Wednesday, October 31, 2018

দিকশূন্যপুরের রাস্তায় - The Road to Nowhere (৪র্থ পর্ব)


আমার একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে - ঘড়িতে যে সময়েই অ্যালার্ম দিই না কেন, তার মিনিট কুড়ি আগে ঘুম ভাঙবে, একদম ভাঙবেই। খুব রেয়ার কিছু দিন ছাড়া এত বছরে এর কোনো নড়চড় হয়নি। এদিনও তাই হল। ভোর সাড়ে তিনটেতে অ্যালার্ম দিয়ে থাকলেও ঘুম ভেঙে গেল তিনটের পরে পরেই। কিছুক্ষণ ল্যাদ খেয়ে উঠে পাশের ঘরে টোকা মেরে সুমনাকে ঘুম থেকে তুলে নিজে তৈরী হয়ে ঋককে তুললাম। ওদিকে, সুমনাও তৈরী হয়ে ঋতিকে তুলে দিলো। তারপর রিসেপশনে চাবি দিয়ে গাড়িতে ফের জিনিসপত্র তুলে, নীচে দারোয়ানকে ঘুম থেকে তুলে গেট খুলিয়ে বেরোতে বেরোতে সেই পৌনে পাঁচটা হয়েই গেলো।

ওই ভোরে সিউড়ির রাস্তায় একটাও জনমনিষ্যি নেই, শুধু রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো একা একা দাঁড়িয়ে আছে। রওনা দিলাম সিউড়ি-দুমকা হাইওয়ের দিকে। পথে একটা পেট্রোল পাম্প দেখে ট্যাংক ভরে নিলাম। তারপর ফের চলা শুরু।

এখানে প্রধান ভরসা গুগুল ম্যাপ, কারণ মিচেলিনের পুরনো ম্যাপে বর্ধমান থেকে সিউড়ির যে রাস্তা দিয়ে এসেছি সেটা নেইই। আর যেহেতু গুগুল ম্যাপ বেশ সুন্দরভাবে নিয়ে এসেছে, তাই ভরসাও বেড়েছে। তা এক্ষেত্রেও গুগুল ম্যাপ ধরেই চলতে চলতে একটা বড় রাস্তায় এসে পড়লাম - সেখান থেকে লরি ছুটছে দেখতে পাচ্ছি। মনে হল এটাই হয়তো সিউড়ি-দুমকা হাইওয়ে হবে, কিন্তু গুগুল তো আমাকে সোজা এইটা পেরিয়ে উল্টোদিকের অন্ধকার রাস্তাতে যেতে বলছে। কেউ নেই যে জিগ্গেস করবো, কাজেই, গুগুলকে ভরসা করে সোজা চলেই গেলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখি সে রাস্তা মাঠঘাটের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলছে, হাইওয়ের সাথে বিন্দুমাত্র মেলে না, আর বেশিটাই মাটির - আর প্রায় কাদা মাটির, আর সুড়কি। এইটাই কি ঠিক রাস্তা? কে জানে বাবা...এগিয়ে তো যাচ্ছি। আর মাঝেমাঝেই আগের দিনের সন্ধ্যের মত হঠাৎ হঠাৎ কুয়াশা ধেয়ে আসছে কাঁচের ওপর। চার পাঁচ কিলোমিটার এভাবেই চলার পর চোখে পড়লো একটা গুমটিঘর - তার সামনে একটা লোক কুপি জ্বালিয়ে বসে রয়েছে। তাকেই শুধোলাম - এইটা কি দুমকার রাস্তা? সে বল্ল হাঁ হাঁ, ইটাই। তারপর জিগ্গেস করলুম - আর কতটা এরকম রাস্তা? সে বল্ল আরো কিলোমিটার দুয়েক।

অন্ততঃ হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেলো - যে ভুল রাস্তায় আসিনি। দুই কিলোমিটারটা ঠিক দুই ছিলো না, চার পাঁচ হবে হয়তো - তারপর পাকা রাস্তা দেখা গেলো। ততক্ষণে আলোও ফুটেছে, আশপাশটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে - মাঠ, কাশের বন, লাল মাটি...ঋক/ঋতিকে দেখানোর ইচ্ছে ছিলো - কিন্তু দুজনের একজন পিছনের সীটে, আরেকজন মাঝের সীটে লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

রাস্তাটা ক্রমশঃ ভালো হল, তারপর বেশ ভালো হল। ভোরের হালকা শিশিরে ভেজা কালো পিচঢালা রাস্তা এগিয়েছে দুপাশে ছোট ছোট গ্রাম ফেলে রেখে - রঙপুর, ধানিয়াগ্রাম, বড়া চতুরি, সিধুলি...শেষে কেঁদুলী (এই সম্ভবত জয়দেবের কেঁদুলী - ঠিক জানি না) ছাড়িয়ে ঢুকে গেলাম ঝাড়খন্ডে। গুগুল ক্রমাগত রাস্তার নাম বলে চলে, প্রায় প্রতি জাংশনে - আর সে এক কিম্ভুত উচ্চারণে। ঝাড়খন্ডে ঢুকে পড়েছি বোঝা গেল আশেপাশে দোকানের বোর্ডে ভাষা বদলে যাওয়ায়। প্রথম যে জায়গাটার নাম খেয়াল করলাম সেটা হল দিগুলী। জানি না, সিধুলি, কেঁদুলী আর দিগুলী - এই তিনটে পর পর জায়গার মধ্যে কোনো লিংক রয়েছে কিনা, নামের মিল রয়েছে তা তো দেখাই যাচ্ছে।

সিউড়ি থেকে ম্যাসাঞ্জোর প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার - এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া উচিৎ ছিলো - কিন্তু শুরুর ওই দশ কিলোমিটার মাটি-সুড়কির গর্তভরা রাস্তায় সময় খেয়ে নেওয়ায় ম্যাসাঞ্জোর ব্যারেজের পাশে এসে পৌঁছলাম তখন ছ'টা বেজে গেছে। মনটা চা চা করছে - সেই ভোরে উঠেছি, চা খাইনি। অথচ সকালের চা-টা দুধ চিনি ছাড়া লিকার খেতে ইচ্ছে করে না - অনেকদিনের অভ্যেস। ড্যামের একদম শুরুতেই একটা চায়ের দোকান - ভাবলুম যদি চা পাই। গিয়ে দেখি সে একটা বাচ্চা ছেলে বসে রয়েছে - সে সবে দোকান খুলেছে, হয়তো তার বাপ বা মা কেউ এসে উনুন ধরাবে। কাজেই চা পাওয়া গেল না, বরং ওইখানেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে সাথে আনা গরমজলের সদ্ব্যবহার করে সেই লিকার চা-ই খেলাম। ঋক/ঋতি তখনো গভীর ঘুমে, কাজেই আমি একটা ধোঁয়াও টেনে নিলাম (টেরিয়ে তাকাবেন না মোটে, এই লম্বা ড্রাইভে আমার অফিশিয়াল পারমিশন থাকে)। তারপর ম্যাসাঞ্জোর লেকের ধার ধরে এগোলাম দুমকার দিকে।

রাস্তার এই অংশটা বড় সুন্দর। ছোট ছোট লালচে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে শুয়ে রয়েছে ঝাঝাপাড়া ছাড়িয়ে আরো কিছু দূর অবধি। তারপর পাহাড় শেষ হয়ে বিস্তীর্ণ রুক্ষ লালচে জমির মধ্যে দিয়ে সোজা টানা রাস্তা - মাঝে মাঝে ওঠে নামে, আর কালো পিচের ওপর লালচে ধূলো ছড়িয়ে ছুটে যায় একের পর এক লরি....

ম্যাসাঞ্জোর থেকে দুমকা হয়ে যে রাস্তাটা ভাগলপুরের দিকে চলে গেছে সেটা ন্যাশনাল হাইওয়ে ১১৪এ। দুমকা অবধি এই নাম, তারপর দুমকা শহর বাঁদিকে ফেলে রেখে ডানদিকে ঘুরে ন্যাশনাল হাইওয়ে ১৭ সোজা চলে গেছে ভাগলপুর। সিউড়ি থেকে হিসেব করলে সাত ঘন্টায় পূর্ণিয়া পৌঁছনোর কথা। ভোর পাঁচটায় বেরিয়েছি - অর্থাৎ, দুপুরের মধ্যে পূর্ণিয়া পৌঁছে যাবো। দুপুরের খাওয়া পূর্ণিয়া ছাড়িয়ে কোনো একটা ধাবায় সেরে নেবো, আপাতত সকালের জন্যে কিছু পেটে দিতে হবে। দেবাশিস আগেই বলেছিলো এই রাস্তায় ভালো খাবারের দোকান পাওয়া একটু চাপের, ওর সাজেশন ছিলো হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরনো, বা প্যাক করে নিয়ে আসা - কিন্তু ভোর সাড়ে চারটেয় ওসব হবে কোত্থেকে? আগের দিন বাড়ি থেকে রওনা দেওয়ার সময় কিছু মিষ্টি ছাঁদায় বাঁধা ছিলো, আর ছিলো একটা পাঁউরুটির প্যাকেট। ঠিক হল কোথাও থেকে ডিম কলা কিনে নেওয়া হবে, তাই দিয়ে ব্রেকফাস্ট মোটামুটি হয়ে যাবে।

হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে মাঝেমাঝেই ছোটো ছোটো গ্রাম, বা আরেকটু বড় - ঠিক শহর নয়, মাঝামাঝি কিছু বলা যায় - পেরোতে হয়। সেখানে বাজার টাজার বসেছে। গাড়ি দাঁড় করানো একটু কঠিন - কারণ যে রাস্তায় বাজার, সেই একই রাস্তায় বাস, লরি, অটো, টোটো, গরু, মোষ, ছাগল, হাঁস, মুরগি, মানুষ সবই একসাথে সহাবস্থান করে। দুমকার একটু আগে থেকেই হাইওয়ের মসৃণ পিচের সাড়ে দেড়টা বেজে গেছে। পুরো ভাঙ্গা না হলেও, টুকটাক ভাঙাচোরা, বাম্পার, ধুলো...আবার এই ছোটো বাজারগুলো পেরিয়ে গেলে মোটামুটি ঠিকঠাক।

তো এরকম একটা বাজার, যেখানে একটু চওড়া রাস্তা, আর রাস্তার পাশে কিছুটা ফাঁকা জায়গা পেলাম, সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটা দোকানে কলা কিনলাম। কোনো দোকানে ডিম পাওয়া যাবে? সেদ্ধ? কলার দোকানদার বল্ল - ইঁয়েহি মিল যায়েগা, আভি ফুন লাগাতে হেঁ। সে দিব্যি মোবাইল বের করে কাউকে একটা ফোন করলো - আমায় বল্ল - আন্ডেওয়ালেকো ফুন কিয়া। তা আমাদের দুর্ভাগ্য, আন্ডেওয়ালা তখনই সিদ্ধ ডিম দিতে পারলো না। কিন্তু লোকটা আমাদের মত আরবিট লোকের জন্যে চেষ্টা তো করেছিলো - সেটাকেই বাহবা দিতে হয়। আরো দু চার জায়গায় খোঁজ করলাম - চায়ের দোকান ইত্যাদিতে। একজন বল্ল - নবরাত্রি শুরু হয়ে গেছে, আর কি কোথাও পাবেন...হুঁ, সেইটা কারণ হতেই পারে। ডিমের আশা ছেড়ে দিয়ে এগোতে এগোতে দেখলাম অনেক মিষ্টির দোকান পড়ছে - থরে থরে লাড্ডু, পেঁড়া সাজানো। আচ্ছা, যদি নোনতা কিছু পাই...পুরি-সবজি, আলু-পরোটা? আমাদের একজন আবার সুগারের রুগী, কাজেই শুধু পাঁউরুটি/কলা/মিষ্টিতে একটু আপত্তি আছে। নাঃ, পুরি-সবজিও পাওয়া গেলো না, তবে বালুসাই দেখে লোভ হল। ফ্রেশ বানানো, মাছি বসছে যদিও, আর গরুতে চেটেও থাকতে পারে - খোলা রাখা রয়েছে, গরু আশেপাশেই ঘুরছে দোকানের সামনে...তা জাতীয় মা বলে কথা, চেটে দিলে দোষ নেই - এই ভেবে খান কয়েক কিনেই ফেল্লাম। মাইরি বলছি - কলকাতায় অনেক বালুসাই খেয়েছি, কিন্তু ফ্রেশ বালুসাই, সে রাস্তার দোকানে খোলা বিক্রি হলেও - জায়গার কল্যাণে কিনা জানি না - ঝক্কাস টেস্ট। আমি তো খেলামই, ছেলেমেয়েও পটাপট খেয়ে ফেললো, এমনকি সুগারের রুগীও খেয়ে নিলো। জায়গাটা খুব সম্ভবত হংসডিহা বা হাঁসডিহা - একদম বিহার-ঝাড়খন্ড বর্ডারের কাছেই।

ঝাড়খন্ড পেরোলাম, বিহারে ঢুকতে মনে হল এই যে নীতিশবাউকে লোকে এত তোল্লাই দেয় - রাস্তা টাস্তা নাকি ব্যাপক বানিয়েছেন - সেটা কী সম্পূর্ণ ঢপ? মানে যা দেখলাম তাতে মনে হল পূর্ণিয়ার বহু আগে, এমনকি ভাগলপুর পৌঁছনোরও আগে সকালে যা খেয়েছি সব হজম হয়ে যাবে। রাস্তার ধারে বাজারের সংখ্যাও বাড়ছে, ভিড়ও বাড়ছে - এইভাবে চললো বেশ কিছুটা। ভাগলপুর থেকে তখন ওই পঁচিশ-তিরিশ কিলোমিটার দূরে - একটা পেট্রোল পাম্পে দাঁড়ালাম, একটু হাল্কা হওয়া দকরকার সবারই। পাম্পের ঠিক মুখে একটা চায়ের দোকান - সেখান থেকে একটু গরম জল ফ্লাস্কে ভরে নিতে হবে, আর চাও খাবো ভাবলাম। চা খেতে খেতে দোকানীর পাশে একজনের সাথে কিছু কথা হল...

কাঁহাসে আ রাহেঁ হেঁ?

কলকত্তেসে।

কাঁহা যাইয়েগা?

শিলিগুড়ি যায়েঙ্গে।

শিলিগুড়ি ইঁহাসে ক্যাইসে যায়েঙ্গে?

কিঁউ? ভাগলপুর-পূর্ণিয়া হো কর?

সাব, ভাগলপুর তো যায়েঙ্গে, পর পূর্ণিয়া ক্যায়সে যায়েঙ্গে?

যা শালা, আমি তো হুব্বা। ভাগলপুর দিয়েই তো বিক্রমশীলা ব্রীজ টপকে পূর্ণিয়া যায়। আমি তাই বল্লুম। যা উত্তর দিলো শুনে সাথে সাথে যেন ঝড়-ঝঞ্ঝা-বজ্রপাত-সুনামি-ভূমিকম্প-অগ্নুৎপাত-দাবানল সব একসাথে...

সাব, হাম ইয়াঁহা তিন দিনসে বইঠে হ্যায়। বিক্রমশীলা ব্রীজ পুরা বন্‌ধ হ্যায়, সতরা তারিখ কো চালু হোগা! উও দেখিয়ে, উও মেরা ট্রাক।

কেলেঙ্কারি করেছে। গুগুল ম্যাপ তো দিব্যি দেখাচ্ছে বিক্রমশীলা ব্রীজে স্লো ট্রাফিক। বন্ধ তো বলছে না। কিছুক্ষণ কথা বলে বুঝলাম ২৭শে সেপ্টেম্বর বিক্রমশীলা ব্রীজ বন্ধ হয়েছে, ১৭ই অক্টোবর খোলার কথা। সেই সময়ে একদম মাঝের একটা ৩৪ মিটারের স্প্যানে কাজ হচ্ছে বলে এপার থেকে ছোট গাড়ি (অটো ইত্যাদি) কিছুদূর যাচ্ছে, তারপর হেঁটে পেরিয়ে ওপার থেকে আবার সেই অটো/টোটো। সেই জন্যেই ট্রাফিক বন্ধ দেখাচ্ছে না, কনজেস্টেড বা স্লো দেখাচ্ছে।

(কথা বলতে বলতে গুগুলে সার্চ মেরে দেখলাম - ঠিকই, ২৪শে সেপ্টেম্বরের টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় খবর আছে - সেখানেও বলেছে ১৭ই অক্টোবর খুলবে - আমাদেরই দোষ - ফারাক্কা এড়ানোর জন্যে যখন নতুন প্ল্যান করলাম, তখনই চেক করে নেওয়া উচিৎ ছিলো - কিন্তু এ জিনিস মাথায় আসবে কী করে যে এরকম একটা ভাইটাল ব্রীজ বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও ফারাক্কায় এই সময়েই মেনটেনেন্স শুরু হবে...)

তখন বাজে প্রায় বেলা এগারোটা। কী করি? আবার দুমকা অবধি ফিরে যেতে হবে?

(চলবে)

(আগের কথা)

No comments: