শেষ হয়ে আসছে বেড়ানোর দিন। পানঝরা থেকে আমরা যাবো মেন্ডাবাড়ি - সেখান থেকে
আবার ফেরা শুরু। বহুদিন পরের বেড়ানোটা এখনো অবধি দিব্যি হয়েছে। আমাদের
প্রথমবার ডুয়ার্স আসা - এখনো অবধি সেভাবে বোর হতে হয়নি কোথাও।
আলিপুরদুয়ার থেকে মোটামুটি কুড়ি কিলোমিটার দূরে, জলদাপাড়ার পাশেই চিলাপাতা ফরেস্ট, হাসিমারা থেকে খুবই কাছে। এর মধ্যেই কোদাল বস্তির পাশে হল মেন্ডাবাড়ি জাঙ্গল ক্যাম্প - ডুয়ার্সের মধ্যে আরো একটা ইকো টুরিস্ট রিসর্ট। সময়মত গেলে আর কপালে থাকলে ক্যাম্পে বসেই আশেপাশে বুনো জন্তুজানোয়ার দেখতে পাওয়া যায় - কারণ চিলাপাতা রেঞ্জটা জলদাপাড়া আর বক্সা টাইগার রিজার্ভের মধ্যে একটা ন্যাচারাল করিডরের কাজ করে। এখানে যেতে হলে আপনাকে চাপড়ামারি ছাড়িয়ে নাগরাকাটা, বানরহাট, বীরপাড়া পেরিয়ে যেতে হবে হাসিমারা। হাসিমারা গুরদোয়ারা পেরিয়ে আরেকটু এগোলেই চিলাপাতার শুরু। যাওয়ার পথটা জলদাপাড়ার পাশ দিয়ে চলে গেছে সোজা গৌহাটির দিকে, দুধারে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য চা-বাগান। মাঝে কথা হয়েছিলো এই রাস্তাটাকে ৪-লেন হাইওয়ে বানানোর - তাতে চা-বাগান তো নষ্ট হতই, আরো অনেক গাছ কাটা পড়তো - এমনকি জলদাপাড়ার গায়েও হাত পড়তো। কাজও শুরু হয়ে গেছিলো - নানা জায়গায় সেই কাজের চিহ্ন দেখতে পাবেন। কিন্তু পরিবেশের চাপে ভাগ্যক্রমে এই প্ল্যান বাতিল করে অন্য একটা রাস্তাকে চওড়া করার কাজ শুরু হয়েছে। বেঁচে গেছে অনেকটা জঙ্গল। জানা নেই যদিও কতদিনের জন্যে - সভ্যতা ক্রমশ ডুয়ার্সের দিকে হাত বাড়ানো শুরু করেছে বেশ কিছুদিন হল...
চাপড়ামারি থেকে হাসিমারা লাগলো ঘন্টাখানেক। দূরত্ব বেশি নয়, কিন্তু ৪০ কিলোমিটারের স্পীড লিমিট বাঁধা রয়েছে গোটা পথেই। হাসিমারা এয়ারবেস এর কাছেই রাস্তার ধারে দেবাশিসরা দাঁড়িয়েছিলো। ওরাও যাবে আমাদের সাথে মেন্ডাবাড়ি। বাকি পথটা দেবাশিসই চিনিয়ে নিয়ে গেলো আমাদের আগে আগে গিয়ে।
পিচমোড়া রাস্তা থেকে হঠাৎই একটা কাঁচা রাস্তা ঢুকে পড়েছে বাঁদিকে জঙ্গলের মধ্যে - সেই রাস্তা ধরতেই চোখের সামনে দৃশ্য পুরো বদলে যায়। চিলাপাতায় ঢুকলে চাপড়ামারিকে মনে হবে ঝোপঝাড়ের চেয়ে অল্প বড় কিছু। একইভাবে গাড়ি চলে চলে দুটো সমান্তরাল দাগ হয়ে রয়েছে - সেটাই রাস্তা। দুধারে ঘন জঙ্গল, গাড়ির গায়ে ছোঁয়া দিয়ে যায়। চাকার দাগদুটোর মধ্যেকার ঝোপঝাড় আরো অনেক ঘন। রাস্তার পাশেই খানায়েক ময়ূর খেলে বেড়াচ্ছে - গাড়িদুটোর দিকে একবার তাকিয়ে ফের খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। চলতে চলতে এসে পড়লাম কোদাল বস্তির সামনে। একটা ছোটো খাল পেরোতে হয় এখানে - আগে জলের মধ্যে দিয়েই পার হতে হত, কিছুদিন হল একটা কাঠের সাঁকো বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। জঙ্গলের মধ্যে একটা খোলা জায়গায় দুটো বাড়ি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর একটা কাঠের গোল বাড়ি - সেটা খাওয়ার জায়গা। দুটো দোলনা রয়েছে খেলার জন্যে। আর ওই চত্ত্বরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে আরো কয়েকটা ময়ূর। চারপাশে তারের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা, পাশেই ছোটো গ্রামটা, আর বড় বড় গাছে ঘেরা চারদিক...অসংখ্য পাখি, বিশেষ করে টিয়ার মেলা...বাইরে গ্রামের দিকটায় একটা কুনকী হাতি দাঁড়িয়ে কান নাড়িয়ে চলেছে, বড় নয়, বাচ্চা একটা। গ্রামে দুর্গাপুজো হচ্ছে - তার ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। হাতিটা যেন সেইটা শুনেই মাঝে মাঝে দুলে উঠছে, যেন নাচছে।
(https://media-cdn.tripadvisor.com/media/photo-s/09/1e/4e/4b/chilapata-
jungle-camp.jpg - বাড়িটার ছবি তুলতে ভুলে গেছি, তাই ট্রিপ অ্যাডভাইসর থেকে একটা ছবি দিলাম)
বাড়িটার দোতলায় (নাকি একতলাই বলা উচিৎ) দুটো বড় ঘর আছে - ডর্মিটরি টাইপের। এক একটা ঘরে পাঁচ ছয়্জন থাকতে পারে। ঘরগুলো বিশেষ মেন্টেইন হয় না - কারণ মেন্ডাবাড়ির গ্ল্যামার কোশেন্ট কমই বলা চলে। ঠিক luxurious জায়গা তো নয়। বাথরুমের অবস্থাও খুব ভালো নয় - একটু ভাঙা ভাঙা। কিন্তু চলে যায়। ইন ফ্যাক্ট, এরকম জঙ্গলের মধ্যে ঝাঁ চকচকে ঘরদোর বেমানানই লাগতো হয়তো।
[আর একটা বাড়ি আছে এখানে - সেটা আরেকটু উন্নত বলা যায়, কারণ এসি মেশিন বসানো রয়েছে - বছর দুয়েক আগে রাণিমা পদধূলি দিয়েছিলেন বলে বসানো হয়েছিলো। ভোল্টেজ এতই কম যে সে মেশিন বিশেষ চলেই না।]
(https://northbengaltourism.com/images/govt-resorts/mendabari_jungle_ca
mp_1_1024.jpg - এই ছবিটা নর্থ বেঙ্গল টুরিজমের সাইট থেকে দিলাম)
দুপুরের খাওয়া অ্যাজ ইউজুয়াল - ভাত, আলুভাজা, ডাল, তরকারি আর ডিমের ঝোল। সেদিন আমরা আটজন, পরিমাণও সেই অনুপাতে। রাঁধুনী আর কেয়ারটেকার দেবাশিসের পরিচিত - সেই কারণে, নাকি দেবাশিসের বক্তব্য অনুযায়ী গাঁজার ধুমকিতে - কে জানে - আট জনের জন্যে দুই ডজন ডিম! ডিমখোড়ের মধ্যে পড়ি আমি, সুমনা আর দেবাশিস...তাতেও একটা/দুটো এক্সট্রা হলে কথা ছিল - আটটা ডিম বেশি - ভাত খাওয়ার পর কোনোমতেই শেষ করা সম্ভব নয়।
খাওয়াদাওয়া শেষে বেলা পড়ে আসার আগে দুটো গাড়িতে রওনা দিলাম জয়ন্তী নদীর দিকে। হাইওয়ে ধরে কিছুদূর গিয়ে বক্সা টাইগার রিজার্ভের সীমানা। তার মধ্যে দিয়েই চলে গেছে হাইওয়েটা সোজা ভুটান সীমান্তের দিকে। শুধু গেট পার হওয়ার আগে টিকিট কাটতে হয় - টোলও বলা যায়। কালো চকচকে পিচঢালা রাস্তা, দুপাশে বেশ ঘন জঙ্গল। কিন্তু যদি জন্তুজানোয়ার দেখার ইচ্ছে থাকে, এই পথে সেই ইচ্ছে পুরো সফল হবে না, কারণ শ'য়ে শ'য়ে মোটরগাড়ি আর মোটরসাইকেল যাচ্ছে এই রাস্তায়। এমনকি বাসও। পাখির ডাক শুনতে পাবেন - যদি না জঙ্গল কাঁপিয়ে কোনো বাইক চলে যায়। কিছু পাখি দেখতেও হয়তো পাবেন। দু একটা ছোটখাটো জন্তুও হয়তো - যেমন হরিণ (আমরা পেলাম একটা বার্কিং ডিয়ার)। তার বেশি কিছু চাইলে এখানকার সাফারি ছাড়া উপায় নেই।
এই পথটা জঙ্গলের মধ্যে দুভাগ হয়ে একটা ভাগ চলে যায় জয়ন্তী নদীর দিকে। সেখানে বিকেলের দিকে যেন মেলা বসে যায়। নদী পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে একটা ওয়াচটাওয়ার আছে - কিন্তু সেখানে যেতে চাইলে জিপসি জাতীয় গাড়ি নেওয়াই ভালো। আমরা হয়তো পেরিয়ে যেতে পারতাম বিআরভি নিয়ে, কিন্তু দেবাশিসদের ছোট গাড়ি, এগজস্টে জল ঢুকে গেলে চিত্তির। তাই নদী না পেরিয়ে নদীর ধারেই কিছুটা সময় কাটানো হল।
নদীর খাতটা বেশ চওড়া - হয়তো বর্ষার সময় পুরো ভরে যায়। পুজোর সময় জল শুধু মাঝে অল্প কিছুটা, বড়জোর তিরিশ ফুট। নুড়িপাথরে মোড়া খাত, জুতো খুলে নদীর জলে নামলে টের পাবেন যে সেটা পাহাড় থেকে নেমেছে। উল্টোদিকে আবছা নীলচে ভুটান পাহাড় দেখা যায়। ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে সময় কাটানোর পক্ষে বেশ ভালো জায়গা, শুধু একমাত্র আপদ গাদা গাদা মোটরসাইকেল, আর তাদের স্টান্টবাজি। নুড়িপাথরের মধ্যে চাকার গ্রিপ ভালো ধরে না, তাই হাতের কাছে অফরোডিং এর সাইট হল এইটা...বাইক নিয়ে গোঁ গোঁ করে জলে নামছে, নদীর মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার গোঁ গোঁ করছে, তারপর আবার উল্টোদিকে ফিরে যাচ্ছে - এইটাই ওদের স্টান্ট। এর মধ্যে আমরা কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়িয়ে, নদীর পাথর কুড়িয়ে ব্যাংবাজি করে ঘন্টাখানেক সময় কাটিয়ে ফেললাম। তারপর সন্ধ্যে নামতে আবার বক্সার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মেন্ডাবাড়ি অবধি। মাঝে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে উত্তরবঙ্গের রসগোল্লা...
মেন্ডাবাড়িতে সেদিন আমাদের প্রথম আর শেষ রাত্রি। ডুয়ার্সেও শেষ রাত্রি। শুধু বাকি রয়েছে পরের দিন ভোরবেলার সাফারি। চাপড়ামারির মত চিলাপাতায় কিন্তু অত বেশি সংখ্যক গাড়ি আসে না। ভোর পাঁচটায় আর বিকেল তিনটের সময় মেন্ডাবাড়ি থেকে দুটো, চিলাপাতা বাংলো থেকে চারটে - এই ছ'টা গাড়িই একসময় জঙ্গলে ঢুকতে পারে। সেরকমই একটা জিপসি আমরা বুক করে রাখলাম পরের দিন সকালের জন্যে।
রাতে খাওয়ার (ঠিক ধরেছেন, রুটি আর চিকেন) পর বারান্দায় গল্প করছি। হঠাৎ নিস্তব্ধ জঙ্গল খানখান হয়ে গেল টিন পেটানোর আওয়াজে। সাথে তুমুল জোরে ঢাকের আওয়াজ, আর লোকজনের চেঁচামেচি। পাশের কোদাল বস্তি পুরো জেগে গেছে। কারণ বাংলোর ঠিক পাশের জঙ্গলে হাতি এসেছে। যদিও টর্চ ফেলেও আমরা কিছু দেখতে পাইনি। বাংলোয় সার্চলাইট থাকলে হয়তো দেখা যেত, হয়তো যেত না। শুনলাম হাতি চাইলে প্রায় নিঃশব্দেই যাওয়াআসা করতে পারে - কেউ টেরটিও পাবে না। আধ ঘন্টা টিন পেটানো, ঢাক, চিৎকারের পর সব শান্ত হল। আমরা ঘুমোতে চলে গেলাম। ভোর পাঁচটায় গাড়ি এসে যাবে।
(চলবে)
(আগের কথা)
আলিপুরদুয়ার থেকে মোটামুটি কুড়ি কিলোমিটার দূরে, জলদাপাড়ার পাশেই চিলাপাতা ফরেস্ট, হাসিমারা থেকে খুবই কাছে। এর মধ্যেই কোদাল বস্তির পাশে হল মেন্ডাবাড়ি জাঙ্গল ক্যাম্প - ডুয়ার্সের মধ্যে আরো একটা ইকো টুরিস্ট রিসর্ট। সময়মত গেলে আর কপালে থাকলে ক্যাম্পে বসেই আশেপাশে বুনো জন্তুজানোয়ার দেখতে পাওয়া যায় - কারণ চিলাপাতা রেঞ্জটা জলদাপাড়া আর বক্সা টাইগার রিজার্ভের মধ্যে একটা ন্যাচারাল করিডরের কাজ করে। এখানে যেতে হলে আপনাকে চাপড়ামারি ছাড়িয়ে নাগরাকাটা, বানরহাট, বীরপাড়া পেরিয়ে যেতে হবে হাসিমারা। হাসিমারা গুরদোয়ারা পেরিয়ে আরেকটু এগোলেই চিলাপাতার শুরু। যাওয়ার পথটা জলদাপাড়ার পাশ দিয়ে চলে গেছে সোজা গৌহাটির দিকে, দুধারে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য চা-বাগান। মাঝে কথা হয়েছিলো এই রাস্তাটাকে ৪-লেন হাইওয়ে বানানোর - তাতে চা-বাগান তো নষ্ট হতই, আরো অনেক গাছ কাটা পড়তো - এমনকি জলদাপাড়ার গায়েও হাত পড়তো। কাজও শুরু হয়ে গেছিলো - নানা জায়গায় সেই কাজের চিহ্ন দেখতে পাবেন। কিন্তু পরিবেশের চাপে ভাগ্যক্রমে এই প্ল্যান বাতিল করে অন্য একটা রাস্তাকে চওড়া করার কাজ শুরু হয়েছে। বেঁচে গেছে অনেকটা জঙ্গল। জানা নেই যদিও কতদিনের জন্যে - সভ্যতা ক্রমশ ডুয়ার্সের দিকে হাত বাড়ানো শুরু করেছে বেশ কিছুদিন হল...
চাপড়ামারি থেকে হাসিমারা লাগলো ঘন্টাখানেক। দূরত্ব বেশি নয়, কিন্তু ৪০ কিলোমিটারের স্পীড লিমিট বাঁধা রয়েছে গোটা পথেই। হাসিমারা এয়ারবেস এর কাছেই রাস্তার ধারে দেবাশিসরা দাঁড়িয়েছিলো। ওরাও যাবে আমাদের সাথে মেন্ডাবাড়ি। বাকি পথটা দেবাশিসই চিনিয়ে নিয়ে গেলো আমাদের আগে আগে গিয়ে।
পিচমোড়া রাস্তা থেকে হঠাৎই একটা কাঁচা রাস্তা ঢুকে পড়েছে বাঁদিকে জঙ্গলের মধ্যে - সেই রাস্তা ধরতেই চোখের সামনে দৃশ্য পুরো বদলে যায়। চিলাপাতায় ঢুকলে চাপড়ামারিকে মনে হবে ঝোপঝাড়ের চেয়ে অল্প বড় কিছু। একইভাবে গাড়ি চলে চলে দুটো সমান্তরাল দাগ হয়ে রয়েছে - সেটাই রাস্তা। দুধারে ঘন জঙ্গল, গাড়ির গায়ে ছোঁয়া দিয়ে যায়। চাকার দাগদুটোর মধ্যেকার ঝোপঝাড় আরো অনেক ঘন। রাস্তার পাশেই খানায়েক ময়ূর খেলে বেড়াচ্ছে - গাড়িদুটোর দিকে একবার তাকিয়ে ফের খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। চলতে চলতে এসে পড়লাম কোদাল বস্তির সামনে। একটা ছোটো খাল পেরোতে হয় এখানে - আগে জলের মধ্যে দিয়েই পার হতে হত, কিছুদিন হল একটা কাঠের সাঁকো বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। জঙ্গলের মধ্যে একটা খোলা জায়গায় দুটো বাড়ি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর একটা কাঠের গোল বাড়ি - সেটা খাওয়ার জায়গা। দুটো দোলনা রয়েছে খেলার জন্যে। আর ওই চত্ত্বরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে আরো কয়েকটা ময়ূর। চারপাশে তারের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা, পাশেই ছোটো গ্রামটা, আর বড় বড় গাছে ঘেরা চারদিক...অসংখ্য পাখি, বিশেষ করে টিয়ার মেলা...বাইরে গ্রামের দিকটায় একটা কুনকী হাতি দাঁড়িয়ে কান নাড়িয়ে চলেছে, বড় নয়, বাচ্চা একটা। গ্রামে দুর্গাপুজো হচ্ছে - তার ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। হাতিটা যেন সেইটা শুনেই মাঝে মাঝে দুলে উঠছে, যেন নাচছে।
(https://media-cdn.tripadvisor.com/media/photo-s/09/1e/4e/4b/chilapata-
jungle-camp.jpg - বাড়িটার ছবি তুলতে ভুলে গেছি, তাই ট্রিপ অ্যাডভাইসর থেকে একটা ছবি দিলাম)
বাড়িটার দোতলায় (নাকি একতলাই বলা উচিৎ) দুটো বড় ঘর আছে - ডর্মিটরি টাইপের। এক একটা ঘরে পাঁচ ছয়্জন থাকতে পারে। ঘরগুলো বিশেষ মেন্টেইন হয় না - কারণ মেন্ডাবাড়ির গ্ল্যামার কোশেন্ট কমই বলা চলে। ঠিক luxurious জায়গা তো নয়। বাথরুমের অবস্থাও খুব ভালো নয় - একটু ভাঙা ভাঙা। কিন্তু চলে যায়। ইন ফ্যাক্ট, এরকম জঙ্গলের মধ্যে ঝাঁ চকচকে ঘরদোর বেমানানই লাগতো হয়তো।
[আর একটা বাড়ি আছে এখানে - সেটা আরেকটু উন্নত বলা যায়, কারণ এসি মেশিন বসানো রয়েছে - বছর দুয়েক আগে রাণিমা পদধূলি দিয়েছিলেন বলে বসানো হয়েছিলো। ভোল্টেজ এতই কম যে সে মেশিন বিশেষ চলেই না।]
(https://northbengaltourism.com/images/govt-resorts/mendabari_jungle_ca
mp_1_1024.jpg - এই ছবিটা নর্থ বেঙ্গল টুরিজমের সাইট থেকে দিলাম)
দুপুরের খাওয়া অ্যাজ ইউজুয়াল - ভাত, আলুভাজা, ডাল, তরকারি আর ডিমের ঝোল। সেদিন আমরা আটজন, পরিমাণও সেই অনুপাতে। রাঁধুনী আর কেয়ারটেকার দেবাশিসের পরিচিত - সেই কারণে, নাকি দেবাশিসের বক্তব্য অনুযায়ী গাঁজার ধুমকিতে - কে জানে - আট জনের জন্যে দুই ডজন ডিম! ডিমখোড়ের মধ্যে পড়ি আমি, সুমনা আর দেবাশিস...তাতেও একটা/দুটো এক্সট্রা হলে কথা ছিল - আটটা ডিম বেশি - ভাত খাওয়ার পর কোনোমতেই শেষ করা সম্ভব নয়।
খাওয়াদাওয়া শেষে বেলা পড়ে আসার আগে দুটো গাড়িতে রওনা দিলাম জয়ন্তী নদীর দিকে। হাইওয়ে ধরে কিছুদূর গিয়ে বক্সা টাইগার রিজার্ভের সীমানা। তার মধ্যে দিয়েই চলে গেছে হাইওয়েটা সোজা ভুটান সীমান্তের দিকে। শুধু গেট পার হওয়ার আগে টিকিট কাটতে হয় - টোলও বলা যায়। কালো চকচকে পিচঢালা রাস্তা, দুপাশে বেশ ঘন জঙ্গল। কিন্তু যদি জন্তুজানোয়ার দেখার ইচ্ছে থাকে, এই পথে সেই ইচ্ছে পুরো সফল হবে না, কারণ শ'য়ে শ'য়ে মোটরগাড়ি আর মোটরসাইকেল যাচ্ছে এই রাস্তায়। এমনকি বাসও। পাখির ডাক শুনতে পাবেন - যদি না জঙ্গল কাঁপিয়ে কোনো বাইক চলে যায়। কিছু পাখি দেখতেও হয়তো পাবেন। দু একটা ছোটখাটো জন্তুও হয়তো - যেমন হরিণ (আমরা পেলাম একটা বার্কিং ডিয়ার)। তার বেশি কিছু চাইলে এখানকার সাফারি ছাড়া উপায় নেই।
এই পথটা জঙ্গলের মধ্যে দুভাগ হয়ে একটা ভাগ চলে যায় জয়ন্তী নদীর দিকে। সেখানে বিকেলের দিকে যেন মেলা বসে যায়। নদী পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে একটা ওয়াচটাওয়ার আছে - কিন্তু সেখানে যেতে চাইলে জিপসি জাতীয় গাড়ি নেওয়াই ভালো। আমরা হয়তো পেরিয়ে যেতে পারতাম বিআরভি নিয়ে, কিন্তু দেবাশিসদের ছোট গাড়ি, এগজস্টে জল ঢুকে গেলে চিত্তির। তাই নদী না পেরিয়ে নদীর ধারেই কিছুটা সময় কাটানো হল।
নদীর খাতটা বেশ চওড়া - হয়তো বর্ষার সময় পুরো ভরে যায়। পুজোর সময় জল শুধু মাঝে অল্প কিছুটা, বড়জোর তিরিশ ফুট। নুড়িপাথরে মোড়া খাত, জুতো খুলে নদীর জলে নামলে টের পাবেন যে সেটা পাহাড় থেকে নেমেছে। উল্টোদিকে আবছা নীলচে ভুটান পাহাড় দেখা যায়। ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে সময় কাটানোর পক্ষে বেশ ভালো জায়গা, শুধু একমাত্র আপদ গাদা গাদা মোটরসাইকেল, আর তাদের স্টান্টবাজি। নুড়িপাথরের মধ্যে চাকার গ্রিপ ভালো ধরে না, তাই হাতের কাছে অফরোডিং এর সাইট হল এইটা...বাইক নিয়ে গোঁ গোঁ করে জলে নামছে, নদীর মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার গোঁ গোঁ করছে, তারপর আবার উল্টোদিকে ফিরে যাচ্ছে - এইটাই ওদের স্টান্ট। এর মধ্যে আমরা কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়িয়ে, নদীর পাথর কুড়িয়ে ব্যাংবাজি করে ঘন্টাখানেক সময় কাটিয়ে ফেললাম। তারপর সন্ধ্যে নামতে আবার বক্সার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মেন্ডাবাড়ি অবধি। মাঝে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে উত্তরবঙ্গের রসগোল্লা...
মেন্ডাবাড়িতে সেদিন আমাদের প্রথম আর শেষ রাত্রি। ডুয়ার্সেও শেষ রাত্রি। শুধু বাকি রয়েছে পরের দিন ভোরবেলার সাফারি। চাপড়ামারির মত চিলাপাতায় কিন্তু অত বেশি সংখ্যক গাড়ি আসে না। ভোর পাঁচটায় আর বিকেল তিনটের সময় মেন্ডাবাড়ি থেকে দুটো, চিলাপাতা বাংলো থেকে চারটে - এই ছ'টা গাড়িই একসময় জঙ্গলে ঢুকতে পারে। সেরকমই একটা জিপসি আমরা বুক করে রাখলাম পরের দিন সকালের জন্যে।
রাতে খাওয়ার (ঠিক ধরেছেন, রুটি আর চিকেন) পর বারান্দায় গল্প করছি। হঠাৎ নিস্তব্ধ জঙ্গল খানখান হয়ে গেল টিন পেটানোর আওয়াজে। সাথে তুমুল জোরে ঢাকের আওয়াজ, আর লোকজনের চেঁচামেচি। পাশের কোদাল বস্তি পুরো জেগে গেছে। কারণ বাংলোর ঠিক পাশের জঙ্গলে হাতি এসেছে। যদিও টর্চ ফেলেও আমরা কিছু দেখতে পাইনি। বাংলোয় সার্চলাইট থাকলে হয়তো দেখা যেত, হয়তো যেত না। শুনলাম হাতি চাইলে প্রায় নিঃশব্দেই যাওয়াআসা করতে পারে - কেউ টেরটিও পাবে না। আধ ঘন্টা টিন পেটানো, ঢাক, চিৎকারের পর সব শান্ত হল। আমরা ঘুমোতে চলে গেলাম। ভোর পাঁচটায় গাড়ি এসে যাবে।
(চলবে)
(আগের কথা)
No comments:
Post a Comment