Tuesday, November 27, 2018

দিকশূন্যপুরের রাস্তায় - The Road to Nowhere (৮ম পর্ব)

সম্পূর্ণ নির্জনতা চান? টোটাল সলিটিউড? যেখানে অন্য ট্যুরিস্ট এসে লাফালাফি করবে না...শুধু আপনি, আপনার অল্প কয়েকজন সঙ্গী, ক্যামেরা, বই? মৌচুকী ক্যাম্প একেবারেই তাই। যে একদিন বা দুদিন এখানে থাকবেন, আপনার সঙ্গী বলতে (সঙ্গে যারা আছে তারা বাদ দিয়ে) চারপাশের জঙ্গল, বেশ কিছু পাখি, ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, সন্ধ্যেবেলা আলো দেখে ধেয়ে আসা দলে দলে পোকা, দুটো হৃষ্টপুষ্ট কুকুর, আর বুদ্ধ - মানে মৌচুকীর কেয়ারটেকার। টুরিস্টের ভিড় নেই, মেমোরেবিলিয়ার দোকান নেই, গাড়ির আওয়াজ নেই...নিশ্ছিদ্র নিশ্চুপ নির্জনতা।

পাখির সীজনে গেলে - মানে আরেকটু শীত পড়লে - আপনি হেঁটে হেঁটে পিছনের পাহাড়টায় উঠতে পারেন - পাখির ছবিশিকারীদের স্বর্গ। আকাশ পরিষ্কার থাকলে পূবদিকে ভুটান পাহাড় স্পষ্ট দেখা যায়। আর যদি আরেকটু অ্যাডভেঞ্চারের ইচ্ছে থাকে, তাহলে যে পাথরবসানো রাস্তায় উঠেছেন, সেই পথ বেয়েই নেমে যেতে পারেন পনেরো কিলোমিটার মতন দূরে মূর্তি নদীর ওপর একটা ছোট ঝরনার ধারে - জায়গাটার নাম ওরা দিয়েছে "রকি আইল্যান্ড", বা পিকনিক করে আসতে পারেন রিভার ক্যাম্পের কাছে মূর্তির ধারে। আর যেতে পারেন যুগলে, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বা nth মধুচন্দ্রিমার জন্যে - ঠকবেন না গ্রান্টী।

আমরা গেছিলাম ল্যাদ খাবো বলে। আর আমার সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো একটু pampered হওয়ার। ঋতিকে বললাম - রোজ তো আমি তোদের সবাইকে ঘুম থেকে তুলে স্কুল যাবার জন্যে তৈরী করি, এই কদিন না হয় তোরা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবি, ব্রেকফাস্ট খাওয়াবি, ঘুরতে নিয়ে যাবি...ঋতি শুনে এক কথায় উত্তর দিলো - "আহ্লাদী":-)

সেদিন মৌচুকী পৌঁছে দেখলাম দোতলা কাঠের বাড়িটায় নীচের তলায় দুটো ঘর খালি, দোতলায় একটা ফ্যামিলি রয়েছে - তারা পরের দিন ফিরে যাবে। নীচের দুটো ঘরের মাঝখানে খাবার জায়গা। তিনবেলা খাবার পাবেন - সকালে ব্রেকফাস্ট, দুপুরের লাঞ্চ, রাতের ডিনার। এর মাঝে চা পেয়ে যাবেন চাইলে। নীচের ঘরে জিনিসপত্র রেখে একটু আশপাশটা দেখতে দেখতেই দুপুরের খাবার ডাক পড়লো। সাধারণ খাওয়া - ডাল, ভাত, তরকারি আর ডিমের ঝোল, কিন্তু পরিমাণ দেখে চক্ষু চড়কগাছ। বুদ্ধ মনে হয় খোদ আবদুর রহমানের হাতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। একটা পেল্লায় ক্যাসারোলে ভাত, প্রায় সেরকমই বড় পাত্রে ডাল/তরকারি...ডিমের ঝোলে ডিমের সংখ্যা অবশ্য মাথাপিছু দুটো করে। খাবার দেখিয়ে বুদ্ধ বললো - কম পড়লে বলবেন, আরো দিয়ে যাচ্ছি। খাওয়া শেষে দেখলাম ভাতের ক্যাসারোলের ওপরের ১/৩ কমেছে মাত্র, ডাল প্রায় যেমনকার তেমনি রয়ে গেছে, তরকারি - মানে তেলতেলে আলুভাজাটাই পুরো শেষ, আর ডিমের ঝোলটা। বুদ্ধকে জানিয়ে দিতে হল যে ভাত/ডালের পরিমাণটা একটু কম হলেই ভালো...

দুপুরে বাংলো খালি হয়ে যায় - বুদ্ধ আর ওকে সাহায্য করে বাচ্চামতন একটা ছেলে - ওরা নীচে ওদের গ্রামে যায়। একা থাকার অভ্যেস না থাকলে সেই সময়টা মনে হবে ভূতের বাড়িতে বসে আছেন। আলো পড়ে আসে তাড়াতাড়িই, পাহাড়ের গা বেয়ে মেঘ নামে - আস্তে আস্তে অল্প অল্প দেখতে পাওয়া ভুটান পাহাড় পুরো মেঘে ঢেকে যায়। নীচে কয়েক কিলোমিটার দূরে গ্রামটার ছোট ছোট বাড়িগুলোও চলে যায় মেঘের আড়ালে। কিছুক্ষণ পর বাড়িগুলোতে আলো জ্বলে উঠলে মেঘের মধ্যে দিয়ে আবছা আলোটা দেখা যায়। আর দেখা যায় উল্টোদিকের পাহাড়ের গায়ের বাড়িগুলোর আলো।

বারান্দায় বসে বই পড়ছিলাম, উঠে আলোটা জ্বালাতে হল। আর তার কিছুক্ষণ পরেই দলে দলে পোকা ধেয়ে এলো। প্রথমদিকে কত রকমের পোকা সেটা গোণার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করেছিলাম - অল্প সময়ের মধ্যেই হাল ছাড়তে হল - কারণ পোকার সংখ্যা আর তার রকমের সংখ্যা হাতের বাইরে ততক্ষনে। বুদ্ধ এসে চা দিলো, তারপর আবার বই পড়া বা বকবক করা - কাজ বলতে এই। ছেলেমেয়ে কিছুক্ষণ বই পড়লো, কিছুক্ষণ মোবাইলে গেম খেললো। ওপরের পরিবারের লোকজনের সাথে দুটো চারটে কথা হল চা খাওয়ার সময়...

রাতের খাবারের সময় সেই একই হাল - দুপুরের মত। রুটি কটা লাগবে তা আর বলা হয়নি - অতএব খান পঁচিশেক রুটি এসে হাজির। সাথে আবার তেলতেলে আলুভাজা, ডাল আর চিকেন। অল্প ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া, সাথে গরম রুটি, ডাল ইত্যাদি - রোজকার দুটো রুটির লিমিট পেরিয়ে সেদিন মনে হয় খান আষ্টেক খেয়ে ফেলেছিলাম। রান্নাও এখানে ভালোই করে, আর মুরগীটাও পোলট্রির পানসে মুরগী নয়...

ন'টা বাজতেই পাহাড়ে মাঝরাত হয়ে যায়। নিঝুম অন্ধকারে চারপাশে ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ও হ্যাঁ, দোতলায় পায়ে চলার জন্যে কাঠের মেঝের ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ ছাড়া।



(চলবে)



(আগের কথা)

No comments: