Friday, May 11, 2012

শহর থেকে শহরে - ১১

সেন্ট জেমস-এর ইতিকথা
============

তখন মেরিল্যান্ডে ভেরাইজনে চাকরি করি - বলা ভালো বেগার খাটি, আর পালানোর কথা ভাবি। অবাক লাগে, তাই না? যে দেশে সবাই আসতে চায়, যে দেশকে সবাই "সব পেয়েছির দেশ" বলে জানে, সেখান থেকে পালানোর কথা ভাবে - এ লোকটা কে রে!!! থেকে বুঝছিলাম সে দেশটা আমার জন্যে নয়। শুধু পয়সার বাইরে যদি জীবন খোঁজেন, সে দেশ আপনারও হয়তো ভালো লাগবে না। দেশটা সব পেয়েছির দেশ হলেও। আমারও অসহ্য লাগতো, বিশেষ করে প্রতিদিনের চিন্তা - কাল আমার কিউবমেটের হাতে গোলাপী কাগজ ধরিয়েছে, আজ আমাকেও দেবে না তো? প্রোজেক্টে পয়সা নেই, সুতরাং তোমার দামও নেই, দাম শুধু ওপরতলার ম্যানেজার-ভাইসপ্রেসিডেন্টদের - ওদের প্রাইভেট জেট কখনো বন্ধ হয় না। আজ প্রোজেক্টে পয়সা নেই, তুমি যাও ভাই, আগের সপ্তাহে সেরা কর্মী হয়ে থাকলেও...তার ওপর সদ্য ঘটা ৯/১১...বিদেশীদের দিকে সন্দেহের চোখ...দেড় বছরের চেনা সিকিউরিটি গার্ড তখন রোজ খুঁটিয়ে আইডেন্টিটি কার্ড দেখে আগের দেড় বছর ধরে প্রতিদিন আমাদের দেখেও...এ দেশ ছেড়ে যাওয়াই ভালো।

একদিন নিউক্যাসলে এলাম ইন্টারভিউ দিতে, ইউনিভার্সিটিতে, রিসার্চের কাজ। সেদিন চোখ টানেনি শহরটা, কেমন যেন বিষন্ন, মেঘে ঢাকা, স্যাঁতস্যাঁতে...ইউনিভার্সিটির বাড়িটা অনেকটা বিই কলেজের মতন...জমে থাকা ধুলো, নোংরা...কোথায় ভেরাইজনের ঝাঁ-চকচকে অফিসবাড়ি...কোথায় গেথার্সবারের্গ ঝাঁ-চকচকে লেক ফরেস্ট মল...

কিন্তু চলে এলাম, মাস কয়েকের মধ্যে আমেরিকার পাততাড়ি গুটিয়ে...শুরুর ঠিকানা উইন্ডসর টেরাসের এক কামরার শেয়ার্ড অ্যাকোমোডেশন। ততদিনে দুজন থেকে তিনজন হয়েছি, সুমনা আর ছোট্ট ঋক গেছে কলকাতায়, যে প্লেনে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে লন্ডন এসেছি, সেই প্লেনেই। আমি একা এসেছি নিউক্যাসলে। মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হলে ওরা আসবে। কয়েকমাস পর নতুন ঠিকানা হল ওয়ারউইক স্ট্রীট, কলকাতা থেকে নিয়ে এলাম ওদের, সুমনা স্কট উইলসনে চাকরি পেয়ে গেলো। দেখতে দেখতে দিন কাটতে লাগলো, ওয়ারউইক স্ট্রীট থেকে হেল্মস্লে রোড, ঋক এখন চার পেরিয়েছে, আর আমি নিউক্যাসল ইউনাইটেডের ভক্ত হয়ে গেছি। এই শহরটার কথাই লিখবো এবার।

রোমান আমলে তৈরী শহর, রোমান সম্রাট হেড্রিয়ানের তৈরী হেড্রিয়ান্‌স ওয়ালের ধ্বংসাবশেষ এখনও আছে। রোমানরা চলে যাওয়ার পর এর নাম হয় মঙ্কচেস্টার, শক্তিশালী অ্যাংলো-স্যাক্সন রাজার রাজত্বের অংশ। পর পর যুদ্ধবিগ্রহে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া মঙ্কচেস্টারের বুকের ওপর রবার্ট কার্থোজের আমলে তৈরী হয় নোভাম ক্যাস্টেলাম - বা - নিউক্যাসল। শিল্পবিপ্লবের সময় মাথা তোলে নিউক্যাসল - আশে পাশে অপর্যাপ্ত কয়লার যোগানের দৌলতে। ১৫৩৮ সাল থেকে চালু হয় প্রবাদ - ক্যারিয়িং কোল্‌স টু নিউক্যাসল - সেও এই কয়লাখনির দৌলতে। তৈরী হয় জাহাজের কারখানা, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প - এসবের জোরে নিউক্যাসল পাল্লা দিতে থাকে ম্যাঞ্চেস্টার আর লিভারপুলের সাথে। সে অনেকদিন আগের কথা।

তারপর টাইন নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, টাইনের কালো জলে নিউক্যাসলের সেদিনের স্বচ্ছতা ধুয়ে গেছে। শেষ কয়লাখনির দরজা বন্ধ হল কয়েকবছর আগে। জাহাজের কারখানা রুগ্ন, ইংল্যান্ডের ক্রমশঃ বাড়তে থাকা নর্থ-সাউথ ডিভাইডের কবলে পড়ে নিউক্যাসল আজ অক্সিজেনের অভাবে ধুঁকতে থাকা এক হাঁপানির রুগী - যার আরেকটি বার উঠে দাঁড়ানোর ইচ্ছের কোনো খামতি নেই - শুধু উঠে দাঁড়ানোর জন্যে সম্বল কিচ্ছু নেই। শিল্পের সম্বলহীন নিউক্যাসল কয়েক দশক ধরে আঁকড়ে রয়েছে শুধু একটা ফুটবল ক্লাবকে - নিউক্যাসল ইউনাইটেড...

শুধুমাত্র গত দুই তিন বছরে নতুন কিছু হচ্ছে এখানে - মিলেনিয়াম ব্রীজ, বল্টিক, নতুন করে সাজানো কী-সাইড, সায়েন্স সিটি...তাও জর্ডি-প্রাইড অবর্তিত হয় নিউক্যাসল ইউনাইটেডকে ঘিরে...

জর্ডি - মানে টাইন নদীর আশেপাশের মানুষজন...

নিউক্যাসল ইউনাইটেড এখানকার মানুষের কাছে শুধু একটা ফুটবল ক্লাব নয় - অনেক বেশি - গোটা অঞ্চলের উঠে দাঁড়ানোর হাতিয়ার। "The Geordie nation, that's what we are fighting for. London's the enemy! You exploit us, you use us." - নর্থ-সাউথ ডিভাইডের প্রত্যক্ষ ফসল, স্যার জন হল-এর ব্যবসাবুদ্ধির শুরু।

গার্ডিয়ান লেখে - Michael Martin, the editor of the True Faith fanzine, recalls his own Geordie blood stirring as Keegan's rejuvenated side galloped into the breakaway Premier League. "John Hall tapped into something latent, the pride and the apartness of the north-east. Newcastle was depressed; industries like mining and shipbuilding had been destroyed. We bought into the idea of the club as the flagship of revival."

স্যার জন হল শুধুমাত্র ব্যবসার খাতিরে জর্ডি-প্রাইডকে খুঁচিয়ে তুললেও এখানকার মানুষ কিন্তু নিউক্যাসল ইউনাইটেডকে আঁকড়ে থাকার অভ্যেস ছাড়তে পারেনি। উঠে যাওয়া জাহাজ কারখানার শ্রমিক, বন্ধ হয়ে যাওয়া খনির মজুর, রিটেল শপের কর্মী - এরাই দলটার নাছোরবান্দা সমর্থক - মাসমাইনের অর্ধেক দিয়ে খেলার টিকিট কাটে - প্রতি সপ্তাহে অন্তত পঞ্চাশ হাজার মানুষ ভিড় করে সেন্ট জেম্‌স পার্কে, মদের বোতল আর অবিশ্রান্ত বকর বকর করা ছাড়া এই এদের এন্টারটেইনমেন্ট। প্রতি সপ্তাহে এরা স্বপ্ন দেখে অ্যালান শিয়ারার, নবি সোলানো, শে গিভেনদের নিয়ে...মাঠের ভিতরে ডায়ার আর লী বোওইয়ার নিজেদের মধ্যে মারামারি করলে কান্নায় ভেঙে পড়ে এরা...প্রিমিয়ার লীগে দুই বা তিন থেকে পাঁচে নেমে গেলে ক্ষুব্ধ হয় এরা, আবার গ্রেম সোনেসের হাতে পড়ে তলানিতে ঠেকে গিয়ে গ্লেন রোডারের হাত ধরে তেরো নম্বর থেকে সাতে উঠে আসায় এরাই আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখে...

মায়া পড়ে যায়। এদের দেখতে দেখতে আমিও কবে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের সমর্থক হয়ে গেছি নিজেই জানি না। এখন আমিও প্রতি হপ্তায় রেডিওতে খেলা শুনতে শুনতে চেঁচাই, নিউক্যাসল ইউনাইটেড হেরে গেলে রাতের খাবারটা বিস্বাদ লাগে, পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে কফি খেতে খেতে এই নিয়েই কথা বলি...ব্লগে মোহনবাগানের পাশে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের লিংক রাখি...

চার বছরের ছেলেটা ফুটবল বোঝে না কিছুই, কিন্তু অ্যালান শিয়ারারকে একশোবার চেনে, চেয়েচিন্তে সাদাকালো জার্সি বাগিয়েছে - পিছনে শিয়ারারের নয় নম্বর আর নাম লেখা...ওই পরে ও নার্সারীতে শিয়ারার হয়। অ্যালান শিয়ারারের টেস্টিমোনিয়াল ম্যাচের দিন গোটা শহরটা যখন সাদা-কালো হয়ে ওঠে, আমিও নিউক্যাসল ইউনাইটেডের সাদা-কালো জামা পরি...

এই শহরে বেশিদিন থাকবো না। জানি। পড়াশোনাটা শেষ করে ফিরে যাবো সেই আমার পুরনো শহরে। কিন্তু এই শহরটার স্মৃতি থেকে যাবে - ওই সাদা-কালো জামাটার মধ্যে। কখনো এই শরটার সঙ্গে আবার দেখা হলে আমিই জিজ্ঞেস করবো - "how gadgie , ya'aalreet deein?"

পাকাপাকি প্রেমে মনে হয় এবারই পড়লাম।

1 comment:

রেজওয়ান said...

আমি আপনার এই সিরিজের লেখাগুলো পড়তে পারছি না। অখচ আগের পোস্টগুলো (ধরুন উপলব্ধি - ডিসে. ২০১০) পড়া যায়। আপনি কি ফন্ট ব্যবহার করেছেন এই সাম্প্রতিক পোস্টগুলোতে? ইউনিকোডে কনভার্ট করে দিলে ভাল হয়। ধন্যবাদ।