নিউ অর্ডারের উৎস বুঝতে চাইলে একটা কনসেপ্ট আগে বুঝে নিতে হবে - লিভিং স্পেস, বা বাসস্থানের কনসেপ্ট - জার্মান ভাষায় শব্দটা হল লেবেনস্রাউম। নাৎসিদের জাতিগত ধ্যানধারণা বা বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দেশদখল - পুরোটাই দাঁড়িয়েছিল এই লেবেনস্রাউমের ওপর। তাই, এই ধারণাটা সম্পর্কে কিছুটা লেখা দরকার।
শব্দটা প্রথম আনেন এক জার্মান ভৌগোলিক, নাম ফ্রেডরিখ র্যাটজেল - ১৯০১ সালে। সেই সময়ে তিনি এবং আরও অনেকে মনে করতেন যে একটা দেশকে সুরক্ষিত থাকতে হলে তাকে সমস্ত রকম রিসোর্স এবং বাসস্থানের দিক থেকে স্বনির্ভর হতে হবে। র্যাটজেলের মত বাকিরাও ডারউইনের "ন্যাচারাল সিলেকশন"-এর তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু কোনও কারণে (ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত ভুল, তা আজ আর জানা যায় না) ডারউইনের প্রাণিজগতের তত্ত্ব এঁরা চাপিয়ে দিয়েছিলেন দেশের বা রাষ্ট্রের ওপরে। বলেছিলেন, প্রাণীরা যেমন প্রাকৃতিক সম্পদের জন্যে প্রতিযোগিতায় নামে, এবং যে জেতে সেই বেঁচে থাকে - যা ইভোলিউশনের জগতে "সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট" বলে বিখ্যাত, সেরকমভাবেই সমস্ত রাষ্ট্রও প্রাকৃতিক সম্পদের জন্যে প্রতিযোগিতায় নামে - জয়ী রাষ্ট্রই টিঁকে থাকে। ব্রিটিশ এবং ফরাসী কলোনিগুলো দেখিয়ে র্যাটজেল বলতেন যে জার্মানিকেও একইভাবে জায়গা দখল করতে হবে জার্মানির ক্রমবর্ধমান নাগরিকদের বসবাস করানোর জন্য…এবং সবচেয়ে লজিক্যাল জার্মান এক্সটেনশন হল জার্মানির পূর্বদিকের অঞ্চল - অর্থাৎ পূর্ব ইউরোপ থেকে রাশিয়া…
নাৎসি উত্থানের আগে থেকেই, মোটামুটি মধ্যযুগ থেকেই জার্মানরা পূর্ব ইউরোপে মাইগ্রেট করতে শুরু করেছিলো - মূলত অর্থনৈতিক কারণে - স্লাভিক এবং বল্টিক অঞ্চলগুলোতে বড় সংখ্যায় জার্মানরা বসবাস করতো। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে জার্মান স্কলার এবং আমজনতার মধ্যে একটা ধারণা বাড়তে শুরু করে - যে এই সব অঞ্চলে জাতিগতভাবে নিচুস্তরের লোকজনের জন্যে রিসোর্সের সদ্ব্যবহার ঠিকভাবে হয়ে উঠছে না। জাতিগতভাবে নিচুস্তর বলতে স্লাভিক আর ইহুদী সম্প্রদায়ের লোকজন। ইউরোপের বাকি অংশে জার্মান অধিকারের ভুল ঐতিহাসিক দর্শনের সাথে এই নতুন জৈবিক দর্শন মিশে গিয়ে জন্ম নেয় বিংশ শতকের লেবেনস্রাউমের আইডিয়া - পরবর্তীকালে জার্মানির ভবিষ্যৎ লেখা হয় যার ওপরে…
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি এই লিভিং স্পেস প্রায় বানিয়েই ফেলেছিল - পূর্বদিকে প্রায় মিনস্ক অবধি মিলিটারি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে - যে একনায়কতন্ত্রের লক্ষ্য ছিলো এই গোটা অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ নিজের দখলে আনা, এবং দরকারমত ভূপ্রাকৃতিক ব্যবস্থার অদলবদল করা। ১৯১৮ সালের ১লা নভেম্বর, কম্পেইনের একটা রেল কামরায় জার্মানি আত্মসমর্পণ করে। ১৯১৯ সালের ২৮শে জুন সই হয় ভার্সাই চুক্তি - যার ফলে পূর্ব ইউরোপে দখলীকৃত সমস্ত অঞ্চল (৬৫০০০ বর্গকিলোমিটার জায়গা এবং ৭০ লক্ষ মানুষ) ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় জার্মানি - ইউরোপের ম্যাপ থেকে অবলুপ্ত পোল্যান্ড ফিরে আসে, জন্ম হয় চেকোস্লোভাকিয়ার, স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে থেকে যায় ড্যানজিগ…
যুদ্ধে হারের ক্ষত, আর সাথে অত জায়গা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ হারানো - ভার্সাই চুক্তি কঠিন দাগ রেখে যায় গোটা জার্মান জাতির মধ্যে, সাথে রেখে যায় বিশ্বাস - যে জার্মানিকে জিততে হলে পূবদিকে এগোতেই হবে। এই অবস্থারই সুযোগ নেন হিটলার - জার্মানির ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ন্যাশনাল সোশ্যালিজম বা নাৎসি ধারণার বীজ পুঁতে।
রাজনৈতিক স্লোগান Volk ohne Raum (ভূমিহীন জাতি) তৈরী হয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানিকে নিয়ে। একই সময় জার্মান ইউজেনিসিস্টরা স্লোগান তোলেন Volk ohne Jugend (তারুণ্যহীন জাতি) - পপুলেশন ডেমোগ্রাফিকে সম্পুর্ণ অস্বীকার করে যেখানে দাবী করা হয় যে জার্মান পপুলেশন ক্রমহ্রাসমান, সবাই প্রায় বয়স্ক - কাজেই জার্মানিকে বাঁচাতে হলে জার্মান পপুলেশনের বৃদ্ধি এবং জার্মান অঞ্চলের বৃদ্ধি - দুইয়েরই প্রয়োজন। ১৯২০এর দশকে এই দাবী মান্যতা পেয়ে যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জার্মানের কাছে। ১৯২৫ সালে লেখা Mein Kampf বইয়ে হিটলার একটা বড় অংশ রক্ষিত রাখেন লেবেনস্রাউমের জন্যে। হোহেনজোলেম সাম্রাজ্যের পলিসির সমালোচনা করে লেখেন - "ভৌগলিক সীমার সমস্যার সমাধান ক্যামেরুনে নয়, ইউরোপের মূল ভূখণ্ডেই রয়েছে। প্রকৃতি ইউরোপের মাটি কোনও বিশেষ দেশ বা জাতির জন্য সংরক্ষণ করে রাখেনি, বরং এই মাটি রয়েছে যার দখল করার ক্ষমতা আছে তার জন্য।" [Mein Kampf, page 138-139]
জার্মানির একটা বড় অংশের ইন্টেলেকচুয়ালরা চাইতেন জার্মানিকে ১৯১৪ সালের (মানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের) আগের বর্ডার ফিরিয়ে দেওয়া হোক। হিটলার মনে করতেন সেটা বালখিল্যতা - এই ইন্টেলেকচুয়ালরা জিওপলিটিক্সের বোঝেটা কী? বরং, উনি পিছিয়ে গেলেন ছ'শো বছর - যখন জার্মানির দখলে ছিলো গোটা স্লাভিক এবং বল্টিক অঞ্চল।
"And so we National Socialists … take up where we broke off six hundred years ago. We stop the endless German movement to the south and west, and turn our gaze toward the land in the East...If we speak of soil in Europe today, we can primarily have in mind only Russia and her vassal border states" [Mein Kampf, page 654]
অর্থাৎ, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, বল্টিক দেশগুলো - যেমন রুমানিয়া, লিথুয়ানিয়া, যুগোস্লাভিয়া, এবং সবশেষে রাশিয়া। নিউ অর্ডারের কনসেপ্ট অনুযায়ী এই স্লাভিক/বল্টিক/রাশিয়ান/ইহুদী পপুলেশন - কয়েক কোটি মানুষ - এরা সকলেই অনার্য্য, দূষিত রক্তের নীচুশ্রেণীর মানুষ...এদের জন্ম জার্মান জাতের দাসত্ব করার জন্য। অথবা, পাকাপাকিভাবে শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য। "এক্সটারমিনেশন" শব্দটা বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে - Mein Kampf এ, বা সেনাবাহিনীকে দেওয়া হিটলারের বিভিন্ন লিখিত আদেশে। লেবেনস্রাউমের সরাসরি ফসল জার্মান জাতিগত পলিসি, আর সেখান থেকেই তৈরী "নিউ অর্ডার।"
যদি কষ্ট করে এতদূর পড়ে থাকেন, তাহলে আরেকটু কষ্ট করে বর্তমান হিন্দুত্ববাদীদের তত্ত্ব বা কাজকর্মের সাথে একটু মিলিয়ে দেখতে পারেন - অখন্ড ভারতের সাথে লেবেনস্রাউমের মিল পান কিনা, বা "হিন্দু খতরেঁ মে হ্যায়" এর সাথে Volk ohne Raum আর Volk ohne Jugend স্লোগানের মিল, বা এমনকী পদ্ধতিরও মিল পান কিনা...
এই পর্ব শেষ করি হলোকাস্ট এনসাইক্লোপিডিয়ার একটা লাইন দিয়ে -
"লেবেনস্রাউমের ধারণা একা হলোকাস্টের জন্য দায়ী নয়, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী, জাতীয়তাবাদী এবং জাতিগত বিদ্বেষমূলক ভাবধারার সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত - শেষ অবধি যে সমস্ত ধারণার ফলে ইউরোপের ইহুদীদের মরতে হয়েছিলো।"
সুত্রঃ
(১) Mein Kampf - Adolf Hitler
(২) Rise and Fall of the Third Reich - William Shirer
(৩) Coming of the Third Reich - Richard J Evans
(৪) Lebensraum - The Holocaust Encylopedia
No comments:
Post a Comment