তাইলে আর কি - চলুন বেড়িয়ে আসি, সরি, ঘরে ফিরি৷
এয়ারপোর্টে নামুন, লাইনে দাঁড়ান, পাসপোর্টে ছাপ্পা লাগান, কাস্টমস ক্লিয়ার করুন - এসব সিম্পল সিম্পল কাজকম্মোগুলো শেষ করে চলুন বেরোই৷ বাড়ির গাড়ি থাকলে তাতে, নয়তো "কলকাতা ক্যাব'-ও আছে৷ আর নেহাত পুরনোপন্থী হলে হলদে ট্যাক্সিও - ওই যে আকাশ থেকে হলদে মোজাইকটা দ্যাখেননি? শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে...না: আসলে মনে হয় কোটি কোটি৷
গাড়িতে উঠে রেডিও চালিয়ে দিন - 91.9FM - কলকাতার নতুন ক্রেজ - ফ্রেণ্ডস এফএম৷ অটটা থেকে দশটা, দশটা থেকে বারোটা - সিনেমার শোয়ের মতন খেপে খেপে প্রোগ্রাম - টক শো৷ গান শুনতে পাবেন, চাইলে ফোন করুন৷ আঙুলে বাত থাকলে ভালো ব্যায়াম হবে৷ ফোনে আড্ডা মারুন টক শো হোস্টের সঙ্গে৷ উত্তর দিন "উত্তমকুমার অভিনীত নায়ক সিনেমার নায়কের ভূমিকায় কে অভিনয় করেছিলেন' গোছের প্রশ্নের এবং জিতে নিন গিফট ভাউচার৷ তবে ফোন করার আগে নিজের বাংলা স্টাইলটা একটু ঝালিয়ে নিন৷
"হাই নীলান
"আমি থিংক কড় ড়হি থি ekbar ক্যালিম্পং ভি
ভাবছেন বানান ভুল? ব্যকরণ ভুল? এক্কেরে না৷ এগুলো সঅঅঅঅঅব ঠেকে শেখা - কলকাতার হালফিলের ভাষা-বিপ্লব৷ শপিং মলে আচ্ছন্ন ড্যাশিং কলকাতার ড্যাশিং ইয়ং বেঙ্গলের সাথে বাতচিত করতে হলে আপনাকে এই ভাষাবিপ্লবে ভাগ নিতে হবে৷
আপিস কোথায়? সেক্টর ফাইভে? আগে বাটার দোকানে গিয়ে একটা গামবুট কিনে আনুন, অভাবে রবারের জুতো৷ ল্যাপটপের ব্যাগের মধ্যে বা অন্য ব্যাগে সেগুলো ভরে আপিস চলুন - কারণ নবদিগন্ত বর্ষায় সত্যিই দিগন্তবিস্তৃত জলাশয়৷ সাড়ে ন'টায় আপিস? অবশ্যই কখন বেরোবেন সেটা নির্ভর করবে আপনার বাড়ি কোথায় তার ওপর৷ দক্ষিণ কলকাতার শহরতলি এলাকায় থাকলে এই সাড়ে সাতটা নাগাদ বেরিয়ে পড়াই ভালো কারণ ভূতল পরিবহণ নিগমের দ্রুতগামী বাসগুলো প্রতি দশ মিটারে একবার দাঁড়াবে যাত্রী তোলার জন্যে৷ যত পারবেন রোগা হয়ে যান, নইলে বাসে চড়া কঠিন হবে৷ কে বলে যানবাহনের অভাব? এত শাটল আছে কি করতে? রাস্তায় যদি দেখেন একটা গাড়ির (সাধারণত: অ্যাম্বাস্যাডর বা ইন্ডিকা) দিকে জনা পঞ্চাশেক লোক ছুটে যাচ্ছে, বুঝে নেবেন ওইটি শাটল৷ পারলে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে জায়গা করে নিন - অ্যাম্বাস্যাডরে ছয়জন, ইন্ডিকায় পাঁচ৷ ওই যে বল্লাম - একটু সরু হয়ে যান, ছোট হয়ে যান৷ এই হবে আপনার জীবনমন্ত্র - নইলে বাস, মেট্রো, অটো - কোথাওই চড়তে পারবেন না৷
নিজে গাড়ি কিনবেন? একবার Q-এর সাথে পারলে দেখা করুন - জেমস বণ্ডের মতন গেজেট লাগাতে হবে গাড়িতে, পাশের গাড়ি খুব কাছে এসে গেলেই যাতে আপনার গাড়ি থেকে ইস্পাতের ফলা বেরিয়ে আসে - নইলে আপনি আপনার গাড়িতে আছেন না পাশের গাড়িতে এই ধাঁধা উদ্ধার করতে করতে আপনার গাড়ির কোন একটা অংশ হাপিস হয়ে যাবে৷ রাস্তায় গাড়ি চালানোর আগে মন দিয়ে মাসখানেক অবস্ট্যাকল রেস অভ্যেস করুন, গাড়ি নিয়ে - ওই ফুটবল মাঠে ট্রেনিং হয় দেখেছেন - ফুটবলাররা প্র্যাকটিস কোনের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে ছোটে বল নিয়ে - সেরকম৷ আর কব্জির ব্যায়াম করুন - রজার ফেডারারের চেয়েও নমনীয় কব্জি চাই - নইলে ওই অবস্ট্যাকল রেসে কূল পাবেন না৷ ও হ্যাঁ, যদি সাবধানী ড্রাইভার হয়ে থাকেন কখনো, বা ভালোভাবে গাড়ি চালানো শিখে থাকেন, তাহলে চেষ্টা করুন সে সব ভুলে যেতে, নইলে গাড়ি স্টার্ট করে দাঁড়িয়েই থাকতে হবে৷ মুজতবা আলির দেশেবিদেশে পড়ে নেবেন - বিশেষ করে পেশোয়ারের রাস্তার বর্ণনা৷ শুধু মনে রাখবেন যতক্ষণ না মানুষের গায়ে ছোঁয়া লাগছে ততক্ষণ সবাই পাঠানদের মতন নির্লিপ্ত, ছোঁয়া লেগে গেলে আপনি সবসময়েই দোষী৷ ভালো দৌড়তে পারলে হয়তো বেঁচে গেলেও যেতে পারেন৷
পোঁটলা-পুঁটলি আছে বলেছিলেন না? স্কুলে ভর্তি করবেন নিশ্চয়৷ স্টেটাস বড় হলে আপনার জন্যে আছে হেরিটেজ বা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, তবে হেরিটেজ কি নামে হয়? সেই হেরিটেজ যদি আপনার চাহিদা হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে বেরোতে হবে - স্কুলে স্কুলে৷ ছানাপোনা পয়দা করে আপনি মহা অন্যায় করেছেন সেটা স্কুলের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আপিস থেকে হেডমাস্টার অবধি সবাই আপনাকে সফলভাবে বুঝিয়ে দেবেন৷ হ্যাঁ, ব্যতিক্রম আছে বৈকি - ছেলেমেয়ের ক্রিমিন্যাল বাপ-মা হিসেবে আপনার কর্তব্য সেই ব্যতিক্রম খুঁজে বের করা৷ কিন্তু তারপরেও কি পার পেয়ে যাবেন ভাবছেন? সে সিঙ্গুরে বালি - ছেলেমেয়ের স্ক্র্যাপবুকের জন্যে ছবি লাগবে - আঁকলে হবে না - দোকানে ঘুরে ঘুরে খুঁজুন কোথায় কামিনী/কাঞ্চন/দোপাটি ইত্যাদি ফুলের ছবি আছে, বর্ষার ফুলের চারখানি নমুনা লাগবে, তাও ছেলেমেয়ের ইস্কুলের খাতায় দিদিমণি যে ফুলগুলোর নাম বলেছেন সেগুলোই৷ হপ্তায় পঁয়তাল্লিশ ঘন্টা আপিসে কাজ করতে হবে - শ্রম আইনের মুখে জুতো মেরে - কম করেও রাত সাড়ে আটটা-নটায় ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়েকে হোমওয়ার্ক করাতে বসান৷ ওদের এখন আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ নয় - লেট টু বেড, আর্লি টু রাইজ৷ নইলে আপনার পথে তারা হাঁটবে কি করে? অবশ্য আপনি যদি ওদের ওই পথেই একশো মিটার স্প্রিন্টের গতিতে দৌড় করাতে চান তাহলে হয়তো সিস্টেমটা আপনার পছন্দ হয়ে গেলেও যেতে পারে৷ কথিত আছে যে কিছু স্কুলে যেখানে হোমওয়ার্কের চাপ তুলনামূলকভাবে কম, সেখানে অভিভাবকরা সোরগোল তোলেন কেন তাঁদের ছয়-সাত বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের অমুকতমুক স্কুলের চেয়ে কম কাজ করানো হচ্ছে৷ ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের গোটা প্ল্যানিংটা এক্ষুণি করে ফেলবেন কিনা সেটা অবশ্যই আপনার হাতে৷
সপ্তাহের শেষে বেড়াতে যাবেন? বা খেতে যাবেন? এই দুটো ব্যাপারে কলকাতা অভাবনীয় উন্নতি করেছে৷ সাউথ সিটি মল, প্যান্টালুনস, ওয়েস্ট সাইড, সিটি সেন্টার, ফ্যাবইন্ডিয়া - মলের কমতি আছে নাকি? ইরেসপেক্টিভ অব পকেটের ওজন, বেড়ানোর পক্ষে আইডিয়াল৷ ঠাণ্ডা হাওয়া পাবেন, চলমান সিঁড়ি পাবেন, মনের বয়স থাকলে পরস্পরের চোখ এড়িয়ে সুন্দর দৃশ্য পাবেন৷ পকেট ভারি হলে হালকা করুন, হালকা হলে গন্ধ শুঁকে অর্ধভোজন করুন - মানে উইন্ডো শপিং করুন৷ আর ভোজন - খাদ্যরসিক হলে কলকাতা এই মুহুর্তে আপনাকে দুই হাত তুলে স্বাগত জানাবে৷ ডেকার্স লেন এখনও আছে, ব্যাঙ্কশাল কোর্টের আশেপাশে বা শিপিং অথরিটির আশেপাশে সেই রাস্তার ধারের খাবারের দোকান থেকে শুরু করে সেক্টর ফাইভের "ঝুপস"; মাঝারি পকেটের জন্যে ভজহরি মান্না বা ফিঙ্গারটিপস; ভারী পকেটের জন্যে অর্কজ ইত্যাদি৷ নির্ভর করবে আপনি কুলপি কি ভাবে খান - দাম দেখে না স্বাদ দেখে, কারণ যে কুলপি ছেলেবেলায় আপনি আট টাকায় খেতেন, অর্কজে সেই কুলপিই পাবেন একশোকুড়ি টাকায়৷ বিশদ জানতে চাইলে অপেক্ষা করুন অদূর ভবিষ্যতের বই "কলকাতার খাবারদাবার ফর ডামিজ'-এর জন্যে৷
নাটক সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন তো অনেক সিনেমা হল আছে, মাল্টিপ্লেক্স গোছের৷ গ্রুপ থিয়েটার এখনও হয়৷ তবে চব্বিশ ঘন্টা নিরবচ্ছিন্ন নাটক দেখতে হলে টিউন ইন করুন বাংলা চব্বিশ ঘন্টার খবরের চ্যানেলগুলোতে৷ তারকাখচিত কাস্টিং৷ একদিকে রাজনীতির জগতের তারকারা, সাথে সঙ্গত করেন সুশীল তারকাদের এক মহা ব্যাটেলিয়ন, এবং কে নেই তাতে৷ কেউ ধর্না দেন তো কেউ মহামিছিল করেন তো কেউ মৃত্যুঘন্টার সাথে ভায়োলিনের সঙ্গত করেন তো কেউ মোমবাতির চাষ করেন৷ চব্বিশ ঘন্টা ঘটতে থাকা নানান নাটক ফলো করতে চাইলে এই নিউজ চ্যানেলগুলোর টেলিকাস্ট আর রিটেলিকাস্ট ছাড়া আপনার জীবন অন্ধকার৷ আপিস থেকে ফিরে এই চ্যানেলগুলো আপনার সঙ্গী, নিরবচ্ছিন্ন এন্টারটেইনমেন্টের জন্যে৷ কখনো সখনো একটু বোর হয়ে গেলে চ্যানেল ঘুরিয়ে দেখে নিন চলতে থাকা অসংখ্য রিয়েলিটি শো-র কোনো একটা - কচি ছেলেমেয়েরা সুপার ট্যালেন্ট হওয়ার লক্ষ্যে আপনার মন ভোলাবে "ধক্ ধক্ করনে লাগা" বা "তু চীজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত" দিয়ে, আর ফাউ হিসেবে সমস্ত হিট হতে চাওয়া বাবা-মা-অভিভাবকদের ইঁদুরদৌড়ও পেয়ে যাবেন, বিচারকদের "কনস্ট্রাকটিভ" সমালোচনা - যেগুলো কিনা প্রতিযোগীদের মানসিকভাবে ধাক্কা দেয় - সরি সরি - শক্ত করে - সেগুলোও পাবেন এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবে...
এই ভাবেই চলবে - ততদিন যতদিন আপনি তাল রেখে চলতে পারবেন৷ তাল রাখতে না পারলে এই কলকাতা আর আপনার জন্যে নয়৷ কলকাতা আপনাকে কখনও চায়নি, আপনি কলকাতাকে চেয়ে থাকলেও৷ আপনি পিছিয়ে আছেন, কলকাতা অনেক এগিয়ে গিয়েছে ব্ল্যাক হোলের দিকে - এর সাথে দৌড়নোর বয়স আপনার চলে গেছে৷ আপনার দৌড়নোর ক্ষমতা কতদূর সেটা জানতে হলে বরং আগে কিছুদিন ট্রায়াল দিয়ে নেবেন ফাইনাল সাইনিং-এর আগে - মানে বাক্সো-ডেক্সো গুটিয়ে নিয়ে আসার আগে৷ মাঝের এই বছরগুলোতে আপনাকে বাদ দিয়ে আপনার বাড়ি কতটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে সেটাও সেই ট্রায়ালের সময় আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠবে৷ আর সেটা আপনার পক্ষে বরং উপকারী - কারণ ওই একটা জায়গায় তাল কেটে গিয়ে থাকলে আপনি এই "দেশে ফেরা ফর ডামিজ" হাজারবার পড়েও নিজেকে তৈরী করতে পারবেন না৷
যদি তাল রাখতে পারেন তাহলে এই বইয়ের পরের এডিশন লেখার জন্যে প্রকাশক আপনার বাড়ি ধাওয়া করবে৷
(মূল লেখা এখানে)