এই বছর, আরেকরকম পত্রিকার পুজো সংখ্যায় অধমের কিছু হাঁউমাউখাঁউ ছেপে বেরিয়েছিল। সংখ্যাটা যেহেতু শুধুই প্রিন্ট ভার্সন, তাই মাসখানেক পর এখানে পোস্ট করলাম...
বেঙ্গল ফাইলস
পশ্চিমবঙ্গের জন্মবৃত্তান্ত ও শ্যামাপ্রসাদ
(১)
"শ্যামাপ্রসাদ পশ্চিমবঙ্গের জনক" বা "শ্যামাপ্রসাদের জন্যেই কলকাতা পশ্চিমবঙ্গে রয়ে গেছে" এই মিথদুটোর বয়স বেশ কয়েকবছর হল। ফি বছর হিন্দুত্ববাদীরা এই নিয়ে প্রচার করে, তার পালটা লেখাও তৈরী হয়, আবার তার পরের বছর একই ঘটনা ঘটে। তবে দুটো মিথকেই সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় কিছু তথ্য আর ম্যাপ দিয়ে। এই লেখার উদ্দেশ্য সেইটাই। যদিও তার আগে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতটা একটু দেখে নেওয়া প্রয়োজন - তার জন্যে খানিক গৌরচন্দ্রিকা…
তিরিশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই ম্যাকডোনাল্ড অ্যাওয়ার্ড (কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড নামেও ইতিহাসে পরিচিত) আর বেঙ্গল টেনেন্সী অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট - মূলত: এই দুটো ঘটনা, আর গ্রামের দিকে বাড়তে থাকা কৃষক আন্দোলন - এই সবকিছুর জেরে ভদ্রলোক হিন্দুরা কংগ্রেসের দিক থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করে। বিশেষ করে যে জমিদার আর হিন্দু ব্যবসায়ীদের চাঁদার ওপর কংগ্রেস ভালোমত নির্ভরশীল ছিল, তারা বিমুখ হওয়ায় কংগ্রেস বেশ চাপে পড়ে যায়। ১৯৩৬-৩৭-এর প্রাদেশিক ভোটে আশিটা সাধারণ আসনের মাত্র আটচল্লিশটা আর বিশেষ সংরক্ষিত হিন্দু আসনের মাত্র চারটে জেতে কংগ্রেস। নির্দল হিন্দু প্রার্থীরা জেতে সাঁইত্রিশটা আসনে, হিন্দু মহাসভা দুটো আসনে।
হিন্দু এবং হিন্দুধর্মকে রক্ষার দাবী নিয়ে ততদিনে হিন্দু ভদ্রলোক আইডেন্টিটি তৈরী হয়ে গেছে - মূলত: শিক্ষিত সমাজকে ঘিরে, যাদের বেশিরভাগের গ্রামের দিকে জমিজমা, বাড়ি আর শহরে চাকরি ছিল - অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ক্ষমতাশালী উচ্চবিত্ত, বা মধ্যবিত্তের ক্রীমি অংশ। চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে প্রান্তিক গোষ্ঠীর লোকজনকেও এই বৃহত্তর হিন্দু সমাজের অংশ হিসেবে টেনে আনার চেষ্টা শুরু হয়। জনপ্রিয় ধর্মীয় উৎসবগুলো হয়ে ওঠে রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র, ফলে গ্রাম বা ছোট মফস্বল শহরের সাধারণ হিন্দুদের মধ্যেও এই প্রবল হিন্দু আইডেন্টিটি ছড়াতে শুরু করে।
১৯৩৬-৩৭ এর ভোটের ফলাফলের পর কংগ্রেসও আর এর বাইরে থাকার কথা ভাবেনি। কমতে থাকা ফান্ড আর সরতে থাকা "ভদ্রলোক সাপোর্টের" ধাক্কায় কংগ্রেসও উঠেপড়ে লেগেছিল হিন্দু প্রোফাইল তৈরী করতে। প্রথম পদক্ষেপ ছিল সুভাষ-শরতের আমলে কংগ্রেস ছেড়ে চলে যাওয়া হিন্দু জমিদারদের খুব কাছের লোক নলিনীরঞ্জন সরকারকে আবার বড় দায়িত্ব দিয়ে ফিরিয়ে আনা। তারপর ক্রমশ: কৃষক আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে উলটে জমিদারদের পক্ষ নেওয়া, সুভাষ-শরতকে একঘরে করে দেওয়া এবং শেষপর্যন্ত সরিয়েই দেওয়া – সবটাই ঘটেছিল বাংলা কংগ্রেসকে ফের ভদ্রলোকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে। জয়া চ্যাটার্জী তাঁর বেঙ্গল ডিভাইডেড বইয়ে রীতিমত তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে, এই সময়ে, মানে সুভাষ আর শরৎ বসুকে বের করে দেওয়ার পর, হিন্দু মহাসভা আর বাংলা কংগ্রেসের মধ্যে বিশেষ কোনো তফাৎ সাধারণ চোখে ধরাই পড়তো না।
১৯৪৫-৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে হাতেনাতে ফল পায় কংগ্রেস এই আইডেন্টিটি পরিবর্তনের - বাংলার হিন্দুরা একজোটে কংগ্রেসের পক্ষে ভোট দেয় - একাত্তরটা সাধারণ আসন আর পনেরোটা বিশেষ হিন্দু আসন জেতে কংগ্রেস, তার মধ্যে বেশ কয়েকটা হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনা। হিন্দু মহাসভা ছাব্বিশটা আসনে কংগ্রেসের বিপক্ষে লড়ে পায় মোটে ২.৭৩% ভোট। একটা মাত্র আসনে - বিশেষ ইউনিভার্সিটি আসন – সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জেতেন শ্যামাপ্রসাদ। খুব স্পষ্টভাবে, ভদ্রলোক হিন্দুদের রায় ছিল কংগ্রেসের পক্ষেই। অন্যদিকে, সংরক্ষিত তফশিলী আসনের ৮০% জেতে কংগ্রেস, ৩৬-৩৭ সালে যেটা ২৫%-এরও কম ছিল। সব মিলিয়ে মোটামুটি ৯০% হিন্দু ভোটার মনে করেছিল যে কংগ্রেসই তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা - ধনী ব্যবসায়ী, জমিদার - যাদের মধ্যে হিন্দু মহাসভা তিরিশের দ্বিতীয়ভাগ থেকে ক্রমশ: শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, তাদেরও বিপুল সমর্থন পেয়েছিল কংগ্রেস - এই নতুন পাওয়া হিন্দু আইডেন্টিটির জোরে [১]।
আলাদা হিন্দু অধ্যুষিত রাজ্যের দাবীও ওঠে এই সময় থেকেই। ১৯৪৬-এর ভোটে সুরাহওয়র্দীর মন্ত্রীসভার ক্ষমতায় আসা, বিশেষ করে দুর্ভিক্ষের সময়ে যে সুরাহওয়র্দীকে নিয়ে প্রবল ক্ষোভ ছিল হিন্দুদের মধ্যে, ছেচল্লিশের কুখ্যাত দাঙ্গা, এবং সেই সময়ে কলকাতার রাস্তায় ঘটে চলা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ সামলাতে না পারা - সব মিলিয়ে বাংলার হিন্দুদের বদ্ধমূল ধারণা তৈরী হয়ে যায় যে "মুসলমানদের সরকার" থাকলে বাংলার পাকিস্তান হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না, হিন্দুদের থেকে যেতে হবে মুসলমানদের অধীনে। স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদের হাতে লেখা ছেচল্লিশ সালের একটা নোট [২] পাওয়া যায় এই মর্মে, যার মূল বক্তব্য ছিল – “বাংলা যদি পাকিস্তান হয়ে যায়, বাঙালী হিন্দুদের যদি পাকাপাকি মুসলমান শাসনে থাকতে হয়, তাহলে সেটা হবে বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির শেষ অধ্যায়…নীচু জাতের কিছু হিন্দু যারা মুসলমান হয়েছে, তাদের খুশী করতে হিন্দু সংস্কারকে বলি দেওয়া…”
একসময় "অবিভক্ত বাংলা"-র সমর্থক শ্যামাপ্রসাদ সেই সময়েই কিন্তু বাংলা ভাগের পক্ষে চলে গিয়েছিলেন। আর, ব্রিটিশ রাজের শেষ দুটো বছরে, বাংলার হিন্দু ভদ্রলোকদের মধ্যে হিন্দু মহাসভা বস্তুত: কংগ্রেসের সেকেন্ড ফিডল হিসেবেই থেকে গিয়েছিল।
(২)
ছেচল্লিশের দাঙ্গায় দোষী কে সেই প্রসঙ্গে যাওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। হাজারো লেখা আছে, বই আছে - পড়ে দেখতে পারেন। যেটা বাস্তব, সেটা হল ১৯৪৭ সালে দেশভাগই যে একমাত্র পথ সেইটা মোটামুটি সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বই মেনে নিয়েছিলেন। ১৯৪৭-এর ৮ই মার্চ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিও জানিয়ে দেয় যে দেশভাগ যদি হতেই হয়, তাহলে মুসলমান-প্রধান বাংলা আর পাঞ্জাবকেও ভাগ করতে হবে। ৩রা জুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ঘোষণা করেন যে দশ সপ্তাহের মধ্যে ইংরেজরা ভারত ছেড়ে যাবে। ১৫ই আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের দুই উত্তরসুরীর হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হবে। দুই মুসলমান প্রধান রাজ্য, বাংলা আর পাঞ্জাবকে ভাগ করে মুসলমান অধ্যুষিত পাশাপাশি জেলাগুলো দেওয়া হবে পাকিস্তানকে, আর অ-মুসলমানপ্রধান বাকি জেলাগুলো থেকে যাবে ভারতে।
মানে, ওই দশ সপ্তাহের মধ্যে বাংলার সব হিন্দু রাজনৈতিক নেতা (কংগ্রেস ও মহাসভা মিলিয়ে) - যাঁরা আগের কয়েক বছর ধরে নিরন্তর রাজ্যভাগের কথা বলে এসেছিলেন - তাঁদের সকলকেও এবার দেশভাগের জমাখরচের হিসেব কষতে হবে…
দেশভাগের অধিকাংশ ইতিহাস জানায় যে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ তাঁর মর্জিমত কলমের আঁচরে ভারত আর পাকিস্তানকে আলাদা করেছিলেন। তড়িঘড়ি করে করা এই কাজে ভারত আর পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ছিল দাবার বোড়ে মাত্র। বাস্তবে যদিও, যে রাজনীতিকরা দেশভাগের পক্ষে মত দিয়েছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই স্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে এই নতুন রাজ্যের বর্ডার কী হবে সেইটা স্থির করার কাজ করে গিয়েছিলেন।
কাজটা অবশ্যই সহজ ছিল না। ৩রা জুন থেকে ১৭ই আগস্ট - এই অল্প কয়েকটা দিনের মধ্যেই শুধু যে দুই দেশের সীমা নির্ধারণ করতে হবে তা নয়, ভাগ করতে হবে আরো অনেক কিছুই - নদীনালা, রাস্তা, ব্রিজ, রেলপথ, গুদামে থাকা জিনিসপত্র, মায় সরকারি কর্মচারীদেরও। আর, এমনও নয় যে এর কোন ব্লুপ্রিন্ট কোথাও ছিল, যাতে সেটা দেখে দেখে কাজটা সহজেই করে ফেলা যায়। বেসিক গ্রাউন্ডরুল লন্ডন ও দিল্লী থেকেই বলে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু রাজ্যের কোন অঞ্চল কীভাবে ভাগ হবে - সেটা ছাড়া হয়েছিল রাজ্যের ওপরেই। এই গ্রাউন্ডরুল অনুযায়ী বাংলার আইনসভাকে দুটো ভাগে ভাগ করা হবে - মুসলমান আসনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে একটা ভাগ, আর হিন্দু আসনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে আরেকটা ভাগ - দুটো ভাগেই আলাদা করে দেশভাগের ওপর ভোট নেওয়া হবে আর, কোনো একটা ভাগে পার্টিশনের পক্ষে ভোট হলেই ভাগ করা হবে রাজ্যকে। ২০শে জুন ১৯৪৭ - যে দিনটাকে হিন্দুত্ববাদীরা পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করেছে - সেই দিন, বাংলার আইনসভায় এই দুটো ভাগ তৈরী করে ভোট হয়। সেই ঐতিহাসিক ভোটে, একেবারে প্রত্যাশিতভাবেই হিন্দু অংশ ভোট দেয় বাংলা ভাগের পক্ষে আর মুসলমান অংশ ভোট দেয় বিপক্ষে। বাংলার রাজ্যপাল ফ্রেডেরিক বারোওজ টেলেক্স করে মাউন্টব্যাটেনকে জানান -
Separate meetings of members West repeat West Bengal Legislative Assembly this afternoon decided under paragraph six of H.M.G.’s statement by 58 votes to 21 votes that Province should be partitioned; and under paragraph eight of statement by 58 votes to 21 votes again that West Bengal should join existing Constituent Assembly. Separate meeting of members East repeat East Bengal Legislative Assembly this afternoon decided under paragraph six of statement by 106 votes to 35 votes that Province should not repeat not be partitioned; under paragraph eight of statement by 107 votes to 34 that East Bengal should join new Constituent Assembly; and under paragraph thirteen of statement by 105 votes to 34 votes that East Bengal would agree to amalgamation of Sylhet. [৩, ৪]
এখানে যেটা দেখার, সেটা হল বাংলা ভাগের পক্ষে রাজ্যের হিন্দু প্রতিনিধিরা একজোট হয়েই ভোট দিয়েছিলেন, আর সেই সময়ে আইনসভায় হিন্দু মহাসভার তরফে ছিলেন একজনই - শ্যামাপ্রসাদ নিজে। কাজেই, খুব সাধারণ অঙ্কের হিসেবেও ৫৮টা ভোটকেই শ্যামাপ্রসাদ হিসেবে ধরা যায় না (সে ইদানীংকালে কেউ কেউ ২৯৪ আসনে তাঁকেই প্রার্থী হিসেবে দেখতে বললেও)...
মানে, আগে যে ধারণার কথা লিখেছিলাম - বাংলার অধিকাংশ হিন্দু রাজনৈতিক নেতৃত্বই রাজ্যভাগের প্রশ্নে একমত ছিলেন - আইনসভাতে হিন্দু অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠের মত সেই ধারণাকেই প্রতিষ্ঠিত করে। আর এই হিন্দু প্রতিনিধিদের প্রায় সকলেই বাংলা কংগ্রেস থেকে আসা। পশ্চিমবঙ্গের গঠনের পিছনে হিন্দু মহাসভা ও শ্যামাপ্রসাদের আলাদা কোনো কৃতিত্ব নেই। বরং বলা ভালো কোনো কৃতিত্বই নেই।
[আদৌ কাউকেই এই কৃতিত্ব দেওয়া যায় কিনা সে সম্পূর্ণ আলাদা প্রসঙ্গ, আলাদাভাবে লেখা প্রয়োজন তাই নিয়ে। শুধু এইটুকু বলি - দেশভাগের হিউম্যান কস্ট আর দুটো দেশেরই ক্ষয়ক্ষতি, বিশেষ করে রিসোর্সের হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বিচার করলে কৃতিত্ব শব্দটাই এখানে বেমানান। দেশভাগ বাঙালীর কাছে একটা যন্ত্রণার ঘটনা, এবং পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে এমন একটা ধাক্কা যেখান থেকে এই রাজ্যটা কখনোই বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাই, অত্যন্ত নোংরা খুনে মানসিকতার লোক না হলে ২০শে জুন তারিখটা নিয়ে উৎসব কেউ করবে না।]
(৩)
এবার আসা যাক অন্য প্রসঙ্গটায় - কলকাতার পশ্চিমবঙ্গে থাকা বা না-থাকা নিয়ে…তার জন্যে আমাদের যেতে হবে ২০শে জুন ১৯৪৭-এর পরের কয়েক সপ্তাহে, ঢুকতে হবে বাউন্ডারি কমিশনের ভিতরে...যার কাজ শুরু হয়েছিল তুমুল অনিশ্চয়তার মধ্যে। বাংলা আর পাঞ্জাব, দুই জায়গাতেই চারজন বিচারককে নিয়ে তৈরী হয়েছিল বাউন্ডারি কমিশন, দুই কমিশনেই চেয়ারপার্সন ছিলেন সিরিল র্যাডক্লিফ। আর চারজন বিচারককে মনোনীত করেছিল কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ। বাংলা কংগ্রেসের তরফে এই কমিশনে ছিলেন জাস্টিস বি.কে. মুখার্জী এবং জাস্টিস সি.সি. বিশ্বাস। মুসলিম লীগের মনোনীত সদস্য ছিলেন জাস্টিস আবু সালেহ মহম্মদ আক্রম, এবং জাস্টিস এস.এ. রহমান। এবং স্বাভাবিকভাবে সকলেই রীতিমত অনুগতভাবে নিজের নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং দলগত নীতির প্রতিনিধিত্ব করে গেছিলেন পুরো সময়টা জুড়ে। মাসখানেক ধরে ৩৬জন উকিল ৩৬টা আবেদন এই কমিশনের সামনে হাজির করলেও (সময়াভাবে আরো ৭১টা আবেদন পেশই করা যায়নি) র্যাডক্লিফ পুরো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শুধুমাত্র কমিশনের চার সদস্যের আনা দাবী আর পাল্টা-দাবীর ওপর ভিত্তি করে - মানে বাস্তবে কংগ্রেসের "সেন্ট্রাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি" আর মুসলিম লীগের পেশ করা বক্তব্যের ওপরেই [৫]।
এই পুরো পর্বটা জুড়েই কংগ্রেস হাইকম্যান্ড বাউন্ডারি কমিশন থেকে হাজার মাইল দূরে দাঁড়িয়ে থেকেছিল, রাজ্যের সীমানা সংক্রান্ত সমস্ত সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর ছেড়ে দিয়ে। এই নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। স্বয়ং বাবাসাহেব আম্বেদকর কংগ্রেসের এই অবস্থানের কড়া সমালোচনা করেছিলেন - তাঁর বক্তব্য ছিল এই সীমানা নির্ধারণ রাজ্যের নয়, দেশের সরকারের দায়িত্ব হওয়ার কথা, এবং এখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বদলে সেনাবাহিনীর লোকজনের থাকা প্রয়োজন, কারণ শেষ অবধি, সীমানার দেখভালের দায়িত্ব তাদেরই। অবশ্যই আম্বেদকরের এই কথায় বিশেষ কেউ কান দেয়নি - না কংগ্রেস হাইকম্যান্ড, না ব্রিটিশ রাজ, না প্রতিরক্ষা দপ্তরের কেউ (ওই দপ্তর থেকে কেউ বাউন্ডারি কমিশনের সামনে হাজির পর্যন্ত হননি)।
সেন্ট্রাল কো-অর্ডিনেশন কমিটিটা ছিল খানিক খিচুরি সংগঠন - বারো সদস্যের এই কমিটিতে দুজন ছিলেন বাংলা কংগ্রেস থেকে (এই দুজনের একজন ব্যারিস্টার অতুল চন্দ্র গুপ্ত - কমিটির চেয়ারম্যান), বাকি দশজন ছিলেন হিন্দু মহাসভা, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন আর নিউ বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের তরফে। বারোজনের মধ্যে দশজন দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী - স্পষ্টতই যাকে বলা যায় "বিপর্যয়ের রেসিপি"।
এবার, পার্টিশনের গ্রাউন্ড রুল - যেটা লন্ডন থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল - সেটা ছোট করে বুঝে নেওয়া দরকার। লন্ডনের তরফে ৩রা জুনের স্টেটমেন্টটা যদি একবার দেখি -
For the immediate purpose of deciding on the issue of partition, the members of the legislative assemblies of Bengal and the Punjab will sit in two parts according to Muslim majority districts (as laid down in the Appendix) and non-Muslim majority districts. This is only a preliminary step of a purely temporary nature as it is evident that for the purposes of final partition of these provinces a detailed investigation of boundary question will be needed; and as soon as a decision involving partition has been taken for either province a boundary commission will be set up by the Governor-General, the membership and terms of reference of which will be settled in consultation with those concerned. It will be instructed to demarcate the boundaries of the two parts of the Punjab on the basis of ascertaining the contiguous majority areas of Muslims and non-Muslims. It will also be instructed to take into account other factors. Similar instructions will be given to the Bengal Boundary Commission. Until the report of a boundary commission has been put into effect, the provisional boundaries indicated in the Appendix will be used. [৬]
পাশাপাশি অবস্থিত মুসলমানপ্রধান জেলাগুলো যাবে পাকিস্তানে, আর বাদবাকি জেলাগুলো থেকে যাবে ভারতে - শুধু এই নিয়মের ভিত্তিতে যদি বাংলা ভাগ করা হয়, তাহলে ভাগীরথী-হুগলীর পূর্বদিকের প্রায় পুরো অঞ্চলই বাদ দিতে হয়, বাদ দিতে হয় গঙ্গার উত্তরের একটা বড় অংশও। ভদ্রলোক হিন্দু বাঙালি পার্টিশন চেয়েছিল কারণ তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সঙ্গে একসাথে থাকতে চায়নি, ক্ষমতার ভাগাভাগি চায়নি। সেক্ষেত্রে মুসলমান প্রধান জেলাগুলোকে বাদ দিয়ে দিলে পশ্চিমবঙ্গের ভাগে পড়ে থাকে দক্ষিণবঙ্গের অর্ধেক - শুধু বর্ধমান, হুগলী, হাওড়া, কলকাতা, ২৪ পরগণা, বাঁকুড়া, বীরভূম, আর মেদিনীপুর - মানে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলো - ঠিক যে যে জেলায় পার্টিশনের পক্ষে সবচেয়ে বেশি প্রচার চলেছিল...[প্রথম ছবি: Map 1]
অক্ষরে অক্ষরে নিয়ম মেনে চললে এ বড় কঠিন বাস্তব। যে পশ্চিমবঙ্গের জন্য ভদ্রলোক হিন্দু এতদিন লড়ে এলো, বা যে পাকিস্তানের জন্যে মুসলিম লীগ, সেই সবই যদি এরকম পোকায় কাটা অর্ধেক রাজ্য হয়ে যায়, তাহলে সেই রাজ্য কি আদৌ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে? যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল নিয়ে এত কথা, এই অর্ধেক রাজ্যে সেই ক্ষমতার কতটুকুই বা বাকি থাকবে?
কাজেই, ওই বেঁধে দেওয়া গ্রাউন্ডরুলের মধ্যে একটা বাক্যের আশ্রয় নিতে হয়েছিল কো-অর্ডিনেশন কমিটি আর লীগকে - “It will also be instructed to take into account other factors" - দুই পক্ষই এই "আদার ফ্যাক্টরস"-কে নিজের মত করে ব্যাখ্যা করে তাদের ভাগের অংশকে বাড়ানোর চেষ্টা করে গেছিল ক্রমাগত। তবে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট হল যে এই "আদার ফ্যাক্টরস" শব্দবন্ধকে ব্যবহার করে কতটা জমি পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে আনার চেষ্টা করা হবে, তাই নিয়ে কো-অর্ডিনেশন কমিটির মধ্যেই বড়সড় মতভেদ ছিল, আর সেটা একেবারে শুরুতেই সামনে আসে।
এই মতবিরোধটাই এই প্রসঙ্গে আপাতত জরুরী। শ্যামাপ্রসাদের জন্যেই কলকাতা পশ্চিমবঙ্গে এসেছিল কিনা সেটা যাচাই করতে আমাদের ঠিক এই জায়গাতেই যেতে হবে...
(৪)
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল পশ্চিমবঙ্গ কত বড় হলে রাজ্যভাগের রাজনীতির আঙিনার চরিত্ররা সন্তুষ্ট হবেন, আর এই নতুন রাজ্যটাও অর্থনৈতিকভাবে কার্য্যকর হবে। আর এই প্রশ্নে সেন্ট্রাল কো-অর্ডিনেশন কমিটির বিভিন্ন পক্ষ একে অপরের সম্পূর্ণ উলটো মেরুতে বসে ছিলেন। একদল ছিলেন রাজ্যের কলেবর যতটা সম্ভব বাড়ানোর পক্ষে, আরেকদল ছিলেন ছোট কমপ্যাক্ট রাজ্যের পক্ষে - যা শাসন করা অপেক্ষাকৃত সহজ। আর, এই বিভেদ ছিল একেবারে পার্টি লাইন বরাবর। ছোট দলগুলোর দাবী ছিল আকাশপ্রমাণ। হিন্দু মহাসভা আর নিউ বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন চেয়েছিল যতটা সম্ভব এলাকা দাবী করতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওই "আদার ফ্যাক্টরস" শব্দবন্ধকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অসম্ভব বাড়িয়ে তুলে। এগারোটা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা (বর্ধমান, মেদিনীপুর, বীরভূম, বাঁকুড়া, হাওড়া, হুগলী, কলকাতা, ২৪ পরগণা, খুলনা, দার্জিলিং আর জলপাইগুড়ি) ছাড়াও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার অনেক অংশও এদের দাবীর মধ্যে ছিল - যেমন নদীয়ার বড় অংশ, ফরিদপুর, দিনাজপুর, এবং রংপুর আর রাজশাহীর বেশ কিছু অঞ্চল। মহাসভা আর নিউ বেঙ্গলের দাবী মানলে পশ্চিমবঙ্গে আসতো অবিভক্ত বাংলার পাঁচভাগের প্রায় তিন ভাগ [দ্বিতীয় ছবি - Map 2][৭]
উল্টোদিকে, অতুল চন্দ্র গুপ্তর নেতৃত্বে কংগ্রেস ক্যাম্পের দাবী তুলনামূলকভাবে অনেক নিচু স্কেলে বাঁধা ছিল। তাঁরা বলতে চেয়েছিলেন যে অহেতুক অযৌক্তিক দাবীর ফলে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা সংক্রান্ত সমস্ত দাবীই লঘু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলোর প্রতিনিধিরা এই প্রস্তাব নাকচ করলে অতুল চন্দ্র গুপ্ত স্ট্র্যাটেজি বদলে দুটো প্রস্তাব রাখেন - একটা "কংগ্রেস স্কিম", যেখানে অনেক বড় আকারে দাবী পেশ করা হয়েছিল - মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলার অংশ জুড়ে (যদিও সেটাও মহাসভার দাবীর চেয়ে কমই ছিল), আর দ্বিতীয়টা "কংগ্রেস প্ল্যান", যেখানে প্রথম স্কিমের চেয়ে কম এলাকা চাওয়া হলেও সেটা মোটামুটিভাবে ওই মৌলিক তত্ত্ব মেনেই, অর্থাৎ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোকেই নিয়ে। "আদার ফ্যাক্টরস" হিসেবে অল্প কিছু মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল চাওয়া হয়েছিল এই প্ল্যানে। তৃতীয় ছবি, অর্থাৎ Map 3 খেয়াল করে দেখলে দেখতে পাবেন কংগ্রেস স্কিম আর কংগ্রেস প্ল্যান - দুটোর ক্ষেত্রেই প্রস্তাবিত এলাকা দাগ দিয়ে বোঝানো রয়েছে। এবং, দুটো ম্যাপেই কলকাতা কিন্তু প্রস্তাবিত পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই রয়েছে। হিন্দু মহাসভা এই প্রস্তাবও মানেনি। শেষ অবধি তারা আলাদাভাবে পিটিশন জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। Map 2 তারই ফসল।
মোদ্দা কথা হল, যে কয়েকটা পিটিশন জমা পড়েছিল কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভার তরফে, তার প্রতিটাতেই কলকাতা ছিল পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই। অর্থাৎ, হিন্দুত্ববাদীদের দ্বিতীয় দাবী, যে শ্যামাপ্রসাদের জন্যেই কলকাতা পশ্চিমবঙ্গে এসেছে, সেই দাবীটিকেও এই ম্যাপের দৌলতে সহজেই নস্যাৎ করে দেওয়া যায়।
(৫)
এই লেখাটা এইখানেই শেষ করে দেওয়া যেত। কিন্তু মনে হল সম্পূর্ণতার খাতিরে আরো কিছু তথ্য জুড়ে দেওয়া দরকার। উদ্দেশ্য শ্যামাপ্রসাদ ও হিন্দু মহাসভা, এবং আজকের বিজেপি – উগ্র দক্ষিণপন্থার আসল মানসিকতাটা চিনে নেওয়া…
চল্লিশের দশকের রাজ্যভাগের রাজনীতির সঙ্গীদের থেকে পশ্চিমবঙ্গের জন্যে অনেক কম এলাকা দাবী করে কংগ্রেস বেশ বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছিল। যেহেতু দেশভাগের পর তারাই সরকারে বসবে, অর্থাৎ তারাই হবে ব্রিটিশ রাজের উত্তরাধিকারী, সেহেতু, তাদের বিরুদ্ধে “বাংলার জন্মগত অধিকার খর্ব করা” বা “ভারতের নিজস্ব ভৌগলিক এলাকা শত্রুর হাতে তুলে দেওয়া” জাতীয় অভিযোগ তোলা সহজেই সম্ভব। কংগ্রেসের যুক্তিটা এখানে কংগ্রেসেরই দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে হবে - তাদের লক্ষ্য ছিল এই নতুন রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখা, শুধু উত্তরাধিকারী হিসেবে নয়, তার পরেও। এবং তার জন্যে যদি এই অভিযোগের জবাব দিতে হয়, তাহলে সেটাই এই ক্ষমতা ধরে রাখার দাম। এবং হিন্দু মহাসভাও এইটা ভালোমতনই বুঝে গেছিল।
হিন্দু কো-অর্ডিনেশন কমিটি পাকাপাকি ভেঙে যাওয়ার পর হিন্দু মহাসভা আর তাদের সঙ্গীরা বুঝে যায় যে তাদের আর হারানোর কিছু নেই, এবং তারা চাইলে নির্বিচারে আরো যুক্তিহীন দাবীও তুলতে পারে। এবং দক্ষিণপন্থী হিন্দুদের সামনে এই দেখনদারি চেঁচামেচিতে বরং তাদের লাভ হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায় (যেটা আজ একেবারে ১০০% বাস্তব)। চরম দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলো আরো চমকপ্রদ দাবী তুলতে থাকে মহাসভার উস্কানিতে...যেমন আর্য্য রাষ্ট্র সংঘ (হয়তো হাতে গোনা একশোটা লোক ছিল এতে) অবিভক্ত বাংলার পাঁচভাগের চারভাগ চেয়ে বসে, সঙ্গে বাংলার প্রত্যেকটা শহরও, কারণ বাংলার শহরাঞ্চলে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি…
মহাসভা এই নতুন জন্মানো রাজ্যের সীমানা নিয়ে ক্রমশঃ আরো উদ্ভট দাবী করতে শুরু করে কারণ তারা পুরোপুরি বুঝে গিয়েছিল যে এই নতুন রাজ্যে তাদের কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই। কাজেই, পাশাপাশি জেলার তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়ে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ যে কোনো জেলাকেই তারা পশ্চিমবঙ্গে ঢোকানোর কথা বলে ওই "আদার ফ্যাক্টরস"-এর হিসেবে। যেমন, গোটা নদীয়া চেয়ে বসে শ্রীচৈতন্যের জন্মস্থান হিসেবে, রাজশাহী চেয়ে বসে সেখানে বারেন্দ্র রিসার্চ সেন্টার রয়েছে বলে, এবং বরিশাল - সেখানকার হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্যে। মহাসভা জানতো যে তাদের এই দাবীগুলো কোথাওই কোনো গুরুত্ব পাবে না, তা সত্ত্বেও নিজেদের "হিন্দুস্বার্থ রক্ষার সৈন্য" হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টায় খামতি রাখেনি। দুইদিকেই লাভ - একদিকে হিন্দুস্বার্থ রক্ষার একনিষ্ঠ সৈনিকের খ্যাতি - যদি দাবীগুলোর একটাও বাস্তবে সত্যি না হয়; অন্যদিকে কংগ্রেসের প্ল্যানের বাইরে সামান্য এলাকাও পশ্চিমবঙ্গে এলে তার কৃতিত্ব নেওয়ার সুযোগ...একই সঙ্গে ভবিষ্যতের ইলেকশন যুদ্ধে নিজেদের জায়গা পোক্ত করা। বস্তুতঃ প্রোপাগান্ডাই ছিল মহাসভার মূল উদ্দেশ্য। সেদিনও যা ছিল, আজও তাই।
উল্টোদিকে কংগ্রেসের হাতে এই কল্পনাবিলাসের সুযোগ ছিল না। নতুন যে রাজ্য তৈরী হবে, তাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল, আর তাদের প্রতি পদক্ষেপ ছিল সেই লক্ষ্যে। অতুল গুপ্তের তত্ত্বাবধানে কংগ্রেসের কমিটি রাজ্যের প্রতিটা থানার জনসংখ্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব করেছিল সেন্সাস রিপোর্টের সাহায্য নিয়ে [চতুর্থ ছবি - Map 4]। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দেখলে, কংগ্রেস প্ল্যানে অনেক সমস্যা চোখে পড়লেও, কংগ্রেসের প্ল্যানাররা মোটামুটিভাবে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির কথা ভেবেই সীমানা নির্ধারণের চেষ্টা করেছিলেন। দার্জিলিং এর চা-বাগান এলাকা, ভাগিরথী-হুগলীর নদীপথ, এবং কলকাতা বন্দরের কথা ভেবে মালদা-মুর্শিদাবাদ-নদীয়া - এগুলো সব তাঁদের প্ল্যানে ধরা ছিল - “this territory has been included in West Bengal for the most compelling factor of essential necessity for requirements and preservation of the Port of Calcutta. The life of the Province of West Bengal is mostly dependent on Calcutta, and with the partition it will become wholly so dependent” [৮] - অর্থাৎ, এখানেও কলকাতাকে বাদ দিয়ে কোনো প্ল্যানই ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত প্ল্যান তৈরী হয়েছিল কলকাতাকে তার কেন্দ্রে রেখেই।
আরো অনেক হিসেবনিকেশ ছিল কংগ্রেস প্ল্যানে। সেই হিসেবগুলো যে ঠিক, সে কথা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বলা যায় না। এও ভাবতে আশ্চর্য্য লাগে যে এই প্ল্যানের মধ্যে বেশ কিছু এমন "অনুমান" ছিল, যেগুলো রেট্রোস্পেক্টে দেখলে ধৃষ্টতা মনে হয়। পিছন ফিরে তাকিয়ে এও মনে হয় যে সেই সময়ে গণপরিষদে বাংলার প্রতিনিধিদের সমস্ত পদক্ষেপই ছিল যেনতেনপ্রকারেণ এই নতুন রাজ্যের ক্ষমতা ধরে রাখার দিকে তাকিয়ে। কংগ্রেসের নিজের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ছিল এই প্ল্যান নিয়ে। অতুল্য ঘোষ এবং তাঁর গোষ্ঠীর তরফে আরো সংক্ষিপ্ত রাজ্যের একটা প্ল্যান দেওয়া হয়েছিল শুধুমাত্র দক্ষিণবঙ্গের হিন্দুপ্রধান জেলাগুলোকে নিয়ে (যদিও কংগ্রেস সেই প্ল্যান জমা দেয়নি) - যেখানে অতুল্য ঘোষের মূল উদ্দেশ্য সম্ভবত: ছিল নতুন রাজ্যে তাঁর গোষ্ঠীর (মানে হুগলী-বর্ধমান জেলার) নেতাদের ক্ষমতা সুরক্ষিত করা। এত কিছু সত্ত্বেও, বিশেষ করে দূরদর্শিতার অভাব থাকলেও, এইটুকু বলাই যায় যে বাউন্ডারি কমিশনের সামনে জমা দেওয়া প্ল্যানের মধ্যে প্রোপাগান্ডা ছিল না, জনতাকে উত্তেজিত করার উদ্দেশ্যে দেখনদারি ছিল না। এইটাই আসল কথা - আর এই বাস্তবটা ওই সময়ের কিছু ডকুমেন্ট খুঁটিয়ে দেখলেই জানা যায়।
শেষ অবধি, সিরিল র্যাডক্লিফ যে পার্টিশন লাইনটা টানেন, সেটা মোটামুটিভাবে কংগ্রেস প্ল্যানের সঙ্গেই মিলে গিয়েছিল। শুধু খুলনার বদলে পশ্চিমবঙ্গে আসে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ - গঙ্গা-ভাগিরথী রিভার সিস্টেমকে অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে।
আজ এই অবধি থাক। অন্য কোনোদিন চেষ্টা করবো পার্টিশনের জমাখরচ নিয়ে লিখতে। বারবার শুধু এইটাই বলার – হিন্দুত্ববাদীরা সেদিনও প্রোপাগান্ডাকেই তাদের অস্ত্র করেছিল, আজও তাই। ফ্যাসিবাদী শক্তি তার জন্মলগ্ন থেকে এই কাজই করে এসেছে। ভারতের এই নয়া ফ্যাসিস্টরা তাদের রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু গোয়েবলসের শিক্ষাই মেনে চলেছে – সেদিনও, আর আজও।
তথ্যসূত্র -
[১] Bengal Divided: Hindu Communalism and Partition, 1932-1947, Joya Chatterji, Cambridge University Press
[২] Shyama Prasad Mookerjee Papers, II-IV Instalment, File No. 75/1945-46
[৩] The Spoils of Partition: Bengal and India 1947-1967, Joya Chatterji, Cambridge University Press
[৪] Constitutional Relations between Britain and India: Transfer of Power, 1942-7, Volume XI The Mountbatten Viceroyalty, Announcement and Reception of the 3 June Plan, 31 May – 7 July 1947, ed: Nicholas Mansergh, Penderel Moon
[৫] The Fashioning of a Frontier: The Radcliffe Line and Bengal’s Border Landscape, 1947-52, Joya Chatterji, Modern Asian Studies / Cambridge University Press
[৬] Statement by His Majesty’s Government, dated the 3rd June 1947, PP I, p. 2
[৭] Memorandum for the Bengal Boundary Commission. Submitted by the Bengal Provincial Hindu Mahasabha and the New Bengal Association, Shyama Prasad Mookerjee Papers, 1st Instalment, Printed Material, File No. 17 (Serial No. 8).
[৮] Memorandum on the partition of Bengal presented on behalf of the Indian National Congress before the Boundary Commission, p. 7.
(সমস্ত ছবির সোর্স: জয়া চ্যাটার্জীর "স্পয়েলস অফ পার্টিশন")