Wednesday, October 31, 2018

দিকশূন্যপুরের রাস্তায় - The Road to Nowhere (৪র্থ পর্ব)


আমার একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে - ঘড়িতে যে সময়েই অ্যালার্ম দিই না কেন, তার মিনিট কুড়ি আগে ঘুম ভাঙবে, একদম ভাঙবেই। খুব রেয়ার কিছু দিন ছাড়া এত বছরে এর কোনো নড়চড় হয়নি। এদিনও তাই হল। ভোর সাড়ে তিনটেতে অ্যালার্ম দিয়ে থাকলেও ঘুম ভেঙে গেল তিনটের পরে পরেই। কিছুক্ষণ ল্যাদ খেয়ে উঠে পাশের ঘরে টোকা মেরে সুমনাকে ঘুম থেকে তুলে নিজে তৈরী হয়ে ঋককে তুললাম। ওদিকে, সুমনাও তৈরী হয়ে ঋতিকে তুলে দিলো। তারপর রিসেপশনে চাবি দিয়ে গাড়িতে ফের জিনিসপত্র তুলে, নীচে দারোয়ানকে ঘুম থেকে তুলে গেট খুলিয়ে বেরোতে বেরোতে সেই পৌনে পাঁচটা হয়েই গেলো।

ওই ভোরে সিউড়ির রাস্তায় একটাও জনমনিষ্যি নেই, শুধু রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো একা একা দাঁড়িয়ে আছে। রওনা দিলাম সিউড়ি-দুমকা হাইওয়ের দিকে। পথে একটা পেট্রোল পাম্প দেখে ট্যাংক ভরে নিলাম। তারপর ফের চলা শুরু।

এখানে প্রধান ভরসা গুগুল ম্যাপ, কারণ মিচেলিনের পুরনো ম্যাপে বর্ধমান থেকে সিউড়ির যে রাস্তা দিয়ে এসেছি সেটা নেইই। আর যেহেতু গুগুল ম্যাপ বেশ সুন্দরভাবে নিয়ে এসেছে, তাই ভরসাও বেড়েছে। তা এক্ষেত্রেও গুগুল ম্যাপ ধরেই চলতে চলতে একটা বড় রাস্তায় এসে পড়লাম - সেখান থেকে লরি ছুটছে দেখতে পাচ্ছি। মনে হল এটাই হয়তো সিউড়ি-দুমকা হাইওয়ে হবে, কিন্তু গুগুল তো আমাকে সোজা এইটা পেরিয়ে উল্টোদিকের অন্ধকার রাস্তাতে যেতে বলছে। কেউ নেই যে জিগ্গেস করবো, কাজেই, গুগুলকে ভরসা করে সোজা চলেই গেলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখি সে রাস্তা মাঠঘাটের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলছে, হাইওয়ের সাথে বিন্দুমাত্র মেলে না, আর বেশিটাই মাটির - আর প্রায় কাদা মাটির, আর সুড়কি। এইটাই কি ঠিক রাস্তা? কে জানে বাবা...এগিয়ে তো যাচ্ছি। আর মাঝেমাঝেই আগের দিনের সন্ধ্যের মত হঠাৎ হঠাৎ কুয়াশা ধেয়ে আসছে কাঁচের ওপর। চার পাঁচ কিলোমিটার এভাবেই চলার পর চোখে পড়লো একটা গুমটিঘর - তার সামনে একটা লোক কুপি জ্বালিয়ে বসে রয়েছে। তাকেই শুধোলাম - এইটা কি দুমকার রাস্তা? সে বল্ল হাঁ হাঁ, ইটাই। তারপর জিগ্গেস করলুম - আর কতটা এরকম রাস্তা? সে বল্ল আরো কিলোমিটার দুয়েক।

অন্ততঃ হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেলো - যে ভুল রাস্তায় আসিনি। দুই কিলোমিটারটা ঠিক দুই ছিলো না, চার পাঁচ হবে হয়তো - তারপর পাকা রাস্তা দেখা গেলো। ততক্ষণে আলোও ফুটেছে, আশপাশটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে - মাঠ, কাশের বন, লাল মাটি...ঋক/ঋতিকে দেখানোর ইচ্ছে ছিলো - কিন্তু দুজনের একজন পিছনের সীটে, আরেকজন মাঝের সীটে লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

রাস্তাটা ক্রমশঃ ভালো হল, তারপর বেশ ভালো হল। ভোরের হালকা শিশিরে ভেজা কালো পিচঢালা রাস্তা এগিয়েছে দুপাশে ছোট ছোট গ্রাম ফেলে রেখে - রঙপুর, ধানিয়াগ্রাম, বড়া চতুরি, সিধুলি...শেষে কেঁদুলী (এই সম্ভবত জয়দেবের কেঁদুলী - ঠিক জানি না) ছাড়িয়ে ঢুকে গেলাম ঝাড়খন্ডে। গুগুল ক্রমাগত রাস্তার নাম বলে চলে, প্রায় প্রতি জাংশনে - আর সে এক কিম্ভুত উচ্চারণে। ঝাড়খন্ডে ঢুকে পড়েছি বোঝা গেল আশেপাশে দোকানের বোর্ডে ভাষা বদলে যাওয়ায়। প্রথম যে জায়গাটার নাম খেয়াল করলাম সেটা হল দিগুলী। জানি না, সিধুলি, কেঁদুলী আর দিগুলী - এই তিনটে পর পর জায়গার মধ্যে কোনো লিংক রয়েছে কিনা, নামের মিল রয়েছে তা তো দেখাই যাচ্ছে।

সিউড়ি থেকে ম্যাসাঞ্জোর প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার - এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া উচিৎ ছিলো - কিন্তু শুরুর ওই দশ কিলোমিটার মাটি-সুড়কির গর্তভরা রাস্তায় সময় খেয়ে নেওয়ায় ম্যাসাঞ্জোর ব্যারেজের পাশে এসে পৌঁছলাম তখন ছ'টা বেজে গেছে। মনটা চা চা করছে - সেই ভোরে উঠেছি, চা খাইনি। অথচ সকালের চা-টা দুধ চিনি ছাড়া লিকার খেতে ইচ্ছে করে না - অনেকদিনের অভ্যেস। ড্যামের একদম শুরুতেই একটা চায়ের দোকান - ভাবলুম যদি চা পাই। গিয়ে দেখি সে একটা বাচ্চা ছেলে বসে রয়েছে - সে সবে দোকান খুলেছে, হয়তো তার বাপ বা মা কেউ এসে উনুন ধরাবে। কাজেই চা পাওয়া গেল না, বরং ওইখানেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে সাথে আনা গরমজলের সদ্ব্যবহার করে সেই লিকার চা-ই খেলাম। ঋক/ঋতি তখনো গভীর ঘুমে, কাজেই আমি একটা ধোঁয়াও টেনে নিলাম (টেরিয়ে তাকাবেন না মোটে, এই লম্বা ড্রাইভে আমার অফিশিয়াল পারমিশন থাকে)। তারপর ম্যাসাঞ্জোর লেকের ধার ধরে এগোলাম দুমকার দিকে।

রাস্তার এই অংশটা বড় সুন্দর। ছোট ছোট লালচে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে রাস্তাটা এঁকেবেঁকে শুয়ে রয়েছে ঝাঝাপাড়া ছাড়িয়ে আরো কিছু দূর অবধি। তারপর পাহাড় শেষ হয়ে বিস্তীর্ণ রুক্ষ লালচে জমির মধ্যে দিয়ে সোজা টানা রাস্তা - মাঝে মাঝে ওঠে নামে, আর কালো পিচের ওপর লালচে ধূলো ছড়িয়ে ছুটে যায় একের পর এক লরি....

ম্যাসাঞ্জোর থেকে দুমকা হয়ে যে রাস্তাটা ভাগলপুরের দিকে চলে গেছে সেটা ন্যাশনাল হাইওয়ে ১১৪এ। দুমকা অবধি এই নাম, তারপর দুমকা শহর বাঁদিকে ফেলে রেখে ডানদিকে ঘুরে ন্যাশনাল হাইওয়ে ১৭ সোজা চলে গেছে ভাগলপুর। সিউড়ি থেকে হিসেব করলে সাত ঘন্টায় পূর্ণিয়া পৌঁছনোর কথা। ভোর পাঁচটায় বেরিয়েছি - অর্থাৎ, দুপুরের মধ্যে পূর্ণিয়া পৌঁছে যাবো। দুপুরের খাওয়া পূর্ণিয়া ছাড়িয়ে কোনো একটা ধাবায় সেরে নেবো, আপাতত সকালের জন্যে কিছু পেটে দিতে হবে। দেবাশিস আগেই বলেছিলো এই রাস্তায় ভালো খাবারের দোকান পাওয়া একটু চাপের, ওর সাজেশন ছিলো হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরনো, বা প্যাক করে নিয়ে আসা - কিন্তু ভোর সাড়ে চারটেয় ওসব হবে কোত্থেকে? আগের দিন বাড়ি থেকে রওনা দেওয়ার সময় কিছু মিষ্টি ছাঁদায় বাঁধা ছিলো, আর ছিলো একটা পাঁউরুটির প্যাকেট। ঠিক হল কোথাও থেকে ডিম কলা কিনে নেওয়া হবে, তাই দিয়ে ব্রেকফাস্ট মোটামুটি হয়ে যাবে।

হাইওয়ে দিয়ে যেতে যেতে মাঝেমাঝেই ছোটো ছোটো গ্রাম, বা আরেকটু বড় - ঠিক শহর নয়, মাঝামাঝি কিছু বলা যায় - পেরোতে হয়। সেখানে বাজার টাজার বসেছে। গাড়ি দাঁড় করানো একটু কঠিন - কারণ যে রাস্তায় বাজার, সেই একই রাস্তায় বাস, লরি, অটো, টোটো, গরু, মোষ, ছাগল, হাঁস, মুরগি, মানুষ সবই একসাথে সহাবস্থান করে। দুমকার একটু আগে থেকেই হাইওয়ের মসৃণ পিচের সাড়ে দেড়টা বেজে গেছে। পুরো ভাঙ্গা না হলেও, টুকটাক ভাঙাচোরা, বাম্পার, ধুলো...আবার এই ছোটো বাজারগুলো পেরিয়ে গেলে মোটামুটি ঠিকঠাক।

তো এরকম একটা বাজার, যেখানে একটু চওড়া রাস্তা, আর রাস্তার পাশে কিছুটা ফাঁকা জায়গা পেলাম, সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটা দোকানে কলা কিনলাম। কোনো দোকানে ডিম পাওয়া যাবে? সেদ্ধ? কলার দোকানদার বল্ল - ইঁয়েহি মিল যায়েগা, আভি ফুন লাগাতে হেঁ। সে দিব্যি মোবাইল বের করে কাউকে একটা ফোন করলো - আমায় বল্ল - আন্ডেওয়ালেকো ফুন কিয়া। তা আমাদের দুর্ভাগ্য, আন্ডেওয়ালা তখনই সিদ্ধ ডিম দিতে পারলো না। কিন্তু লোকটা আমাদের মত আরবিট লোকের জন্যে চেষ্টা তো করেছিলো - সেটাকেই বাহবা দিতে হয়। আরো দু চার জায়গায় খোঁজ করলাম - চায়ের দোকান ইত্যাদিতে। একজন বল্ল - নবরাত্রি শুরু হয়ে গেছে, আর কি কোথাও পাবেন...হুঁ, সেইটা কারণ হতেই পারে। ডিমের আশা ছেড়ে দিয়ে এগোতে এগোতে দেখলাম অনেক মিষ্টির দোকান পড়ছে - থরে থরে লাড্ডু, পেঁড়া সাজানো। আচ্ছা, যদি নোনতা কিছু পাই...পুরি-সবজি, আলু-পরোটা? আমাদের একজন আবার সুগারের রুগী, কাজেই শুধু পাঁউরুটি/কলা/মিষ্টিতে একটু আপত্তি আছে। নাঃ, পুরি-সবজিও পাওয়া গেলো না, তবে বালুসাই দেখে লোভ হল। ফ্রেশ বানানো, মাছি বসছে যদিও, আর গরুতে চেটেও থাকতে পারে - খোলা রাখা রয়েছে, গরু আশেপাশেই ঘুরছে দোকানের সামনে...তা জাতীয় মা বলে কথা, চেটে দিলে দোষ নেই - এই ভেবে খান কয়েক কিনেই ফেল্লাম। মাইরি বলছি - কলকাতায় অনেক বালুসাই খেয়েছি, কিন্তু ফ্রেশ বালুসাই, সে রাস্তার দোকানে খোলা বিক্রি হলেও - জায়গার কল্যাণে কিনা জানি না - ঝক্কাস টেস্ট। আমি তো খেলামই, ছেলেমেয়েও পটাপট খেয়ে ফেললো, এমনকি সুগারের রুগীও খেয়ে নিলো। জায়গাটা খুব সম্ভবত হংসডিহা বা হাঁসডিহা - একদম বিহার-ঝাড়খন্ড বর্ডারের কাছেই।

ঝাড়খন্ড পেরোলাম, বিহারে ঢুকতে মনে হল এই যে নীতিশবাউকে লোকে এত তোল্লাই দেয় - রাস্তা টাস্তা নাকি ব্যাপক বানিয়েছেন - সেটা কী সম্পূর্ণ ঢপ? মানে যা দেখলাম তাতে মনে হল পূর্ণিয়ার বহু আগে, এমনকি ভাগলপুর পৌঁছনোরও আগে সকালে যা খেয়েছি সব হজম হয়ে যাবে। রাস্তার ধারে বাজারের সংখ্যাও বাড়ছে, ভিড়ও বাড়ছে - এইভাবে চললো বেশ কিছুটা। ভাগলপুর থেকে তখন ওই পঁচিশ-তিরিশ কিলোমিটার দূরে - একটা পেট্রোল পাম্পে দাঁড়ালাম, একটু হাল্কা হওয়া দকরকার সবারই। পাম্পের ঠিক মুখে একটা চায়ের দোকান - সেখান থেকে একটু গরম জল ফ্লাস্কে ভরে নিতে হবে, আর চাও খাবো ভাবলাম। চা খেতে খেতে দোকানীর পাশে একজনের সাথে কিছু কথা হল...

কাঁহাসে আ রাহেঁ হেঁ?

কলকত্তেসে।

কাঁহা যাইয়েগা?

শিলিগুড়ি যায়েঙ্গে।

শিলিগুড়ি ইঁহাসে ক্যাইসে যায়েঙ্গে?

কিঁউ? ভাগলপুর-পূর্ণিয়া হো কর?

সাব, ভাগলপুর তো যায়েঙ্গে, পর পূর্ণিয়া ক্যায়সে যায়েঙ্গে?

যা শালা, আমি তো হুব্বা। ভাগলপুর দিয়েই তো বিক্রমশীলা ব্রীজ টপকে পূর্ণিয়া যায়। আমি তাই বল্লুম। যা উত্তর দিলো শুনে সাথে সাথে যেন ঝড়-ঝঞ্ঝা-বজ্রপাত-সুনামি-ভূমিকম্প-অগ্নুৎপাত-দাবানল সব একসাথে...

সাব, হাম ইয়াঁহা তিন দিনসে বইঠে হ্যায়। বিক্রমশীলা ব্রীজ পুরা বন্‌ধ হ্যায়, সতরা তারিখ কো চালু হোগা! উও দেখিয়ে, উও মেরা ট্রাক।

কেলেঙ্কারি করেছে। গুগুল ম্যাপ তো দিব্যি দেখাচ্ছে বিক্রমশীলা ব্রীজে স্লো ট্রাফিক। বন্ধ তো বলছে না। কিছুক্ষণ কথা বলে বুঝলাম ২৭শে সেপ্টেম্বর বিক্রমশীলা ব্রীজ বন্ধ হয়েছে, ১৭ই অক্টোবর খোলার কথা। সেই সময়ে একদম মাঝের একটা ৩৪ মিটারের স্প্যানে কাজ হচ্ছে বলে এপার থেকে ছোট গাড়ি (অটো ইত্যাদি) কিছুদূর যাচ্ছে, তারপর হেঁটে পেরিয়ে ওপার থেকে আবার সেই অটো/টোটো। সেই জন্যেই ট্রাফিক বন্ধ দেখাচ্ছে না, কনজেস্টেড বা স্লো দেখাচ্ছে।

(কথা বলতে বলতে গুগুলে সার্চ মেরে দেখলাম - ঠিকই, ২৪শে সেপ্টেম্বরের টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় খবর আছে - সেখানেও বলেছে ১৭ই অক্টোবর খুলবে - আমাদেরই দোষ - ফারাক্কা এড়ানোর জন্যে যখন নতুন প্ল্যান করলাম, তখনই চেক করে নেওয়া উচিৎ ছিলো - কিন্তু এ জিনিস মাথায় আসবে কী করে যে এরকম একটা ভাইটাল ব্রীজ বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও ফারাক্কায় এই সময়েই মেনটেনেন্স শুরু হবে...)

তখন বাজে প্রায় বেলা এগারোটা। কী করি? আবার দুমকা অবধি ফিরে যেতে হবে?

(চলবে)

(আগের কথা)

দিকশূন্যপুরের রাস্তায় - The Road to Nowhere (৩য় পর্ব)

১৩ তারিখ সকাল থেকে অল্প টেনশন ছিলো - একেবারে ছিলো না বলা যাবে না। কারণটা মূলতঃ অনেক দিন পরে লঙ ড্রাইভে বেরোনো। সেই ২০১৩ সালের পর। এর মধ্যে বয়স বেড়েছে, রিফ্লেক্স কমে থাকতেই পারে। আর যেটা হয়েছে সেটা হল প্রোগ্রেসিভ লেন্স - মানে চালশেও ধরেছে আর কী। রোজ দুবেলা নেতাজীনগর - নিউটাউন গাড়ি ঠ্যাঙালেও, হাইওয়েতে যাওয়াআসা নিয়ে দেড় হাজার কিলোমিটার একটু অন্য জিনিস। তবে সে বেশিক্ষণ থাকেনি - হাইওয়েতে পড়তেই আবার সেই চেনা অনুভূতিটা ফিরে এলো - কালো পিচঢালা রাস্তায় দৌড় দৌড় দৌড়...

সেদিন মনে হয় পঞ্চমী ছিলো। এই প্রায় মহালয়া থেকে পুজো উদ্বোধন শুরু করে কী রেটে যে হাল বেহাল হয়েছে সেটা কলকাতায় না থাকলে বোঝা অসম্ভব। মোটামুটি দ্বিতীয়া থেকেই রাস্তায় কুলকুলিয়ে লোক নেমে গেছে, বাকিরা দেখে ফেলার আগেই ঠাকুর দেখতে হবে এরকম কিছু মানসিকতা নিয়ে মনে হয়। মহালয়ার দিন উত্তর থেকে ফেরার সময় সন্ধ্যেবেলা দেখেছি মণি স্কোয়্যার থেকে লেক টাউন অবধি জ্যাম - তা পঞ্চমীর দিন কী হতে পারে বুঝতেই পারছেন। ওই দুপুরবেলাতেও লর্ডস মোড় পেরোতে কান্নাকাটির অবস্থা। এর মধ্যে দুটো চল্লিশ বেজেও গেছে, ছেলে স্কুল থেকে বেরিয়ে তিনবার ফোনও করে ফেলেছে। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে পৌঁছে তাকে তুলতে তুলতেই তিনটে বেজে গেলো। তারপর আবার ডোভার রোড ঘুরে বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে এসে জ্যাম। গুরুসদয় দত্ত রোডে জ্যাম। থিয়েটার রোডে জ্যাম। তো সেসব পেরিয়ে এজেসি বোস রোড ফ্লাইওভারে উঠতেই সাড়ে তিনটে। সেকেন্ড ব্রীজ পেরোতে প্রায় চারটে। ওদিকে সিউড়ি যেতেই লাগবে ঘন্টা পাঁচেক - মানে সাড়ে আটটা - ন'টার আগে কোনোভাবেই পৌঁছনো যাবে না।

এবার সেকেন্ড হুগলী ব্রীজ পেরিয়েই দেখি কোণা এক্সপ্রেসওয়ে পুরো জ্যাম। জানলাম পুজোর সময় শহরে ট্রাক ঢোকার উপর রেসট্রিকশন রয়েছে, যেগুলো ঢুকেছিলো সেগুলো তখন বেরিয়ে যাচ্ছে, কাজেই রাস্তার হাল খারাপ। সে জ্যাম চললো সাঁতরাগাছি ব্রীজ অবধি। তারপরেও রেহাই নেই - ডানকুনিতেও বাজে জ্যাম। ওই অবধি পৌঁছতেই জ্যামে জ্যামে হাল বেহাল।

ডানকুনি পেরোনোর পরে হাইওয়ে ফাঁকা পেলাম - বর্ধমান অবধি কোনো চাপ নেই। বর্ধমান থেকে দুটো উপায়ে সিউড়ি যাওয়া যায় - এক) গুশকরা - সুরুল হয়ে, দূরত্ব ২০৫ কিমি - রাস্তাটা ন্যাশনাল হাইওয়ে হলেও দুটো লেনের; আর দুই) দুর্গাপুর/অন্ডাল হয়ে - দূরত্ব একটু বেশি, রাস্তাও চওড়া, কিন্তু সময় বেশি লাগছে - অর্থাৎ, গুশকরা-সুরুলের রাস্তা সরু হলেও, অসুবিধাজনক নয় বলেই মনে হয়।


বর্ধমান পৌঁছে ডানদিকে ঘুরে ন্যাশনাল হাইওয়ে ১১৪ (সেকমপুর-সাহাপুর রোড) - সোজা চলে গেছে গুশকরার দিকে। এই রাস্তাটা ওই প্রায় জিটি রোডের মত - একটা যাওয়ার লেন, একটা আসার লেন, মাঝে কোথাও কোথাও মিডিয়ান মার্ক করা আছে, কোথাও নেই। আর প্রপার গ্রামবাংলার মধ্যে দিয়ে রাস্তা। দুদিকে ক্ষেত, রাস্তার ধারে কাশবনের ছড়াছড়ি, আর, সন্ধ্যের মুখে সেসব ক্ষেতে আর মাঠে হু হা কুয়াশা। মাঝে মাঝে এক একটা গ্রামে তখনো প্যান্ডেল বাঁধার কাজ চলছে (ওদিকে কলকাতায় পুজোর অর্ধেক হয়ে গেছে সেটা মনে রাখবেন)। উল্টোদিক থেকে গাড়ি ধেয়ে আসছে ডিপারের তোয়াক্কা না করে - সেই সময়টুকু চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া ছাড়া এই রাস্তাটা নির্ঝঞ্ঝাট বলাই যায়। শুধু মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় কুয়াশা রাস্তা ঢেকে দেয় - গাড়ির উইন্ডশিল্ডের ওপর হইহই করে ধেয়ে আসে - গাড়ির হেডলাইট হাই-বীমে দিলে আরোই বরং বেশি জ্বলজ্বল করে ওঠে, চোখ ধাঁধায়। কোথাও কোথাও রাস্তার ধারের গাছগুলো দুপাশ থেকে বেঁকে এসে টানেলের মত তৈরী করে দিয়েছে - গাড়ি থেকে দেখলে মনে হয় পাতামোড়া একটা টানেলের মধ্যে দিয়ে হু হু করে এগিয়ে যাচ্ছি - ওই দূরে টানেলের মুখ, সেখান দিয়ে বেরোলেই একটা নতুন কিছু দেখতে পাবো...

এই রাস্তাটা গুশকরা পেরিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে সুরুল অবধি। সেখানে শান্তিনিকেতনকে ডানদিকে ফেলে রেখে আপনি সিউড়ি-বোলপুর রোড ধরে আরো এগিয়ে যাবেন। আশেপাশে শান্তিনিকেতন অঞ্চলের চেনা কিছু নামের বোর্ড দেখতে পাবেন - প্রান্তিক যেমন একটা। আরো এগিয়ে অবশেষে সিউড়ি। বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে অল্প এগোলেই বাঁদিকে হোটেল সাগর।

গাড়ি পার্ক করে রাতের জন্যে দরকারি ব্যাগ, আর ক্যামেরা ব্যাগ নিয়ে চেকইন করলুম। প্রথম প্রশ্ন - "আপনারা কি তারাপীঠ যাবেন?" কে জানে, সিউড়িতে যারাই যায় তারা তারাপীঠ যায় কিনা। যাই হোক, ঘরগুলো ভালোই (তবে এক একটা ঘরে দুজন করেই - তাই আমাদের চারজনের জন্যে দুটো ঘর নিতে হয়েছিলো)। ছেলেমেয়ে বায়না করলো বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, বাড়ির মত ভাত-ডাল-রুটি খাবো না, এলোমেলো খাবো। এবার এদের এলোমেলো মানে পিজ্জা/বার্গার - সে আর কোথায় পাওয়া যাবে - চাউমিন আর চিলি চিকেনই সই। খেয়েদেয়ে চটপট ঘুমিয়ে পড়ার কথা, কারণ পরের দিন অনেকটা পথ চালাতে হবে - প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার, কাজেই ভোরে বেরোতে হোবে। টার্গেট দিলাম সাড়ে চারটে, আর সাড়ে তিনটেতে অ্যালার্ম দিয়ে সেদিনের মত গুডনাইট।

পরের দিনের গন্তব্য লাটাগুড়ি পেরিয়ে টিলাবাড়ি টুরিস্ট কমপ্লেক্স।

(চলবে)

(আগের কথা)

Tuesday, October 30, 2018

দিকশূন্যপুরের রাস্তায় - The Road to Nowhere (২য় পর্ব)

আইটিনেরারি মত বুকিং করে ফেল্লুম - পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের সাইট থেকে বহরমপুর টুরিস্ট লজ আর টিলাবাড়ি আমিই করে নিলুম, আর আমার নর্থ বেঙ্গলের এক বন্ধু যে ট্যুর অপারেটরের কাজ করে, সে মৌচুকি ফরেস্ট বাংলো, পানঝরা আর মেন্ডাবাড়িতে বুকিং করে দিলো।

সব ঠিকঠাকই ছিলো, এই মার্কেটে হঠাৎ পুজোর আগে খবর বেরোলো যে ফারাক্কায় কাজ শুরু হয়েছে, একটা লেন বন্ধ থাকবে মাসখানেক। আমি চটজলদি দেবাশিসকে (মানে নর্থ বেঙ্গলের যে বন্ধুর কথা বললাম - এর কথা পরে আরো বলবো, ক্ষ্যাপাটে লোক) ফোন করলুম - সে বল্ল ন্যাশনাল হাইওয়ের ওপরে কুড়ি কিলোমিটার লম্বা লরির লাইন লেগে থাকছে - কারণ রাত্রি নটার আগে লরি ছাড়ছে না, আর সেই লরির লাইন কাটতে বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে।

অনেকদিন আগে একবার গাড়ি নিয়ে নর্থ বেঙ্গল প্ল্যান করেছিলাম - তখন একজন অন্য একটা রাস্তা বাতলেছিলো - যেটা একটু ঘুরপথ (প্রায় শ'খানেক কিলোমিটার), কিন্তু তাতে করে ফারাক্কা/মালদা এড়িয়ে যাওয়া যায়। সেটা সিউড়ি-দুমকা হয়ে। মিচেলিনের ম্যাপ বই আর গুগুল ম্যাপ কনসাল্ট করে আমি নতুন রুট প্ল্যান করলুম - যেহেতু আমার রওনা দিতে তিনটে বেজে যাবে (যে কারণে বহরমপুরে থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম) - প্রথম হল্ট এবার সিউড়িতে। পরের দিন ভোরে বেরিয়ে সিউড়ি-দুমকা হাইওয়ে ধরে ম্যাসাঞ্জোরের গা দিয়ে দুমকা অবধি, তারপর সেখান থেকে ঝাড়খন্ড-বিহারের মধ্যে দিয়ে ভাগলপুর। ভাগলপুরে গঙ্গা পেরোতে হবে বিক্রমশীলা ব্রীজ দিয়ে, সেখান থেকে পূর্ণিয়া হয়ে একেবারে ডালখোলা রেলগেট ছাড়িয়ে আবার ন্যাশনাল হাইওয়ে ৩৪-এ উঠবো। ভালো কথা। সেই মত সিউড়িতে একটা হোটেল বুক করলাম - বাস স্ট্যান্ডের কাছেই, নাম সাগর। গো-আইবিবো দিয়ে বুকিং হয়, রিভিউও ভালোই। ফেরার সময় প্ল্যান করলাম ভাগলপুরে থাকবো - সেখানে হাইওয়ের ধারেই বৈভব হাইওয়ে ইন - তারও রিভিউ ভালো। সেখানে ফোন করে কথা বলে নেওয়া হল - বল্ল আলাদা করে টাকা পাঠিয়ে বুক করতে হবে না, এসে নাম বলবেন, তাহলেই হবে।

[বাই দ্য ওয়ে, এখন মনে হয় এই ন্যাশনাল হাইওয়েগুলোর নম্বর বদলানো হচ্চে, কারণ মিচেলিনের ম্যাপ, যেটা কয়েক বছরের পুরনো, আর গুগুল ম্যাপে রাস্তা এক হলেও নম্বর আলাদা। যেমন, NH34 বহরমপুরের পর গুগুল ম্যাপ বলছে NH12 - যেটা ফারাক্কা/মালদা হয়ে উত্তরবঙ্গে যায়। NH31, যেটা শিলিগুড়ি থেকে গুয়াহাটির দিকে যায়, সেটাও NH114 না কী যেন বলছে গুগুল। অবিশ্যি নম্বর আলাদা বল্লেও রাস্তাগুলো দিব্যি ঠিকই বলে - সেই নিয়ে কোনো চাপ নেই। পরে জায়গায় জায়গায় রাস্তার ডিটেলস বলে দেবো।]

এই নতুন রুট শুনে বাবাও বেশ উত্তেজিত - কারণ পূর্ণিয়া হল আমাদের দ্যাশের বাড়ি (কেন আমি ছাতু খেতে পছন্দ করি এবারে বুইলেন তো?) - যদিও আমি কখনো দেখিইনি, বাবা ছোটোবেলায় ওখানেই থাকতো। সতীনাথ ভাদুড়ির বাড়িও আশেপাশেই ছিলো, এবং ঢোঁড়াইরাও (রেফঃ ঢোঁড়াই চরিত মানস) থাকতো ওই বাড়ির পাশেই। তা সেই বাড়ি (প্রচুর জমি - আম-জাম বাগান সহ) বিক্রি হয়ে গেছে - সেখানে নাকি হোটেল হবে - বাড়ি আর দেখার কিছুই নেই, শুধু আমি ওই পথে গেলে জায়গাটা দেখে আসতে পারবো...

জিনিসপত্র গোছগাছ হল - গাড়িতে যাবো, অ্যাবান্ড্যান্ট জায়গা, কাজেই এবারে প্যাকিং নিয়ে ঝগড়া (যেটা কিনা ইউজুয়াল জিনিস) হল না। গাড়িতে ফ্লাস্ক যাবে - গরম জল, টী ব্যাগ, সুগার কিউব সব নিয়ে যাওয়া হবে যাতে গাড়িতে বসেই চা খাওয়া যায় (স্পিল-প্রুফ ট্র্যাভেল কাপে)। সুমনার ইচ্ছে ছিলো বিউটেন স্টোভও নিয়ে যায় - কিন্তু ডিম সেদ্ধটা হবে কোথায় - রাস্তার ধারে ধুলো খেতে খেতে - এই প্রশ্ন তোলায় সেটা বাতিল হয়। বাড়তি উঠলো টায়ার পাংচার কিট আর এমার্জেন্সি পাম্প (গাড়ির সকেট থেকে চালানো যায়, একটু আস্তে আস্তে হলেও দরকারে চাকায় হাওয়া ভরা যায়)। এছাড়া জামাকাপড়, ক্যামেরার ব্যাগ ইত্যাদি আনুসাঙ্গিক জিনিস তো উঠলোই।

এই সময়ে ঋকের ঘাড়ে একখান ফোঁড়া হয়েছিলো - আমি ফাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করাতে পেল্লায় চেঁচামেচি করে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওষুধ টষুধ নিয়ে এলো, প্লাস গরমজলে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট মিশিয়ে সেঁক দেওয়ার ফরমান। সুতরাং আরেকটা ফ্লাস্ক, তাতে ওষুধ মেশানো গরমজল। প্লাস ফোন+ট্যাব+কিন্ডল - এই সারাদিন গাড়িতে থাকবে, কিছু একটা তো চাই। মাঝে একবার বলা হয়েছিলো গাড়িতে টিভি লাগানো যাবে কিনা...

তা এসে গেলো ১৩ই অক্টোবর। বাড়ি থেকে রওনা দিলুম তখন সওয়া দুটো। ঋকের স্কুল ছুটি হবে দুটো চল্লিশে, ওকে স্কুল থেকে তুলে আমরা বেরিয়ে পড়বো।

মোটামুটি এই ছিলো যাওয়ার প্ল্যান -



(চলবে)


(আগের কথা)

Monday, October 29, 2018

দিকশূন্যপুরের রাস্তায় - The Road to Nowhere - শুরুর কথা

অনেকদিন বাদে ব্লগ লিখছি। প্রথমতঃ সময় পাই না, প্রায় ধরুন বছর দেড়েক পরে কোথাও বেড়াতে গেলাম - প্রধান কারণ ছেলের মাধ্যমিক (হ্যাঁ, সেই ছেলে বড় হয়ে গেছে, ক্লাস ইলেভেনে উঠে গেছে), আর দ্বিতীয়তঃ সেরকম অ্যাডভেঞ্চারের ট্রিপ সেই ২০১৩ সালে সাতকোশিয়ার পর আর হয়নি। সে একটা সময় ছিল, আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে যখন গাড়ি নিয়ে টই টই করে বেড়িয়েছি। এখানেও শুরুর দিকে চিলিকা, সাতকোশিয়া - তারপর এই স্কুল-টুলের চক্করে সে সব ডকে উঠেছিলো। বেড়াতে গেছি - ধরুন নর্থ সিকিম, তুঙ্গনাথ, তার আগে মধ্যপ্রদেশ, কিন্তু লেখার মত কিছু ছিলো না। আসলে প্ল্যান ছিলো ছেলের মাধ্যমিকের পরে দিন পনেরোর জন্যে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়বো লম্বা কোথাও - অরুণাচল প্রদেশ বা উত্তরাখণ্ড। সেই মত রুট ম্যাপও করে রেখেছিলাম। কিন্তু আজকাল মাধ্যমিকের পর ছুটি মেলে না। ক্লাস ইলেভেনের অ্যাডমিশন অধিকাংশ জায়গায় হয়ে যায় ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেই। টিউশনে ভর্তিগুলোও ওরকম সময়ে হয়ে যায়। সবই অ্যাডভান্সড ব্যাপার স্যাপার। তো এসব তেমন জানতামও না - তাই নিয়ে হুড়োহুড়িও গেছে মাধ্যমিক শেষ হওয়ার পরেই। আর এপ্রিল থেকেই টিউশন আর স্কুল শুরু হয়ে গেল - রেজাল্ট বেরনোর আগেই। এসব ঝামেলায় সেই প্ল্যান করা ট্রিপটা পুরো বরবাদ হয়ে গেলো। আর শুনলাম এই এগারো ক্লাসে স্কুল যদি বা মিস হয়, টিউশন যেন একেবারেই মিস না হয়। মাইরি বলছি - এরকম চাপ জন্মেও ভাবিনি। তা স্কুল আর টিউশনের কমন ছুটি হল পুজোর সময় - ষষ্ঠী থেকে লক্ষ্মীপুজো। সেইমত নতুন প্ল্যান বানিয়ে এই কিছুদিন একটু ঘুরে এলাম। হ্যাঁ, অনেকদিন পর আরেকটা রোড ট্রিপ।

লিখতে শুরু করার আরেকটা কারণ হল - আপিসের ম্যাগাজিনে লেখা দিতে বলেছে। তো সেইটা লেখার আগে একটা মকশো করে নিই, এর একটা ছোটো ভার্সন আপিসে দিয়ে দেবো, ইঞ্জিরি করে।

চেষ্টা করে দেখি, শেষ করতে পারি কিনা।

গোড়ার কথা

"রোড ট্রিপ কেন? এই তো বেশ নর্থ সিকিম ঘুরে এলাম, তুঙ্গনাথ ঘুরে এলাম - সেও তো গাড়িতেই, তা তোর নিজে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার এত শখ কেন?"

এই প্রশ্নটা প্রায় রেগুলার শুনি বাড়িতে রোড ট্রিপের কথা বল্লেই। সমস্যা হল এর উত্তরটা দিলেও যারা কখনো যায়নি, তারা ব্যাপারটা বুঝবেই না। ওই থ্রিলটা খুবই ব্যক্তিগত। যারা যায়, তাদের রাস্তা যেন ডাকে - আমায় ডাকে। রাতের বেলা ধানক্ষেতের মধ্যে বা জঙ্গলের মধ্যে এঁকেবেঁকে শুয়ে থাকা রাস্তার ওপর গাড়ি যখন ছুটিয়ে যাওয়ার সময় উল্টোদিক থেকে ধেয়ে আসা কুয়াশা, হাইওয়ের বাতি, দুপাশে ভেজা মাঠ, বা পাহাড়ি রাস্তার বাঁকগুলো অ্যাডিকশন ধরিয়ে দিয়েছে সেই যবে থেকে ইন্টারস্টেট ৭০ ধরে রকি মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্কে গেছিলাম, তবে থেকেই। এইটা এখন বাড়িতে বোঝানোর চেষ্টা করা ছেড়েই দিয়েছি। সুমনা জানে, তার নিজেরও ইন্টারেস্ট আছে, ঋক/ঋতি বলা যায় বেড়াতে পারলেই হল - কীসে গেলাম, গাড়িতে না রকেটে তাতে ওদের কিস্যু এসে যায় না। এই চারজনের বাইরে রোড ট্রিপ শুনলেই সবাই কেমন আঁতকে ওঠে।

তা এবারও তাই উঠলো যখন বল্লুম ডুয়ার্স যাবো। এক বন্ধুর সাথে কথা বলে আইটিনেরারি ঠিক করলাম। রিকোয়্যারমেন্ট ছিলো নির্জনতা চাই, পাহাড় চাই, জঙ্গল চাই। সেই মতন ঠিক হল কলকাতা থেকে বেরিয়ে প্রথমে যাবো টিলাবাড়ি, যদিও প্রথম গন্তব্য সান্তালেখোলায় মৌচুকি ফরেস্ট বাংলো। টিলাবাড়ি যাবো কারণ সন্ধ্যে ছটার পর মৌচুকিতে ঢুকতে দেয় না, আর একদিনে কোনোমতেই তার আগে পৌঁছনো সম্ভব নয়। তাছাড়া, পুজোর আগের শনিবার অবধি স্কুল খোলা - কাজেই স্কুল ছুটির পরেই আমি রওনা দিতে পারবো - মানে বিকেল তিনটে নাগাদ - সেক্ষেত্রে, মাঝ্পথে কোথাও রাত কাটাতে হবে। মাঝপথ মানে বহরমপুর - তাহলে ভোরে বেরিয়ে পড়লে ভিড় এড়িয়ে ফারাক্কা আর মালদা পেরিয়ে যাওয়া যাবে।

সান্তালেখোলায় দুদিন সম্পূর্ণ ল্যাদ খাওয়ার প্রোগ্রাম। বহু বছর ধরে সকালে আমি সবাইকে ডেকে তুলে স্কুল/আপিসের জন্যে ঠেলছি, তাই বলেছিলুম এই ট্রিপে আমি সবাইকে পৌঁছে দেবো, কিন্তু তারপর সবাই আমাকে প্যাম্পার করবে - সকালে ডেকে তুলবে, ব্রেকফাস্ট করাবে, বেড়াতে নিয়ে যাবে ইত্যাদি। সান্তালেখোলা তার জন্যে আদর্শ।

তারপর যাবো চাপড়ামারি - পানঝোরা ফরেস্ট বাংলোতে - মূর্তি নদীর ধারে। সেখান থেকে মেন্ডাবাড়ি - সেটা চিলাপাতায়। মেন্ডাবাড়িতে এক রাত থেকে ফের ফিরে আসা, মাঝপথে মালদায় রাত কাটানো।

এই হল প্ল্যান। ১৩ই অক্টোবর রওনা দিয়ে ২০শে অক্টোবর বাড়ি ফেরা। রুট এইরকম -

কলকাতা থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে ৩৪ ধরে বহরমপুর, সেখান থেকে ফারাক্কা পেরিয়ে রায়গঞ্জ হয়ে বোতলবাড়ি-রসুলপুরের রাস্তা ধরে দিনাজপুরের ভিতর দিয়ে ইসলামপুর (এটা ডালখোলা এড়ানোর জন্যে), তারপর ফুলবাড়ি-ঘোষপুকুর বাইপাস ধরে শিলিগুড়ি এড়িয়ে গাজলডোবা হয়ে লাটাগুড়ি। ফেরার সময়েও মেন্ডাবাড়ি থেকে ফালাকাটা-ধূপগুড়ি-আমবাড়ি-বেলাকোবা হয়ে হাইওয়েতে পড়ে মালদায় হল্ট করে পরের দিন মোরগ্রাম-বর্ধমান (স্টেট হাইওয়ে ৭) হয়ে কলকাতা।

কিন্তু ওই যে বলে - man proposes, God disposes...

(চলবে)