সব পেয়েছির দেশে - অল্প কিছুদিন
==================
দিল্লী ছাড়ার পরের ঠিকানা সিলভার স্প্রিং, মেরিল্যান্ড। ডিসেম্বরের শেষ, চারদিক সাদা, এবং ক্রিসমাসের ছুটির ঠিক আগে। ডাউনটাউন সিলভার স্প্রিং-এর একটা মোটেলে থেকে প্রথম দু তিনদিন অফিস, তারই মধ্যে অফিসের মাইল চারেকের মধ্যে একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকার ব্যবস্থা হল। কিন্তু ভালো লাগতো না। চতুর্দিক সাদা, কনকনে ঠান্ডা, চেনা লোক একটাও নেই, কথা বলার কেউ নেই - অফিসে টুকটাক কথা ছাড়া। বাড়িতে তখনও কিছুই নেই - কাছের একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কেনা দুটো কমফর্টার আর দুটো ছোট টেবিলল্যাম্প ছাড়া। বাড়ি ফিরে সন্ধ্যেবেলা দুজন ভুতের মতন বসে থাকতাম ওই অল্প আলোয়। সময় কাটানোর সম্বল বললে মার্কেজের তিনটে বই। প্রথম পনেরোদিনের চেকটা হাতে পেয়ে একটা টিভি আর টেপ-কাম-রেডিও কিনে অল্প একটু স্বস্তি। তাও একা লাগতো - দুজন হয়েও। দম বন্ধ করা একা।
অভ্যেস হতে শুরু করলো। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আধ মাইল দূরে বাসের জন্যে দাঁড়াতাম, কখনো কয়েক মিনিট, কখনো আধ ঘন্টাও। ফেরার সময় অফিসের পিছনের রাস্তায় ঘন্টাখানেকও দাঁড়িয়েছি একটা বাস মিস্ করার পর। এদিক ওদিক চেনাপরিচিতদের মাধ্যমে যোগাযোগ হল শ্যামলদার সঙ্গে - প্রাক্তন বিই কলেজ, সেই সুত্রে দিদি-জামাইবাবুদের সাথে প্রচন্ডই আলাপ এবং দারুন সম্পর্ক - সেই সুত্রে আমাদের সঙ্গেও সম্পর্কটা শুরু হয়ে গেলো। নিজেই আমাদের ওই ভুতের অ্যাপার্টমেন্টে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন ওঁর বাড়িতে, তার পরে ওয়াশিংটন ডিসি এলাকার সংস্কৃতির সরস্বতী পুজোয়। গাড়ি একটা খুব দরকার - চারপেয়ে বাহন ছাড়া ওই মুল্লুকে জীবন অচল - শ্যামলদা নিজেই বিভিন্ন শোরুমে নিয়ে গেলেন - গাড়িও একটা কেনা হল। আরো কিছুটা স্বস্তি। বাজার টাজার ঠিকঠাক করা যাবে, এদিক ওদিক যাওয়াও যাবে। তার আগে অবধি তো ঘরে বন্দী, বাজার করে ফেরা মানে দুজনের হাতে পেল্লায় চার পাঁচটা ব্যাগ নিয়ে কোনো রকমে আড়াই মাইল হেঁটে বাড়ি ফেরা...
ওদেশে থাকতে থাকতে একটা অভ্যেস ভালো রপ্ত হয়েছিলো - গাড়ি নিয়ে দূর দূরে ঘুরে বেড়ানো। সে অবশ্য সিলভার স্প্রিং-এর আগেই। দিল্লী থেকে কাজের সুত্রে যেতাম কলোরাডো - বাহন ছাড়া সেখানেও জীবন অচল। কিন্তু কাজের সুত্রে যাওয়ার ফলে অফিস থেকে রেন্টাল গাড়ি দিত। ওই কলোরাডোতে থাকতে থাকতেই গাড়ি চালানো শিখেছিলাম - আর তখন থেকেই আলপটকা দূরে দূরে ঘুরতে যাওয়ার অভ্যেসটাও গায়ে লেগে গেছিলো। লাইসেন্স পাওয়ার অল্প কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় সাড়ে আটশো মাইল দূরে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে ঘুরতে চলে গেছিলাম আমি আর শ্রীকৃষ্ণ (তখনকার কলীগ)। তারপর আরো দু তিনজন মিলে প্রায় এগারোশো মাইল দূরে লস এঞ্জেলস। এই নেশার শুরু তখনই।
মেরিল্যান্ডেও যখন ভালো লাগতো না, এটাই ছিলো ওষুধ। কখনো স্মোকি মাউন্টেন, কখনো ভার্জিনিয়া বীচ বা অ্যাটলান্টিক সিটি, কখনো শেনানডোয়া ন্যাশনাল ফরেস্ট, কখনো নায়াগ্রা। হাতের কাছে পোটোম্যাকের ওপর মেরিল্যান্ড আর ভার্জিনিয়ার বর্ডারে গ্রেট ফল্স তো ছিলোই।
অভ্যেস হতে থাকলো, কিন্তু ভালো লাগলো না। এখনও খুব একটা ভালো স্মৃতি খুঁজে পাই না - শুধু অল্প কিছু ছাড়া। এক এই গাড়ি নিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় বেড়িয়ে পড়া, আর অন্যটা ঋক। মেরিল্যান্ডে থাকতে থাকতেই ঋক আসার খবর জানান দিলো। ততদিনে সিলভার স্প্রিং-এর অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে আমরা গেথার্সবার্গে চলে গেছি - সুমনার অফিস থেকে কাছে হত বলে।
ওদিকে ততদিনে ডট কম বাব্ল ফেটে গেছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে অস্বাভাবিক ডিপ্রেসিং অবস্থা। যে জন্যে গেছিলাম - যে চাকরি করতে করতে পড়াশোনাটা এগিয়ে নিয়ে যাবো আরেকটু - সেই রাস্তাও হতাশাজনকভাবে বন্ধই। কারণ চাকরির বাজার পড়তে শুরু করে মোটামুটি ২০০১-এর শুরুর দিক থেকেই। তার ওপর এলো ২০০১-এর ১১ই সেপ্টেম্বর।
সেদিন আমি যেমন সময়ে অফিস যাই, তেমন সময়েই গেছি। অভ্যাসমত কম্পিউটারে সিএনএন খুলেছি। খোলার সাথে সাথেই চোখে পড়লো টুইন টাওয়ারের জ্বলন্ত ছবি। অফিসে তখন সকলে এখানে ওখানে আলোচনায় ব্যস্ত। এর মধ্যে খবর এলো পেন্টাগনের। মোবাইল নেটওয়ার্ক জ্যামড। বাড়িতে খবর দেওয়ার উপায় নেই। অফিস বন্ধ করে দেওয়া হল - কারণ সিলভার স্প্রিং-এর ভেরাইজনের অফিসটা ডিসি থেকে খুব দূরে নয়। গাড়ি নিয়ে যখন ওয়াশিংটন বেল্টওয়েতে পড়ি তখন সেখানে মাইলের পর মাইল লম্বা শুধু গাড়ির লাইন - সকলে ব্যস্ত হয়ে বাড়ির পথে বেরোয়েছে। আর আকাশে চক্কর দিচ্ছে কয়েকটা ফাইটার। সবকিছু আরো পাল্টে গেলো সেদিনের পর।
গেথার্সবার্গের অ্যাপার্টমেন্টে একদিন বিকেলে কমকাস্টের লোকের আসার কথা ছিলো কেবল কানেকশনের জন্যে। অভ্যাসমত আমি বাড়িতে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে। লোকটি আমার দিকে বার দুয়েক দেখে প্রশ্ন করলো - "আর ইউ আ মোসলেম?" সাধারণ লোকের চোখে অবিশ্বাস দেখার শুরু সেদিন। লেক ফরেস্ট মল-এ বইয়ের দোকানে উইলিয়াম শিরারের "রাইজ অ্যাণ্ড ফল অব দ্য থার্ড রাইখ" কিনে কাউন্টারে দাম দেওয়ার সময়ও দেখলাম কাউন্টারের মেয়েটি বারকয়েক মেপে নিলো। অফিসের সিকিউরিটি গার্ডরা তো দিনে বার দশেক কার্ড চেক করতোই - বছর দেড়েক রোজ সামনে দিয়ে ঢুকতে বেরোতে দেখার পরেও। সুমনার অফিসের ভারতীয় মালিক একদিন ওকে বললেন পারলে চুড়িদার অ্যাভয়েড করতে আর একটা টিপ পরতে - সে অবশ্য ভালো মনেই - কারণ অবস্থাটা উনিও জানতেন।
মনটা কোনোদিন বসেওনি, আর এর পর তো একেবারেই উড়ে গেলো। চাকরি বদলানোর আশা নেই, কাজেই চাকরি করতে করতে পড়াশোনা করার আশাও নেই। জিআরই স্কোর ছিলো, কিন্তু চাকরি ছেড়ে পুরো সময়ের পড়াশোনাটা অর্থনৈতিকভাবে বেশি রিস্ক মনে হল। অন্য উপায় খুঁজতে শুরু করলাম - অন্য কোথাও, অন্য দেশে। হতাশ লাগতো - বিশেষ করে দুটো ভালো সুযোগ ছেড়ে এদেশে আসায়। একটা ছিলো নোকিয়া ফিনল্যান্ডে পাকা চাকরি - অন্যটা কমনওয়েল্থ স্কলারশিপ। দ্বিতীয়টার জন্যে বেশি হতাশ লাগতো - পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের সৌজন্যে চিঠিটা এসে পৌঁছেছিলো ডেডলাইনের দেড় মাস পর, ততদিনে কিছু জানতে না পেরে হয়নি ধরে নিয়ে আমেরিকার অফারটা অ্যাকসেপ্ট করে চলে এসেছিলাম।
খুঁজতে খুঁজতে সুযোগও এলো - অন্য দেশে। ইন্টারভিউ দিলাম, পেয়েও গেলাম। তার কিছুদিন পরেই ঋক জন্মালো ট্যাকোমা পার্কের এক হাসপাতালে। ঋকের তিন মাস বয়স হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হল - নয়তো অত ছোট একটা পুঁটলি নিয়ে অত দূর ট্র্যাভেল করা অসুবিধার। এর মধ্যে ভেরাইজনও আমি চলে যাবো জানতে পেরে নানা রকম অফার দিতে শুরু করলো - কিন্তু লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হত যতই অফার দিক, সব পেয়েছির দেশের প্রেশার আমার জন্যে নয় - চোখের সামনে এক এক দিন এক এক জন নতুন কিউব-মেট দেখার প্রেশার বড্ড বেশি আমার মত ছাপোষা লোকের পক্ষে। ও দেশটাও আমার জন্যে নয়।
২০০২-এর মে মাসে আবার বাক্সো-প্যাঁটরা গুছিয়ে রওনা দিলাম অন্য দেশের দিকে। লন্ডনে প্লেন নামার পর ঋককে একবার কোলে নিয়ে আদর করে আমি চলে গেলাম ডোমেস্টিক টার্মিনালের দিকে - সেখান থেকে যাবো উত্তর ইংল্যান্ডে নিউক্যাসল আপন টাইন বলে শিল্পবিপ্লবের সময়কার এক শহরে। ঋক আর সুমনা ফিরবে কলকাতায় - কিছুদিনের জন্যে। নিউক্যাসলে বাড়িঘরের ব্যবস্থা করে ওদের নিয়ে আসবো।
==================
দিল্লী ছাড়ার পরের ঠিকানা সিলভার স্প্রিং, মেরিল্যান্ড। ডিসেম্বরের শেষ, চারদিক সাদা, এবং ক্রিসমাসের ছুটির ঠিক আগে। ডাউনটাউন সিলভার স্প্রিং-এর একটা মোটেলে থেকে প্রথম দু তিনদিন অফিস, তারই মধ্যে অফিসের মাইল চারেকের মধ্যে একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকার ব্যবস্থা হল। কিন্তু ভালো লাগতো না। চতুর্দিক সাদা, কনকনে ঠান্ডা, চেনা লোক একটাও নেই, কথা বলার কেউ নেই - অফিসে টুকটাক কথা ছাড়া। বাড়িতে তখনও কিছুই নেই - কাছের একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কেনা দুটো কমফর্টার আর দুটো ছোট টেবিলল্যাম্প ছাড়া। বাড়ি ফিরে সন্ধ্যেবেলা দুজন ভুতের মতন বসে থাকতাম ওই অল্প আলোয়। সময় কাটানোর সম্বল বললে মার্কেজের তিনটে বই। প্রথম পনেরোদিনের চেকটা হাতে পেয়ে একটা টিভি আর টেপ-কাম-রেডিও কিনে অল্প একটু স্বস্তি। তাও একা লাগতো - দুজন হয়েও। দম বন্ধ করা একা।
অভ্যেস হতে শুরু করলো। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আধ মাইল দূরে বাসের জন্যে দাঁড়াতাম, কখনো কয়েক মিনিট, কখনো আধ ঘন্টাও। ফেরার সময় অফিসের পিছনের রাস্তায় ঘন্টাখানেকও দাঁড়িয়েছি একটা বাস মিস্ করার পর। এদিক ওদিক চেনাপরিচিতদের মাধ্যমে যোগাযোগ হল শ্যামলদার সঙ্গে - প্রাক্তন বিই কলেজ, সেই সুত্রে দিদি-জামাইবাবুদের সাথে প্রচন্ডই আলাপ এবং দারুন সম্পর্ক - সেই সুত্রে আমাদের সঙ্গেও সম্পর্কটা শুরু হয়ে গেলো। নিজেই আমাদের ওই ভুতের অ্যাপার্টমেন্টে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন ওঁর বাড়িতে, তার পরে ওয়াশিংটন ডিসি এলাকার সংস্কৃতির সরস্বতী পুজোয়। গাড়ি একটা খুব দরকার - চারপেয়ে বাহন ছাড়া ওই মুল্লুকে জীবন অচল - শ্যামলদা নিজেই বিভিন্ন শোরুমে নিয়ে গেলেন - গাড়িও একটা কেনা হল। আরো কিছুটা স্বস্তি। বাজার টাজার ঠিকঠাক করা যাবে, এদিক ওদিক যাওয়াও যাবে। তার আগে অবধি তো ঘরে বন্দী, বাজার করে ফেরা মানে দুজনের হাতে পেল্লায় চার পাঁচটা ব্যাগ নিয়ে কোনো রকমে আড়াই মাইল হেঁটে বাড়ি ফেরা...
ওদেশে থাকতে থাকতে একটা অভ্যেস ভালো রপ্ত হয়েছিলো - গাড়ি নিয়ে দূর দূরে ঘুরে বেড়ানো। সে অবশ্য সিলভার স্প্রিং-এর আগেই। দিল্লী থেকে কাজের সুত্রে যেতাম কলোরাডো - বাহন ছাড়া সেখানেও জীবন অচল। কিন্তু কাজের সুত্রে যাওয়ার ফলে অফিস থেকে রেন্টাল গাড়ি দিত। ওই কলোরাডোতে থাকতে থাকতেই গাড়ি চালানো শিখেছিলাম - আর তখন থেকেই আলপটকা দূরে দূরে ঘুরতে যাওয়ার অভ্যেসটাও গায়ে লেগে গেছিলো। লাইসেন্স পাওয়ার অল্প কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় সাড়ে আটশো মাইল দূরে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে ঘুরতে চলে গেছিলাম আমি আর শ্রীকৃষ্ণ (তখনকার কলীগ)। তারপর আরো দু তিনজন মিলে প্রায় এগারোশো মাইল দূরে লস এঞ্জেলস। এই নেশার শুরু তখনই।
মেরিল্যান্ডেও যখন ভালো লাগতো না, এটাই ছিলো ওষুধ। কখনো স্মোকি মাউন্টেন, কখনো ভার্জিনিয়া বীচ বা অ্যাটলান্টিক সিটি, কখনো শেনানডোয়া ন্যাশনাল ফরেস্ট, কখনো নায়াগ্রা। হাতের কাছে পোটোম্যাকের ওপর মেরিল্যান্ড আর ভার্জিনিয়ার বর্ডারে গ্রেট ফল্স তো ছিলোই।
অভ্যেস হতে থাকলো, কিন্তু ভালো লাগলো না। এখনও খুব একটা ভালো স্মৃতি খুঁজে পাই না - শুধু অল্প কিছু ছাড়া। এক এই গাড়ি নিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় বেড়িয়ে পড়া, আর অন্যটা ঋক। মেরিল্যান্ডে থাকতে থাকতেই ঋক আসার খবর জানান দিলো। ততদিনে সিলভার স্প্রিং-এর অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে আমরা গেথার্সবার্গে চলে গেছি - সুমনার অফিস থেকে কাছে হত বলে।
ওদিকে ততদিনে ডট কম বাব্ল ফেটে গেছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে অস্বাভাবিক ডিপ্রেসিং অবস্থা। যে জন্যে গেছিলাম - যে চাকরি করতে করতে পড়াশোনাটা এগিয়ে নিয়ে যাবো আরেকটু - সেই রাস্তাও হতাশাজনকভাবে বন্ধই। কারণ চাকরির বাজার পড়তে শুরু করে মোটামুটি ২০০১-এর শুরুর দিক থেকেই। তার ওপর এলো ২০০১-এর ১১ই সেপ্টেম্বর।
সেদিন আমি যেমন সময়ে অফিস যাই, তেমন সময়েই গেছি। অভ্যাসমত কম্পিউটারে সিএনএন খুলেছি। খোলার সাথে সাথেই চোখে পড়লো টুইন টাওয়ারের জ্বলন্ত ছবি। অফিসে তখন সকলে এখানে ওখানে আলোচনায় ব্যস্ত। এর মধ্যে খবর এলো পেন্টাগনের। মোবাইল নেটওয়ার্ক জ্যামড। বাড়িতে খবর দেওয়ার উপায় নেই। অফিস বন্ধ করে দেওয়া হল - কারণ সিলভার স্প্রিং-এর ভেরাইজনের অফিসটা ডিসি থেকে খুব দূরে নয়। গাড়ি নিয়ে যখন ওয়াশিংটন বেল্টওয়েতে পড়ি তখন সেখানে মাইলের পর মাইল লম্বা শুধু গাড়ির লাইন - সকলে ব্যস্ত হয়ে বাড়ির পথে বেরোয়েছে। আর আকাশে চক্কর দিচ্ছে কয়েকটা ফাইটার। সবকিছু আরো পাল্টে গেলো সেদিনের পর।
গেথার্সবার্গের অ্যাপার্টমেন্টে একদিন বিকেলে কমকাস্টের লোকের আসার কথা ছিলো কেবল কানেকশনের জন্যে। অভ্যাসমত আমি বাড়িতে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে। লোকটি আমার দিকে বার দুয়েক দেখে প্রশ্ন করলো - "আর ইউ আ মোসলেম?" সাধারণ লোকের চোখে অবিশ্বাস দেখার শুরু সেদিন। লেক ফরেস্ট মল-এ বইয়ের দোকানে উইলিয়াম শিরারের "রাইজ অ্যাণ্ড ফল অব দ্য থার্ড রাইখ" কিনে কাউন্টারে দাম দেওয়ার সময়ও দেখলাম কাউন্টারের মেয়েটি বারকয়েক মেপে নিলো। অফিসের সিকিউরিটি গার্ডরা তো দিনে বার দশেক কার্ড চেক করতোই - বছর দেড়েক রোজ সামনে দিয়ে ঢুকতে বেরোতে দেখার পরেও। সুমনার অফিসের ভারতীয় মালিক একদিন ওকে বললেন পারলে চুড়িদার অ্যাভয়েড করতে আর একটা টিপ পরতে - সে অবশ্য ভালো মনেই - কারণ অবস্থাটা উনিও জানতেন।
মনটা কোনোদিন বসেওনি, আর এর পর তো একেবারেই উড়ে গেলো। চাকরি বদলানোর আশা নেই, কাজেই চাকরি করতে করতে পড়াশোনা করার আশাও নেই। জিআরই স্কোর ছিলো, কিন্তু চাকরি ছেড়ে পুরো সময়ের পড়াশোনাটা অর্থনৈতিকভাবে বেশি রিস্ক মনে হল। অন্য উপায় খুঁজতে শুরু করলাম - অন্য কোথাও, অন্য দেশে। হতাশ লাগতো - বিশেষ করে দুটো ভালো সুযোগ ছেড়ে এদেশে আসায়। একটা ছিলো নোকিয়া ফিনল্যান্ডে পাকা চাকরি - অন্যটা কমনওয়েল্থ স্কলারশিপ। দ্বিতীয়টার জন্যে বেশি হতাশ লাগতো - পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের সৌজন্যে চিঠিটা এসে পৌঁছেছিলো ডেডলাইনের দেড় মাস পর, ততদিনে কিছু জানতে না পেরে হয়নি ধরে নিয়ে আমেরিকার অফারটা অ্যাকসেপ্ট করে চলে এসেছিলাম।
খুঁজতে খুঁজতে সুযোগও এলো - অন্য দেশে। ইন্টারভিউ দিলাম, পেয়েও গেলাম। তার কিছুদিন পরেই ঋক জন্মালো ট্যাকোমা পার্কের এক হাসপাতালে। ঋকের তিন মাস বয়স হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হল - নয়তো অত ছোট একটা পুঁটলি নিয়ে অত দূর ট্র্যাভেল করা অসুবিধার। এর মধ্যে ভেরাইজনও আমি চলে যাবো জানতে পেরে নানা রকম অফার দিতে শুরু করলো - কিন্তু লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হত যতই অফার দিক, সব পেয়েছির দেশের প্রেশার আমার জন্যে নয় - চোখের সামনে এক এক দিন এক এক জন নতুন কিউব-মেট দেখার প্রেশার বড্ড বেশি আমার মত ছাপোষা লোকের পক্ষে। ও দেশটাও আমার জন্যে নয়।
২০০২-এর মে মাসে আবার বাক্সো-প্যাঁটরা গুছিয়ে রওনা দিলাম অন্য দেশের দিকে। লন্ডনে প্লেন নামার পর ঋককে একবার কোলে নিয়ে আদর করে আমি চলে গেলাম ডোমেস্টিক টার্মিনালের দিকে - সেখান থেকে যাবো উত্তর ইংল্যান্ডে নিউক্যাসল আপন টাইন বলে শিল্পবিপ্লবের সময়কার এক শহরে। ঋক আর সুমনা ফিরবে কলকাতায় - কিছুদিনের জন্যে। নিউক্যাসলে বাড়িঘরের ব্যবস্থা করে ওদের নিয়ে আসবো।
No comments:
Post a Comment