ্গী ছিলেন - এখনও তাঁদের উষ্কানির বিরুদ্ধে কথা বলবো। এর জন্যে যাঁরা বলেন "ইফ ইউ আর নট উইথ আস..." তাঁদের বলবো আয়না দেখতে।
এই মুহুর্তে আমাদের অনেকের মনোভাব হয়তো বাংলালাইভের এই "শেষ বসন্তের ডায়েরী"-র সাথে মেলে...
আর বন্ধু বৈজয়ন্তের পাঠানো লিংকে জেনোসাইডাল সোসাইটির কথা পড়ে আমারও হাড়ে কাঁপুনি ধরে। আমরা কি এই পথেই?
Friday, March 16, 2007
অন্যদিকে
নন্দীগ্রাম নিয়ে তোলপাড় যখন চলছে, ঠিক তখনই আরো একটা ঘটনা ঘটে গেছে - হয়তো আমাদের অনেকের চোখে পড়েনি - ইচ্ছাকৃতই হোক, কি অনিচ্ছাকৃত...
হিন্দুস্তান টাইমস থেকে - Fear grips Bijapur area after massacre of 50 policemen
কিন্তু এর জন্যে কেউ প্রতিবাদ করেনি - অন্তত আমি দেখলাম না। অধিকাংশেরই ধারণা হয়তো যে পুলিশ মানুষ নয়।
হিন্দুস্তান টাইমস থেকে - Fear grips Bijapur area after massacre of 50 policemen
কিন্তু এর জন্যে কেউ প্রতিবাদ করেনি - অন্তত আমি দেখলাম না। অধিকাংশেরই ধারণা হয়তো যে পুলিশ মানুষ নয়।
নন্দীগ্রাম আবার
গুরুচণ্ডা৯র পাতা থেকে একটি লেখা তুলে দিলাম। কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেটা সময়ই বলবে। ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হচ্ছে। যদি সত্যি হয়, আর কখনো মুখ খুলবো না, কিন্তু যদি মিথ্যে হয়, তাহলে তারা চ্যানেল এবং সৌমিত্র বসুকে জবাবদিহি করতে হবে মৃত্যুকে নিয়ে ঘৃণ্য ব্যবসা ফাঁদার জন্যে, আর গুরুচণ্ডা৯কেও প্রশ্ন করবো এই ব্যবসায় সঙ্গী হবার দায়ে - অরিজিৎ
___________________________________________________
নন্দীগ্রামের সেই রাত
- সৌমিত্র বসু, সম্পাদক, অন্যস্বর
এটা সেই রাতের ঘটনা৷ ১৪ই মার্চ রাত৷ দিনের বেলার "অপারেশন নন্দীগ্রাম' শেষ হবার পর রাতে সিপিএম স্থানীয়ভাবে একটি বারো ঘন্টার বন্ধ ডাকে৷ এই রকম একটি প্রত্যন্ত এলাকায়, যেখানে লোকজন এমনিতেই সন্ধ্যা হলেই ঘরে ঢুকে পড়ে, সেখানে এরকম একটি বন্ধ ডাকার অর্থ কি? দিনের আলোয় প্রথম পর্বের পুলিশি আক্রমণের পর, যখন খবর আসছিল, ৬০ জনের মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে, মানুষের মৃত্যুতে আমরা শিহরিত, আতঙ্কিত হচ্ছিলাম, তখনও জানা ছিলনা, এই গণহত্যার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পর্বটি এখনও বাকি থেকে গেছে৷ ঠিক তখনই, মহাকরণে আমাদের প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, মুখ্য সচিব এবং স্বরাষ্ট স্র্চিব এই দ্বিতীয় এবং ভয়ঙ্করতম পর্বটির পরিকল্পনা করছিলেন৷ সেই পরিকল্পনাকে কাজে পরিণত করতে বন্ধ এবং রাতের অন্ধকারের প্রয়োজন ছিল তো বটেই৷
রাত নামছিল নন্দীগ্রামে আর মৃত্যু নিয়ে সংখ্যার খেলা ততক্ষণে যথেষ্ট ধূম্রজাল সৃষ্টি করে ফেলেছিল৷ সেই ধূম্রজাল পরেও কাটেনি৷ দৈনিক স্টেটসম্যান জানাচ্ছে ৩১ জন মৃত, বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলি জানাচ্ছে ১৮ জন মারা গেছেন৷ বিবিসি সংবাদদাতা অমিত ভট্টশালী প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন ৩২ জন মারা গেছে, এবং তারপরে প্রকাশ্যেই ঘোষণা করছেন, সরকার থেকে নির্দেশের ফলে বিবিসি কেবলমাত্র সরকারি সংখ্যাটিই ঘোষণা করতে বাধ্য, তাই তাঁরা সংখ্যাটাকে ১১ই রাখছেন৷ তারা টিভির গৌরাঙ্গ, যাকে পুলিশ দিনের বেলায় আটক করে সিপিএম বাহিনীর হাতে তুলে দেয়, এবং প্রকাশ্য টিভিতে যাঁকে সিপিএম বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হতে শোনা গেছে, তিনি তাঁর "অফ-দা-রেকর্ড' বক্তব্যে মৃতের সংখ্যা ১০০+, এবং অন-দা-রেকর্ড বক্তব্যে "অগুন্তি' বলে জানাচ্ছেন৷ তারা টিভির সংবাদদাতা সুব্রত, মমতার সঙ্গে ছিলেন, তিনি জানাচ্ছেন, মৃতের সংখ্যা "অসংখ্য', কারণ কারোর পক্ষেই সঠিক সংখ্যা জানা বা বলা সম্ভব নয়৷ মহান রাজ্য সরকার এবং তার মুখপাত্র শ্রী ভোরা জানাচ্ছেন, মৃতের সংখ্যা ৬৷ এই সংখ্যাটাই তাঁকে জানানো হয়েছে, এবং তিনি প্রেসকে পরে আরও জানাবেন৷
সংখ্যা, এভাবেই কমছিল বাড়ছিল, যেন মানুষ নয়, সংখ্যার খেলা হচ্ছে৷ ইতিমধ্যে নন্দীগ্রামে বন্ধ ও সন্ধ্যা নেমেছিল যথাসময়ে৷ তারা টিভির সুব্রত এবং গৌরাঙ্গ ঘটনাস্থলে ছিলেন৷ রাতের সেই ভয়ঙ্করতম ঘটনার তারা প্রত্যক্ষদর্শী৷ এই বিবরণ মূলত: তাদেরই বিবরণ৷ ঘটনার বর্ণনার আগে সেই প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে শুনে নেওয়া যাক, সেই সেন্সরশিপের কথা, যা, সে নিজেই নিজের উপর আরোপ করেছে৷ "আমি যা দেখেছি, আমার যা বলা উচিত, আমি মিডিয়াকে সেসব বলছিনা, কারণ মানুষ বা আমাদের দর্শকরা সেসব বিশ্বাস করবে না৷ মানুষের বিশ্বাসের একটা সীমা আছে, লোকে আমাকে পাগল বলবে৷ আমি যা দেখেছি, শুনেছি, যার মধ্যে দিয়ে গেছি, নিজেই নিজেকে সেসব বিশ্বাস করাতে পারছিনা৷ দু:স্বপ্নের রাতের মতো যদি যা দেখেছি, শুনেছি, সেগুলো সত্যিই যদি প্রলাপ হত৷৷৷ '
গৌরাঙ্গ এবং সুব্রত জানাচ্ছেন, না,থেট্র বা মারধোরের কারণে নয়, সেই রাতে তাঁরা যা দেখেছেন, তার পর হোটেলের ঘরে ফিরে তাঁদের সত্যিই অনেকবার বমি করতে হয়েছে৷
""ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল্স আর কম্যান্ডোদের নিয়ে সিপিএম বাহিনী প্রত্যেকটা পাড়ায়, প্রত্যেকটা গ্রামে ঢোকে৷ পুরুষদের টেনে বার করে আনা হয়৷ ওরা কাউকে আটক করছিল না৷ কোনো বন্দী নেই, কোনো সাক্ষী নেই,ওরা গুলি করছিল,পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে নাড়িভুঁড়ি বার করে আনছিল,শরীরগুলো ভাসিয়ে দিচ্ছিল খালে, সেখান থেকে মোহনা আর সমুদ্রে৷ তারপর কমবয়সী মেয়েদের টেনে আনা হচ্ছিল, তাদেরকে ফাঁকা জায়গায় একসঙ্গে জড়ো করা হয়,ক্রমাগত ধর্ষণ করে চলা হয়, যতক্ষণ না একেকজন কোলাপ্স করে যায়, তারপর, একদম আক্ষরিক অর্থে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে আনা হয়,কাউকে কাউকে একদম টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়,তারপর হলদি নদী কিংবা তালপটি খালে ভাসিয়ে দেওয়া হয়৷ এসবের কোনো সাক্ষী টিকে নেই৷ থাকলেই বা কি,যদি কেউ বেঁচেও থাকে, মেদিনীপুরের কোন মেয়েই বা নিজের উপরে অত্যাচারের গল্প ফলাও করে বলবে, আর বললে বিশ্বাসই বা করবে কে? তাছাড়া কেউ বললে তাকেও তো একই জিনিস করে খুন করা হবে৷
এইসব শেষ হবার পর, সিপিএম আর পুলিশ তারপর গোটা এলাকা লাল ব্যানার আর পতাকা দিয়ে ঢেকে দিচ্ছিল৷ মানে, এলাকা এখন নিরাপদ আর শুধু তাদের রাজত্বই চলবে৷ যারা গ্রাম থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিল, তারা প্রায় সবাই ধরা পড়ে গ্রামের কিনারায় বা আশেপাশে৷ তাদের কি হয়েছে, কেউ জানেনা৷ আমরা শুধু তাদের কথাই শুনতে পেয়েছি, যারা মাঠ আর জঙ্গল পেরিয়ে পালাতে পেরেছে৷ সেটাও খুব কঠিন৷ এখন মাঠ শুকনো৷ ফসল কাটা হয়ে গেছে৷ মাঠের উপর দিয়ে গেলে যে কেউ দেখতে পাবে৷
অসংখ্য ধর্ষণ হয়েছে৷ সরকারি ভাবে ধর্ষণের সংখ্যা ৬, কারণ, এই কজনই নিজেদের গল্প বলার জন্য টিকে আছে৷ এরা সবাই মধ্যবয়সী, সেই কারণেই হয়তো কেটে কুচিকুচি হবার হাত থেকে কোনোভাবে বেঁচে গেছে৷ গ্রামের পর গ্রামে এই জিনিস চলেছে৷ রাত পেরিয়ে সকালেও চলেছে৷ সমস্ত সাংবাদিকদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ দৈনিক স্টেটসম্যানের সাংবাদিক সুকুমার মিত্র বুলেটবৃষ্টির মধ্যে কোনোরকমে পালিয়েছেন৷ ওনাকে নাম ধরে, বিশেষ করে খোঁজা হচ্ছিল, কোনো কায়দায় উনি পালাতে পেরেছেন৷ আক্রমণকারীরা এতো হিংস্র, যে স্থানীয় কোনো লোক কারো কাছে মুখ খুলতে চাইছে না৷ ভয়কে একটা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ আতঙ্ককে ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক সেন্সরশিপের একটা পদ্ধতি হিসাবে৷
পাশেই হরিপুর সাবডিভিশান৷ যেটা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য চিহ্নিত৷ সেখানেও প্রতিবাদ হয়েছে৷ সেখানকার লোকেরা মূলত: মাছ ধরে৷ তাদের মাছ ধরা এখন বন্ধ করতে হয়েছে দুটো কারণে৷ এক, খাঁড়ি আর সমুদ্র মৃতদেহে ভরে আছে৷ দুই, আরও খারাপ যেটা, হাঙর, কুমীর আর ঘড়িয়ালরা তাজা রক্তের লোভে সুন্দরবন থেকে এইদিকে চলে আসছে৷ এরা মানুষের শরীর তো খাচ্ছেই, সঙ্গে সমস্ত মাছও খেয়ে নেবে এরকম একটা আশঙ্কা৷ মাছ ধরতে গেলে জালে কুমীর আর হাঙর উঠে আসছে৷ এরকম চলতে থাকলে হরিপুরের মানুষ আগামী সপ্তাহখানেক কাজ করতে পারবেনা৷ স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস, হরিপুরকে শিক্ষা দেবার জন্য এটা প্রশাসন আর সিপিএমের পূর্বপরিকল্পিত৷ হরিপুরে কেন্দ্রীয় দল, এমনকি আরও বড়ো পুলিশ বাহিনী ঘুরে গেছে৷ নন্দীগ্রাম আর হরিপুরকে একসাথে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে৷
মৃতদেহের কোনো চিহ্ন কখনও পাওয়া যাবেনা,ধর্ষণের কোনো প্রমাণ থাকবেনা, এটাই এখন ওদের মডেল৷ সত্যিই কতজন মারা গেছে জানা যাবে তিন মাস পরে, তাও যদি এলাকায় শান্তি ফিরে আসে, যদি বাসিন্দারা আদৌ ফিরে আসতে পারে, যদি তারপর নিখোঁজ মানুষজনের সংখ্যা গোণা হয়৷ কিন্তু সিপিএম এখন এই এলাকাগুলোকে "মুক্ত', "স্বাধীন' করেছে, এর পরে মনে হয়না এলাকাছাড়াদের ফিরে আসতে দেওয়া হবে, আর এদের সম্পত্তি দিয়ে দেওয়া হবে কেশপুর গড়বেতা থেকে সিপিএমের যে লোকজন এসেছে, তাদেরকে৷ নন্দীগ্রাম আর হরিপুরকে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য নিরাপদ এলাকা বানিয়ে তারপর পুরোটা গুটিয়ে ফেলা হবে৷''
এই সেই গল্প, যা দেশভাগের গল্পের চেয়েও ভয়াবহ৷ সাংবাদিকরা সবাই এই সব জানেন, কিন্তু কেউই বলতে এগিয়ে আসবেননা৷ বললে তাদেরকে খুঁজে বার করা হবে, এবং লোপাট করে দেওয়া হবে৷ যে সমস্ত সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীরা বিপক্ষে গেছেন, তাঁদের ভয় দেখানো তো শুরু হয়েই গেছে৷
আমাদেরই তাই লিখতে হবে বিকল্প ইতিহাস৷ অন্য কোনো বিকল্প নেই৷ আমি জানিনা, কে কতটা বিশ্বাস করলেন, তবে নাম-ধাম-সূত্র সবই দেওয়া রইল আগ্রহী মানুষ, ইতিহাসকার এবং ভবিষ্যতের জন্য৷ যদি কেউ চান, তিনি যাচাই করতে পারেন৷ খুঁড়ে বার করতে পারেন৷ এ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প আছে কিনা আমার জানা নেই৷
___________________________________________________
হ্যাঁ - নাম-ধাম-সুত্র যখন রয়েছে, তখন এই লেখার সত্যাসত্য প্রমাণিত হোক। সত্যি প্রমাণ হলে শাস্তি হোক দোষীদের, আর মিথ্যে প্রমাণ হলে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক তারা নিউজ, সৌমিত্র বসু আর গুরুচণ্ডা৯কে।
আপডেটঃ এখনো অবধি তারা নিউজ ছাড়া এই খবর কেউ দেয়নি। অদ্ভুতভাবে খবরের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন করলে আপনার মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। ইফ ইউ আর নট উইথ আস, ইউ আর এগেইনস্ট আস - কথাটা এখানেও সত্যি বলে দেখছি। তারা নিউজের ক্রেডিবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন আগেও উঠেছে, কিন্তু এক্ষেত্রে দেখছি এই প্রশ্ন করাটাকে ইক্যুয়েট করা হচ্ছে নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানোকে সমর্থন করার সাথে। আর অন্য কোথাও তারা নিউজের সমর্থনে কোনও খবর না থাকলেও, ইন্টারনেটে বিভিন্ন ফোরামে এর সমর্থনে একটা ভালো প্রচার চলছে, যেটা আরও বেশি প্রশ্ন জড়ো করছে।
আমরা সকলেই শুধু সেটাই বিশ্বাস করি, যেটা বিশ্বাস করতে চাই। কেউ প্রশ্ন করলে তার গায়ে নানারঙের ছাপ দিয়ে দিতে বা তাকে অমানুষ জন্তু হিসেবে তুলে ধরতে হাত একটুও কাঁপে না।
- অরিজিৎ
___________________________________________________
নন্দীগ্রামের সেই রাত
- সৌমিত্র বসু, সম্পাদক, অন্যস্বর
এটা সেই রাতের ঘটনা৷ ১৪ই মার্চ রাত৷ দিনের বেলার "অপারেশন নন্দীগ্রাম' শেষ হবার পর রাতে সিপিএম স্থানীয়ভাবে একটি বারো ঘন্টার বন্ধ ডাকে৷ এই রকম একটি প্রত্যন্ত এলাকায়, যেখানে লোকজন এমনিতেই সন্ধ্যা হলেই ঘরে ঢুকে পড়ে, সেখানে এরকম একটি বন্ধ ডাকার অর্থ কি? দিনের আলোয় প্রথম পর্বের পুলিশি আক্রমণের পর, যখন খবর আসছিল, ৬০ জনের মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে, মানুষের মৃত্যুতে আমরা শিহরিত, আতঙ্কিত হচ্ছিলাম, তখনও জানা ছিলনা, এই গণহত্যার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পর্বটি এখনও বাকি থেকে গেছে৷ ঠিক তখনই, মহাকরণে আমাদের প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, মুখ্য সচিব এবং স্বরাষ্ট স্র্চিব এই দ্বিতীয় এবং ভয়ঙ্করতম পর্বটির পরিকল্পনা করছিলেন৷ সেই পরিকল্পনাকে কাজে পরিণত করতে বন্ধ এবং রাতের অন্ধকারের প্রয়োজন ছিল তো বটেই৷
রাত নামছিল নন্দীগ্রামে আর মৃত্যু নিয়ে সংখ্যার খেলা ততক্ষণে যথেষ্ট ধূম্রজাল সৃষ্টি করে ফেলেছিল৷ সেই ধূম্রজাল পরেও কাটেনি৷ দৈনিক স্টেটসম্যান জানাচ্ছে ৩১ জন মৃত, বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলি জানাচ্ছে ১৮ জন মারা গেছেন৷ বিবিসি সংবাদদাতা অমিত ভট্টশালী প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন ৩২ জন মারা গেছে, এবং তারপরে প্রকাশ্যেই ঘোষণা করছেন, সরকার থেকে নির্দেশের ফলে বিবিসি কেবলমাত্র সরকারি সংখ্যাটিই ঘোষণা করতে বাধ্য, তাই তাঁরা সংখ্যাটাকে ১১ই রাখছেন৷ তারা টিভির গৌরাঙ্গ, যাকে পুলিশ দিনের বেলায় আটক করে সিপিএম বাহিনীর হাতে তুলে দেয়, এবং প্রকাশ্য টিভিতে যাঁকে সিপিএম বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হতে শোনা গেছে, তিনি তাঁর "অফ-দা-রেকর্ড' বক্তব্যে মৃতের সংখ্যা ১০০+, এবং অন-দা-রেকর্ড বক্তব্যে "অগুন্তি' বলে জানাচ্ছেন৷ তারা টিভির সংবাদদাতা সুব্রত, মমতার সঙ্গে ছিলেন, তিনি জানাচ্ছেন, মৃতের সংখ্যা "অসংখ্য', কারণ কারোর পক্ষেই সঠিক সংখ্যা জানা বা বলা সম্ভব নয়৷ মহান রাজ্য সরকার এবং তার মুখপাত্র শ্রী ভোরা জানাচ্ছেন, মৃতের সংখ্যা ৬৷ এই সংখ্যাটাই তাঁকে জানানো হয়েছে, এবং তিনি প্রেসকে পরে আরও জানাবেন৷
সংখ্যা, এভাবেই কমছিল বাড়ছিল, যেন মানুষ নয়, সংখ্যার খেলা হচ্ছে৷ ইতিমধ্যে নন্দীগ্রামে বন্ধ ও সন্ধ্যা নেমেছিল যথাসময়ে৷ তারা টিভির সুব্রত এবং গৌরাঙ্গ ঘটনাস্থলে ছিলেন৷ রাতের সেই ভয়ঙ্করতম ঘটনার তারা প্রত্যক্ষদর্শী৷ এই বিবরণ মূলত: তাদেরই বিবরণ৷ ঘটনার বর্ণনার আগে সেই প্রত্যক্ষদর্শীর মুখ থেকে শুনে নেওয়া যাক, সেই সেন্সরশিপের কথা, যা, সে নিজেই নিজের উপর আরোপ করেছে৷ "আমি যা দেখেছি, আমার যা বলা উচিত, আমি মিডিয়াকে সেসব বলছিনা, কারণ মানুষ বা আমাদের দর্শকরা সেসব বিশ্বাস করবে না৷ মানুষের বিশ্বাসের একটা সীমা আছে, লোকে আমাকে পাগল বলবে৷ আমি যা দেখেছি, শুনেছি, যার মধ্যে দিয়ে গেছি, নিজেই নিজেকে সেসব বিশ্বাস করাতে পারছিনা৷ দু:স্বপ্নের রাতের মতো যদি যা দেখেছি, শুনেছি, সেগুলো সত্যিই যদি প্রলাপ হত৷৷৷ '
গৌরাঙ্গ এবং সুব্রত জানাচ্ছেন, না,থেট্র বা মারধোরের কারণে নয়, সেই রাতে তাঁরা যা দেখেছেন, তার পর হোটেলের ঘরে ফিরে তাঁদের সত্যিই অনেকবার বমি করতে হয়েছে৷
""ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল্স আর কম্যান্ডোদের নিয়ে সিপিএম বাহিনী প্রত্যেকটা পাড়ায়, প্রত্যেকটা গ্রামে ঢোকে৷ পুরুষদের টেনে বার করে আনা হয়৷ ওরা কাউকে আটক করছিল না৷ কোনো বন্দী নেই, কোনো সাক্ষী নেই,ওরা গুলি করছিল,পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে নাড়িভুঁড়ি বার করে আনছিল,শরীরগুলো ভাসিয়ে দিচ্ছিল খালে, সেখান থেকে মোহনা আর সমুদ্রে৷ তারপর কমবয়সী মেয়েদের টেনে আনা হচ্ছিল, তাদেরকে ফাঁকা জায়গায় একসঙ্গে জড়ো করা হয়,ক্রমাগত ধর্ষণ করে চলা হয়, যতক্ষণ না একেকজন কোলাপ্স করে যায়, তারপর, একদম আক্ষরিক অর্থে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে আনা হয়,কাউকে কাউকে একদম টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়,তারপর হলদি নদী কিংবা তালপটি খালে ভাসিয়ে দেওয়া হয়৷ এসবের কোনো সাক্ষী টিকে নেই৷ থাকলেই বা কি,যদি কেউ বেঁচেও থাকে, মেদিনীপুরের কোন মেয়েই বা নিজের উপরে অত্যাচারের গল্প ফলাও করে বলবে, আর বললে বিশ্বাসই বা করবে কে? তাছাড়া কেউ বললে তাকেও তো একই জিনিস করে খুন করা হবে৷
এইসব শেষ হবার পর, সিপিএম আর পুলিশ তারপর গোটা এলাকা লাল ব্যানার আর পতাকা দিয়ে ঢেকে দিচ্ছিল৷ মানে, এলাকা এখন নিরাপদ আর শুধু তাদের রাজত্বই চলবে৷ যারা গ্রাম থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিল, তারা প্রায় সবাই ধরা পড়ে গ্রামের কিনারায় বা আশেপাশে৷ তাদের কি হয়েছে, কেউ জানেনা৷ আমরা শুধু তাদের কথাই শুনতে পেয়েছি, যারা মাঠ আর জঙ্গল পেরিয়ে পালাতে পেরেছে৷ সেটাও খুব কঠিন৷ এখন মাঠ শুকনো৷ ফসল কাটা হয়ে গেছে৷ মাঠের উপর দিয়ে গেলে যে কেউ দেখতে পাবে৷
অসংখ্য ধর্ষণ হয়েছে৷ সরকারি ভাবে ধর্ষণের সংখ্যা ৬, কারণ, এই কজনই নিজেদের গল্প বলার জন্য টিকে আছে৷ এরা সবাই মধ্যবয়সী, সেই কারণেই হয়তো কেটে কুচিকুচি হবার হাত থেকে কোনোভাবে বেঁচে গেছে৷ গ্রামের পর গ্রামে এই জিনিস চলেছে৷ রাত পেরিয়ে সকালেও চলেছে৷ সমস্ত সাংবাদিকদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ দৈনিক স্টেটসম্যানের সাংবাদিক সুকুমার মিত্র বুলেটবৃষ্টির মধ্যে কোনোরকমে পালিয়েছেন৷ ওনাকে নাম ধরে, বিশেষ করে খোঁজা হচ্ছিল, কোনো কায়দায় উনি পালাতে পেরেছেন৷ আক্রমণকারীরা এতো হিংস্র, যে স্থানীয় কোনো লোক কারো কাছে মুখ খুলতে চাইছে না৷ ভয়কে একটা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ আতঙ্ককে ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক সেন্সরশিপের একটা পদ্ধতি হিসাবে৷
পাশেই হরিপুর সাবডিভিশান৷ যেটা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য চিহ্নিত৷ সেখানেও প্রতিবাদ হয়েছে৷ সেখানকার লোকেরা মূলত: মাছ ধরে৷ তাদের মাছ ধরা এখন বন্ধ করতে হয়েছে দুটো কারণে৷ এক, খাঁড়ি আর সমুদ্র মৃতদেহে ভরে আছে৷ দুই, আরও খারাপ যেটা, হাঙর, কুমীর আর ঘড়িয়ালরা তাজা রক্তের লোভে সুন্দরবন থেকে এইদিকে চলে আসছে৷ এরা মানুষের শরীর তো খাচ্ছেই, সঙ্গে সমস্ত মাছও খেয়ে নেবে এরকম একটা আশঙ্কা৷ মাছ ধরতে গেলে জালে কুমীর আর হাঙর উঠে আসছে৷ এরকম চলতে থাকলে হরিপুরের মানুষ আগামী সপ্তাহখানেক কাজ করতে পারবেনা৷ স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস, হরিপুরকে শিক্ষা দেবার জন্য এটা প্রশাসন আর সিপিএমের পূর্বপরিকল্পিত৷ হরিপুরে কেন্দ্রীয় দল, এমনকি আরও বড়ো পুলিশ বাহিনী ঘুরে গেছে৷ নন্দীগ্রাম আর হরিপুরকে একসাথে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে৷
মৃতদেহের কোনো চিহ্ন কখনও পাওয়া যাবেনা,ধর্ষণের কোনো প্রমাণ থাকবেনা, এটাই এখন ওদের মডেল৷ সত্যিই কতজন মারা গেছে জানা যাবে তিন মাস পরে, তাও যদি এলাকায় শান্তি ফিরে আসে, যদি বাসিন্দারা আদৌ ফিরে আসতে পারে, যদি তারপর নিখোঁজ মানুষজনের সংখ্যা গোণা হয়৷ কিন্তু সিপিএম এখন এই এলাকাগুলোকে "মুক্ত', "স্বাধীন' করেছে, এর পরে মনে হয়না এলাকাছাড়াদের ফিরে আসতে দেওয়া হবে, আর এদের সম্পত্তি দিয়ে দেওয়া হবে কেশপুর গড়বেতা থেকে সিপিএমের যে লোকজন এসেছে, তাদেরকে৷ নন্দীগ্রাম আর হরিপুরকে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য নিরাপদ এলাকা বানিয়ে তারপর পুরোটা গুটিয়ে ফেলা হবে৷''
এই সেই গল্প, যা দেশভাগের গল্পের চেয়েও ভয়াবহ৷ সাংবাদিকরা সবাই এই সব জানেন, কিন্তু কেউই বলতে এগিয়ে আসবেননা৷ বললে তাদেরকে খুঁজে বার করা হবে, এবং লোপাট করে দেওয়া হবে৷ যে সমস্ত সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীরা বিপক্ষে গেছেন, তাঁদের ভয় দেখানো তো শুরু হয়েই গেছে৷
আমাদেরই তাই লিখতে হবে বিকল্প ইতিহাস৷ অন্য কোনো বিকল্প নেই৷ আমি জানিনা, কে কতটা বিশ্বাস করলেন, তবে নাম-ধাম-সূত্র সবই দেওয়া রইল আগ্রহী মানুষ, ইতিহাসকার এবং ভবিষ্যতের জন্য৷ যদি কেউ চান, তিনি যাচাই করতে পারেন৷ খুঁড়ে বার করতে পারেন৷ এ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প আছে কিনা আমার জানা নেই৷
___________________________________________________
হ্যাঁ - নাম-ধাম-সুত্র যখন রয়েছে, তখন এই লেখার সত্যাসত্য প্রমাণিত হোক। সত্যি প্রমাণ হলে শাস্তি হোক দোষীদের, আর মিথ্যে প্রমাণ হলে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক তারা নিউজ, সৌমিত্র বসু আর গুরুচণ্ডা৯কে।
আপডেটঃ এখনো অবধি তারা নিউজ ছাড়া এই খবর কেউ দেয়নি। অদ্ভুতভাবে খবরের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন করলে আপনার মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। ইফ ইউ আর নট উইথ আস, ইউ আর এগেইনস্ট আস - কথাটা এখানেও সত্যি বলে দেখছি। তারা নিউজের ক্রেডিবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন আগেও উঠেছে, কিন্তু এক্ষেত্রে দেখছি এই প্রশ্ন করাটাকে ইক্যুয়েট করা হচ্ছে নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালানোকে সমর্থন করার সাথে। আর অন্য কোথাও তারা নিউজের সমর্থনে কোনও খবর না থাকলেও, ইন্টারনেটে বিভিন্ন ফোরামে এর সমর্থনে একটা ভালো প্রচার চলছে, যেটা আরও বেশি প্রশ্ন জড়ো করছে।
আমরা সকলেই শুধু সেটাই বিশ্বাস করি, যেটা বিশ্বাস করতে চাই। কেউ প্রশ্ন করলে তার গায়ে নানারঙের ছাপ দিয়ে দিতে বা তাকে অমানুষ জন্তু হিসেবে তুলে ধরতে হাত একটুও কাঁপে না।
- অরিজিৎ
Thursday, March 15, 2007
নন্দীগ্রাম
The news of deaths by police firing in Nandigram has filled me with a sense of cold horror. .... the point uppermost in my mind is not "who started it", "who provoked it" or whether there were agent-provocateurs behind it...The thought in my mind – and of all sensitive people now is – “Was this spilling of human blood not avoidable? What is the public purpose served by the use of force that we have witnessed today?” – Gopalkrishna Gandhi
___________________________________________________
___________________________________________________
কাল সারাটা দিন হাসপাতালে নানান ঝুট-ঝামেলায় কেটেছে৷ যেমন আর পাঁচটা কাজের দিন যায়, তার থেকে একটু বেশীই৷ সাঁঝের ঝোঁকে সোফাতে একটু গা এলালেই নয় যখন, ডক্টর'স রুমে ঢুকতেই কলকল করে বন্ধু ও সহকর্মীরা জানাল -আবার বাংলা বন্ধ৷ শুক্রবার৷
কে ডাকল?
কে আবার, দিদি ছাড়া?
কেন হে?
নাকি নন্দীগ্রামে কিসব ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট হয়েছে৷
আ-ব্বার বন্ধ, শুক্কুরবারদিন যে আমার চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি! কিছু বাছা বাছা খিস্তি ঠোঁটে আসছে, এক-আধটা বলেওছি, সুরঞ্জনাদি বলল-নারে, অনেক লোক মারা গেছে৷
তখনো ভাবছি-নিশ্চয়ই কৃষিজমি বাঁচাও কমিটির সঙ্গে সিপিএম ক্যাডারদের খুচরো ক্যালাকেলি৷ তো, ধরো অনিকেশদাকে৷ অনিকেশদা (নাম পাল্টে দেওয়া হল) আমাদের কনসালট্যান্ট কার্ডিওলজিস্ট ও মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র; মাই ডিয়ার লোক৷
অনিকেশদা জানাল, না, সিপিএম নয়, ক্যাডার নয়, বিশাল পুলিশবাহিনী ঠান্ডা মাথায় গুলি চালিয়ে মানুষ মেরেছে৷ মেয়েরাও মারা গেছে৷ বুদ্ধবাবু (উত্তেজিত গলায়) মেদিনীপুরকে শেষ না করে থামবে না৷ হতাশ ও ক্রুদ্ধ; অভিমানী৷ এই অনিকেশদাই নন্দীগ্রামের প্রথম ঘটনার পরে বলেছিল- এর নাম মেদনিপুর(না, মেদিনীপুর বলে নি, এবং গলায় ভূমিপুত্রসুলভ অ্যাক্সেন্ট ছিল), ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে ওখানটা স্বাধীন হয়েছে৷
তারপর তো বেশীরাতে বাড়ি ফিরে এসে দেখলাম টিভিতে৷ বন্যার মত টেলিভিশন ফুটেজ আছড়ে পড়তে লাগল চোখে ও মাথায়৷ অপটিক নার্ভ, কায়াজমা, অপটিক ট্র্যাক্ট হয়ে মাথার পেছনদিককার অক্সিপিটাল কর্টেক্সে রক্ত এসে লাগতে থাকল, লিটার লিটার রক্ত, মানুষের রক্ত-মেয়েমানুষের রক্ত, পুরুষমানুষের রক্ত, বাচ্চা-বুড়ো-পাগল-মুনিষ-মাইন্দর-নকশাল-তৃনমূল-সিপিএম-পুলিশের রক্ত৷ যতটা রক্ত বেরোলে পরে মানুষ অনিবার্য হাইপোভোলেমিক শকে চলে যায়, ফেরে না আর কিছুতেই, হদৃযন্ত্র বন্ধ হয়ে যায়, অবসন্ন৷
যতটা রক্ত বেরোলে পরে মাথার ভেতরে নিও-কর্টিক্যাল এরিয়াতে সিগন্যালেরা সব ঘুলিয়ে যায় পথহারা, বুদ্ধিশুদ্ধি ঠিক তেমনি হাড়গোড়ভাঙা দ হয়ে যায়, যেমন হয়ে রয়েছে পুলিশে খোবলানো নন্দীগ্রামের মানুষেরা, তাদের ভাঙা কলার বোন, হাত-পা ও পাঁজর নিয়ে৷
ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়া নয়া বাংলা গড়বো? না:, বুদ্ধবাবু, এই গান আর উঠে আসেনা, এ গান একদা আপনিও গুণগুণিয়ে গাইতেন কিনা সে প্রশ্নও উঠে আসেনা আর ৷
শুধু ক্রোধ, পাশবিক; শুধু ঘৃণা, তাল তাল ও জমাট- বাঁধা- কালো, যতটা কালো হতে পারে জমাট বাঁধা রক্ত, মানুষের রক্ত৷ নকশালী রক্ত? তৃণমূলী রক্ত? আপনি ভাল জানবেন, হে সংস্কৃতিবান পুলিশমন্ত্রী; আরো ভাল জানবেন আপনার প্রিয় বয়স্য, সখা, কৃষকসভা নেতা বিনয় কোঙার, যিনি বলেছেন- পুলিশ কি ফুলের পাপড়ি ছুঁড়বে?
প্রমোদ দাশগুপ্ত একদা বলেছিলেন-পুলিশের বুলেটে কি নিরোধ লাগানো আছে, নকশালরা মরে না কেন? হরেকৃষ্ঞ কোঙার নির্দোষ প্রশ্ন করেছিলেন-পুলিশ কি তবে রসগোল্লা ছুঁড়বে? আর কারা যেন একদা কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় শ্লোগানে শ্লোগানে ভরিয়ে দিয়েছিল-পুলিশ, তুমি যতই মারো/মাইনে তোমার একশ' বারো৷
হা:, রঙ্গপ্রিয় ইতিহাস!
খবরে প্রকাশ , মৃত অন্তত: চোদ্দ, আহতের সংখ্যা পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই৷ হতাহতদের প্রাথমিকভাবে নন্দীগ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ আমি নিশ্চিত্ জানি, যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁদের যথাযোগ্য চিকিত্সা ঐ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবশ্যই হয়েছিল, কেননা পশ্চিমবঙ্গের যে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতই নন্দীগ্রামেও কি আর যথেষ্ট পরিমাণ হজমের ওষুধ, কৃমি ও আমাশার বড়ি এবং গর্ভনিরোধক পিল (তেমন তেমন হলে চাই কি এক-আধখানা স্টেথোস্কোপ-ও !) ছিল না !
বিভাস চক্রবর্তী বললেন- বুদ্ধবাবুর সাদা পাঞ্জাবীতে কিন্তু রক্তের ছিটে লেগেছে, এবং লেডী ম্যাকবেথের মত ("আমি নাটকের ভাষাই ব্যবহার করছি'-উনি বললেন) উনিও ওঁর হাতে লেগে থাকা রক্তের দাগ তুলবার চেষ্টায় প্রাণান্ত হয়ে যাবেন, কিন্তু পারবেন না৷
লেডী ম্যাকবেথ? বুদ্ধবাবু? কল্পনা করবার চেষ্টা করলাম বুদ্ধবাবুর রংও রুজ মাখানো গাল , স্বর্ণাভ উইগ ও মানানসই অ্যাটায়ার-রক্তাক্ত হাত নিয়ে তীব্র বেগুনী আঁধারে তীক্ষ্ণ চীত্কার করে প্রাসাদ অলিন্দ দিয়ে ছুটে যাচ্ছেন৷ হাসি পেয়ে গেল৷ কেননা আমরা তো নাটক দেখিনা সে আজ বহুকাল৷ বাচ্চাটা হওয়ার পর ওকে নিয়ে নাটক দেখতে যাওয়া যায় না, তাছাড়াও ওর পেছনে সময় দেওয়া, আমার হাসপাতাল, আরো পড়াশুনো, সঙ্গীতার অফিস৷ কফি উইদ অর উইদাউট করণ৷ সিটি সেন্টার, কাফিলা;তার ডেকর পেশওয়ারী, তার দেয়ালে ঝোলানো সাজানো বন্দুক, হায় কি অসহায় নির্বিষ !
হাসি ছাড়া তাই কিছু আর নেই আমাদের৷ চিনিহীন কালো কফির মত তেতো হাসি, ঈষত্ বাঁকা, মুখটেপা ও কাষ্ঠ-কিন্তু কোনমতেই হা হা নয়-এমন হাসি৷ এই হাসি মেখে আমরা ট্রামে-বাসে চড়ি , সিট নিয়ে মানুষের সঙ্গে ঝগড়া করি, বিকেলে বিষণ্ন হই,সকালে কোষ্ঠসাফ ও রাতে সঙ্গম করি, শিশুকে আদর করি, বসকে হ্যা-হ্যা বলি ৷ আর গর্তে ঢুকি৷ মেট্রোরেলের, রাজারহাটের,ওপেল অ্যাস্ট্রার .....
প্রসঙ্গত:, বিভাসবাবু সহ আরো বেশ কয়েকজন নাট্যব্যক্তিত্ব-কৌশিক সেন, সুমন মুখোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু এবং সম্ভবত: মনোজ মিত্র ও অশোক মুখোপাধ্যায়ও -নাট্য একাডেমির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন৷ বিভাসবাবু আরো বললেন- শঙ্খদার(কবি শঙ্খ ঘোষ) সঙ্গে একদিন দেখা হল, উনি বললেন- বুদ্ধবাবু যে বলেছিলেন, এইসব নিয়ে একদিন কথা বলবেন, কই , বললেন না তো !
বুদ্ধবাবু হাজারো কাজের মানুষ, সবার সঙ্গে কথা বলার সময় না-ও থাকতে পারে৷ ভুলে যেতেই পারেন নন্দীগ্রামের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলার কথা, SEZ -এর আওতায় তাঁদের গ্রামটিকেও ঢোকানো নিয়ে নোটিশ পড়বার আগে৷ ভুলে যেতে পারেন নন্দীগ্রামে পুলিশ ঢোকানোর আগে এলাকার সিপিআই বিধায়ককে অবহিত করবার কথা৷ আর, এমনই বা কে মাথার দিব্যি দিয়েছে যে ভুলে যাওয়া যাবেনা- বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নামের একজন মানুষ একদা একটি দল করতেন , যার নাম মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি , ট্রামভাড়া ন্যূনতম বাড়লে যারা কলকাতা অচল করে দিয়েছিল, খাদ্য আন্দোলন আর শিক্ষক আন্দোলনের সামনে তারাই ছিল, হ্যা হ্যা, সেইসব মানুষেরা যারা পুলিশকে ইঁট-পাটকেল ছুঁড়তে পিছপা হয় নি, দরকারে বোমা ও পাইপগান৷ এবং আমি বিশ্বাস করি, তারা ভুল কিছু করেনি৷ বুদ্ধবাবু, আপনি?
তবে , ভুলে যাওয়া কিছু বুদ্ধদেবের একচেটিয়া নয়৷ পৃথিবী জুড়ে অ্যামনেশিয়া-ডিমেনশিয়ার বাড়বাড়ন্ত, মানুষ-সব মানুষ সব কিছুই ভুলে যায়, সালভাদর আলেন্দে ও পিনোশে, গুলাগ ও হিরোশিমা, লুমুম্বা ও গেভারা, তেভাগা-তেলেঙ্গানা ও মরিচঝাঁপি৷ করন্দার কথা তো লোকে কব্বে ভুলে বসে আছে৷ নন্দীগ্রাম? মাসখানেক সময় দেবেন তো মশায়! তাছাড়া সামনে যখন ইলেকশন নেই ও ব্রান্ড বুদ্ধ যখন সেলিং লাইক হট কচুরিজ, হ্যা, এখনো, এই আতান্তরেও,জাতীয় নিউজ চ্যানেলের sms পোলে৷
তাছাড়া , আমরা ই কি চাইনি, গোপনে ও প্রকাশ্যে কত মজলিশে-এদেশের বুকে আর্মি আসুক নেমে !
আজ সকালটাও শুরু হয়েছিল বড় অদ্ভুতভাবে৷ বিধাননগর স্টেশনে নেমে দেখি ভিড় ঠেলে ওভারব্রীজে ওঠা যাচ্ছে না, এত লোক ! সার বেঁধে দাঁড়িয়ে কি যেন দেখছে৷ নিশ্চয়ই কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ৷ আমি তো ওসব দেখব না, ও বড় অশ্লীল, ভয়ুরিস্টিক, তাই মানুষ ঠেলে সটান এগিয়ে যাই৷ কিন্তু কোন বিড়ালই বা কবে বেঁচেছে কৌতুহলের কাছে ! তাই একটিবার তাকাই এবং দেখতে পাই একটি মুন্ডহীন ধড়, আদ্যন্ত পরিষ্কার , তাতে রক্তের ছিটেফোঁটা লেগে নেই, শুধু হাত-পা- ক"টি শরীরের সঙ্গে অদ্ভুত কোণ রচনা করে মুচড়ে রয়েছে, যেন পিকাসোর বাউন্ডুলে কোনো ছবি৷ হনহনিয়ে এগিয়ে যাই,একেই যথেষ্ট দেরী হয়ে গেছে ... তাছাড়া ও তো মরেই গেছে, আমার মাঝখান থেকে গন্তব্যে পৌঁছতে দেরী হয়ে যাবে৷
রাতে টিভি দেখে মনে হল, নন্দীগ্রামের প্রতিবাদও ঐভাবেই মুখ মুচড়ে পড়ে রয়েছে, একদা সোনালী ডানার চিল ছিল হয়তো বা, যখন আমরা, আমাদের বাপ-দাদারা স্বপ্নে দেখত যৌথ খামার৷ অবিকল পিকাসোর বাউন্ডুলে কোনো ছবি৷ লেননের ফার-ফেচেড ইমাজিনেশন৷
কিন্তু সে আজিকে হল কত কাল৷ ওসব এক্কেবারে মরে গেছে, অত্যাধুনিক ইনস্যাস রাইফেলের ঠেলায় কি আর কেউ টেকে ! এতেও না শানালে সেনা ছিল, এ কে ৪৭/৫৬ ছিল .. থাগগে৷ কেমিক্যাল হাবের সঙ্গে সঙ্গে হোটেলটোটেলও হলে পর, সালেম গ্রুপ যখন, একবার বরং ঘুরে আসা যাবে উইকএন্ডে,ছোট পরিবার, সুখী পরিবার৷
বারংবার হটে হটে হঠাৎ হটেনটট যোদ্ধা যেন ছুটে যায় সিংহের দিকে/ এরকমই স্বপ্নে ঘুমে বুকের ভেতরে যেন গুরগুর ... তুষার রায় একদা লিখেছিলেন৷ কিন্তু তুষার রায় তো এখন মৃত৷ আর মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনো৷ তাদের কবরের ওপর আর কেউ নয়, কিছু নয় শুধুই তুষার, শুধু ধূ ধূ প্রান্তরে বনে কেবলই তুষার ঝরে, শুধুই তুষার৷
আর, যারা ফেরে, তারা তো প্রেত৷ তুষার ঠেলে ঠেলে ছাই রং মুন্ডহীন কবন্ধ, শুকনো মামড়ি-ওঠা ঠোঁট, কাটা হাত তুষারযোনি অশরীরী৷
দেশ যাদের কোনো মাতৃভাষা দেয় নি কখনো৷৷
- ইন্দ্রনীল ঘোষদস্তিদার
কে ডাকল?
কে আবার, দিদি ছাড়া?
কেন হে?
নাকি নন্দীগ্রামে কিসব ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট হয়েছে৷
আ-ব্বার বন্ধ, শুক্কুরবারদিন যে আমার চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি! কিছু বাছা বাছা খিস্তি ঠোঁটে আসছে, এক-আধটা বলেওছি, সুরঞ্জনাদি বলল-নারে, অনেক লোক মারা গেছে৷
তখনো ভাবছি-নিশ্চয়ই কৃষিজমি বাঁচাও কমিটির সঙ্গে সিপিএম ক্যাডারদের খুচরো ক্যালাকেলি৷ তো, ধরো অনিকেশদাকে৷ অনিকেশদা (নাম পাল্টে দেওয়া হল) আমাদের কনসালট্যান্ট কার্ডিওলজিস্ট ও মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র; মাই ডিয়ার লোক৷
অনিকেশদা জানাল, না, সিপিএম নয়, ক্যাডার নয়, বিশাল পুলিশবাহিনী ঠান্ডা মাথায় গুলি চালিয়ে মানুষ মেরেছে৷ মেয়েরাও মারা গেছে৷ বুদ্ধবাবু (উত্তেজিত গলায়) মেদিনীপুরকে শেষ না করে থামবে না৷ হতাশ ও ক্রুদ্ধ; অভিমানী৷ এই অনিকেশদাই নন্দীগ্রামের প্রথম ঘটনার পরে বলেছিল- এর নাম মেদনিপুর(না, মেদিনীপুর বলে নি, এবং গলায় ভূমিপুত্রসুলভ অ্যাক্সেন্ট ছিল), ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে ওখানটা স্বাধীন হয়েছে৷
তারপর তো বেশীরাতে বাড়ি ফিরে এসে দেখলাম টিভিতে৷ বন্যার মত টেলিভিশন ফুটেজ আছড়ে পড়তে লাগল চোখে ও মাথায়৷ অপটিক নার্ভ, কায়াজমা, অপটিক ট্র্যাক্ট হয়ে মাথার পেছনদিককার অক্সিপিটাল কর্টেক্সে রক্ত এসে লাগতে থাকল, লিটার লিটার রক্ত, মানুষের রক্ত-মেয়েমানুষের রক্ত, পুরুষমানুষের রক্ত, বাচ্চা-বুড়ো-পাগল-মুনিষ-মাইন্দর-নকশাল-তৃনমূল-সিপিএম-পুলিশের রক্ত৷ যতটা রক্ত বেরোলে পরে মানুষ অনিবার্য হাইপোভোলেমিক শকে চলে যায়, ফেরে না আর কিছুতেই, হদৃযন্ত্র বন্ধ হয়ে যায়, অবসন্ন৷
যতটা রক্ত বেরোলে পরে মাথার ভেতরে নিও-কর্টিক্যাল এরিয়াতে সিগন্যালেরা সব ঘুলিয়ে যায় পথহারা, বুদ্ধিশুদ্ধি ঠিক তেমনি হাড়গোড়ভাঙা দ হয়ে যায়, যেমন হয়ে রয়েছে পুলিশে খোবলানো নন্দীগ্রামের মানুষেরা, তাদের ভাঙা কলার বোন, হাত-পা ও পাঁজর নিয়ে৷
ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়া নয়া বাংলা গড়বো? না:, বুদ্ধবাবু, এই গান আর উঠে আসেনা, এ গান একদা আপনিও গুণগুণিয়ে গাইতেন কিনা সে প্রশ্নও উঠে আসেনা আর ৷
শুধু ক্রোধ, পাশবিক; শুধু ঘৃণা, তাল তাল ও জমাট- বাঁধা- কালো, যতটা কালো হতে পারে জমাট বাঁধা রক্ত, মানুষের রক্ত৷ নকশালী রক্ত? তৃণমূলী রক্ত? আপনি ভাল জানবেন, হে সংস্কৃতিবান পুলিশমন্ত্রী; আরো ভাল জানবেন আপনার প্রিয় বয়স্য, সখা, কৃষকসভা নেতা বিনয় কোঙার, যিনি বলেছেন- পুলিশ কি ফুলের পাপড়ি ছুঁড়বে?
প্রমোদ দাশগুপ্ত একদা বলেছিলেন-পুলিশের বুলেটে কি নিরোধ লাগানো আছে, নকশালরা মরে না কেন? হরেকৃষ্ঞ কোঙার নির্দোষ প্রশ্ন করেছিলেন-পুলিশ কি তবে রসগোল্লা ছুঁড়বে? আর কারা যেন একদা কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় শ্লোগানে শ্লোগানে ভরিয়ে দিয়েছিল-পুলিশ, তুমি যতই মারো/মাইনে তোমার একশ' বারো৷
হা:, রঙ্গপ্রিয় ইতিহাস!
খবরে প্রকাশ , মৃত অন্তত: চোদ্দ, আহতের সংখ্যা পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই৷ হতাহতদের প্রাথমিকভাবে নন্দীগ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ আমি নিশ্চিত্ জানি, যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁদের যথাযোগ্য চিকিত্সা ঐ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবশ্যই হয়েছিল, কেননা পশ্চিমবঙ্গের যে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতই নন্দীগ্রামেও কি আর যথেষ্ট পরিমাণ হজমের ওষুধ, কৃমি ও আমাশার বড়ি এবং গর্ভনিরোধক পিল (তেমন তেমন হলে চাই কি এক-আধখানা স্টেথোস্কোপ-ও !) ছিল না !
বিভাস চক্রবর্তী বললেন- বুদ্ধবাবুর সাদা পাঞ্জাবীতে কিন্তু রক্তের ছিটে লেগেছে, এবং লেডী ম্যাকবেথের মত ("আমি নাটকের ভাষাই ব্যবহার করছি'-উনি বললেন) উনিও ওঁর হাতে লেগে থাকা রক্তের দাগ তুলবার চেষ্টায় প্রাণান্ত হয়ে যাবেন, কিন্তু পারবেন না৷
লেডী ম্যাকবেথ? বুদ্ধবাবু? কল্পনা করবার চেষ্টা করলাম বুদ্ধবাবুর রংও রুজ মাখানো গাল , স্বর্ণাভ উইগ ও মানানসই অ্যাটায়ার-রক্তাক্ত হাত নিয়ে তীব্র বেগুনী আঁধারে তীক্ষ্ণ চীত্কার করে প্রাসাদ অলিন্দ দিয়ে ছুটে যাচ্ছেন৷ হাসি পেয়ে গেল৷ কেননা আমরা তো নাটক দেখিনা সে আজ বহুকাল৷ বাচ্চাটা হওয়ার পর ওকে নিয়ে নাটক দেখতে যাওয়া যায় না, তাছাড়াও ওর পেছনে সময় দেওয়া, আমার হাসপাতাল, আরো পড়াশুনো, সঙ্গীতার অফিস৷ কফি উইদ অর উইদাউট করণ৷ সিটি সেন্টার, কাফিলা;তার ডেকর পেশওয়ারী, তার দেয়ালে ঝোলানো সাজানো বন্দুক, হায় কি অসহায় নির্বিষ !
হাসি ছাড়া তাই কিছু আর নেই আমাদের৷ চিনিহীন কালো কফির মত তেতো হাসি, ঈষত্ বাঁকা, মুখটেপা ও কাষ্ঠ-কিন্তু কোনমতেই হা হা নয়-এমন হাসি৷ এই হাসি মেখে আমরা ট্রামে-বাসে চড়ি , সিট নিয়ে মানুষের সঙ্গে ঝগড়া করি, বিকেলে বিষণ্ন হই,সকালে কোষ্ঠসাফ ও রাতে সঙ্গম করি, শিশুকে আদর করি, বসকে হ্যা-হ্যা বলি ৷ আর গর্তে ঢুকি৷ মেট্রোরেলের, রাজারহাটের,ওপেল অ্যাস্ট্রার .....
প্রসঙ্গত:, বিভাসবাবু সহ আরো বেশ কয়েকজন নাট্যব্যক্তিত্ব-কৌশিক সেন, সুমন মুখোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু এবং সম্ভবত: মনোজ মিত্র ও অশোক মুখোপাধ্যায়ও -নাট্য একাডেমির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন৷ বিভাসবাবু আরো বললেন- শঙ্খদার(কবি শঙ্খ ঘোষ) সঙ্গে একদিন দেখা হল, উনি বললেন- বুদ্ধবাবু যে বলেছিলেন, এইসব নিয়ে একদিন কথা বলবেন, কই , বললেন না তো !
বুদ্ধবাবু হাজারো কাজের মানুষ, সবার সঙ্গে কথা বলার সময় না-ও থাকতে পারে৷ ভুলে যেতেই পারেন নন্দীগ্রামের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলার কথা, SEZ -এর আওতায় তাঁদের গ্রামটিকেও ঢোকানো নিয়ে নোটিশ পড়বার আগে৷ ভুলে যেতে পারেন নন্দীগ্রামে পুলিশ ঢোকানোর আগে এলাকার সিপিআই বিধায়ককে অবহিত করবার কথা৷ আর, এমনই বা কে মাথার দিব্যি দিয়েছে যে ভুলে যাওয়া যাবেনা- বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নামের একজন মানুষ একদা একটি দল করতেন , যার নাম মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি , ট্রামভাড়া ন্যূনতম বাড়লে যারা কলকাতা অচল করে দিয়েছিল, খাদ্য আন্দোলন আর শিক্ষক আন্দোলনের সামনে তারাই ছিল, হ্যা হ্যা, সেইসব মানুষেরা যারা পুলিশকে ইঁট-পাটকেল ছুঁড়তে পিছপা হয় নি, দরকারে বোমা ও পাইপগান৷ এবং আমি বিশ্বাস করি, তারা ভুল কিছু করেনি৷ বুদ্ধবাবু, আপনি?
তবে , ভুলে যাওয়া কিছু বুদ্ধদেবের একচেটিয়া নয়৷ পৃথিবী জুড়ে অ্যামনেশিয়া-ডিমেনশিয়ার বাড়বাড়ন্ত, মানুষ-সব মানুষ সব কিছুই ভুলে যায়, সালভাদর আলেন্দে ও পিনোশে, গুলাগ ও হিরোশিমা, লুমুম্বা ও গেভারা, তেভাগা-তেলেঙ্গানা ও মরিচঝাঁপি৷ করন্দার কথা তো লোকে কব্বে ভুলে বসে আছে৷ নন্দীগ্রাম? মাসখানেক সময় দেবেন তো মশায়! তাছাড়া সামনে যখন ইলেকশন নেই ও ব্রান্ড বুদ্ধ যখন সেলিং লাইক হট কচুরিজ, হ্যা, এখনো, এই আতান্তরেও,জাতীয় নিউজ চ্যানেলের sms পোলে৷
তাছাড়া , আমরা ই কি চাইনি, গোপনে ও প্রকাশ্যে কত মজলিশে-এদেশের বুকে আর্মি আসুক নেমে !
আজ সকালটাও শুরু হয়েছিল বড় অদ্ভুতভাবে৷ বিধাননগর স্টেশনে নেমে দেখি ভিড় ঠেলে ওভারব্রীজে ওঠা যাচ্ছে না, এত লোক ! সার বেঁধে দাঁড়িয়ে কি যেন দেখছে৷ নিশ্চয়ই কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ৷ আমি তো ওসব দেখব না, ও বড় অশ্লীল, ভয়ুরিস্টিক, তাই মানুষ ঠেলে সটান এগিয়ে যাই৷ কিন্তু কোন বিড়ালই বা কবে বেঁচেছে কৌতুহলের কাছে ! তাই একটিবার তাকাই এবং দেখতে পাই একটি মুন্ডহীন ধড়, আদ্যন্ত পরিষ্কার , তাতে রক্তের ছিটেফোঁটা লেগে নেই, শুধু হাত-পা- ক"টি শরীরের সঙ্গে অদ্ভুত কোণ রচনা করে মুচড়ে রয়েছে, যেন পিকাসোর বাউন্ডুলে কোনো ছবি৷ হনহনিয়ে এগিয়ে যাই,একেই যথেষ্ট দেরী হয়ে গেছে ... তাছাড়া ও তো মরেই গেছে, আমার মাঝখান থেকে গন্তব্যে পৌঁছতে দেরী হয়ে যাবে৷
রাতে টিভি দেখে মনে হল, নন্দীগ্রামের প্রতিবাদও ঐভাবেই মুখ মুচড়ে পড়ে রয়েছে, একদা সোনালী ডানার চিল ছিল হয়তো বা, যখন আমরা, আমাদের বাপ-দাদারা স্বপ্নে দেখত যৌথ খামার৷ অবিকল পিকাসোর বাউন্ডুলে কোনো ছবি৷ লেননের ফার-ফেচেড ইমাজিনেশন৷
কিন্তু সে আজিকে হল কত কাল৷ ওসব এক্কেবারে মরে গেছে, অত্যাধুনিক ইনস্যাস রাইফেলের ঠেলায় কি আর কেউ টেকে ! এতেও না শানালে সেনা ছিল, এ কে ৪৭/৫৬ ছিল .. থাগগে৷ কেমিক্যাল হাবের সঙ্গে সঙ্গে হোটেলটোটেলও হলে পর, সালেম গ্রুপ যখন, একবার বরং ঘুরে আসা যাবে উইকএন্ডে,ছোট পরিবার, সুখী পরিবার৷
বারংবার হটে হটে হঠাৎ হটেনটট যোদ্ধা যেন ছুটে যায় সিংহের দিকে/ এরকমই স্বপ্নে ঘুমে বুকের ভেতরে যেন গুরগুর ... তুষার রায় একদা লিখেছিলেন৷ কিন্তু তুষার রায় তো এখন মৃত৷ আর মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনো৷ তাদের কবরের ওপর আর কেউ নয়, কিছু নয় শুধুই তুষার, শুধু ধূ ধূ প্রান্তরে বনে কেবলই তুষার ঝরে, শুধুই তুষার৷
আর, যারা ফেরে, তারা তো প্রেত৷ তুষার ঠেলে ঠেলে ছাই রং মুন্ডহীন কবন্ধ, শুকনো মামড়ি-ওঠা ঠোঁট, কাটা হাত তুষারযোনি অশরীরী৷
দেশ যাদের কোনো মাতৃভাষা দেয় নি কখনো৷৷
- ইন্দ্রনীল ঘোষদস্তিদার
Friday, March 02, 2007
বর্ণপরিচয় এখন
পাঁচ বছরের ছেলেটাকে বাংলা শেখানোর চেষ্টা চলছে - পড়তে আর লিখতে, যাতে আগামী বছর কলকাতায় ফিরে স্কুলে ভর্তি হতে অসুবিধা না হয়। কঠিন কাজ - কারণ সেই এক বছর বয়স থেকে সে সারাদিন কাটিয়েছে নার্সারী/প্লেগ্রুপে - সেখানে আশেপাশে শুধুই ইংরিজী - সে বেশির ভাগ সময় ওই ভাষাতেই কথা বলতে অভ্যস্ত, বাড়িতে আমরা বাংলা বললেও। ঋক বাংলা বলতে পারে (যদিও "জর্ডি" টানে) - কিন্তু ইংরিজীর মতন পড়তে/লিখতে এখনো পুরোপুরি শেখেনি। কলকাতার স্কুল থেকে খবর নিয়েছিলুম - বর্ণপরিচয় পড়তে হবে - তাই কলকাতা থেকে বয়ে নিয়ে আসা নতুন বর্ণপরিচয় নিয়ে পড়তে বসা...
অভিজ্ঞতা খুব সুবিধের নয়...
প্রথমত, বইটা অত্যন্ত ম্যাড়মেড়ে - ফিকে গেরুয়া আর সবুজ রঙ - তুলনায় ইংরিজী বইগুলো অনেক ঝকঝকে - বাচ্চাদের কাছে অনেক আকর্ষণীয়।
দ্বিতীয়ত, ভাষা - এমন ভাষা, যে ভাষায় আমরা কেউই কথা বলি না - "গিরিশ তুমি কাল পড়িতে এস নাই কেন" - ছেলে প্রশ্ন করে "কেন 'এস' বলেছে?"
তৃতীয়ত, পদ্ধতি - ইংরিজী পড়াতে/লেখাতে শেখানোর সময় দেখেছি কত নতুন নতুন পদ্ধতি বেরিয়েছে - লেটারল্যান্ড এর মধ্যে অন্যতম - অথচ বাংলায় সেই দুশো বছরের পুরনো পদ্ধতির কোন পরিবর্তন নেই। বাচ্চাদের শেখানোর পদ্ধতি নিয়ে অন্যান্য দেশে যত গবেষণা হয়, তার একাংশও বাংলা নিয়ে হয় না (অন্তত পশ্চিমবঙ্গে)। বাংলাদেশে কি হয় জানার আগ্রহ আছে আমার।
এটা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেখলুম যে আমরা মোটামুটি আবেগের সুতোয় আটকে - বর্ণপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন করা মানে বিদ্যাসাগরের অপমান, বাংলা ভাষা নিয়ে শ্রদ্ধা-ভালোবাসার অভাব, মাতৃভাষার মূলরূপ সম্পর্কে অনীহা, বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে অনাগ্রহ, ইত্যাদি ইত্যাদি...
অথচ, বিদ্যাসাগর সম্পর্কে যতটুকু জানি, তাতে মনে হয় বর্ণপরিচয়কে প্রয়োজনে সম্পূর্ণ ওভারহল করে আজকের উপযোগী করলে সবচেয়ে খুশি হতেন ওই ভদ্রলোকই। নতুন পদ্ধতি চালু করলেও দুঃখিত হতেন না, বরং আমরা ওঁকে পুতুল বানিয়ে পুজো না করে নতুন করে চিন্তাভাবনা করছি দেখে খুশিই হতেন।
কিন্তু আমরা সাবেক বাঙালীরা 'বাঙালী' ঐতিহ্য ধুয়ে জল খেয়ে যাবো...বিদ্যাসাগরকে পুতুল বানিয়ে পুজো করবো...নতুন কিছু ভাববো না...কূপমণ্ডুকতা বললে কম বলা হয়।
অভিজ্ঞতা খুব সুবিধের নয়...
প্রথমত, বইটা অত্যন্ত ম্যাড়মেড়ে - ফিকে গেরুয়া আর সবুজ রঙ - তুলনায় ইংরিজী বইগুলো অনেক ঝকঝকে - বাচ্চাদের কাছে অনেক আকর্ষণীয়।
দ্বিতীয়ত, ভাষা - এমন ভাষা, যে ভাষায় আমরা কেউই কথা বলি না - "গিরিশ তুমি কাল পড়িতে এস নাই কেন" - ছেলে প্রশ্ন করে "কেন 'এস' বলেছে?"
তৃতীয়ত, পদ্ধতি - ইংরিজী পড়াতে/লেখাতে শেখানোর সময় দেখেছি কত নতুন নতুন পদ্ধতি বেরিয়েছে - লেটারল্যান্ড এর মধ্যে অন্যতম - অথচ বাংলায় সেই দুশো বছরের পুরনো পদ্ধতির কোন পরিবর্তন নেই। বাচ্চাদের শেখানোর পদ্ধতি নিয়ে অন্যান্য দেশে যত গবেষণা হয়, তার একাংশও বাংলা নিয়ে হয় না (অন্তত পশ্চিমবঙ্গে)। বাংলাদেশে কি হয় জানার আগ্রহ আছে আমার।
এটা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেখলুম যে আমরা মোটামুটি আবেগের সুতোয় আটকে - বর্ণপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন করা মানে বিদ্যাসাগরের অপমান, বাংলা ভাষা নিয়ে শ্রদ্ধা-ভালোবাসার অভাব, মাতৃভাষার মূলরূপ সম্পর্কে অনীহা, বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে অনাগ্রহ, ইত্যাদি ইত্যাদি...
অথচ, বিদ্যাসাগর সম্পর্কে যতটুকু জানি, তাতে মনে হয় বর্ণপরিচয়কে প্রয়োজনে সম্পূর্ণ ওভারহল করে আজকের উপযোগী করলে সবচেয়ে খুশি হতেন ওই ভদ্রলোকই। নতুন পদ্ধতি চালু করলেও দুঃখিত হতেন না, বরং আমরা ওঁকে পুতুল বানিয়ে পুজো না করে নতুন করে চিন্তাভাবনা করছি দেখে খুশিই হতেন।
কিন্তু আমরা সাবেক বাঙালীরা 'বাঙালী' ঐতিহ্য ধুয়ে জল খেয়ে যাবো...বিদ্যাসাগরকে পুতুল বানিয়ে পুজো করবো...নতুন কিছু ভাববো না...কূপমণ্ডুকতা বললে কম বলা হয়।
Subscribe to:
Posts (Atom)