ইয়র্কশায়ার ডেলের গপ্পো
দিব্যি বেড়ালুম৷
শনিবার সকালবেলা (সকাল মানে প্রায় দশটা) রওনা দিলুম - ইয়র্কশায়ার ডেলের মধ্যে দিয়ে প্রথমে Kirkby Lonsdale - একটা ছোট্ট ব্রীজ আছে, নাম "ডেভিলস ব্রীজ", কেন ডেভিলস ব্রীজ আর কে-ই বা ডেভিল, সে কথা গাইডবুকে লেখা নেইকো - সেটা দেখে সোজা ইঙ্গলটনের দিকে৷ বিচ্ছিরি বৃষ্টি পড়ছিলো, তার মধ্যে দিয়ে পাহাড় ঘুরে ঘুরে ইঙ্গলটন থেকে আরেকটু এগিয়ে "হোয়াইট স্কার কেভস" - ইংল্যাণ্ডের সবচেয়ে বড় "শো-কেভ" - প্রায় মাইলখানেক ভিতর অবধি নিয়ে যায়, আর অর্ধেকটাই কুঁজো হয়ে, মাথায় হেলমেট ছিলো বলে মাথাটা বেঁচে গেছে৷ ঋকের বেশ মজা - ওকে কুঁজো হতে হয়না, তাই দুপদুপিয়ে গেছে, একবার যদিও ওকেও একটু নীচু হতে হয়েছিলো৷ কয়েকশো মিলিয়ন বছরের পুরনো কেভ, ভিতরে ভর্তি স্ট্যালাগমাইট আর স্ট্যালাকটাইট৷ সবচেয়ে সুন্দর একদম শেষের দিকে সরু সরু লম্বা অসংখ্য স্ট্যালাকটাইট - আলো নিভিয়ে দিলে অন্ধকারের মধ্যে নীলচে রেশমের পর্দার মতন দেখায়৷
ওখান থেকে বেরোতে বেরোতে বাকি সব বন্ধ হয়ে যাবার সময় হয়ে গেছে, তাই "কটেজ"-এর দিকে গেলুম৷ আগে তো কখনো কটেজে থাকিনি - এবার কোন হোটেল বা বেড-অ্যাণ্ড-ব্রেকফাস্ট পাইনি (সব ভর্তি) - এই একটাই কটেজ পাওয়া গেসলো - দু রাতের জন্যে ষাট পাউন্ড - বেড অ্যাণ্ড ব্রেকফাস্টের অর্ধেক৷ আমরা ভেবেছিলুম বড়জোর খান দুই নাইলনের খাট থাকবে, রান্না তো বলেই দিয়েছিলো নিজের করতে হবে - তো আমরা একদম ক্যাম্পিংএর স্টোভ, অ্যালুমিনিয়মের বাসন, খাবার-দাবারের মধ্যে সসেজ, ডিম, পাঁউরুটি সব নিয়ে গেছি - গিয়ে দেখি হোটেলের বাড়া - একটা বড় ফার্ম-হাউজের একাংশ, সেল্ফ-সাফিসিয়েন্ট দোতলা, বড় বড় ঘর, সাজানো বিছানা, গ্যাস, মাইক্রো-ওয়েভ, টোস্টার, ডেনবীর স্টোনওয়্যারের সেট, টিভি, ভিসিআর, ক্যাসেট ...ঋ
ক দৌড়লো পাশের পুকুরে মাছ দেখতে, হলুদ-কমলা মাছ ...
পরের দিন আবার ইঙ্গলটন - ওখানে একটা পাঁচ মাইলের সার্কুলার রুট আছে, হাঁটার জন্যে - "ইঙ্গলটন ওয়াটারফলস ওয়াক" - একটা জিওলজিক্যাল ফল্টের মধ্যে দিয়ে দুটো নদীর ধার ধরে পর পর জলপ্রপাতের পাশ দিয়ে দিয়ে - জলপ্রপাতগুলো বেশ সুন্দর, মোটামুটি জঙ্গল - সেও সুন্দর - মাঝে মাঝে "ব্লুবেল"-এর কার্পেট ... রাস্তা বেশ কঠিন - অন্তত হাঁটার অভ্যেস না থাকলে, আর আগেরদিন বৃষ্টি পড়ে কাদা-ভর্তি - ঋকের খুব মজা, ওয়াকিং শু পড়ে কাদার মধ্যে ছপাত্ ছপাত্ - এমনি তো করতে পারে না ... তবে ছেলেটা বিনা প্রতিবাদে পাঁচ মাইল হেঁটে দিলো, কোন কমপ্লেন নেই - শুধু সেই আগের বারের মতন মুখ বন্ধ হয়নি এক সেকেন্ডের তরে৷ একবার শুধু কান্না জুড়েছিলো - সে "থর্নটন ফোর্স" বলে একটা প্রপাত আছে, আমি সেখানে ওদের ধারে রেখে একটু ভিতরদিকে চলে গেছি ধারের একটা ছোট্ট প্রপাতের ছবি তুলবো বলে - মোটামুটি জলের মধ্যে, দুটো পাথরের ওপর ব্যালান্স করে দাঁড়িয়ে - ছবি তুলছি, আর ঋক তো ভেড়ার ছানার মতন "বাবাআআআআআ ... " করে কান্না জুড়েছে - আমি ঘুরে ওকে থামাতে গিয়ে ধপ্পাস!!! পুরো জলের মধ্যে - জুতোর ওপর দিয়ে জল ঢুকে ভিতরের দুটো মোজাই ভিজে চুপ্পুস, প্যান্ট ভিজে, ক্যামেরাটা বেঁচে গেছে, আর পাথরে ধাক্কা খেয়ে হাঁটুতে চোট:-) তো ঐ ভিজে মোজা-প্যান্ট পরেই বাকি রাস্তাটুকু হাঁটলুম৷
আড়াইটে নাগাদ ওখান থেকে গেলুম "সেটল" - ইচ্ছে "সেটল-কার্লাইল" লাইনের ট্রেনে চড়বো - অন্যতম বিখ্যাত "সীনিক রুট"৷ হতভাগারা প্রমোট করছে এই বলে, অথচ, রোববার বলে আড়াইটেতে একটা ট্রেন, তাপ্পর সাড়ে ছটা - সেটাতে গেলে ফেরার কোন ট্রেন নেই৷ অগত্যা, উল্টোদিকের ট্রেনে চড়লুম - ঋককে শান্ত করতে - ট্রেনের মূলো দেখিয়েই পাঁচ মাইল হাঁটানো হয়েছে কিনা৷ উল্টো দিকে "কিথলী" বলে একটা জায়গাতে একটা পুরনো স্টীম ইঞ্জিন চলে - ওয়ারথ ভ্যালী রেলওয়ে, চার-পাঁচটা স্টেশনকে সেই গত শতাব্দীর শুরুর দিকের মতন করে রেখেছে - ভলান্টিয়াররা ট্রেন চালায়, টিকিট বিক্রী করে যা পয়সা ওঠে সব যায় লাইনের রক্ষণাবেক্ষণের পিছনে৷ এবার কিথলী পৌঁছে দেখি যে আমরা যদি ঐ স্টীম ট্রেনে উঠি, তাহলে পুরো সার্কুলার রুট ঘুরে যখন ফেরত্ আসবো, ততক্ষণে কিথলী থেকে সেটল ফেরার শেষ ট্রেন চলে যাবে - সুতরাং দেড় ঘন্টা ফাঁকা ইস্টিশনে বসে বসে ভ্যারেণ্ডা ভাজো৷
ট্রেনে করে সেটল ফিরলাম - ঋক ওতেই খুশী - ট্রেনে চড়া হল তো৷ জিএনইআর-এর ভবিষ্যত ড্রাইভার বলে কথা৷ সেটল থেকে গাড়ি নিয়ে ঐ কার্লাইল লাইনের পাশ ধরে গেলুম রিবলহেড-এর দিকে - সেখানে একটা বিখ্যাত "ভায়াডাক্ট" আছে - রিবলহেড ভায়াডাক্ট - বিশাল লম্বা, অনেক পুরনো, হেরিটেজ ব্রীজ, ওপর দিয়ে ঐ কার্লাইল লাইনের ট্রেনগুলো যায় - দেখতে খুব সুন্দর৷ সেখানে গিয়ে এক কাণ্ড - ঋক তো মাঠের ওপর যাবে না - ভেড়া আর ছাগলে "পটি" করে রেখেছে, কোনক্রমে ওয়াকিং রুটটার ওপর নিয়ে যাওয়া হল - কিন্তু ব্রীজের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় না৷ তো আমি বল্লুম যে তোরা দাঁড়া, আমি দুটো ছবি তুলে আনি - এগিয়ে গেছি - প্রায় আধমাইল দূর থেকে সেই পরিচিত "বাবাআআআআআআ ... " - বাবা বোধহয় হারিয়ে গেলো:-)
সেখান থেকে আবার কটেজে ফিরলুম প্রায় রাত্তির আটটা - রাত্তির মানে আমাদের হিসেবে রাত্তির - আটটার সময় এখানে সূর্য দিব্যি চড়চড় করছে৷
সোমবার (গতকাল) নাকি aweful weather হওয়ার কথা ছিলো - বিবিসিতে বললো৷ তো আমরা ভাবলুম চটপট বেরিয়ে এবার ইয়র্কশায়ার ডেলকে দক্ষিণ থেকে উত্তরের রাস্তায় পেরবো৷ সেই রিবলহেড ছাড়িয়ে আরেকটু এগিয়ে "বাটারটাবস পাস" বলে একটা জায়গা আছে - দারুণ৷ একদম পাহাড়ের মাথা অবধি নিয়ে যায়, সরু এঁকা-বেঁকা রাস্তা ধরে - দারুণ দৃশ্য - আর গাড়ি চালিয়ে আনন্দ৷ ঐ রাস্তা ধরে "সোয়েলডেল"-এর মধ্যে দিয়ে রিচমণ্ড হয়ে বাড়ি পৌঁছলুম বিকেল পাঁচটা৷
তাঁবু কেনা হয়েছিলো একটা - এবারে ক্যাম্পিংয়ে যাবো - ভাবলুম তাঁবুটা খাটানোর চেষ্টা করে দেখি - উরিশ্শালা, দুজনে মিলে একদম কেলিয়ে গেসলুম - তবে শেষমেষ ঘন্টাখানেকের চেষ্টায় সেটা দাঁড় করানো গেছিলো - অবশ্যই "টেন্ট পেগ" ছাড়া - বাড়িতে কোথায় পুঁতবো - তবে টেকনিকটা শিখে গেছি - এর পরের একটা ছুটিতে যাবো "গ্লেন নেভিস" - ক্যাম্পিং করতে৷
(ছবি সব এখানে)
2 comments:
দাদা, ছবি গুলো বড় সুন্দর, তবে ভারতের মধ্যপ্রদেশের 'পাঁচমারী'র সাথে এই জায়গার খুব মিল, ৩৯-৪৯ নং ছবি গুলো বাদে ।
আরো ভাল ভাল ছবি চাই।
ছবি আরো পাবেন আমার অ্যালবামে। আর বছরখানেকের মধ্যেই তো ফিরবো, ইচ্ছে আছে মাসখানেক ধরে মধ্যপ্রদেশ ঘোরার, তখন সব দেখা হয়ে যাবে।
Post a Comment