Thursday, November 22, 2012

At the abode of the Cloud Warriors

শনিবার, ২০শে অক্টোবর, ২০১২
=====================
প্রতি বছর যা হয় এবারও তাই। গোছগাছের সময় তাড়াহুড়ো, অতএব টুকটাক জিনিস ভোলা - পুজোর সময়, তাই হাতে সময় নিয়ে রওনা দেওয়া, অতএব স্টেশনে বসে ভ্যারেন্ডা ভাজা ইত্যাদি। তবে এবার একটু বেশি বেশিই। বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে লেক গার্ডেন্স পৌঁছে খেয়াল হল ঋকের ক্যামেরার (ট্রেনি ফটোগ্রাফার এবার ৩৫০ডি ব্যবহার করতে শিখছে) চার্জার আনা হয়নি, এবং ব্যাক-আপ ব্যাটারিটা পুরো মৃত। শেয়ালদা পৌঁছে দেখি তিল ধারণের জায়গা নেই। দশটায় ট্রেন, আমরা পৌঁছে গেছি সাড়ে ছটায়। এমনিতেই শেয়ালদা স্টেশনটা অত্যন্ত বাজে, বসার জায়গা নেই, ওয়েটিং রুমের অবস্থা খারাপ, আর এবার মনে হয় ভিড় বেশিই ছিলো। তায় সন্ধের দিকে পরপর উত্তরবঙ্গের ট্রেন ছাড়ে। অতক্ষণ কে আর দাঁড়িয়ে থাকবে - একটা কাগজের স্টল থেকে "এই সময়" কিনে এনে পেতে বসে পড়লাম...

সাড়ে নটা নাগাদ কোন প্ল্যাটফর্ম জানতে গিয়ে দেখি ট্রেন এসে গেছে। সবাইকে টেনে তুলতে গিয়ে সুমনার জুতোর সোল খুলে ঝুলতে শুরু করলো (চোদ্দ বছরের পুরনো উডল্যান্ডস)। প্ল্যাটফর্মে কী ভিড়, বাপরে বাপ্‌। জেনারেল কম্পার্টমেন্ট সাধারণতঃ মনে হয় দুটো থাকে - দার্জিলিং মেলে চারটে - প্রতিটা পুরো প্যাকড আপ, তা সত্ত্বেও সেগুলোর সামনে শখানেক লোক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। স্লিপার ক্লাসে লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিজেদের কামরা অবধি পৌঁছতে বেশ কসরৎ করতে হল। এরকম ভিড় একমাত্র দেখেছিলাম সেই মাধ্যমিকের পর (৮৯ সালে) একটা ঝড় হয়েছিলো - তার পরের দিন ইস্ট কোস্টে।


রবিবার, ২১শে অক্টোবর, ২০১২
====================

দার্জিলিং মেল মোটামুটি ভালোই যায়। সকালে এনজেপি পৌঁছে একটা অটো নিয়ে তেনজিং নোরগে স্ট্যান্ড অবধি চলে গেলাম। অ্যাজ ইউজুয়াল, এনজেপি-তে পেডং শুনেই কেউ সাড়ে তিন, কেউ চার অবধি হাঁকছিলো। তেনজিং নোরগে স্ট্যান্ড থেকে মোটামুটি রিজনেবল দরে কালিম্পং-এর গাড়ি পেলাম, যদিও কালিম্পং-এর গাড়ির স্ট্যান্ড অ্যাকচুয়ালি পানিট্যাঙ্কির কাছে - সেখানে শেয়ারের জিপগুলো পাওয়া যায়।

কালিম্পং পৌঁছে আগে তো জুতো কেনা হল, তাপ্পর একটা ক্যামেরার দোকানে চার্জারও পাওয়া গেলো - যেটা দিয়ে ক্যাননের মোটামুটি সব ব্যাটারি চার্জ করা যাবে। তাপ্পর একটা দোকানে মোমো আর চাউমিন খেয়ে একটা ন্যানোয় চেপে (কি পুঁটকে গাড়ি রে বাবা, ভিতরে বসলে কেন জানি না আরো পুঁটকে লাগে) গেলাম পেডং। কালিম্পং-এ শুধু ওই ঢালু রাস্তায় যেখানে গাড়িগুলো দাঁড়ায় সেখানটা দেখেছি, আর সেখান থেকে দূরে। লোকে খুব কালিম্পং কালিম্পং করে বটে, কিন্তু আমার প্রবল ঘিঞ্জি লাগলো।

পেডং-এ উঠলাম সিল্ক রুট রিট্রিট বলে একটা রিসর্টে। ওদের কয়েকটা ঘর আছে, আর তিনটে কটেজ। কটেজগুলো লগ-কেবিন গোছের, কাঠের বাড়ি, ভিতরে দুটো খাট, বাথরুম ইত্যাদি। খুব বেসিক ব্যবস্থা, কিন্তু গোছানো। টিভি ইত্যাদি নেই। কিন্তু কটেজের পাশে সুন্দর বাগান, তাতে ফুলটুল আছে, আর বেশ কিছু মাকড়সাও। ম্যাক্রো লেন্স থাকলে মাকড়সা বেশ ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট। সিল্ক রুটের ব্যবস্থাপনা ভালো, খাওয়াদাওয়াও মোটামুটি ভালোই। এখানে রিসর্টে থেকে হোটেলে খেয়ে আসার গল্প চলবে না, কারণ রিসর্ট থেকে পেডং বাজার প্রায় আড়াই কিলোমিটার, পুরোটা নীচের দিকে নামা, খেয়ে ফিরতে কালঘাম ছুটে যাবে, আর তাছাড়া পেডং বাজারও খুব ছোট্ট, সেখানেও বিশেষ ব্যবস্থা নেই। তবে seclusion পছন্দ করলে সিল্ক রুট রিট্রিট পছন্দ হবেই হবে।

কেউ পেডং যেতে চাইলে সিল্ক রুট রেকো করবো। ওদের সম্পর্কে ইনফো পাবেন ওদের সাইটে - http://www.thesilkrouteretreat.com/


সোমবার, ২২শে অক্টোবর, ২০১২
=====================

পেডং-এ ঘোরার জায়গা বলতে পাশের সেলারি অঞ্চলটা। সিল্ক রুটের এই দিকের ট্যুরিজম প্রোমোট করেন সেবাস্টিয়ান প্রধান বলে এক ভদ্রলোক - সেলারি, রেশি/ঋষি, জুলুক - এই পুরো এরিয়াটা। পেডং থেকে একটু পিছিয়ে গিয়ে বাঁদিকে একটা সরু রাস্তা উঠে গেছে পাহাড়ের ওপর। সেই রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে সেলারি বনের মধ্যে। দু পাশে কনিফেরাস ফরেস্ট, মাঝখান দিয়ে স্যাঁতস্যাঁতে ভিজে ভিজে রাস্তা - হেঁটে যাওয়ার পক্ষেই ভালো, কারণ তখন ওই ভেজা জঙ্গলের আরো কাছে চলে যেতে পারবেন। তবে সিল্ক রুট রিট্রিট থেকে সেলারি অবধি দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার মতন।

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা ঘুরে ঘুরে ওঠে সেলারি গাঁও-এর দিকে। সেলারি গাঁও ইদানিং একটা হট ডেস্টিনেশন। ইলেকট্রিসিটি নেই, পাহাড়ের গায়ে ২৪টা পরিবারের একটা ছোট্ট গ্রাম। কিন্তু তাও দলে দলে টুরিস্ট এখন এই গ্রামে গিয়ে হোমস্টে-তে থাকে। কলকাতার প্রচুর ট্রাভেল অপারেটর গ্রামের বাসিন্দাদের ফান্ডিং করছে - তারা নিজেদের বাড়িতে হোমস্টে বানায়, লোককে রাখে - লজিংটা কলকাতার অপারেটরদের পকেটে ঢোকে, খাবারের খরচটা সেলারি গাঁওয়ের লোকজন পায়। যেদিকেই তাকাবেন, সেদিকেই গ্রামের বাড়িতে হোমস্টে, সেখানে কচিকাঁচা থেকে শুরু করে বুড়োবুড়িদের ভিড়। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে জীন্সের সাথে গাদাখানেক শাঁখা-পলা-চুড়ি পরিহিতা প্যাকেট ভর্তি সিঁদুর লাগানো বাঙালী মেয়েদের।

সেলারিকে পাশে রেখে আগে উঠে যান ওই অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু রামিটে ভিউপয়েন্টের দিকে। এখান থেকে তিস্তার সবচেয়ে লম্বা স্ট্রেচটা দেখতে পাবেন - ১৪টা বাঁকসহ, একদম রংপো-র সিকিম মনিপাল ইনস্টিট্যুট অফ টেকনোলজি অবধি। আমরা দেখতে পেয়েছি যদিও, কিন্তু সেদিনটা একটু hazy থাকার জন্যে ছবিটা ভালো ওঠেনি - যদি এডিট করে দাঁড় করাতে পারি তাহলে তুলে দেবো।

রামিটে ভিউপয়েন্ট থেকে ফেরার পথে গাড়ি থামিয়ে নীচে নেমে সেলারি গাঁও ঘুরে দেখতে পারেন। হাতে সময় থাকলে দামসাং ফোর্ট (ধ্বংসাবশেষ) ঘুরে আসতে পারেন - অনেকটা ওপরে উঠতে হবে, প্রায় ঘন্টাখানেক, অথবা তিনচুলে (দার্জিলিং-এর গ্রামটা নয়, একটা peak) - সেও অনেকটা দূর। আর যেতে পারেন সাইলেন্স ভ্যালী-তে - ওই সেলারি থেকে নামার পথেই। সেখানে অজস্র ফড়িং ঘুরঘুর করছে, আর নানা রকম জংলী ফুল।

বাদবাকি কয়েকটা স্পট একটু দূরে - যেমন ক্রসহিল্‌স আর রেশিখোলা/ঋষিখোলা।



রেশিখোলাও সেবাস্টিয়ান প্রধানের ব্রেনচাইল্ড। পঃবঙ্গ আর সিকিমের বর্ডারে রেশি নদীর গায়ে একটা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার। পেডং থেকে কুড়ি কিমি মতন হবে, বা তারও কম। আগে একদম নীচে নদীর ধার অবধি গাড়ি চলে যেত, এখন ওই জমি নিয়ে কিছু একটা গোলমালে গাড়ির রাস্তাটা বন্ধ হয়ে গেছে। বড় রাস্তা থেকে একটু ভাঙাচোড়া একটা ট্রেল নেমে গেছে - সেই দিয়ে যেতে হয়। রিসর্ট অবধি যাই নি, কাজেই সেটা নিয়ে বলার কিছু নেই। রেশি নদীও টিপিক্যাল ছোট পাহাড়ি নদী। নদীর ধারটা ভালো পিকনিক স্পট - সকাল সকাল এসে একটু বসে পিকনিক করে চলে যেতে পারেন। থাকার পক্ষে মনে হল না খুব একটা ভালো কিছু।

তবে পোকামাকড়/প্রজাপতিতে আগ্রহ থাকলে এই ট্রেলটা ব্যাপক। মাঝে একটা জায়গায় পাহাড় থেকে একটা ছোট্ট ঝোরা নেমে এসেছে রেশি অবধি, সেখানটা পাথর পেরিয়ে যেতে হয়। তার পাশেই, মাঝে মাঝে অনেকগুলো হলদে প্রজাপতি এসে একটা ক্লাস্টার মত বানিয়ে ফেলে। কিছুক্ষণ বসে থাকে মাটিতে বা পাথরের ওপর, আবার উড়ে পালায়। আবার হয়তো কিছুক্ষণ বাদে এসে জমা হয়। দু তিনবার চেষ্টা করলাম এই ছবিটা ধরে রাখতে - প্রথমবার ওই ঝোরার পাথরের ওপর পা রাখতেই সব উড়ে পালিয়ে গেলো। দ্বিতীয়বার লেন্স বাগিয়ে প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করলাম ওদের জমা হওয়ার জন্যে। ঠিক যখন জমা হচ্ছে, তখনই আরেকদল টুরিস্ট হই হই করে সেই ট্রেল বেয়ে নেমে এলো - ব্যাস্‌, সবকটা প্রজাপতি ফের হাওয়া। তৃতীয়বারেও একই ঘটনা। মেজরিটি টুরিস্টের মধ্যে এই ব্যাপারটা আছে, এবং এটা অসম্ভব বিরক্তিকর - কেউ একজম ক্যামেরা নিয়ে কিছু একটা ছবি তোলার অপেক্ষায় রয়েছে - সেটা এদের কাছে ম্যাটার করে না।






যাই হোক, এখান থেকে ফের রাস্তায় উঠে দেখি গাড়ি হাওয়া। বলেছিলো একটু সামনে এগিয়ে থাকবে, কিন্তু নেই। তাপ্পর জানা গেলো সে আরেকটু ওপরদিকে উঠে গেছিলো গাড়ি ধোয়ার জন্যে, সেখানে কিছু বন্ধুবান্ধব পেয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো। রেশি থেকে ফেরার পথে পেডং ঢোকার অল্প আগে ডানদিকে রাস্তা চলে গেছে ক্রসহিল্‌স-এর দিকে। আঠারোশ কত সালে যেন কয়েকজন মিশনারি এই সিল্ক রুট ধরে চীনে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন - তাদের মেরে দেয়। তখন ওই জায়গায়, চীনের দিকে মুখ করে একটা ক্রস বসানো হয়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখানকার দৃশ্য খুব সুন্দর, এবং কপালে থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘারও দেখা মেলে। তবে সেরকম আকাশ আমরা পাইনি। পেডং-এ ঘোরার দিনটা পুরোটাই নীচে কুয়াশায় ঢাকা hazy ছিলো।


মঙ্গলবার, ২৩শে অক্টোবর ২০১২ - জুলুকের পথে
==============================

অবশেষে ২৩ তারিখ। যে জায়গাটার ছবি ইন্ডিয়ামাইকে দেখে ফিদা হয়ে গেসলাম, যে জায়গাটায় যাবো বলে সেই মে মাস থেকে হা পিত্যেশ করে বসে আছি, সেখানে যাবো।

পেডং থেকেই শুরু ওল্ড সিল্ক রুটের - যেটা একসময় তিব্বতী লাসার সঙ্গে ভারতকে জুড়তো জেলেপ লা-র মধ্যে দিয়ে - আপাতত যেটা পূর্ব সিকিম, টুরিস্টদের কাছে আপেক্ষিকভাবে একটা নতুন জায়গা - খুব বেশিদিন নয় এই পথটা টুরিস্টদের জন্যে খোলা হয়েছে। গোটা পথে কাতারে কাতারে মিলিটারি, প্রায় প্রতিটা গ্রামে মিলিটারি ছাউনি। এরই মধ্যে ৯৫০০ ফুট ওপরে ছোট্ট গ্রাম জুলুক - যেখানে রয়েছে "ক্লাউড ওয়ারিয়র"-দের base - একটা ট্রানজিট ক্যাম্প। বর্ডার অঞ্চলে যে সৈন্যরা যায় তারা এখানে কয়েকদিন থাকে, acclimatisation-এর জন্যে। রোজ ছয় কিলোমিটার ওপরে ওঠায়, ট্রেনিং করায় - যারা সুস্থ থাকে তাদের বর্ডার পোস্টে পাঠানো হয়।


এই পথে শুধু তখনই যাবেন যখন মনে হবে যে হোটেল/রিসর্ট/ফুডকোর্ট/মল ইত্যাদির বাইরে অনেক দূরে শুধুমাত্র খুব বেসিক থাকা-খাওয়াতেও এই জায়গাটার সৌন্দর্য শুষে নিতে পারবেন আপনি...যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই পথেও আজকাল কিছু টুরিস্টের ভিড় হয় যারা ওখানে পৌঁছে ছোটখাটো ঘর বা সাধারণ চালের ভাত-ডাল-ডিমের ঝোল দিয়ে খাওয়া বা রুম-কমফর্টের অভাব নিয়ে অভিযোগ করে। হোম-স্টে-টাও অনেকটা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হয়ে গেছে - সেলারিতে যেরকম টুরিস্টের ভিড় দেখেছিলাম, সেরকম লোকজন ইদানিং জুলুকেও যায়। টুরিস্ট আসা জুলুকের পক্ষে খারাপ না হলেও এই ধরণের টুরিস্টের ভিড় মনে হয় না খুব একটা ভালো। জুলুককে ভালো লাগাতে গেলে শুধু হিমালয়কে ভালোবেসে যেতে হবে। মনে রাখবেন জুলুক দার্জিলিং বা গ্যাংটক নয়, কখনো চাইবোও না জুলুক সেরকম হয়ে যাক। জুলুক যেমন আছে তেমনই থাকুক - পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট একটা গ্রাম - সরু রাস্তা ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে - যেখানে গায়ের ওপর দিয়ে মেঘ চলে যায়, আরো ওপরে উঠলে মেঘের ওপর উঠে যাওয়া যায়...শুধু চোখ বন্ধ করবেন আর ভেসে উঠবে হাজার বছর পুরনো ছবি - লাইন দিয়ে অনেক লোক ফার বা পুশতিনের কোট গায়ে চাপিয়ে হয়তো ব্যাক্ট্রিয়ান ক্যামেলের পিঠে বোঝা চাপিয়ে পাহাড়ি পথে এগিয়ে চলেছে...

জুলুকে থাকার দুইটি জায়গা - এক নম্বর হল গোপাল প্রধানের হোমস্টে (দিলমায়া), আর দুই নম্বর পাসাং শেরপার হোমস্টে (পালজোর)। তিন চারটে মোটামুটি বড় গ্রুপ হলেই জুলুকে আর থাকার জায়গা থাকে না, কাজেই হাতে সময় থাকতে বুক করে ফেলা ভালো। ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছিঃ

গোপাল প্রধান - ৯৬০৯৮৬০২৬৬
পাসাং শেরপা - ৯৭৩৪১৫০৫৪৬

গোপাল প্রধানকে আগে ফোন করেছিলাম - সেই মে মাসেই। তখন থেকেই পুজোর ছুটিতে ওঁর হোমস্টে পুরো ভর্তি হয়ে গেছে। পাসাং শেরপাকে ফোন করে জায়গা পেয়েছিলাম। গাড়ির কথাও হয়েছিলো। থাকা-খাওয়ার জন্যে জনপিছু ৭০০/-, আর গাড়ি দিনপিছু ৩৫০০/- - সেই গাড়ি আমাদের পেডং থেকে নিয়ে আসবে, জুলুকের আশেপাশে যা ঘোরার ঘোরাবে, আবার পরের দিন গ্যাংটক ছেড়ে আসবে।

তো কথামত গাড়ি এসে গেলো পেডং-এ পাক্কা সাড়ে আটটায়। ব্যাগপত্র গুছিয়ে রওনা দিলাম - সেই রেশিখোলার পথেই আবার। রেশিখোলা ছাড়িয়ে আরো একটু এগিয়ে প্রথম জনপদ "রেনক", আরো এগিয়ে "রংলি" - এখানে আপনাকে একটু দাঁড়াতে হবে, কারণ জুলুকের রাস্তায় যেতে হলে পারমিট লাগে। আপনার/আপনাদের আইডি সঙ্গে রাখবেন - ফটোকপিসহ - নইলে এখানে ফের ফটোকপি করাতে হবে, আর রাখবেন পাসপোর্ট সাইজ ফটো। গাড়ির ড্রাইভারই এইসব ডকুমেন্ট নিয়ে গিয়ে পারমিট করিয়ে আনবে। রংলিতে চা-টা খেয়ে ফের ওঠা শুরু, আর এই পথই আপনাকে নিয়ে যাবে জুলুক। পথে দেখবেন পর পর মিলিটারি ট্রাক যাচ্ছে - বেশ আস্তেই, কারণ রাস্তা বেশ চড়াই। এই ট্রাকের লাইনের পাশ দিয়েই অল্প জায়গা করে নিয়ে ছোট গাড়িগুলোকে বেরোতে হয়। প্রথম পেরোবেন লিংথাম - যেখানে আপনাদের পাস চেক করা হবে, চেকপোস্টের লোক পাসের একটা কপি রেখে দেবে। এর পর আরো উঠতে থাকবেন, আরো আরো উঁচুতে - গাড়ির জানলাটা একটু একটু করে বন্ধ করতে হবে, কারণ হাওয়া ক্রমশঃ ঠান্ডা হচ্ছে...আরেকটা ছোট গ্রাম পেরোবেন - নাম পদমচেন - এখানে হেডহান্টার্সদের ছউনি।

আরো উঠতে থাকুন - একের পর এক হেয়ারপিন বেন্ড। গাড়ির ড্রাইভার আপনাকে বলবে এ আর এমন কি - জুলুকের ওপরে দেখবেন আসল হেয়ারপিন বেন্ড কাকে বলে...উঠতে উঠতে একসময় রাস্তা ঢেকে যাবে মেঘ আর কুয়াশায়, তার ফাঁক দিয়ে নীচের দিকে তাকালে আপনার গা শিউড়ে উঠবে - ভাবতে কষ্ট হবে যে ওই রাস্তায় আপনি উঠে এসেছেন। তারপর এক জায়গায় দেখবেন পর পর মিলিটারি লরির লাইন - সেই লাইনের পাশ দিয়ে এগোতে এগোতে পৌঁছবেন ছোট্ট গ্রাম জুলুকে - যেখানে থাকে Cloud Warriors...


জুলুক পৌঁছলাম দুপুর দেড়টা নাগাদ। মোড়ের মাথাতেই পাসাং শেরপার একটা ছোট দোকান - সেখানে টুকটাক জিনিসপত্র, সিগারেট, লজেন্স আর ইসে পাওয়া যায়। দিনের খাওয়া দাওয়াও ওখানেই। ছোটখাটো চেহারার লোক পাসাং, একগাল হাসি নিয়ে ওয়েলকাম জানালেন, বল্লেন জিনিসপত্র এখানেই থাক - দুপুরের খাওয়া প্রায় তৈরী, খেয়ে নিয়ে ঘরে যাবেন। ছোট দোকানের এক কোণে পাসাং-এর স্ত্রী রান্না করছিলেন, তিনিও এসে এক গাল হাসি দিয়ে ঋতির গাল টিপে দিয়ে গেলেন।

খাওয়াদাওয়া খুব সাধারণ। সাধারণ চালের ভাত, কালো ডাল, একটা ভাজা ভাজা তরকারি - সম্ভবতঃ লাউ, আর ডিমের ঝোল। বাইরে তখন বেশ ঠান্ডা, যদিও অনেক দিনের নর্থ ইস্ট ইংল্যান্ডের অভ্যাসে তখনও সেই ঠান্ডা ম্যানেজেবল। ভাত খেয়ে ঘরে গেলাম - কাঠের বাড়ি, টিনের চাল। একটা ছোট ঘরে তিনটে খাট, লেপ-কম্বল শুদ্ধু। পুরনো দিনের মেঝেওয়ালা বাথরুম, তবে কমোড সিস্টেম - যেটা কিনা একটু সুবিধার, কারণ হাঁটু বিগরোনোর পর দেশি সিস্টেম ব্যবহার করতে একটু কষ্ট হয়। গরম জলের কল নেই, ঝরণার জল ট্যাঙ্কে ভরে বাথরুমে ছাড়া হয়। ঘরে টিভি ইত্যাদি নেই, টিমটিমে দুটো আলো আছে, আর টেবিলে একটা কেরোসিন ল্যাম্প আর মোমবাতি, কারণ সন্ধ্যের দিকে প্রায়ই লোডশেডিং হয়। মোবাইলে সিগন্যাল কখনো থাকে, এক ফুট এদিক ওদিক সরে গেলেই সিগন্যালও হাওয়া হয়ে যায় - তবে সেটা এয়ারটেল। ওসব জায়গায় অন্য প্রোভাইডার হয়তো ভালো চলে - জানি না।

হিমালয়ে যাঁরা প্রায়ই যান তাঁরা হয়তো লক্ষ্য করেছেন - দুপুরের পর থেকে আবহাওয়া আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে যায়। জুলুকেও তাই। একটু বেলা গড়াতেই হু হু করে মেঘ উড়ে এসে রাস্তাঘাট ঢেকে ফেললো - ঘরটা আরো স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে উঠলো। তার মধ্যেই ঘরের পিছনদিকে পাহাড়ের গায়ে একটা সরু হাঁটাপথ ধরে একটু এদিক ওদিক ঘুরে এলুম - পাহাড়ের গা বেয়ে যেদিকে সিল্ক রুট উঠে গেছে সেটা নীচ থেকে দেখা যায়। আর অনেক ওপরে, পাহাড়ের মাথায় যেখানটা পুরো মেঘে ঢাকা - সেখানেই রয়েছে থাম্বি ভিউপয়েন্ট, আর আরো একটু এগিয়ে লুংথুং - আমাদের পরের দিনের ভোরবেলার গন্তব্য - সানরাইজ পয়েন্ট।


সন্ধ্যেবেলা আর কিছু করার নেই। ছেলেমেয়ে খুবই বোর হতে শুরু করলো - সে অবশ্য পেডং-এও হয়েছিলো, কারণ টিভি নেই এমন জায়্গায় ওদের থাকা এই প্রথম (ছোটবেলার ইউরোপীয় ইউথ হোস্টেল বাদ দিলে - আর টিভির অপরিহার্যতা এখন আরো বেশি ওদের কাছে)। পেডং বাজার থেকেই এক প্যাকেট তাস আর একটা লুডো কিনে রেখেছিলাম - পেডং-এও কাজে এসেছিলো, এখানেও এলো। ওদিকে পেডং-এ একদিন পাকামি করে দেওয়ালের কাছে একটা বিছানায় একা শুয়ে ঋকের কাশিটা একটু বেড়েছিলো (কলকাতা থেকেই সর্দিভাব ছিলো, জানলা খুলে গাড়িতে বসে সেটা বেড়ে গেছিলো) - এখানে ঠান্ডায় আরো একটু যেন বেড়ে গেলো। পাশের ঘরে আরেকটা বাঙালী গ্রুপ এসেছিলো, তারা রুম হিটার নিয়েছিলো, আর সোয়েটার-জ্যাকেট-রামের বোতল সত্ত্বেও তারা ঠান্ডায় ঠকঠক করছিলো (ফোনে কারো সাথে কথোপকথন থেকে বুঝলাম)।

রাতে পাসাং-এর বাবার তৈরী রুটি আর মুরগীর ঝোল খেয়ে শুয়ে পড়লাম - সাথে তিনটের সময় অ্যালার্ম দিয়ে, কারণ পরের দিন ভোর সাড়ে চারটের মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে।


বুধবার, ২৪শে অক্টোবর ২০১২ - সিল্ক রুট
==========================

সাড়ে তিনটেতে অ্যালার্ম দিয়ে উঠলাম, বাইরে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, আর কনকনে ঠান্ডা - নর্থ ইস্ট ইংল্যান্ডের শীতকাল পুরো। তার মধ্যেই ওই কনকনে জল দিয়ে কোনোরকমে মুখ ধোয়ার কাজ সেরে বাকিদের ঠেলে তুললাম। ভোর চারটের সময় অবভিয়াসলি পুঁটকে দুটো উঠতে চাইছিলো না, কিন্তু সানরাইজ পয়েন্টের লোভ দেখিয়ে তুলতে হল। আর তারপর ওই ঠান্ডা জলে মুখ ধোয়ানো এক কেস...

সেসব শেষ করে সওয়া চারটে নাগাদ গেলাম পাসাং শেরপার দোকানে। গাড়ি রেডি, ড্রাইভারও রেডি। কাঁচের গেলাসে ধোঁয়া ওঠা চা-ও এসে গেলো। ঋককেও একটু চা খাওয়ানো হল - প্রথমবার। তখন ওখানে আরো একটা গাড়ি এসে গেছে - তারাও ওপরে যাচ্ছে। এবং তাদের সাথে গোপাল প্রধান। ওই গাড়ির ড্রাইভারকে ঘুম থেকে তোলা যায়নি বলে গোপাল প্রধান নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে অল্প একটু কথা হল চা খেতে খেতে - অতি অমায়িক লোক, মানে সেটা কতটা তা কথা না বল্লে বোঝা সম্ভব নয়। এতটা আস্তে আস্তে (নীচু গলায় এবং ধীরে - দুটোই) কথা বলা লোক চট করে দেখা যায় না। আমরা তৈরী হয়ে বেরোতে বেরোতে আরো একটা গাড়ি উঠে এলো - পদমচেন থেকে - ওখানেও এখন হোমস্টে তৈরী হয়েছে - যারা জুলুকে জায়গা পায় না, তারা পদমচেনে থাকে।

তিনটে গাড়ি লাইন দিয়ে সিল্ক রুট ধরে চলতে শুরু করলো, তখন ভোর সাড়ে চারটে। সাড়ে নহাজার ফুট থেকে আমরা উঠবো থাম্বি ভ্হিউপয়েন্ট পেরিয়ে লুংথুং অবধি - মোটামুটি ১২০০০ ফুট উচ্চতায়। দূরত্ব মাত্র ১২-১৪ কিমি। গাড়ির কাঁচের ওপর ফ্রস্ট জমে রয়েছে, বার বার জল দিয়ে ওয়াইপার চালালেও অল্পক্ষণ পরেই ফের ফ্রস্ট - এখানে বিলেতের মত ওয়াশার ফ্লুইড হিসেবে অ্যালোহলিক সোপ মিক্সের চল নেই। একে অন্ধকার, তায় এইখানেই সিল্ক রুটের সেই বিখ্যাত ভুলভুলাইয়া - একের পর এক চৌঁত্রিশটা সরু হেয়ারপিন বেন্ড - জুলুক থেকে ৯ কিমি দূরের থাম্বি ভিউপয়েন্ট অবধি। উঠতে উঠতে আমরা মেঘের ওপর চলে এসেছি। রাস্তার পাশে নীচে মেঘের কার্পেট। যেতে যেতেই দেখতে পাচ্ছি আকাশের রঙ বদলাচ্ছে আস্তে আস্তে। তর সইছে না, হাত নিশপিশ করছে, অথচ তাড়া করার উপায় নেই - রাস্তা খুবই খতরনাক - যদিও আশার কথা যে ওই সময় উল্টোদিক থেকে গাড়ি আসার সম্ভাবনা নেই।

অবশেষে সাড়ে পাঁচটার একটু আগে আমরা পৌঁছলাম লুংথুং। সেখানে তখন অলরেডি বেশ কিছু লোক - যারা পদমচেন আর নাথাং থেকে পৌঁছে গেছে। সূর্য তখন উঠবো উঠবো করছে, মেঘের কার্পেটের ঠিক ওপরে আকাশের রঙ হলদেটে। উল্টোদিকে নীচে মেঘ। আকাশ পরিষ্কার থাকলে ওদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর রঙের খেলা দেখা যায় - কিন্তু সেদিন শুধুই মেঘ আর কুয়াশা। জুলুক সম্পর্কে সমস্ত লেখায় পড়েছিলাম যে আকাশ পরিষ্কার থাকলে লুংথুং-এর সানরাইজ অন্য যে কোনো বিখ্যাত সানরাইজ পয়েন্টকে কঠিন কম্পিটিশনে ফেলে দেবে। দুর্ভাগ্য আমাদের, সেদিনই আকাশে নীচু মেঘ আর কুয়াশায় একটা hazy ভাব এসেছিলো। যে দৃশ্যের অপেক্ষায় ছিলাম সেটা পেলাম না, কিন্তু যা পেলাম তাও কম নয়।

ওদিকে মেয়ে তো দুমিনিট বাইরে থেকেই ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গাড়িতে চলে গেলো। ঋকও কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ছবি তোলার চেষ্টা করে আর পারলো না। জ্যাকেট ট্যাকেট পরা ছিলো বলে গায়ে সামলানো গেলেও ঠান্ডায় হাতের আঙুল বেঁকে যাওয়ার মত অবস্থা। তার মধ্যেই উল্টোদিকে একটু আধটু ঘুরে দেখলাম - সেদিকেও মিলিটারির লোক টেম্পোরারি ছাউনি ফেলে রয়েছে - তাঁবুতে রাত কাটিয়েছে ওখানে, ভোরে রওনা দেবে।

আশেপাশের পাহাড়ের গায়ে মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাহাড়গুলো লালচে দেখায়। দেখে হঠাৎ করে সেই হাইল্যান্ডস মনে পড়ে গেলো - হেদারে ঢাকা পাহাড়গুলো লালচে দেখাতো, এখানেও হেদারের মত ছোট ছোট না হলেও একটু বড় সাইজের লালচে ঝোপ সারা পাহাড়ের গা জুড়ে - সেরকমই লালচে দেখায়। সেই হাইল্যান্ডসের মতই ধূ ধূ ঢেউ খেলানো জমি আর পাহাড়...


সানরাইজ পয়েন্ট থেকে নামার পথে দুবার দাঁড়ালাম ভুলভুলাইয়ার ছবি তোলার জন্যে। একবার লুংথুং থেকে অল্পদূর নেমেই - যেখান থেকে তিনটে পাহাড়ের গায়ে রাস্তার এই অংশটুকু দেখা যায়, আরেকবার থাম্বি ভিউপয়েন্টে, যেখানে দৃশ্যটা একটু অন্যরকম।


        
জুলুকে ফিরে আসতে আসতে সওয়া সাতটা মতন বাজলো। এবার দিনের বেড়ানোর জন্যে তৈরী হয়ে (চান করার কোনো সীনই নেই, বাকিটুকুর জন্যে পাসাং শেরপার বাবা এক বালতি গরম জল দিয়ে গেলেন) ওয়াই ওয়াই নুডল্স দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে সওয়া আটটা। ফের এক গ্লাস চা খেয়ে সাড়ে আটটায় শুরু করলাম। ফের সেই লুংথুং-এর দিকেই যাওয়া, কিন্তু এবার সেখান থেকে এগিয়ে যাবো নাথাং ভ্যালীর দিকে, তারপর বাবামন্দির আর কুপুপ হয়ে ছাংগু অবধি। এর মধ্যে ম্যাক্সিমাম সাড়ে চোদ্দহাজার ফুটে উঠবো একবার, তারপরে ছাংগুতে ফের বারো হাজার মতন।

লুংথুং-এর রাস্তা সকালে তখন রোদে ঝকমক করছে। দুধারের সেই লাল ঝোপগুলো আরো উজ্জ্বল। আবারো কয়েকটা মিলিটারি ছাউনি পেরোলাম - রায়পুর রেইডার্স, কী একটা শুটার্স - এরা মনে হয় স্নাইপার রেজিমেন্ট এবং আরো কী কী নাম। নাথাং ভ্যালী পড়বে রাস্তার বাঁদিকে কিছুটা নীচে। পাহাড়ের গা বেয়ে মেঘ নেমে নাথাং ভ্যালীকে ঢেকে দিচ্ছে, রাস্তার ওপরেই এক গুচ্ছ মেঘ - যার মধ্যে রাস্তাটা পুরো হারিয়েই গেছে।


আরো একটু এগোলে পুরোই ব্যারেন ল্যান্ড, অনেকটা লেহ্‌-লাদাখের মত ধূসর। এখানেই কোথাও জেলেপ লা-র রাস্তা, যেটা এখন বন্ধ - ৬২-র যুদ্ধের পর। শুধু পড়ে আছে অনেকগুলো পরিত্যক্ত বাঙ্কার - ৬২-র চিহ্ন গায়ে মেখে। এর পরেই আসে আসল বাবা মন্দির - ক্যাপ্টেন হরভজন সিং মান-এর বাঙ্কার। অনেক গল্পকথা চালু আছে হরভজন সিং সম্পর্কে - এখনো নাকি মিলিটারি পোস্টে কেউ পাহাড়া দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়লে "বাবা" খুব রেগে গিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে তুলে বকাবকি করেন।

এখান থেকে চীন বর্ডার খুব কাছেই। উত্তরদিকের পাহাড়গুলোর মাথায় বর্ডার পোস্টগুলো দেখা যায়। একটা বাড়ি দেখিয়ে গাড়ির ড্রাইভার জানালো যে ওইটা কনফারেন্স হল যেখানে ভারত এবং চীনের বর্ডার কনফারেন্স হয়। ওইদিকে যাওয়া মানা, পুরোটাই শুধুমাত্র মিলিটারি এলাকা। চারদিকের এই পাহাড় আর পরিত্যক্ত উপত্যকার মধ্যে দাঁড়ালে কেমন একটা যেন অনুভূতি হয়। কখনো হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, কখনো নিজেকে একটা পিঁপড়ের সমান মনে হয়, কখনো ওইখানে পড়ে থাকা সৈন্যগুলোর জন্যে খারাপ লাগে।

তবে অতটা ভাবার অবস্থা তখন ছিলো না, কারণ ঋক। আগেই বলেছিলাম - কলকাতা থেকে আসার সময়তেই একটু সর্দি ছিলো। পেডং-এ ঠান্ডা লেগে কাশিও শুরু হয়েছিলো। জুলুকে আরো ঠান্ডায় বুকে সর্দি বেশ ভালোমত বসে গেছিলো। নাথাং-এ পৌঁছনোর সময়েই সে আর গাড়ি থেকে নামতে চায়নি। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। বাবা মন্দির পৌঁছে সে গাড়ির সীটে পুরো এলিয়েই পড়লো। আমরা তিনদিন আগে থেকেই সবাই একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাচ্ছিলাম - কোকা না কী যেন নামটা। তবে মনে হয় না তাতে কোনো কাজ দিয়েছিলো। আমার তেমন কিছু অসুবিধা হয়নি, একটু জোরে হাঁটলে অবশ্য বুঝতে পারতাম। সুমনার অল্প অস্বস্তি হয়েছিলো, ঋতির কিছু হয়নি, অথচ ঋক - যার গুরুদংমারের রাস্তাতে কিছু হয়নি, সে পুরোই কাৎ - যদিও তার প্রধান কারণ বুকে সর্দি বসা - যার ফলে অল্টিচিউড সিকনেসের এফেক্টটা বেশি হয়েছিলো। রংলিতে এক শিশি ব্র্যান্ডি কিনেছিলাম - অল্প গরম জলের সাথে এক ঢাকনা মিশিয়ে তাকে খাওয়ানো হল। তারপর চকোলেট। তাতে একটু শরীর গরম হল, বল্ল নিশ্বাসের অস্বস্তিটাও অল্প কমেছে, কিন্তু গাড়ি থেকে আর নামলো না কোথাওই।

একবার ভাবলাম নেমে যাই, আবার মনে হল আর হয়তো এদিকে আসা হবে না। যার জন্যে চিন্তা সেও পুরোটা ঘুরেই তবে ফিরতে ইচ্ছুক। ঠিক হল আরেকটু এগোই, যদি অবস্থা খারাপের দিকে যায় তাহলে নেমে যাবো।

এগোলাম কুপুপের দিকে। নাথাং-এর লালচে ঝোপে ঢাকা পাহাড়ের বদলে এবার ধূসর ল্যান্ডস্কেপ। থেকে থেকে দুটো একটা ছোট ছোট লেক, এখানে বলে পোখরি। তারপর পাহাড়ের গায়ে একটা বাঁক ঘুরেই ডানদিকে বিরাট বড় এলিফ্যান্ট লেক বা হাতি পোখরি। ওপর থেকে দেখতে অনেকটা হাতির মত - দূরের দিকটাতে হাতির শুঁড়, কাছের দিকটা হাতির দেহ। রাস্তা থেকে কিছুটা নেমে লেকের পাশে একটা কুঁড়েঘর - লাক পা, মানে আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড - আমাকে সেখানে যেতে দিলো না, বল্ল ভেড়া পাহারা দেওয়ার কুকুর থাকবে আর সেগুলো বেজায় খতরনাক। হাতিপোখরি ছাড়িয়েই কুপুপ গ্রাম - সেখানেও একপাশে বড় মিলিটারি ছাউনি। গ্রামের মধ্যে কয়েকটা দোকান আছে - সেখানে চা বা অন্যান্য কিছু খাবার পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় চীন থেকে আসা জিনিসপত্র - খেলনা, জ্যাকেট, কার্পেট ইত্যাদি।



রংলিতে যে পাস করানো হয়েছিলো, সেটা ছিলো কুপুপ অবধি। কিন্তু আমরা যাবো ছাংগু। কুপুপের চেকপোস্টে একজন ছিলো যে আমাদের লাক পা-র চেনা - তো লাক পা পাসে ছাপ্পা মারার সময় তার সঙ্গে কথা বলে ক্লিয়ার করে এলো। আমরা এগোলাম ছাংগুর দিকে। জুলুক থেকে কুপুপ হল ৩৪ কিমি, কুপুপ থেকে ছাংগু আরো ৩৪ কিমি মতন। এদিকে ল্যান্ডস্কেপটা আরো কিছুটা বদলায়, কুপুপ বা তার আগের তুলনায় একটু সবুজ। তবে রাস্তা তুলনামূলকভাবে অনেক খারাপ। রংলি থেকে জুলুক হয়ে কুপুপ অবধি যা রাস্তা সেটা কলকাতা পৌরসভাকে লজ্জা দেবে, আবার কুপুপ ছাড়িয়ে নাথু লা/ছাংগুর দিকের রাস্তা দেখে ইস্টার্ন বাইপাসের কনট্র্যাক্টররা গর্ব করতেই পারে। এদিকে কিছুটা এগোলে ডানদিকে একটু দূরে দেখা যায় মেমেন চু লেক।

কুপুপ ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়ে দুই নং বাবা মন্দির। এটা হল আগেরটার ক্লোন। আগেরটাই আসল বাবা মন্দির। যেহেতু কুপুপ থেকে জুলুকের দিকের রাস্তা আগে সাধারণের জন্যে বন্ধ ছিলো, তাই নাথু লা-র কাছে একটা দ্বিতীয় মন্দির বানানো হয় টুরিস্টদের জন্যে। গ্যাংটক থেকে যে টুরিস্টরা ছাংগু/নাথু লা আসেন, তাঁরা এই বাবা মন্দিরেই ঘুরে যান।

বাবা মন্দির ছাড়িয়ে আরেকটু এগোলে নাথু লা-র রাস্তা বেরিয়ে যায় ওপরদিকে। সেখানে যেতে আলাদা পাস লাগে বলে আমরা আর যাইনি। এখানে একটা ইন্দো-চীন বর্ডার মার্কেট বসে - চীন থেকে জিনিসপত্র নিয়ে গাড়ি আসে বর্ডার পেরিয়ে ওই মার্কেটে - সপ্তাহে মনে হয় দুই দিন না তিন দিন বসে বাজারটা। চীন থেকে আসা গাড়িগুলো একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানে ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ পাহারা দেয়। আরো এগোলে আরো কিছু মিলিটারি ছাউনি পেরিয়ে ছাংগু - সিকিমের অতি পরিচিত লেক, আশেপাশে ইয়াক নিয়ে লোকজন ঘুরছে, সিকিমিজ/ভুটানি/লেপচা পোশাক পরে লোকজন ছবি তুলছে - টিপিক্যালি টুরিস্ট স্পট আর অত্যন্ত বোরিং। না এলেও চলে আর কি, কিন্তু এসেই যখন পড়েছি দু একটা ছবি তোলাই যাক। শুনেচি বরফ থাকলে নাকি দেখতে ভালো লাগে, আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে স্নো-পীকগুলোর ছায়া পড়ে।


ছাংগু থেকে ফেরার সময় একটু তাড়াহুড়ো করতে হল, কারণ ততক্ষণে ঋকের ব্র্যান্ডি আর চকোলেটের এফেক্ট ঘুচে গেছে। আরো একটু চকোলেট খাইয়ে, বাবা-বাছা করে নেমে আসতে শুরু করলাম বিশেষ কোথাও না দাঁড়িয়ে। নাথাং-এর আশেপাশে পৌঁছেছি যখন, তখন মেঘ করে এলো আরো বেশি। মুড়ির দানার মত ছোট ছোট স্নো-ফ্লেক পড়তে শুরু করলো। আরো একটু এগোতে রাস্তা পুরো মেঘে ঢাকা, এবং স্নো-ফ্লেকের বদলে বৃষ্টি। সেসব পেরিয়ে জুলুকে পৌঁছলাম তখন আড়াইটে বাজে। ঋকের মুখ তখন কালচে হয়ে গেছে, ঠোঁট নীল। পাসাং শেরপারা বল্লেন ওকে কিছু খাওয়াতে, তাতে সুস্থ লাগবে। সে ছেলে খেতে গিয়ে কাশতে কাশতে বমি করে ফেললো সব, বমির সঙ্গে ঘন সর্দি। আর কিছু না পেয়ে সঙ্গে ডায়ামক্স ছিলো, তাই অর্ধেক খাইয়ে দিলাম। আর আবার এক ঢাকনা ব্র্যান্ডি। সেদিন ঘরে রুম হিটারও লাগালাম যাতে ঘরের ড্যাম্প ভাবটা কাটে। ঘন্টাখানেক ঘুমনোর পর বিকেল নাগাদ ঋক একটু সুস্থ হল - সেটা বোঝা গেলো যখন ঋতির সঙ্গে একটা ছোট ঝগড়া সেরে ফেললো।

রাতটা কাটিয়ে পরের দিন গ্যাংটকে পৌঁছে ডাক্তার দেখাবো ভাবলাম। অন্ততঃ রংলি পৌঁছে একটা কাফ-সিরাপ কিনে খাওয়াবো। যদিও তখন কাশি, আর তার জন্যে একটু নিশ্বাস নিতে অস্বস্তি ছাড়া সে মোটামুটি ভালোই। সন্ধ্যেটা কাটিয়ে রাতে ফের রুটি-মুর্গির ঝোল খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন ওই নটা নাগাদ বেরিয়ে পড়তে হবে, ঘন্টা পাঁচেক লাগবে গ্যাংটক পৌঁছতে।


বৃহস্পতিবার, ২৫শে অক্টোবর, ২০১২
=======================

আগের রাতটা একটু ভয়ে ভয়ে কেটেছে। সেদিন আর ঋককে একা বিছানায় শুতে দিইনি, নিজের পাশে শুইয়েছিলাম। রাতে বারবার উঠে খেয়াল রাখতে হয়েছে সে ঠিকঠাক আছে কিনা।

সকালে একটু বেলা করে উঠলাম - বিশেষ কিছু তো করার নেই, এখান থেকে গাড়িতে গ্যাংটক পৌঁছনো ছাড়া। সকাল মানে ওই সাতটা। পাসাং শেরপাকে বলে গরম জলের ব্যবস্থা করলুম - হাতমুখ ধোওয়া, বড় বাইরে ইত্যাদির জন্য। চান করার প্রশ্নই নেই। আটটা নাগাদ দোকানে গিয়ে সেই ওয়াই ওয়াই নুডল্‌স আর চা খেয়ে সাড়ে আটটা নাগাদ রওনা দিলাম। সেদিন আকাশ আগের দিনের চেয়ে পরিষ্কার - সেদিন ওপরে উঠলে হয়তো লুংথুং আরো ভালো লাগতো, হয়তো ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাও দেখা যেত। জুলুক থেকে অল্প নামতেই অবশ্য কাঞ্চনজঙ্ঘার লেজটুকু দেখা গেছিলো...

পদমচেনে ঢোকার আগে রাস্তার পাশে হেডহান্টার্সদের হাসপাতাল। ওরা শুধু মিলিটারির লোক নয়, সবাইকেই দেখে। লাক্‌ পা বল্ল ঋককে একবার দেখিয়ে নিতে। আর্মির ডাক্তার (মনে হয় প্যারামেডিক) দেখে কিছু ওষুধ দিলো - তখনই এক ডোজ খাইয়েও দেওয়া হল। ফের সেই পুরনো রাস্তা ধরে ঘুরে ঘুরে নামতে নামতে সেই রংলি। এখান থেকে একটা রাস্তা ঘুরে চলে গেছে রংপোর দিকে - যেটা বাংলা-সিকিম বর্ডার - শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক যাওয়ার পথে পড়ে। এই রাস্তাটা ভয়ানক বাজে - পুরো ভাঙা। যেহেতু মিলিটারির যাতায়াত খুব একটা নেই, তাই মেরামতিও নেই। ঝকর ঝকর করে ঘন্টাখানেক পর রংপো পৌঁছে ভালো রাস্তা পাওয়া গেল - সোজা গ্যাংটক অবধি। এই রাস্তাটা একেবারেই আন-ইন্টারেস্টিং, আর সবার চেনা। কজেই নতুন করে কিছু বলার নেই।

গ্যাংটক সম্পর্কেও নতুন করে কিছু বলার নেই। সেই আগেরবার যে সোনম ডেলেক-এ ছিলাম, সেখানেই উঠলাম। আগেরবার ছিলো ২০৪ নম্বর ঘর, এবার ৩০৪। জানলার বাইরে ব্যালকনি, সেদিকে আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। আর সেটা দেখলামও - এই প্রথম এত ভালোভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা। পরের তিনদিন রোজ ভোর পাঁচটায় উঠে ক্যামেরা আর ট্রাইপড নিয়ে ব্যালকনিতে বসে থেকেছি পুরো সিকোয়েন্সটা তুলে রাখবো বলে। সূর্য ওঠার আগে আবছা অন্ধকারে সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘা, সূর্য উঠতে শুরু করার সময় প্রথমে একেবারে ডানদিকের চূড়ার ওপর লালচে আলো, তারপর সেই আলোটুকুর আস্তে আস্তে অন্য চূড়াগুলোর ওপর ছড়িয়ে যাওয়া এক এক করে, তারপর গোটা পাহাড়টারই কমলা রঙে চান করে যাওয়া, আর আস্তে আস্তে সেই রঙ ফিকে হতে হতে হলদে, শেষে সাদা হয়ে যাওয়া - এই পুরো সিকোয়েন্সটা দেখেছি পরের তিন দিন - রোজ।

গ্যাংটকে বিশেষ ভিড় পাইনি। কারণটা মনে হয়ে আমরা দুটো ব্যাচের মাঝে পৌঁছেছিলাম বলে। দুর্গাপুজোয় বেড়াতে আসা দলগুলো তখন নেমে গেছে, আর লক্ষ্মীপুজোর সময়কার দলগুলো তখনো আসেনি - তাদের দেখলাম আমরা নেমে আসার সময়। মাঝের সময়টা গ্যাংটক বেশ ফাঁকা (অন্যবারের তুলনায়)। রুমটেকটা আগে দেখা ছিলো না - এবারে গ্যাংটক আসার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ওইটা দেখা, আর টুকটাক এদিক ওদিক ঘুরে মেইনলি ল্যাদ খাওয়া। তো তাই হল - রুমটেক দেখলাম, আরো দু একটা স্পট এদিক ওদিক - তবে বেলার দিকে আকাশ hazy হয়ে যাওয়ায় বিশেষ কিছু দর্শনীয় পাইনি, একটা ফ্লাওয়ার শো (ওর চেয়ে ঢের সুন্দর শো হয় কলকাতার হর্টিকালচারল সোসাইটির), হ্যান্ডিক্রাফটের বাজার - সেও অতি ঢপের। তবে হ্যাঁ - এঞ্চে মনাস্টেরিটা মন্দ নয়। বেসিক্যালি ল্যাদ খাওয়ার ছিলো - তো দিনের বেলায় এদিক ওদিক চক্কর কেটে বাকি সময়টা প্রচুর ল্যাদ খেয়েছি।

তারপর একদিন সকালে গ্যাংটক থেকে বেরিয়ে ফের সেই এনজেপি। গোটা শিলিগুড়ি বাইপাসটা দেখলাম ভেঙে চৌচির - একটু বেশি রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন হয়ে গেছে আর কি - দু বছর আগেও রাস্তাটা অনেক ভালো অবস্থায় ছিলো। এনজেপি স্টেশনটাও অত্যন্ত পচা, আর বড্ড বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিলো (একটু বেশি সাবধানী হয়ে রাস্তায় আটকে যাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি বেরোলে যা হয় আর কি)। ট্রেনটা ভালোই, তবে শেয়ালদা পৌঁছে এক ঘন্টা ট্যাক্সির জন্যে দাঁড়ানো...এই ফেরাটাই সবচেয়ে কষ্টকর। আর কষ্টকর হল সকাল সাড়ে আটটায় বাড়ি পৌঁছে আপিস যাবো না ভাবার পর ন'টার সময় আপিস থেকে ফোং পেয়ে সেজেগুজে আপিস দৌড়নো...

এই হল বেত্তান্ত। ছবি দেখুন।