Tuesday, November 27, 2018

দিকশূন্যপুরের রাস্তায় - The Road to Nowhere (৮ম পর্ব)

সম্পূর্ণ নির্জনতা চান? টোটাল সলিটিউড? যেখানে অন্য ট্যুরিস্ট এসে লাফালাফি করবে না...শুধু আপনি, আপনার অল্প কয়েকজন সঙ্গী, ক্যামেরা, বই? মৌচুকী ক্যাম্প একেবারেই তাই। যে একদিন বা দুদিন এখানে থাকবেন, আপনার সঙ্গী বলতে (সঙ্গে যারা আছে তারা বাদ দিয়ে) চারপাশের জঙ্গল, বেশ কিছু পাখি, ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, সন্ধ্যেবেলা আলো দেখে ধেয়ে আসা দলে দলে পোকা, দুটো হৃষ্টপুষ্ট কুকুর, আর বুদ্ধ - মানে মৌচুকীর কেয়ারটেকার। টুরিস্টের ভিড় নেই, মেমোরেবিলিয়ার দোকান নেই, গাড়ির আওয়াজ নেই...নিশ্ছিদ্র নিশ্চুপ নির্জনতা।

পাখির সীজনে গেলে - মানে আরেকটু শীত পড়লে - আপনি হেঁটে হেঁটে পিছনের পাহাড়টায় উঠতে পারেন - পাখির ছবিশিকারীদের স্বর্গ। আকাশ পরিষ্কার থাকলে পূবদিকে ভুটান পাহাড় স্পষ্ট দেখা যায়। আর যদি আরেকটু অ্যাডভেঞ্চারের ইচ্ছে থাকে, তাহলে যে পাথরবসানো রাস্তায় উঠেছেন, সেই পথ বেয়েই নেমে যেতে পারেন পনেরো কিলোমিটার মতন দূরে মূর্তি নদীর ওপর একটা ছোট ঝরনার ধারে - জায়গাটার নাম ওরা দিয়েছে "রকি আইল্যান্ড", বা পিকনিক করে আসতে পারেন রিভার ক্যাম্পের কাছে মূর্তির ধারে। আর যেতে পারেন যুগলে, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বা nth মধুচন্দ্রিমার জন্যে - ঠকবেন না গ্রান্টী।

আমরা গেছিলাম ল্যাদ খাবো বলে। আর আমার সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো একটু pampered হওয়ার। ঋতিকে বললাম - রোজ তো আমি তোদের সবাইকে ঘুম থেকে তুলে স্কুল যাবার জন্যে তৈরী করি, এই কদিন না হয় তোরা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবি, ব্রেকফাস্ট খাওয়াবি, ঘুরতে নিয়ে যাবি...ঋতি শুনে এক কথায় উত্তর দিলো - "আহ্লাদী":-)

সেদিন মৌচুকী পৌঁছে দেখলাম দোতলা কাঠের বাড়িটায় নীচের তলায় দুটো ঘর খালি, দোতলায় একটা ফ্যামিলি রয়েছে - তারা পরের দিন ফিরে যাবে। নীচের দুটো ঘরের মাঝখানে খাবার জায়গা। তিনবেলা খাবার পাবেন - সকালে ব্রেকফাস্ট, দুপুরের লাঞ্চ, রাতের ডিনার। এর মাঝে চা পেয়ে যাবেন চাইলে। নীচের ঘরে জিনিসপত্র রেখে একটু আশপাশটা দেখতে দেখতেই দুপুরের খাবার ডাক পড়লো। সাধারণ খাওয়া - ডাল, ভাত, তরকারি আর ডিমের ঝোল, কিন্তু পরিমাণ দেখে চক্ষু চড়কগাছ। বুদ্ধ মনে হয় খোদ আবদুর রহমানের হাতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। একটা পেল্লায় ক্যাসারোলে ভাত, প্রায় সেরকমই বড় পাত্রে ডাল/তরকারি...ডিমের ঝোলে ডিমের সংখ্যা অবশ্য মাথাপিছু দুটো করে। খাবার দেখিয়ে বুদ্ধ বললো - কম পড়লে বলবেন, আরো দিয়ে যাচ্ছি। খাওয়া শেষে দেখলাম ভাতের ক্যাসারোলের ওপরের ১/৩ কমেছে মাত্র, ডাল প্রায় যেমনকার তেমনি রয়ে গেছে, তরকারি - মানে তেলতেলে আলুভাজাটাই পুরো শেষ, আর ডিমের ঝোলটা। বুদ্ধকে জানিয়ে দিতে হল যে ভাত/ডালের পরিমাণটা একটু কম হলেই ভালো...

দুপুরে বাংলো খালি হয়ে যায় - বুদ্ধ আর ওকে সাহায্য করে বাচ্চামতন একটা ছেলে - ওরা নীচে ওদের গ্রামে যায়। একা থাকার অভ্যেস না থাকলে সেই সময়টা মনে হবে ভূতের বাড়িতে বসে আছেন। আলো পড়ে আসে তাড়াতাড়িই, পাহাড়ের গা বেয়ে মেঘ নামে - আস্তে আস্তে অল্প অল্প দেখতে পাওয়া ভুটান পাহাড় পুরো মেঘে ঢেকে যায়। নীচে কয়েক কিলোমিটার দূরে গ্রামটার ছোট ছোট বাড়িগুলোও চলে যায় মেঘের আড়ালে। কিছুক্ষণ পর বাড়িগুলোতে আলো জ্বলে উঠলে মেঘের মধ্যে দিয়ে আবছা আলোটা দেখা যায়। আর দেখা যায় উল্টোদিকের পাহাড়ের গায়ের বাড়িগুলোর আলো।

বারান্দায় বসে বই পড়ছিলাম, উঠে আলোটা জ্বালাতে হল। আর তার কিছুক্ষণ পরেই দলে দলে পোকা ধেয়ে এলো। প্রথমদিকে কত রকমের পোকা সেটা গোণার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করেছিলাম - অল্প সময়ের মধ্যেই হাল ছাড়তে হল - কারণ পোকার সংখ্যা আর তার রকমের সংখ্যা হাতের বাইরে ততক্ষনে। বুদ্ধ এসে চা দিলো, তারপর আবার বই পড়া বা বকবক করা - কাজ বলতে এই। ছেলেমেয়ে কিছুক্ষণ বই পড়লো, কিছুক্ষণ মোবাইলে গেম খেললো। ওপরের পরিবারের লোকজনের সাথে দুটো চারটে কথা হল চা খাওয়ার সময়...

রাতের খাবারের সময় সেই একই হাল - দুপুরের মত। রুটি কটা লাগবে তা আর বলা হয়নি - অতএব খান পঁচিশেক রুটি এসে হাজির। সাথে আবার তেলতেলে আলুভাজা, ডাল আর চিকেন। অল্প ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া, সাথে গরম রুটি, ডাল ইত্যাদি - রোজকার দুটো রুটির লিমিট পেরিয়ে সেদিন মনে হয় খান আষ্টেক খেয়ে ফেলেছিলাম। রান্নাও এখানে ভালোই করে, আর মুরগীটাও পোলট্রির পানসে মুরগী নয়...

ন'টা বাজতেই পাহাড়ে মাঝরাত হয়ে যায়। নিঝুম অন্ধকারে চারপাশে ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ও হ্যাঁ, দোতলায় পায়ে চলার জন্যে কাঠের মেঝের ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ ছাড়া।



(চলবে)



(আগের কথা)

Monday, November 12, 2018

দিকশূন্যপুরের রাস্তায় - The Road to Nowhere (৭ম পর্ব)

দুপাশে চাপড়ামারির জঙ্গল ফেলে রেখে কালো কুচকুচে পিচ ঢালা কুমানি রোড চলে গেছে সাম্তালেখোলার দিকে। দু চোখ যদি খোলা রাখেন, পাশের জঙ্গলে হঠাৎ করে হরিণ দেখে ফেলতেই পারেন। আর পাখি তো অগুণতি, তেমন তাদের রকমারি ডাক। কলকাতা স্টাইলে জানলা বন্ধ করে এসি চালিয়ে গাড়ি চালালে এসব কিছুই মিস করে যাবেন - তাই জানলা খুলে গাড়ি আস্তে চালান - পরিষ্কার হাওয়ার সাথে জঙ্গলের গন্ধ নাকে এসে ঢুকবে। গাড়ির স্টিরিওটাও বন্ধ রাখুন - বরং এই জঙ্গলের গান শুনুন - হরেক রকমের পাখির ডাক, অন্ততঃ তিন চার রকমের ঝিঁঝিঁর ডাক, হাওয়ার ধাক্কায় লম্বা গাছের পাতার ঝিরিঝিরি আওয়াজ...

সিপচু শহীদ বলিদান পার্ক ছাড়িয়ে আরো কিছুটা এগোলে পড়বে খুনিয়া মোড় - একটা তেমাথা। ডানদিকের রাস্তা চলে গেছে ঝালং এর দিকে, আপনি ঘুরবেন বাঁদিকে - নয়া বস্তির দিকে। নয়া বস্তিতে পড়েই দেখবেন জিটিএ এলাকায় এসে গেছেন। আর একটু এগিয়ে একটা তেমাথায় প্রায় হেয়ারপিন বেন্ড (রাস্তা প্রায় ভাঙাই এখানে) ঘুরে নেমে যাবেন মূর্তি নদীর দিকে। একটা সরু ব্রীজের ওপর দিয়ে নদী পেরিয়ে শুরু ডুয়ার্স অঞ্চলের চা-বাগান - এইটাই সামসিং। সরু রাস্তা চা-বাগানের মধ্যে ঘুরে ঘুরে অল্প ওপরের দিকে উঠে গেছে - রাস্তার দুপাশে একটু কালচে সবুজ পাতাওয়ালা চা-গাছ (দেশের যাবতীয় সিটিসি চা সাপ্লাই যায় ডুয়ার্সের এইরকম চা-বাগানগুলো থেকেই), আর ইতস্ততঃ ছড়িয়ে আছে প্রচূর পাথর - সম্ভবতঃ মূর্তি নদীর সাথে বয়ে এসেছিলো কোনোকালে। শুনলাম খুব সকালে এখানে আসতে পারলে অল্প দূরে ভুটান পাহাড়ের পিছন থেকে অসামান্য সূর্য্যোদয় দেখা যায় - যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে। আর থাকে নানা রকমের পাখি - যদি আপনার পাখির ছবি তোলার শখ থাকে...



সামসিং চা বাগান পেরিয়ে পর পর কয়েকটা ছোট গ্রামের মধ্যে দিয়ে ঘুরে ঘুরে রাস্তা চলে গেছে সান্তালেখোলার দিকে - চেনা না থাকলে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর, তাই মাঝে মাঝেই মোড়ের মাথায় জিগ্গেস করে নিতে হচ্ছিলো - বিশেষ করে এক দুই জায়গায় রাস্তার কাজের জন্যে ডাইভার্শন থাকায় - এবং তার ফলে বার দুয়েক অফরোডিং ও করতে হল। দেবাশিসের ছোট গাড়িতে চারজন ছিলো বলে এক জায়গায় তিনজনকে নেমে গাড়ির ওজন কমিয়ে গাড়ি পার করতে হল। একটু বেশি গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স হওয়ার দরুণ আমরা বেঁচে গেলাম।

কিছুদূর এগোতেই পড়বে ফাড়ি বস্তি - ছোট্ট একটা গ্রাম। রাস্তা এখানেই শেষ - মানে বাইরে থেকে আসা এমনি গাড়ির। সামনে একটা গেট রয়েছে যেটা পেরোতে হলে আপনার কাছে হয় সান্তালেখোলা রিভার ক্যাম্প বা মৌচুকি ফরেস্ট বাংলোর বুকিং থাকতে হবে। যদি নদীর ধারে পিকনিকে যেতে চান, বা পাহাড়ের পথে হাইকিং করতে চান - হেঁটে যেতে পারেন, অথবা ওখানে কিছু মারুতি ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে - তাদের ভাড়ায় নিতে পারেন। গাড়ি নিয়ে গেট পেরোতে গেলে আপনার কাছে কাগজ থাকতেই হবে।

তখন প্রায় বারোটা বাজে বলে একটা ছোট দোকানে বসে আমরা একটু মোমো আর চা খেলাম। আর একটা দোকান নজরে পড়লো - যার সামনে বড় ফ্লেক্স লাগানো - ছবিসহ - কবে যেন "তিনি" এখানে এসে মোমো আর চা খেয়ে দাম দিয়েছিলেন!!!

দেবাশিসদের টাটা করে রওনা দিলাম ফরেস্ট বাংলোর দিকে - ওরা ফিরবে জলপাইগুড়ি। আমরা যেদিন মেন্ডাবাড়ি যাবো, সেদিন আবার ওদের সাথে দেখা হবে।

গেট পেরিয়ে রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে নীচে - নদীর ধারে রিভার ক্যাম্পের দিকে, আর একটা সরু ইঁট পাতা রাস্তা উঠে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে - সেইটাই ধরতে হবে আমাদের।

এখানে আগে একটা ডিসক্লেমার দিয়ে রাখি। সান্তালেখোলা রিভার ক্যাম্প বুক না করে মৌচুকি বুক করার ছোট একটা কারণ আছে। আগে, বহুদিন ধরে বহুবার বিলেতের লেক ডিস্ট্রিক্ট বা স্কটিশ হাইল্যান্ডস বা আমেরিকায় রকি মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্কের পাহাড়ি রাস্তা গাড়ি নিয়ে চষে ফেলেছিলাম, এমনকি আমেরিকায় যেটাকে হায়েস্ট মোটোরেবল রোড বলে - রকি মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্কে - প্রায় সাড়ে বারো হাজার ফুট উঁচু - তাও। কিন্তু এই গাড়ি নিয়ে পাহাড়ে যাবো শুনলেই চেনাজানা প্রায় সকলেই হাঁ হাঁ করে ওঠেন - পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানো কী মুখের কথা ইত্যাদি বলে - তাঁদের কাছে লেক ডিস্ট্রিক্ট/স্কটিশ হাইল্যান্ডসের রাস্তা কলকেই পায় না একেবারে। তা হাত মকশো করার জন্যে (বরং বলা ভালো হাত যে মকশো যে করাই আছে সেটা দেখানোর জন্যেই) মৌচুকি যাওয়া, রিভার ক্যাম্পে না গিয়ে। একটুখানি অফরোডিং। একটুখানি প্রমাণ।

পাহাড়টা বিশেষ উঁচু নয়, পাশে গভীর খাদও নেই। যেটা আছে সেটা হল না-থাকা একটা রাস্তা। গুগুল ম্যাপে এখনো যদি দেখেন, দেখবেন ফাড়ি বস্তি থেকে একটা ডটেড লাইন উঠে গেছে মৌচুকি অবধি। কিছুদিন আগে অবধিও এই পথে গাড়ি যেত না। ইদানিং পাথর ফেলে একটা রাস্তা বানানো হয়েছে - চড়াইটাও মন্দ নয় - জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে এই পাথর ফেলা পথ উঠে গেছে প্রায় সাত কিলোমিটার। গাড়ি চলবে দুলে দুলে, ঝড়ের নদীতে নৌকোর মত। সামান্য অসাবধান হলেই হয় চাকা পাথরে ঠেকবে, বা গাড়ির তলায় জানান দেবে - মোবিল ট্যাঙ্ক ফেটে গেলেই চিত্তির। পথে বিশেষ অসুবিধা আর কিছু নেই - মুশকিলটা হল ওটাই রাস্তা কিনা সেইটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ওই গ্রেডিয়েন্টে আর অসমান পাথরের মধ্যে ফার্স্ট গিয়ারের ওপরে গাড়ি উঠবে না, আর কাজেই যেতে হচ্ছে বেজায় আস্তে - মানে সাত কিলোমিটার পেরোতে ঢের সময় লাগবে। কাউকে জিগ্গেস করার উপায় নেই, কারণ কেউ কোত্থাও নেই, আর মোবাইলও মৃত। বেশ খানিকটা ওঠার পর (ততক্ষণে গাড়ির মধ্যে পিনড্রপ সাইলেন্স - শুধু বাইরে ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই - দুটি চ্যাটারবক্সই একেবারে সুইচড অফ) একটা দুটো বাড়ি চোখে পড়লো - রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে এখানে। নেমে গিয়ে ডাকাডাকি করে একজনকে পেলাম - জানতে পারলাম রাস্তা ঠিকই আছে, আরো কিছুটা ওপরে উঠতে হবে, মানে প্রায় পাহাড়টার মাথায়। নিশ্চিন্ত হয়ে এগোতে এগোতে দুটো বাঁক পেরোতেই দেখি একটা গেট (মানে ওই লেভেল ক্রসিং এর গেটের মত) আর তাতে তালা বন্ধ। আর ওপর দিকে দেখা যাচ্ছে সবুজ কাঠের দোতলা একটা বাড়ি - ওইটাই ফরেস্ট বাংলো।

খেয়েছে। এবার আবার কাকে ডেকে তালা খোলাতে হবে? একটু এপাশ ওপাশ ঘুরে কাউকে না দেখে বাধ্য হয়ে বার দুই তিন হর্ন বাজালাম। সাথে সাথেই বাংলোর একটা কোণা থেকে দুটো মুন্ডু বেরিয়ে এলো। অত দূরে চেঁচালে শোনা যাবে না মোটে, তাই হাত নাড়িয়ে ইশারা করাতে একজন মিনিট কয়েকের মধ্যে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে চলে এলো। বুকিং রয়েছে জানাতেই খুল যা সিম সিম...আর খান তিনেক মোড় ঘুরতেই একটা ফাঁকা জায়গা, তার মধ্যে সবুজ দোতলা কাঠের বাড়িটা।

(ফিরে আসার পরে একটা জিনিস খেয়াল করলাম - মৌচুকি ফরেস্ট বাংলো বলে একটা সিনেমাও আছে। অজানা একটা জঙ্গলে তিনটে ছেলের প্যারানর্মাল অভিজ্ঞতা নিয়ে - সেটা নাকি একটা কুড়িয়ে পাওয়া হ্যান্ডি-ক্যাম থেকে বের করা। টুক করে সিনেমাটা দেখে ফেলতে পারেন। মৌচুকির গল্পে পরে আসবো।

https://www.imdb.com/title/tt7855306/)


Wednesday, November 07, 2018

দিকশূন্যপুরের রাস্তায় - The Road to Nowhere (৬ষ্ঠ পর্ব)

রাত সাড়ে এগারোটায় প্রায় টলতে টলতে, (আর গাড়ির বাকিরা ধুঁকতে ধুঁকতে) টিলাবাড়ি পৌঁছে আর কিছু নজর করার অবস্থা ছিলো না। সকালে ঘুম ভাঙতে দেখলাম কমপ্লেক্সটা বেশ বড়। মানে বেশ ভালোই বড়। সাজানো বাগান, পাথরের ফোয়ারা, বড় পার্কিং লট, মিউজিয়াম, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। কটেজগুলোর যা সাইজ, একটায় অনায়াসে চারজন থাকা যায়, কিন্তু ব্যবস্থা এবং নিয়ম করে রেখেছে দুজনের। বছর দুয়েক হল তৈরী হয়েছে এই কমপ্লেক্সটা, উত্তর বঙ্গে ট্যুরিজম বাড়ানোর জন্যে, যদিও, ফরেস্ট লজ বলতে যা বোঝায় টিলাবাড়ি একেবারেই সেরকম নয়, বরং গরুমারার জঙ্গলে এতটা জায়গা নিয়ে ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স একটু বাড়াবাড়ি (এবং বেখাপ্পা) ঠেকেছে। জঙ্গল এলাকার বাইরে হলে ব্যাপারটা অন্যরকম হত। ক্যামেরা আর বের করতে ইচ্ছে করছিলো না - হাতের কাছে মোবাইল ছিলো, তাতেই এদিক ওদিক কয়েকটা ছবি তুলে রেখেছিলো জনতা, ডকুমেন্টেশনের জন্যে (হোয়াটস অ্যাপের দৌলতে রিয়েলটাইম খবরাখবর যায় বিভিন্ন জায়গায়)।

আরো একটা জিনিস দেখে ছেলেমেয়ের খুব মজা - রাতে যেখানে গাড়ি রেখেছিলাম, তার পাশে একই মেক/মডেল/ট্রিম এবং কাছাকাছি রেজিস্ট্রেশন নম্বরের আর একটা গাড়ি, শুধু রঙটা আলাদা।






ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি - তার লিস্টে বেশ কিছু নাম থাকলেও পুরী-তরকারি আর টোস্ট ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেলো না। খেতে খেতে আলাপ হল অন্য গাড়িটার লোকজনের সাথে - তাঁরা কলকাতার সেটা তো অবভিয়াস - যাবেনও সান্তালেখোলা - তবে থাকবেন রিভার ক্যাম্পে (আমরা পাহাড়ের ওপর মৌচুকি জাঙ্গল ক্যাম্পে), তারপর যাবেন "পারেন" আর "জলদাপাড়া"।

স্নানটান সারতে সারতে দেবাশিস ফোন করলো - পানঝরা, সান্তালেখোলা, মেন্ডাবাড়ির কাগজপত্র সব ওর কাছে আছে - ও এসে দিয়ে যাবে। আর আসছেই যখন, তখন পানঝরার রাস্তাটা চিনিয়ে দিয়ে যাবে, কারণ গুগুল ম্যাপে শুধু চাপড়ামারির গেটটা দেখা যায় - সেটাও একটু এদিক ওদিক ঘুরে। দশটা নাগাদ চেক-আউট করলাম। এসব সরকারি গেস্ট হাউজে এখন চেক-আউটের সময় একটা করে গিফট-প্যাক দিচ্ছে (রুম পিছু একটা) - বাঁশের পেনদানি গোছের কিছু, আর একটা চকোলেট।

এর মধ্যে দেবাশিসও এসে গেল, সাথে পুরো পরিবার - স্বাতী (দেবাশিসের বৌ), আর যমজ ছেলেমেয়ে। এই ফাঁকে পরিচয়টা দিয়ে রাখি - দেবাশিসের সাথে আমার আলাপ আমাদের ফটোগ্রাফি ক্লাবে। মধ্যমগ্রামে থাকতো, পেশা ছিলো পড়ানো - স্কুলে টুলে নয়, পুরো টিউশনি। অবসরে ছবি তোলা। ক্লাবের একজনের মেয়েকে পড়াতো, তাই ক্লাবে সবাই "দেবুস্যার" বলেই ডাকে। ভালোই ছিলো, হঠাৎ একদিন কী খেয়াল হল - কলকাতা/মধ্যমগ্রাম ছেড়ে দিয়ে চিলাপাতায় রওনা দিয়ে দিলো - সেখানেই থাকে, জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, জমি কিনে ফার্মিং করে, আর ট্যুর অপারেটরের ব্যবসা। ভালোই চলে - ইদানিং পাহাড়ে (মানে সিকিম) আর জঙ্গলে (মানে ডুয়ার্সে) ভালো পরিচিতি হয়ে গেছে। লোক খুবই ভালো, শুধু মাথাটা...মানে মাঝেমাঝেই বেশ আজগুবি দাবীদাওয়া করে থাকে...মাসখানেকে হিমালয়কে চক্কর দেওয়ার মতন।

টিলাবাড়ি থেকে বেরোতে পৌনে এগারোটা বাজলো। তেল নিতে হবে - গেলাম চালসার দিকে। সেখান থেকে আবার ঘুরে মূর্তি রিভার ক্যাম্পের পাশ দিয়ে একটা সরু ব্রীজ পেরিয়ে চাপড়ামারির রাস্তায় উঠলাম। আগের দিন রাতের মত অন্ধকারে হাতড়ানো নয় আর - দুপাশে ঘন জঙ্গল দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ একটা হরিণও...এরা মাঝেমাঝেই লাফিয়ে রাস্তায় চলে আসে বলে এই পুরো এলাকাতেই স্পীড লিমিট বাঁধা। বেশ জোরে পাখির ডাক শোনা যায়। আর একটা কনস্ট্যান্ট উঁচুতারে ঝিঁঝিঁর ডাক - আমাদের কলকাতা শহরতলির ঝিঁঝিঁর চেয়ে অনেকটাই অন্যরকম।

(চলবে)

(আগের কথা)


Thursday, November 01, 2018

দিকশূন্যপুরের রাস্তায় - The Road to Nowhere (৫ম পর্ব)

ঝটকা সামলে লরি ড্রাইভার আর চা-দোকানীর সাথে কথা বলে যা বুঝলাম সেইটা হল এই রকম -

আমরা ভাগলপুর থেকে পঁচিশ কিলোমিটার মত দূরে। সামনে দুটো উপায় আছে - এক, ওই পথেই এগিয়ে ভাগলপুর হয়ে মোকামা পৌঁছে গঙ্গা পার হওয়া - সেক্ষেত্রে আরো অনেকটা পশ্চিমে যেতে হচ্ছে, ফের আবার পূবদিকে ঘুরে পূর্ণিয়া যেতে হবে; আর দুই, কিছুটা পিছিয়ে বাঁদিকে গোড্ডা বলে একটা জায়গার ডিরেকশন পাওয়া যাবে - সেই রাস্তা ধরে গেলে পাকুড় পেরিয়ে ধূলিয়ানে গিয়ে ফের ন্যাশনাল হাইওয়ে ৩৪ (গুগুলের বক্তব্য অনুযায়ী ন্যাশনাল হাইওয়ে ১২) পাওয়া যাবে। সেই রাস্তা কিছুদিন আগে অবধি বন্ধ ছিলো, সদ্য খুলেছে, আশা করা যায় আমরা পেরিয়ে যেতে পারবো। এছাড়া উপায় হল দুমকা অবধি ফেরৎ যাওয়া - মানে আরো অনেক বেশি উল্টো পথে ঘোরা আর সময় নষ্ট। দেবাশিসকে ফোন করলাম - ও শুনে গোড্ডার রাস্তাটাই সাজেস্ট করলো। ম্যাপে দেখলাম - ধূলিয়ান প্রায় ১৬০ কিলোমিটার, লরি ড্রাইভার বললো ঘন্টা চারেক লাগতে পারে। গুগুল ম্যাপও দেখলাম বলছে সাড়ে চার ঘন্টা। অর্থাৎ, সেদিন সকালে বেরনোর সময় যে দূরত্বটা ছিলো ৫০০কিলোমিটার (বারো ঘন্টার ড্রাইভ), সেইটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে ৬৭৩ কিলোমিটার, প্রায় আঠারো ঘন্টার জার্নি! ছিলো রুমাল, হয়ে গেলো একটা বেড়াল। কিন্তু উপায় তো নেই।


গাড়ি উল্টোদিকে ঘুরলো। যে জায়গাটায় আমরা পৌঁছেছিলাম, সেটার নাম হাতপুরৈনী (Hatpuraini/हातपुरैनी)। উল্টোপথে কিছুটা গিয়ে পড়লো পঞ্জওয়ারা/গোড্ডার রাস্তা। আরো এক প্রস্থ লোকজনকে জিজ্ঞেস করে ঢুকে পড়লাম - সেটা সম্ভবত স্টেট হাইওয়ে ৮৪।

লরি ড্রাইভার কেন "আশা করছিলো যে আমাদের গাড়ি চলে যাবে" সেটা বোঝা গেল খানিকটা। সেই প্রথমবার গাড়ি নিয়ে চিলিকা গেছিলাম যখন, তখন স্থানীয় লোকজন পুরী যাওয়ার একটা শর্টকাট বাতলেছিলো - সেই পথে গিয়ে হাল ঢিলে হওয়ার যোগাড় হয়েছিলো সেবার - খানাখন্দ ভর্তি, আর একদিন ধরে রাস্তা বাঁধানোর কাজ চলছে - রাস্তার দুটো দিকের উচ্চতার মধ্যে ফুটখানেকের তফাৎ। এও একই অবস্থা। কিছুদূর পরে পরেই ডাইভার্সন - সেটা নীচে কালভার্টের তলা অবধি নেমে গর্ত পেরিয়ে আবার ওপরে উঠছে - এর মধ্যেই বাস, অটো (সেও জাম্বো অটো), লরি, কনস্ট্রাকশন ভেহিকল - সবই চলছে। গতিক নাই, আমরাও চল্লুম। গোড্ডা পেরিয়ে রাস্তাটা ঠিকঠাক হল। তখন আমরা ঢুকছি সুন্দরপাহাড়ি বলে একটা জায়গায়...

সুন্দরপাহাড়ি জায়গাটা বেশ মিষ্টি মতন। ঝাড়খন্ডের এই অঞ্চলটা হল রাজমহল পাহাড়ের অংশ - সাঁওতাল পরগনা বললে আরো চেনা লাগবে। ছোটনাগপুর মালভূমির কাছাকাছি হলেও দিব্যি সবুজে ঢাকা, রুক্ষ নয়। হয়তো গঙ্গার অববাহিকার মধ্যে থাকার কারণেই। ঋকের প্রিয় সাবজেক্ট ছিলো ভূগোল - গড়গড়িয়ে কিছু রানিং কমেন্টারি দিয়ে গেলো - রাজমহল পাহাড়ের এই পাহাড়গুলো জুরাসিক আমলের, অগ্নুৎপাতের কারণে তৈরী, সাঁওতাল পরগনার উত্তর-দক্ষিণ বরাবর রয়েছে, এখানেই গঙ্গা তার দক্ষিণমুখী গতিপথ বদলে পূর্বদিকে যাওয়া শুরু করে; পাহাড়ের ওপরদিকে থাকে পাহাড়িয়া উপজাতিরা, আর নীচে উপত্যকা অঞ্চলে সাঁওতালরা - যাদের জীবিকা চাষবাস।

রাস্তাটা এখানে বেশ নির্জন। উল্টো দিক থেকে কচ্চিৎকখনো দু একটা গাড়ি আর রাস্তার পাশের ঘন শালবনে শুকনো পাতা বা কাঠ কুড়োতে আসা কিছু সাঁওতাল মেয়ে ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ, নিঝ্ঝুম জঙ্গল দুপুরে ঘুমিয়ে রয়েছে। তার মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে একটা উঁচুনীচু রাস্তা এগিয়ে গেছে - মাঝে মাঝেই চড়া বাঁক...

সুন্দরপাহাড়ির পরে জোলো, যোগেশ্বর, লিটিপাড়া, হিরণপুর পেরিয়ে পাকুড়। পাকুড়ে এসেই রাস্তাটা কেমন আবার ঘিঞ্জি হয়ে গেলো। গাদা গাদা লরি, অটো, বাস। মাঝে মাঝেই লম্বা লরির লাইন। এদিকে সেদিন আর আমাদের হাতে সময় নেই বলে উল্টো লেন দিয়েই মাঝে মাঝে এগোচ্ছি। বাজার মত একটা জায়গা পেরিয়ে আরো কিছুটা যেতেই দেখলাম সামনেই হাইওয়ে - ন্যাশনাল হাইওয়ে ১২ (বা ৩৪) - যেখান থেকে আমাদের আবার বাঁদিকে হাইওয়ে ধরে চলে যেতে হবে ফারাক্কার দিকে। ওই মোড় থেকে ফারাক্কা আরো আঠারো কুড়ি কিলোমিটার মত। কিন্তু ওখান থেকেই ৪-লেন হাইওয়ের বাঁ দিকের পুরোটাই বন্ধ করে লরি দাঁড়িয়ে রয়েছে। শ'য়ে শ'য়ে, বা হাজারে হাজারে। ঘড়িতে তখন প্রায় তিনটে বাজে, টিলাবাড়ি আরো প্রায় সাড়ে তিনশো কিলোমিটার...

ফারাক্কায় আপাতত ওয়ান-ওয়ে একটা সিস্টেম চালু করেছে। আধ ঘন্টা করে মালদার দিক থেকে আসা গাড়ি ছাড়া হচ্ছে, আধ ঘন্টা করে দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাওয়ার গাড়ি। সেটা ছাড়াও, এনএইচ ৩৪ (বা ১২) তেও চতুর্দিকে কাজ হচ্ছে, ফলে অনেক ডাইভার্সন, খোঁড়াখুঁড়ি। যেমন, ফারাক্কায় ঢোকার আগে একটা ব্রীজ পেরোতে হয় - টেম্পোরারি ব্রীজ - সেটাও ওয়ান ওয়ে, কিন্তু সেখানে দুদিকে গাড়ি আটকানোর জন্যে কেউ নেই। ইন ফ্যাক্ট, আমাদেরই ব্রীজে কিছুদূর উঠেও পিছিয়ে আসতে হল - কারণ উল্টোদিকে বাস উঠে এলো - আর জানেনই তো, হাইওয়েতে (আসলে ভারতের সব রাস্তাতেই) সাইজ ম্যাটারস - রাইট অফ দ্য ওয়ে (right of the way) বস্তুটি এখানে নেই।

ঘটনাচক্রে, এবং কিছুটা এদিক ওদিক দিয়ে নাক গলিয়ে (সচরাচর এই কাজগুলো নিজে করি না, কিন্তু সেদিন লাটাগুড়ি পৌঁছনোর জন্যে যা থাকে কপালে করে চালাতে হয়েছে) একটা আধ ঘন্টার ফ্লো-এর মধ্যে ঢুকে ব্যারেজে উঠে পড়লাম। এইবার পুরো ব্যারেজটাই ঢিকির ঢিকির। প্রায় আড়াই কিলোমিটারের ব্যারেজ - যতক্ষণ লাগলো, হেঁটে গেলেও মনে হয় তার চেয়ে কম সময়ে পৌঁছে যেতাম। তবে লোকে কেন ফারাক্কা ব্যারেজের রাস্তাকে গাল দেয় সেটা স্পষ্ট বোঝা গেল - মানে ওখানে ঠিক রাস্তা বলে কিছু নেই। অসংখ্য উঁচুনীচু পিচের বাটিকে কেউ যদি সিমেন্ট দিয়ে জুড়ে রাখে তাহলে যা হবে, ফারাক্কার অবস্থা তাই। আসলে গর্ত দিয়ে তৈরী বললেই হয়। লীলা মজুমদারের টংলিং এ যেমন সেই পাঁউরুটি দেখে বলেছিলো - পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কতগুলো ফুটো জুড়ে জুড়ে তৈরী...

এর কিছুদিন আগেই মাঝেরহাট ব্রীজ ভেঙে পড়েছে - অতএব, চতুর্দিকে সাজো সাজো রব (গত সাত বছরে কী করছিলেন সেই প্রশ্ন করা যায় না) - তাই ফারাক্কার একটা লেন বন্ধ করে পিচের লেয়ার খুঁড়ে তোলা হচ্ছে, অন্য লেন দিয়ে ওয়ান ওয়ে সিস্টেমে গাড়ি চলছে। শামুকের মতন গতিতে গড়াচ্ছে বললেই ভালো। আড়াই কিলোমিটারের ব্রীজ পেরোতে প্রায় আধ ঘন্টা। তুমুল ধুলো - জানলা খুলবেন তার উপায় নেই। রাস্তার পাশে রেললাইনের ধারে সংখ্যা লেখা রয়েছে - সম্ভবত মাইলস্টোন। কড়িকাঠ নেই বলে সবাই সেইগুলো গুণতে গুণতেই সময় কাটালো...কী আর করবে। এর মধ্যে দুটো ব্যাপার চোখে পড়লো।

এক - লরি রাত ন'টার পরে ছাড়ার কথা হলেও, ওই দুপুরেও কিছু লরি ফারাক্কা পেরোচ্ছে। কীভাবে পেরোচ্ছে আন্দাজ করার জন্যে নকুলদানা নেই।

আর দুই - পিচের লেয়ার কাটা হচ্ছে বড় পাওয়ার ড্রিল দিয়ে, তুমুল আওয়াজ আর ভাইব্রেশন। সেফটি রুল অনুযায়ী (এটা সুমনা দেখেই বললো, কারণ ওদের নানা দেশের কনস্ট্রাকশন প্রোজেক্ট হ্যান্ডল করতে হয়) ওই পাওয়ার ড্রিল কোনো মানুষের মিনিট পাঁচেকের বেশি একটানা ধরে থাকার কথা নয় - মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি হয়। একাধিক লোকের পালা করে কাজটা করার কথা। এখানে হেলথ অ্যান্ড সেফটির এই নিয়মের কথা হয় কেউ জানে না, বা খরচ বাঁচানোর জন্যে নিয়মের তোয়াক্কা কেউ করে না। মানুষ এখানে বড়ই শস্তা।

শেষমেষ সাড়ে তিনটের একটু আগে ফারাক্কা পেরিয়ে গেলাম; তারপর কালিয়াচক - ট্র্যাফিক জ্যামের জন্যে কুখ্যাত - সেটাও পেরোলাম খুব অল্পই দাঁড়িয়ে। দুপুরে খেতে হবে - সকালের পাঁউরুটি আর বালুসাই অনেকক্ষণ হজম হয়ে গেছে, আর যে পথে এসেছি সেখানে শালের গুঁড়ি আর গাছের পাতা ছাড়া খাওয়ার মত কিছু চোখে পড়েনি; তাছাড়া ফারাক্কা পার হওয়ার তাড়াও ছিলো। কালিয়াচক থেকে মালদা অবধি রাস্তা কখনো ভাঙা, কখনো মোটামুটি - আর ঠিকঠাক হোটেল ছাড়ুন, ধাবাও বিশেষ চোখে পড়ে না। তার মধ্যেই একটা ছোট হোটেলে রুটি-সবজি-ডিমভাজা খেয়ে আর ঋক/ঋতির খাবার প্যাক করে (ওরা দুজনে তখন পালা করে পাবজি নিয়ে ব্যস্ত বলে খাওয়ার সময় পায়নি) এগিয়ে পড়লাম। যেখানে সুযোগ পাচ্ছি, স্পীড বাড়িয়ে সময় বাঁচানোর চেষ্টা করছি - এই জিনিসটাও সচরাচর করি না। মালদায় কতটা জ্যামে পড়বো তাই নিয়ে চিন্তায় ছিলাম - কারণ দেবাশিসের কাছে ওর অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি আগে। ভাগ্যক্রমে, এবং সম্ভবত ফারাক্কার দৌলতে, মালদায় জ্যামে দাঁড়াতেই হল না প্রায়। মালদা শহর ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা দূর অবধি রাস্তা ভালো - চওড়া চার লেন - সেখানেও গাড়ি দৌড় করানো যায়।

তখনো ঠিক করে রেখেছি অন্ততঃ শিলিগুড়ি অবধি চলে যাই। যদি খুবই দেরী হয়ে যায়, শিলিগুড়িতে একটা কোনো হোটেলে দাঁড়িয়ে যাবো, টিলাবাড়ির রিজার্ভেশনটা না হয় নষ্টই হবে। আর যদি মনে হয় পৌঁছে যেতে পারবো, তাহলে টিলাবাড়িতে ফোন করে রাতের খাবারের কথা জানিয়ে রাখবো। বেশ কিছুটা রাস্তা একটু জোরে ছুটিয়ে কিছুটা সময় মেকাপ করে ছটার একটু আগে রায়গঞ্জ পেরোলাম। রোড ট্রিপের প্রাইমারি নিয়ম - যে প্রতি দুই থেকে তিন ঘন্টায় একবার দাঁড়ানো - সেদিনের মত ভুলে গিয়ে। ততক্ষণে বারো ঘন্টা পেরিয়ে গেছে আমি একটানা স্টিয়ারিং ধরে আছি - মাঝে ওই এক দু বার চা খেতে দশ মিনিট, আর দুপুরে খাওয়া আধ ঘন্টা বাদ দিলে...

রায়গঞ্জ পেরিয়ে বালিহারা, মকদমপুর ছাড়িয়ে আসে আলতাপুর। এনএইচ ৩৪ (বা ১২) এখান থেকে সোজা চলে গেছে করণদিঘি ছাড়িয়ে ডালখোলা - এখানে পূর্ণিয়া থেকে আসা এনএইচ ২৭ আর এনএইচ ৩৪ মিশে যাচ্ছে - যেটা কিষণগঞ্জ হয়ে শিলিগুড়ি যাচ্ছে। এই রুটটা বিহার-পশ্চিমবঙ্গ মিশিয়ে। গুগুল ম্যাপ আমাকে অন্য রাস্তা দেখালো - আলতাপুর থেকে একটা রাস্তা ডানদিকে ঢুকে গেছে - গুগুলের উচ্চারণ বুঝতে পারবেন না, কাজেই যদি কখনো এই রোড ট্রিপে যান, তাই মনে করে রেখে দিন - বোতলবাড়ি-রসখোয়া রোড - চলে যাচ্ছে সাবধান (ভয় নেই - এটা একটা জায়গার নাম), রুদেল, গোয়াগাঁও হয়ে একেবারে ধানতলা - যেখানে রাস্তাটা ফের ন্যাশনাল হাইওয়ের সাথে মেশে। প্রায় সত্তর কিলোমিটার রাস্তা, পুরোটাই উত্তর দিনাজপুরের গ্রামাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে। মনে আছে, প্রথমদিন যে সেকমপুর-সাহাপুর রোড (ন্যাশনাল হাইওয়ে ১১৪) ধরে গুশকরা পেরিয়ে সিউড়ি এসেছিলাম? এই রাস্তাটাও সেরকমই। ধানক্ষেত, মাঠের মধ্যে দিয়ে পাক খেয়ে যাওয়া রাস্তা, মাঝে মাঝে দুপাশে ছোট ছোট গ্রাম পড়ছে, বা খুব ছোট ছোট বাজার - এই গ্রাম বা বাজারগুলোতে ঢোকা আর বেরনোর সময় হয় ছোট ছোট বাম্প, বা ব্যারিকেড - গাড়ির স্পীড কমানোর জন্যে। এই জনপদগুলো বাদ দিলে রাস্তা ঘুটঘুটে অন্ধকার - শুধু উল্টোদিকের গাড়ির হেডলাইট ছাড়া। অনেকেই আজকাল ডালখোলা এড়ানোর জন্যে এই রাস্তাটা ব্যবহার করে - কারণ ডালখোলা পুরোপুরি আনপ্রেডিক্টেবল - আধ ঘন্টাতেও পেরোতে পারেন, তিন ঘন্টাও আটকে থাকতে হতে পারে। তবে বড় লরি এদিকে বিশেষ আসে না - বেশিরভাগই ছোট গাড়ি, ছোট ম্যাটাডোর আর কিছু বাস।

নীচে রুটটা দিয়ে দিলাম।


কুয়াশা এদিন আরও বেশি। আর তার চেয়ে বড় সমস্যা উল্টোদিকের গাড়ির হাই বীমের হেডলাইট। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমি একবার করে হেডলাইটে ছোট ফ্লিকার মারলে উল্টোদিকের গাড়ির আলোও নেমে আসছে বটে, কিন্তু ঠিক পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে হাই বীম করে দিয়ে। কিছুক্ষণ পরে কারণটা বুঝলাম - নিজে এক দুইবার এক্সপেরিমেন্ট করে। এই কাজটা করে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উল্টোদিকের গাড়ির বাউন্ডারিটা দেখতে পাওয়ার জন্যে - যেটা সাধারণ হেডলাইটের আলোতে চাপা পড়ে যায় - যদিও এইটাও না করাই কাম্য। রাতে এরকম রাস্তায় চালানোর সেরা উপায় (যদি নিজেও যস্মিন দেশে যদাচার না করতে চান) হল উল্টোদিকের গাড়ির মাথার দিকে লক্ষ্য রাখা, আর নিজের বাঁদিকে রাস্তার বাউন্ডারি দেখে গাড়ি চালানো - আমি সাধারণতঃ ডানদিকে অল্প ঘুরে বসি - তাতে কিছুটা সুবিধা হয়। যদিও সেদিন যদিও অত টেকনিক্যালিটি ভাবার সময় ছিলো না। অন্ধকার নেমেছে, অন্য গাড়ির আলো ছাড়া পথে কোনো আলো নেই, তায় কুয়াশা, তায় বার বার চোখ ঘড়ির দিকে আর মোবাইলে অন করে রাখা গুগুল ম্যাপের দিকে যাচ্ছে। এস্টিমেটেড অ্যারাইভাল টাইম (টিলাবাড়িতে) তখন রাত সাড়ে দশটার কাছাকাছি। থ্যাঙ্কফুলি, টিলাবাড়ি ঠিক জঙ্গলের ভিতরে নয় যে গেট বন্ধ হয়ে যাবে - তাই দেরী হলেও ঢুকতে পারবো। কিন্তু পৌঁছতে পারবো কিনা, সেইটা বড় প্রশ্ন তখনও।

ঘন্টা দেড়েক লাগলো এই সত্তর কিলোমিটার পার হতে। মাঝে শুধু একবার চা খেতে দশ মিনিট দাঁড়িয়েছি - সেদিনের মত শেষ স্টপ। ঠিক করে রেখেছি একেবারে টিলাবাড়ি পৌঁছে, বা নেহাতই না পারলে শিলিগুড়িতে দাঁড়াবো। এই স্টেট হাইওয়ের একদম শেষের দিকে - যখন গুগুল ম্যাপ বলছে "দুশো মিটার পর ন্যাশনাল হাইওয়ে ২৭ এ ডানদিকে ঘুরতে হবে" - মানে যে রাস্তাটা ডালখোলা হয়ে এসেছে, সেটাতে উঠতে হবে - হেডলাইটের আলোয় যা দেখলাম, সেটা মোটামুটি চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মত। রাস্তা সিম্পলি নেই। হয়তো কোনো কালে ছিলো - শের শাহ এর আমলে - আপাতত পুরোটাই ঢেউ খেলানো পাথুরে জমি। একটা দুটো গাড়ি পেরোচ্ছে সামনে দেখতে পাচ্ছি - উত্তাল নদীতে দুলন্ত নৌকোর মত - রাস্তার বাঁদিক থেকে ডানদিক আড়াআড়ি গিয়ে গর্ত আর পাথরের পাশ কাটাতে কাটাতে।

[পরে জানা গেছিলো এইটা নাকি বেশ কয়েক বছর ধরে একই রকম হয়ে আছে, প্রতি বর্ষায় আরো একটু করে যন্ত্রণা বাড়ে। এবং বহুবার জানানো সত্ত্বেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। অনেকে বলে ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত, হাইওয়ে থেকে বাস বা লরি যাতে এই রাস্তায় ঢুকে না আসে, সেইটা নিশ্চিত করার জন্যে। কথা হল বাস বা লরির বরং এই রাস্তায় কিচ্ছুটি হবে না - ঘটাং ঘটাং করে পৌঁছে যাবে। চাপ হবে ছোটো গাড়ির। ২০৯ মিমি গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স নিয়েও বিআর-ভি এর তলা একবার ঘষে গেলো - একটা জায়গায় সময়মতন আড়াআড়ি কাটাতে না পেরে। আরো ছোটো মারুতি ইত্যাদি তো আরোই ঠেকে যেতে পারে খুব সাবধানে না পার হলে। যদি এই পথে যান ছোটো গাড়ি নিয়ে, আগে গাড়ি থেকে বাকি যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে খালি গাড়ি নিয়ে পার হবেন। অথবা এই রাস্তার ডানদিকে প্রায় সমান্তরালভাবে আরেকটা রাস্তা চলে গেছে গোয়ালপোখর হয়ে ইসলামপুর অবধি - যেটা "বেঙ্গল-বেঙ্গল" হিসেবে পরিচিত। সেইটা ধরে ইসলামপুর চলে গেলে ধানতলার কাছে এই ভয়ানক অংশটা এড়াতে পারবেন। সমস্যা হল এই পথটার একটু বদনাম রয়েছে - ছিনতাই সংক্রান্ত।]

খুব আস্তে আস্তে এই অংশটা পেরিয়ে (একবার ঘষে গেলো, বার দুয়েক গাড়িতে বসা অন্যদের মাথা ঠুকে গেলো...) উঠলাম ন্যাশনাল হাইওয়ে ২৭ এ, এর পর টার্গেট যতটা সম্ভব সময় মেকাপ করে শিলিগুড়ি বাইপাস ধরা। টিলাবাড়ি তখনও দেড়শো কিলোমিটার। মাঝে রয়েছে ইসলামপুর - আরেকটি বটলনেক। ইসলামপুরের কাছাকাছি পৌঁছে দেখি লম্বা লরির লাইন - দুই তিন কিলোমিটার তো হবেই। তখন ফের সেই উল্টোদিক দিয়ে এগিয়ে দরকারমত আবার ভিতরে সরে এসে (মানে যেসব জিনিস দেখে কলকাতার রাস্তায় এতদিন গালিই দিয়ে এসেছি) ইসলামপুর মোড় পেরিয়ে গেলাম। জ্যামের মূল কারণ রাস্তার ওপর বাজারের মধ্যে পেল্লায় একটা পুজো। দেবাশিস বার দুয়েক ফোন করে খোঁজ নিয়েছে। আর বলে দিয়েছে ইসলামপুর ছাড়ানোর বেশ খানিকটা পরে, মানে এই তিরিশ কিলোমিটার পরে আসবে টোলগেট। তারপর একটা নির্মীয়মান ফ্লাইওভারের পাশ দিয়ে ডানদিকে ঘুরে ধরতে হবে শিলিগুড়ি বাইপাস - মানে ফুলবাড়ি-ঘোষপুকুর রোড। সেই রাস্তা নিয়ে যাবে গাজলডোবা হয়ে জলপাইগুড়ির দিকে। শিলিগুড়ি এমনিতেই খুব ঘিঞ্জি - দুটি মোটে রাস্তা - সেবক রোড, আর হিলকার্ট রোড - যা কিছু আছে শিলিগুড়ির, সবই এই দুটো রাস্তার ওপর - কাজেই সাধারণ সময়েই ভিড় থাকে, পুজোর সময় আরোই ক্যাচাল - শিলিগুড়ি না গিয়ে বাইপাস ধরে জলপাইগুড়ি যাওয়াই তুলনামূলকভাবে ভালো অপশন।

এর মধ্যে টিলাবাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি যে আমরা শিলিগুড়ি বাইপাসে পৌঁছে গেছি - আর ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে টিলাবাড়ি পৌঁছে যাবো। কিছু খাবারও বলে দেওয়া হয়েছে - ওরা রেখে দেবে - যদিও ইন-রুম ডাইনিং ওদের নিয়মে নেই, তাও কেয়ারটেকার ভদ্রলোক সেই রাতে আমাদের নিরুপায় দেখে সেই ব্যবস্থাই করে রেখেছেন।

গুগুল ম্যাপ এই একবারই ভুল রাস্তা দেখালো। আমবাড়ি ক্যানাল রোড ধরার জন্যে এক জায়গায় বাঁদিকে যেতে বলে - সেই রাস্তাটা নেইই, সবে তৈরী হচ্ছে। একটা বেড়া দেওয়া রয়েছে - বাইক নিয়ে লোকে সেই বেড়া পেরিয়ে চলে যাচ্ছে - গাড়ি যাওয়ার কোনো উপায় নেই। গাড়ি নিয়ে যেতে হলে আরো একটু এগিয়ে বাঁদিকে রেলগেট পেরিয়ে চলে যেতে হবে গাজলডোবার দিকে। গাজলডোবায় তিস্তা ব্যারেজ পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। রাত পৌনে এগারোটায় এই ক্যানাল রোডে আর একটাও গাড়ি চোখে পড়ছে না। হেডলাইটের আলোয় যতদূর দেখা যাচ্ছে শুধু জঙ্গল। এইটা পুরোটাই একসময় বৈকুন্ঠপুর জঙ্গলের অংশ ছিলো - এখন কিছু কিছু জায়গায় জনবসতি হওয়ার ফলে আলাদা হয়ে গেছে জঙ্গলগুলো।

বৈকুন্ঠপুর মনে পড়ে? ভবানী পাঠক? দেবী চৌধুরানী? এই সেই বৈকুন্ঠপুরের জঙ্গল, আর এইখানেই তিস্তায় (বঙ্কিম যাকে ত্রিস্রোতা লিখেছেন) ভাসতো দেবীর বজরা।

ঋক আর ঋতিকে গল্পটা বলতে চাইলাম - কিন্তু দুটি চ্যাটারবক্সই তখন অদ্ভুতভাবে চুপ করে গেছে। সারাদিনের ক্লান্তি হতে পারতো, কিন্তু ঋতি যা জানালো তাতে বুঝলাম দুজনেই একটু ভয় পেয়েছে। রাস্তার একপাশে মাঝে মাঝে একটা দুটো চা বাগান দেখা যাচ্ছে, বাকিটা জঙ্গল, অন্যপাশটা শুধুই ঘন জঙ্গল, তার মাঝে কুয়াশা, গাড়ির হেডলাইট ছাড়া আর একটাও আলো নেই, এর মধ্যে একটা একলা রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে কোথায় কতদূরে তা জানি না, কোনও মাইলফলকও চোখে পড়ছে না। আর সম্পূর্ণ জনমানবহীন অন্ধকারে শুধু গাড়ির হেডলাইটে চারদিক একটা পরিত্যক্ত ভুতুড়ে এলাকার মত লাগছে। হয় এদিকে কোনো জনবসতি নেই, নয়তো ততক্ষণে সকলের মাঝরাত হয়ে গেছে। এমনিতেই বৈকুন্ঠপুর জঙ্গলের একটু বদনাম রয়েছে হাতির জন্যে, যদিও সেটা ঋক বা ঋতির জানার কথা নয়। কিন্তু ওই জঙ্গলে, রাতে, যদি গাড়ি খারাপ হয়, বা পাশের জঙ্গল থেকে কিছু বেরিয়ে আসে - এই ভয়ে ঋতি বিশেষ করে খুবই টেনশনে। টেনশন আমারও যে অল্প হচ্ছিলো না তা নয়। গুগুল এদিক দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আর কোনো গাড়ি নেই কেন? এই চিন্তাটা মাথায় ঘুরছিলো - কাটলো রাস্তার পাশে একটা বোর্ডে লাটাগুড়ি ৩০ কিলোমিটার দেখে - এতক্ষণ পরে এই একটা সাইনপোস্ট। তার কিছু পরেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটু দূরে বাঁদিক থেকে আসা গাড়ির আলো চোখে পড়লো - বুঝলাম আর একটা রাস্তার সাথে মিশছি, এবং সেই রাস্তায় গাড়ি যাচ্ছে। এখনো।

অল্প পরেই গরুমারার সাইনপোস্ট চোখে পড়লো - বুঝলাম প্রায় এসে গেছি। ম্যাপও বলছে আর মাত্র কয়েক কিলোমিটার। অবশেষে, ঘড়িতে তখন বাজে সাড়ে এগারোটা - টিলাবাড়ি টুরিস্ট কমপ্লেক্সের অফিস বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়ালাম। ভিতরে তখনো দু তিনজন রয়েছে - আমাদের জন্যেই বসে আছে রাত্তির সাড়ে এগারোটায়।

গাড়ি থেকে নামতেই পা-টা টলে গেলো। সামলে দাঁড়াতেই বুঝতে পারলাম এতক্ষণের টেনশন ঠিক কতটা ছিলো, আর এতক্ষণ - মানে সেই ভোর পৌনে পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা - মাঝে বড়জোর আধ ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ব্রেক - মানে প্রায় একটানা আঠারো ঘন্টা একই ভাবে গাড়ি চালানোর ফল কীভাবে মাথায় জানান দিচ্ছে...তখনও মাথাটা দুলছে বেশ বুঝতে পারছি, মনে হচ্ছে একটা লাগাতার মোশনের মধ্যে রয়েছি...তখনও মনে হচ্ছে চলছি যেন...একা কি আমারই মনে হচ্ছে? সুমনা জানালো ওরও এই মোশনের অনুভূতিটা হচ্ছে। এর ওপরে আমি তখন চোখে হলুদ ফ্ল্যাশ দেখছি - সারা সন্ধ্যে উল্টোদিকের গাড়ির আলো চোখে পড়ার এফেক্ট - লিটারেলি সর্ষেফুল দেখা যাকে বলে।

চেকইন করে ঘরে পৌঁছতেই খাবার দিয়ে গেলো - রুটি, আলুভাজা, কপির তরকারি। ক্ষিদেও পেয়েছিলো - গোগ্রাসে খেলাম। তারপরে বিছানায় বডি ফেলতেই সেদিনের মত ব্ল্যাক আউট।

(চলবে)

[পরে শুনেছি, গাজলডোবার পরে জঙ্গলের মধ্যে ওই রাস্তাতেও একসময় ছিনতাই লেগে থাকতো। ইদানীং অনেকে বলছেন যে সেটা কমে গেছে। তবু, বেশি রাতের দিকে ওই পথে না যাওয়াই ভালো। বরং ফালাকাটা-ময়নাগুড়ি হয়ে যেতে পারেন, বা সেবক-মালবাজার-চালসা হয়েও।]


(আগের কথা)