তখন মেরিল্যাণ্ডে ভেরাইজনে চাকরি করি - বলা ভালো বেগার খাটি, আর পালানোর কথা ভাবি...অবাক লাগছে? শুধু পয়সার বাইরে জীবন যদি খোঁজেন আমেরিকা ভালো লাগবে না, সে দেশ "সব পেয়েছির দেশ" হলেও। আমারও অসহ্য লাগতো, বিশেষ করে প্রতিদিনের চিন্তা - কাল আমার কিউবমেটের হাতে গোলাপি কাগজ ধরিয়েছে, আজ আমাকে দেবে না তো? প্রোজেক্টে পয়সা নেই, সুতরাং তোমারও দাম নেই, দাম শুধু ওপরতলার ম্যানেজার-ভাইস প্রেসিডেন্টদের - ওদের প্রাইভেট জেট কখনো বন্ধ হয় না। আজ প্রোজেক্টে পয়সা নেই, তুমি যাও ভাই, আগের সপ্তাহে "সেরা কর্মী" হয়ে থাকলেও...তারপর সদ্য ঘটা ৯/১১...বিদেশীদের দিকে সন্দেহের চোখ...দেড় বছরের চেনা সিকিউরিটি গার্ড তখন রোজ খুঁটিয়ে আইডেন্টিটি কার্ড দেখে আগের দেড় বছর ধরে প্রতিদিন আমাদের দেখেও...এ দেশ ছেড়ে যাওয়াই ভালো।
একদিন নিউক্যাসলে এলাম ইন্টারভিউ দিতে, ইউনিভার্সিটিতে, রিসার্চের কাজ। সেদিন চোখ টানেনি শহরটা, কেমন যেন বিষন্ন, মেঘে ঢাকা, স্যাঁতস্যাঁতে...ইউনিভার্সিটির বাড়িটা অনেকটা বি ই কলেজের মতন...জমে থাকা ধুলো, নোংরা...কোথায় ভেরাইজনের ঝাঁ-চকচকে অফিসবাড়ি...কোথায় গেথার্সবার্গের ঝাঁ-চকচকে লেক-ফরেস্ট মল...
কিন্তু চলে এলাম, মাস কয়েকের মধ্যে আমেরিকার পাততাড়ি গুটিয়ে...শুরুর ঠিকানা উইন্ডসর টেরাসের এক কামরার শেয়ারড অ্যাকোমোডেশন। ততদিনে দুজন থেকে তিনজন হয়েছি, সুমনা আর ঋক গেছে কলকাতায়, যে প্লেনে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে লণ্ডন এসেছি, সেই প্লেনেই। আমি একা এসেছি নিউক্যাসলে। মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হলে ওরা আসবে। কয়েকমাস পর নতুন ঠিকানা হল ওয়ারউইক স্ট্রীট, কলকাতা থেকে নিয়ে এলাম ওদের, সুমনা স্কট উইলসনে চাকরি পেয়ে গেলো। দেখতে দেখতে চার বছর, ওয়ারউইক স্ট্রীট থেকে এখন হেলমস্লে রোড, ঋক এখন চার পেরিয়েছে, আর আমি নিউক্যাসল ইউনাইটেডের ভক্ত হয়ে গেছি। এই শহরটার কথাই লিখবো এবার।
রোমান আমলে তৈরী শহর, রোমান সম্রাট হেড্রিয়ানের তৈরী হেড্রিয়ানস ওয়ালের ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে। রোমানরা চলে যাবার পর এর নাম হয় "মঙ্কচেস্টার", শক্তিশালী অ্যাংলো-স্যাক্সন রাজার রাজত্বের অংশ...পর পর যুদ্ধ-বিদ্রোহে মঙ্কচেস্টার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবার পর Robert Curthose-এর আমলে তৈরী হয় Novum Castellum বা নিউক্যাসল। শিল্পবিপ্লবের সময় মাথা তোলে নিউক্যাসল, আশে পাশে অপর্যাপ্ত কয়লার যোগানের দৌলতে। ১৫৩৮ সালে প্রথম চালু হয় প্রবাদ "Carrying coals to Newcastle" - সেও এই কয়লাখনির দৌলতে - তৈরী হয় জাহাজের কারখানা, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প - এসবের জোরেই নিউক্যাসল পাল্লা দিয়েছিলো ম্যাঞ্চেস্টার আর লিভারপুলের সাথে। সে অনেক আগের কথা। টাইন নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, টাইনের কালো জলে নিউক্যাসলের সেদিনের স্বচ্ছলতা ধুয়ে গেছে। শেষ কয়লাখনির দরজা বন্ধ হল বছরকয়েক আগে, জাহাজের কারখানা রুগ্ন, ইংল্যাণ্ডের ক্রমশঃ বাড়তে থাকা "নর্থ-সাউথ ডিভাইড"-এর কবলে পড়ে নিউক্যাসল আজ অক্সিজেনের অভাবে ধুঁকতে থাকা এক হাঁপানির রুগী - যার আরেকটিবার উঠে দাঁড়ানোর ইচ্ছের কোন খামতি নেই - শুধু উঠে দাঁড়ানোর জন্যে সম্বল কিছু নেই। শিল্পের সম্বলহীন নিউক্যাসল কয়েক দশক ধরে আঁকড়ে রয়েছে শুধু একটা ফুটবল ক্লাবকে - নিউক্যাসল ইউনাইটেড...
শুধুমাত্র গত দুই তিন বছরে নতুন কিছু হচ্ছে এখানে - মিলেনিয়াম ব্রীজ, বল্টিক, নতুন করে সাজানো কী-সাইড, সায়েন্স সিটি...তাও জর্ডি-প্রাইড আবর্তিত হয় নিউক্যাসল ইউনাইটেডকে ঘিরে...
জর্ডি মানে টাইন নদীর আশেপাশের মানুষজন...
নিউক্যাসল ইউনাইটেড এখানকার মানুষের কাছে শুধু একটা ফুটবল ক্লাব নয় - অনেক বেশি - গোটা অঞ্চলের উঠে দাঁড়ানোর হাতিয়ার। "The Geordie nation, that's what we're fighting for. London's the enemy! You exploit us, you use us." - নর্থ-সাউথ ডিভাইডের প্রত্যক্ষ ফসল, জন হলের ব্যবসা-বুদ্ধির শুরু।
Michael Martin, the editor of the True Faith fanzine, recalls his own Geordie blood stirring as Keegan's rejuvenated side galloped into the breakaway Premier League. "John Hall tapped into something latent, the pride and the apartness of the north-east. Newcastle was depressed; industries like mining and shipbuilding had been destroyed. We bought into the idea of the club as the flagship of revival." [Gurdian]
জন হল শুধুমাত্র ব্যবসার খাতিরে জর্ডি-প্রাইডকে খুঁচিয়ে তুললেও, এখানকার মানুষ কিন্তু নিউক্যাসল ইউনাইটেডকে আঁকড়ে থাকার অভ্যেস ছাড়তে পারেনি। উঠে যাওয়া জাহাজ তৈরীর কারখানার শ্রমিক, বন্ধ হয়ে যাওয়া খনির মজুর, রিটেল শপের কর্মী - এরাই দলটার নাছোরবান্দা সমর্থক - মাসমাইনের অর্ধেক দিয়ে খেলার টিকিট কাটে - প্রতি হপ্তায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ ভিড় করে সেন্ট জেমস পার্কে, মদের বোতল আর অবিশ্রান্ত বকর বকর করা ছাড়া এই এদের এন্টারটেনমেন্ট। প্রতি হপ্তায় এরা স্বপ্ন দেখে অ্যালান শিয়ারার, নবি সোলানো, শে গিভেনদের নিয়ে...মাঠের ভিতরে ডায়ার আর লী বোওইয়ার নিজেদের মধ্যে মারামারি করলে কান্নায় ভেঙে পড়ে এরা...প্রিমিয়ার লীগে দুই বা তিন নম্বর থেকে পাঁচে নেমে গেলে ক্ষুব্ধ হয় এরা, আবার সোনেসের হাতে পড়ে তলানিতে ঠেকে গিয়ে গ্লেন রোডারের হাত ধরে তেরো নম্বর থেকে সাতে উঠে আসায় এরাই আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখে...
মায়া পড়ে যায়। এদের দেখতে দেখতে আমিও কবে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের সমর্থক হয়ে গেছি নিজেই জানি না। এখন আমিও প্রতি হপ্তায় রেডিওতে খেলা শুনতে শুনতে চেঁচাই, নিউক্যাসল ইউনাইটেড হেরে গেলে রাতের খাবারটা বিস্বাদ লাগে, পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে কফি খেতে খেতে এই নিয়েই কথা বলি...ব্লগে মোহনবাগানের পাশে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের লিঙ্ক রাখি...
চার বছরের ছেলেটা ফুটবল বোঝে না কিছুই, কিন্তু অ্যালান শিয়ারারকে একশোবার চেনে, চেয়েচিন্তে সাদাকালো জার্সি বাগিয়েছে - পিছনে শিয়ারারের নয় নম্বর আর নাম লেখা...ওই পরে ও নার্সারীতে শিয়ারার হয়...অ্যালান শিয়ারারের টেস্টিমনিয়াল ম্যাচের দিন গোটা শহরটা যখন সাদা-কালো হয়ে ওঠে, আমিও নিউক্যাসল ইউনাইটেডের সাদা-কালো জামা পরি...
এই শহরটা ছেড়ে চলে যাবো শিগগিরি, বছরখানেকের মধ্যে...কিন্তু নিউক্যাসল ইউনাইটেডের স্মৃতি থেকে যাবে, ওই সাদা-কালো জামাটার মধ্যে...কখনো এই শহরটার সঙ্গে আবার দেখা হলে আমিই জিজ্ঞেস করবো - "how gadgie , ya'aalreet deein?"
মিলেনিয়াম ব্রীজ – অ্যান্থনি বার্ণস, জানুয়ারী ২০০৬
সেন্ট জেমস পার্ক – ইয়ান ব্রিটন
2 comments:
নিউ ক্যসলের গ্রামের ছবি দেখতে চাই।
নিউক্যাসল তো গ্রাম নয়, ইন্ডাস্ট্রিয়াল শহর, যদিও সেই ইন্ডাস্ট্রী প্রায় মৃত। আশেপাশে নর্দামবারল্যাণ্ডে গ্রাম আছে, কিছু ছবি আছে অ্যালবামে, নতুন ছবি আরো লাগাবো। তবে ইয়র্কশায়ার বেশি সুন্দর।
Post a Comment