Monday, March 26, 2007

মড়ার ওপর বসে

শ্মশানে চোদ্দটা মড়া, সেগুলোর ওপরে বসে জনাকয়েক তান্ত্রিক - হাতে মদের ভাঁড়, মড়াগুলোর চারদিকে ঘুরে ঘুরে নেচে বেড়ায় নন্দী-ভৃঙ্গি-ডাকিনী-যোগিনীরা - ঠিক এটাই গত কয়েকদিনের ইতিহাস৷ ১৪ই মার্চের নন্দীগ্রাম, ও অত:পর...

কি হয়েছিলো, কতজন পুলিশ ছিলো, কতজন গ্রামবাসী ছিলো, কজন মরেছে, কজন ঘায়েল, কজন নিখোঁজ - এসবের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব হাতুড়ি দিয়ে দিয়ে মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে আমাদের সেনসেশনাল মিডিয়া৷ অন্যদিকে গলা ফাটিয়ে শোনা গেছে গত আড়াই মাসের কাহিনী - ক'জন ঘরছাড়া, ক'জন ধর্ষিতা, ক'জন...আর একইসময় ওই মড়াগুলোর চারদিকে ঘুরতে দেখেছি আরো এক শ্রেণীর প্রাণীকে - দেখে মনে হয়েছে তারা অপেক্ষা করছে মড়াগুলো কখন গলতে শুরু করবে সেই জন্যে...অনেকগুলো মড়া...বিরাট ভোজ...

ঘটনার অল্পক্ষণ পরেই সিপিএম পলিটব্যুরো থেকে বিবৃতি দেওয়া হয় - "For two and a half months five gram panchayats in Block I of Nandigram have been out of bounds for the administration. Certain elements had resorted to violence and cut off roads and bridges in the area on the pretext of land acquisition.CPI(M) members and supporters were driven out of the area. Two thousand and five hundred people were driven out of the area. More than a thousand people are sheltering in relief camps outside the area. Even after the government categorically declared that no land is being acquired in Nandigram, the Trinamul, naxalite and other elements refused to allow the administration or police into the area. Those who did not go along with their disruptive activities were targeted. Only a few days ago a woman, Sumita Mandal, was raped and killed. The repeated efforts to have meetings so that peace can be resorted were rebuffed with these parties and elements refusing to attend the meetings. Finally, after an all-Party meeting, which was boycotted by the Trinamul Congress, a decision was taken that the administration must reestablish its authority and peace be resorted in the area. The police entered Nandigram to see that the roads, culverts and bridges are repaired and the administration restored. They were attacked by brickbatting, bombs and use of pipe guns. It is regrettable that lives have been lost in police firing. But the organised elements who utilised bombs and pipe guns on the police have to take the blame."

১৯৪৮-এও সেটা ছিলো বসন্তকাল৷ সেই মার্চমাস৷ সেই বাংলা, শুধু একটা দলের জায়গাটা উল্টে গেছে - receiving end-এ আর নয়৷ হাসি আর তাতা যখন ছোট ছোট হাতে রক্ত মোছে তখন রাজর্ষি আর বলেন না "আয় মা, আমিও মুছি" - বরং যুক্তি দেন কেন এই রক্তপাত - তিরিশ বছরটা অনেক সময় de-humanize হওয়ার জন্যে৷ অন্ধকারে পুলিশের বুটের আওয়াজের আড়ালে একটা সময় আরেকদল গুণ্ডা আসতো এলাকা দখল করতে - সেই সব দিনগুলোর কথা যখন আমি খুবই ছোট - শোনা কথা, পড়া কথা৷ তিরিশ বছর পর সেই দিনগুলোই ফিরিয়ে আনলাম? আজ আমার হাতেও রক্ত লাগলো?

এই প্রশ্নগুলো উঠতে উঠতেই চোখে পড়ে যায় ওই অন্য প্রাণীগুলোকে...চোদ্দটা মড়া ভোজসভায় কম পড়বে? তাই সংখ্যা বাড়তে শুরু করে...বিশ...চল্লিশ...একশো...দুশো...নিলামের দরের মতন৷ অবজেক্টিভিটিহীন "তথাকথিত" আঁখো-দেখা হাল চলতে থাকে - "পাশেই হরিপুর সাবডিভিশন যেটা নিউক্লিয়ার পাওয়ারপ্ল্যান্টের জন্যে চিহ্নিত৷ সেখানেও প্রতিবাদ হয়েছে৷ সেখানকার মানুষ মূলত: মাছ ধরে৷ তাদের মাছ ধরা এখন বন্ধ করতে হয়েছে দুটো কারণে৷ এক, খাঁড়ি আর সমুদ্র মৃতদেহে ভরে আছে৷ আর দুই, আরও খারাপ যেটা, হাঙর, কুমীর আর ঘড়িয়ালরা তাজা রক্তের লোভে সুন্দরবন থেকে এইদিকে চলে আসছে..."

হাঙর-কুমীর নয়, আমি স্পষ্ট দেখতে পাই ভোজসভায় যাতে মড়ার সংখ্যা কম না পড়ে, তার চেষ্টা...সজ্ঞানে৷

আর তার পর একটা তুমুল মেরুকরণ৷ জর্জ বুশের তত্ত্বটা যে আমাদের মধ্যে কতটা খাটে টের পেলাম৷ দুদিকেই দেখতে পাই তার ছাপ - "ইফ ইউ আর নট উইথ আস, ইউ আর এগেইনস্ট আস" - স্বাভাবিকভাবে জেগে ওঠা কিছু প্রশ্ন করলে বা জালিয়ানওয়ালাবাগ অথবা জেনারেল ডায়ারের সাথে তুলনাকে বাড়াবাড়ি বললে আপনি সিপিএমের দালাল, আর অন্যদিকে পুলিশি বাড়াবাড়ি, বা লাগামছাড়া কর্মীদের ইনভলভমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন করলে আপনি মাওবাদী বা তৃণমূল৷

এক বন্ধু বললো - মড়ার ওপর বসে তর্ক হয় না - তাই চুপ থাকতে চাইলাম - অন্তত বসন্তের এই দিনটা যাদের শেষ বসন্তের দিন হল, তারা একটু শান্তিতে থাক, একটু সম্মান পাক শেষ বসন্তের দিনটাতে৷ কিন্তু প্রশ্ন বন্ধ হয় না মনের মধ্যে - বিশেষ করে যখন দেখি শোকমিছিলের আড়ালে অঙ্ক কষা চলে - যখন দেখি গুজব ছড়ায়, যার কোন প্রমাণ হয়তো নেই - কবর খুঁড়ে আরেকটা নাম মনে আসে৷ স্বাভাবিক প্রশ্ন করলে উত্তর আসে - "মার শালাকে, ওটা কে? শালা দালাল, সব গুলিয়ে দিতে এসেছে"৷ শিউড়ে উঠি যখন দেখি নিহত অথবা ঘাতকদের পরিচয়ের ভিত্তিতে স্থির হয় এটা গণহত্যা না গণআন্দোলন - নন্দীগ্রামের ঘটনা যাঁদের কাছে গণহত্যা, তাঁদের অনেকের কাছেই হয়তো ওই একই সময়ে ছত্তিশগড়ের ঘটনা গণআন্দোলন...বা সিপিএম কর্মীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা হল মানুষের প্রতিবাদের নমুনা...

শ্মশানে মড়ার ওপর বসে আমরা তান্ত্রিকেরা হাতে মদের ভাঁড় নিয়ে নন্দী-ভৃঙ্গির নাচ দেখি...ক্লেম-কাউন্টার ক্লেমের খেলা চলতে থাকে৷

ক্রমশ সাতটা দিন পেরোয়...

ব্যাকড্রপে আর শ্মশান নেই - ব্যাকড্রপে ওয়াইড স্ক্রীনে ত্রিনিদাদের মাঠ, ভারত-শ্রীলঙ্কার খেলা৷ মড়ার ওপর বসে নেই, বসে নরম গদির ওপর৷ হাতে মদের ভাঁড় নয়, শ্যাম্পেনের পেয়ালা৷ তান্ত্রিক থেকে উত্তোরণ হয় ক্রিকেট-বোদ্ধায়৷

আমাদের সকলের৷

(মূল লেখা এখানে। গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতার নিরিখে এই লেখাটি তৈরী। বেশ কিছু শব্দ আর দৃশ্যকল্পের জন্য ঋণস্বীকার - বৈজয়ন্ত, ইন্দ্রাণী, দুর্গা, অঙ্গনা - এঁদের কাছে)

1 comment:

Anonymous said...

Darun kobita pore,sotti bhalo laglo,
Thanks