চিরকাল মা একটু গজগজ করতো - বাসরাস্তা
থেকে এত দূরে বাড়ি বলে। অথচ আমার কখনো খারাপ লাগেনি। বাসের আওয়াজ নেই,
গাড়ির প্যাঁ পোঁ হর্ন নেই, ধুলো নেই, ধোঁয়া নেই - গরমকালের দুপুরে বড়জোর
কাঁধে বাক্স ঝুলিয়ে রঙিন বরফ বিক্রি করা ফেরিওয়ালার ডাক - "আ-ই-স-কি-রি-ম"।
চব্বিশ বছর ওই নিশ্চুপ নিঃঝুম জায়গায় থেকে এমন অভ্যেস হয়ে গেছিলো যে একটু
বেশি কসমোপলিটান জায়গায় গেলে হাঁফ ধরে যেত - আওয়াজ, আলো, ধোঁয়া থেকে কখন
পালাবো ভাবতাম। অথচ আজ ওখানেই অটোর ভটভট আর লোকনাথের চিৎকারে কানে আঙুল
গুঁজে থাকতে হয়। থাকি, কিন্তু অভ্যেস হয় না।
কুড়ি বছর আগে সেই দিনগুলোতে সকালে উঠে দৌড়দৌড়ি শুরু হত - আটটার মধ্যে বেরোতে হবে, ইস্কুলের বাস আসবে সাড়ে আটটায়। মঙ্গলদার রিক্সা করে রাণীকুঠি অবধি যেতুম। পথে পড়তো রাণীকুঠির পোড়ো বাড়িটা - শোনা কথা ওটা নাকি পুঁটুরাণীর বাড়ি। পুঁটুরাণী - মানে সাবর্ণ রায়চৌধুরির মেয়ে - আদিগঙ্গা-পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা সেই মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দেওয়া হয়েছিলো - তাই পুঁটুরাণী থেকে বদলাতে বদলাতে নাম হল পুঁটিয়ারী। বাড়িটা দেখে মনে হত ভুতের বাড়ি - একদিন আঁকার ইস্কুল থেকে ফেরার সময় আমি আর বাপি সাহস করে ঢুকে পড়লুম। পোড়ো বাড়ি, কিন্তু বসতিহীন নয় - কেউ কেউ ঝুপড়ি বানিয়ে রাস্তার ধারে থাকতো, কেউ ওই বাড়িতে - পোড়ো হলে কী হয়েছে, বাড়ি তো! তাদের পছন্দ হয়নি আচমকা দুটো উটকো ছোঁড়া ঢুকে পড়াতে...বেরিয়ে এসে এদিক সেদিক ঘুরে আবিষ্কার করলুম পুঁটুরাণীর পর এই বাড়িটার মালিকানা ছিলো "ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম স্টুদিও"-র - একটা শুকিয়ে যাওয়া ফোয়ারায় তাদের নাম খোদাই করা।
প্রাইমারী ইস্কুল শেষ করে সেকেন্ডারি ইস্কুলের সময় বাস ধরতে যেতে হত নেতাজীনগর - আর একটু কাছে - আর মঙ্গলদার রিক্সা নয় - এবার থেকে হেঁটে। ইস্কুল বাস মিস্ করলে ধ্যাদ্ধেড়ে ৪১/১ ভরসা - সোজা ইস্কুলের সামনে - আর নয়তো অন্য বাস ধরে হাজরা মোড়ে নেমে এগারো নম্বর বাস। সিক্সে পড়ি যখন, একদিন গড়িয়াহাটের কাছে ইস্কুল বাস জবাব দিলো - পকেটে পয়সা নেই, কিন্তু কয়েকজন বন্ধু মিলে টুক করে একটা এস১৫-তে চেপে বসলুম। কন্ডাক্টরও বুঝলো ইস্কুলের ছেলে - ইস্কুলের বাস তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে আর ইউনিফর্মটা ছিলো ইউনিক। অন্য যাত্রীরা চাঁদা করে আমাদের ভাড়া দিয়ে দিলো। এখন কেউ দেবে? সন্দেহ আছে।
এর পর থেকেই আমাকে প্রতি মাসের শুরুতে দুটো করে টাকা দিত মা, এরকম ঘটনা ঘটলে যাতে বাসের ভাড়াটা দিয়ে দিতে পারি। সেই টাকাগুলো জমাতুম - দুর্গাপুজোর সময়ও অল্প কিছু জমাতুম, কালিপুজোর বাজি না পুড়িয়ে মা'র কাছ থেকে গোটা দশ-পনেরো টাকা নিয়ে জমাতুম - এই করে করে আস্তে আস্তে একটা ক্রিকেট ব্যাট, একটা হকি স্টিক কিনেছিলুম...
ওই সিক্সেই একদিন দুপুরবেলা সেকেন্ডারি সেকশনের প্রিফেক্ট এসে বল্লএন - ইস্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, খবর এলো ইন্দিরা গান্ধীকে গুলি করা হয়েছে। রাস্তাঘাট বন্ধ, বাস চলছে না, আর বাড়িতে ফোনও নেই যে ফোন করে বলবো - আর বললেই বা কে এসে নিয়ে যাবে? অগত্যা আমি, আসিফ আর বৌদি (মানে কৌশিক) হাঁটা দিলাম। কোথাও বাস জ্বলছে, কোথাও ঝুপড়ি, কোথাও ভাঙা কাঁচ ছড়িয়ে - তারই মধ্যে অলি গলি ঘুরে প্রায় দেড় দু ঘন্টা হেঁটে বাড়ি - মা চমকে উঠলো - তখনও খবরটা শোনেওনি কেউ।
দিদি ওই সময়ে বি ই কলেজে চলে গেছে, বাড়িটা ফাঁকা, মারামারি করার কেউ নেই। সপ্তাহের শেষে বাড়ি আসতো, নানা রকম গল্প হত। একদিন দিদি কলেজ লাইব্রেরী থেকে একটা বই এনে দিলো। একটা সপ্তাহ ঘোরের মধ্যে কাটলো পাভেল করচাগিনের সঙ্গে। মাথা বিগরোনোর সেই শুরু। দিদি কলেজে নাটক করতো, গানের গ্রুপে ছিলো - আমি বাড়িতে বসে সেই গানগুলো শিখতুম - হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরীতে ডুবে থাকার শুরুও সেই সময়েই। সল্টলেকে দ্বাদশ পার্টি কংগ্রেসে একটা এগজিবিশন হল, বি ই কলেজ থেকে বেশ কিছু মডেল গেলো, দিদিরাও দিয়েছিলো একটা - শহরের জলের লাইন, রাস্তার প্ল্যানিং-এর ম্যাপ কম্পিউটারে ধরে রাখলে কোথায় কোথায় কী সুবিধা হতে পারে সেই নিয়ে। একদিন ডেমোর সময়ে একজন ধুতি-পাঞ্জাবী পরা, ছোটখাটো কিন্তু টকটকে চেহারার একজন ভদ্রলোক এলেন - মন দিয়ে শুনলেন, প্রচুর প্রশংসা করলেন। আমাকে ওখানে দেখে প্রশ্ন করলেন আমি কে - ওদিকে টিভিতে সেই মুখ দেখা বলে আমি তখনও হাঁ করে তাকিয়েই রয়েছি, উত্তর দেওয়ার কথা ভুলে। তবে তখনই হয়তো মাথায় ঢুকে গেছিলো কোনোভাবে - যে কম্পিউটার নিয়েই পড়তে হবে আর সেটা বি ই কলেজেই।
ক্লাস টেনে পড়ি - তখন দিদির বিয়ে হয়ে গেলো - সেই প্রথম "নিজে পছন্দ করে" বিয়ে দেখার সৌভাগ্য। ইস্কুলটা তো গোঁড়া মিশনারী, তায় শুধু বয়েজ স্কুল - কাজেই ওই সময়ে আমি নেহাতই গুডি গুডি বয়। তখনো সিনেমা হলে দেখেছি গান্স অব ন্যাভারোন বা চ্যাপলিনের সিনেমা - মানে "নিজে পছন্দ করা" একটা বিশাল কিছু (এবং সম্ভবতঃ সেই টার্গেটটাও সেই সময়েই স্থির হয়)। দিদিরা বন্ডেল রোডের কাছে একটা বাড়ি ভাড়া নিলো - রাস্তাটার নাম খুব সম্ভবতঃ রাইফেল রেঞ্জ রোড। একদিন দিদি ওদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করলো - রান্না করে খাওয়াবে। সেদিন ইস্কুলে খেলা ছিলো, খেলার শেষে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কোয়ালিটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি - বিমানদা এসে নিয়ে যাবে - অথচ কারো পাত্তা নেই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি বন্ডেল রোড ধরে হাঁটা দিলুম - খুঁজে খুঁজে রাস্তাটা বেরও করলুম, নম্বর মিলিয়ে বাড়িটাও। আমি জানি ওরা থাকে দোতলায়, কিন্তু বাড়ির সামনেটা অন্য লোকের - দোতলায় কি করে ঢোকে সেটা ভেবে না পেয়ে, এবং আস্ত গর্দভের মত কাউকে জিজ্ঞেসও না করে ফের হাঁটতে হাঁটতে কোয়ালিটির সামনে এসে দাঁড়ালুম, কাউকে না দেখে বাসে চেপে বাড়ি। রাত্তির দশটার সময় একটা ট্যাক্সি এসে বাড়ির সামনে দাঁড়ালো - দিদি নেমেই জিজ্ঞেস করলো "মিতুল ফিরেছে"? উত্তর শুনে সেই গেটের সামনে রাস্তার ওপর বসে হাউহাউ করে কান্না - বেচারি সন্ধে থেকে রাত্তির অবধি টেনশন করেছে। রান্নাগুলো অবশ্য নষ্ট হতে দিইনি, পরেরদিন গিয়ে খেয়ে এসেছিলুম।
হায়ার সেকেন্ডারীও একই ইস্কুলে - শুধু ক্লাস শুরু হত সকাল সাতটায়, বাড়ি থেকে বেরোতুম ভোর সাড়ে পাঁচটায়। শীতকালে আকাশে চাঁদ থাকতো। পাঁচটা পঞ্চাশের ৪১/১ ধরলে সাড়ে ছটা নাগাদ ইস্কুলে পৌঁছতুম। তখন প্রায়ই আমরা হেঁটে ফিরতুম - মাঝে মাঝে সাইকেলে ইস্কুল যেতুম - তিরিশ বছরের পুরনো হারকিউলিস - চট করে অন্য কেউ চালাতে পারতো না।
বেহালা শিখতে শুরু করলাম। মিউজিয়ামের পাশের সাস্তা দিয়ে ঢুকে খুঁজে খুঁজে মার্কুইস স্ট্রীট বের করা - সেখানে ব্রাগাঞ্জার দোকান। ওদের তৈরী বেহালা, ওই দোকান থেকে কেনা ডাব্লু সি হানিম্যানের বই। টোনির বয়স তখন অনেক কম, দোকানে বেশিরভাগ সময়ে থাকতো ওর বাবা, তবে কখনো কোনো দরকারে বাজনা নিয়ে গেলে টুকটাক সারানো বা টিউনিং করতো টোনি। কিছুদিন আগে ছেলের জন্যে হাফ-সাইজ বেহালা কিনতে গিয়ে সেই টোনিকে দেখে মনে হল কত বছর পেরিয়ে গেছে। টোনি কিন্তু ওর সেই পুরনো খদ্দেরদের মনে রেখেছে।
প্রথম মিছিলে হাঁটাও এই সময়েই - সংহতি মিছিল - এসপ্ল্যানেড থেকে পার্ক সার্কাস ময়দান - এখন মনে নেই কী ব্যাপারে ছিলো, তবে অত লোকের মিছিলে হাঁটার সেই শুরু, আজও শেষ হয়নি। গলা খুলে স্লোগান দেওয়ার শুরুও সেই সময়ে, সেই মিছিলে। আজও চলছে।
তার পরের চারটে বছর সম্ভবতঃ সেরা সময় - গানে-স্লোগানে-মিছিলে হু হু করে কেটে যাওয়া...
কুড়ি বছর আগে সেই দিনগুলোতে সকালে উঠে দৌড়দৌড়ি শুরু হত - আটটার মধ্যে বেরোতে হবে, ইস্কুলের বাস আসবে সাড়ে আটটায়। মঙ্গলদার রিক্সা করে রাণীকুঠি অবধি যেতুম। পথে পড়তো রাণীকুঠির পোড়ো বাড়িটা - শোনা কথা ওটা নাকি পুঁটুরাণীর বাড়ি। পুঁটুরাণী - মানে সাবর্ণ রায়চৌধুরির মেয়ে - আদিগঙ্গা-পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা সেই মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দেওয়া হয়েছিলো - তাই পুঁটুরাণী থেকে বদলাতে বদলাতে নাম হল পুঁটিয়ারী। বাড়িটা দেখে মনে হত ভুতের বাড়ি - একদিন আঁকার ইস্কুল থেকে ফেরার সময় আমি আর বাপি সাহস করে ঢুকে পড়লুম। পোড়ো বাড়ি, কিন্তু বসতিহীন নয় - কেউ কেউ ঝুপড়ি বানিয়ে রাস্তার ধারে থাকতো, কেউ ওই বাড়িতে - পোড়ো হলে কী হয়েছে, বাড়ি তো! তাদের পছন্দ হয়নি আচমকা দুটো উটকো ছোঁড়া ঢুকে পড়াতে...বেরিয়ে এসে এদিক সেদিক ঘুরে আবিষ্কার করলুম পুঁটুরাণীর পর এই বাড়িটার মালিকানা ছিলো "ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম স্টুদিও"-র - একটা শুকিয়ে যাওয়া ফোয়ারায় তাদের নাম খোদাই করা।
প্রাইমারী ইস্কুল শেষ করে সেকেন্ডারি ইস্কুলের সময় বাস ধরতে যেতে হত নেতাজীনগর - আর একটু কাছে - আর মঙ্গলদার রিক্সা নয় - এবার থেকে হেঁটে। ইস্কুল বাস মিস্ করলে ধ্যাদ্ধেড়ে ৪১/১ ভরসা - সোজা ইস্কুলের সামনে - আর নয়তো অন্য বাস ধরে হাজরা মোড়ে নেমে এগারো নম্বর বাস। সিক্সে পড়ি যখন, একদিন গড়িয়াহাটের কাছে ইস্কুল বাস জবাব দিলো - পকেটে পয়সা নেই, কিন্তু কয়েকজন বন্ধু মিলে টুক করে একটা এস১৫-তে চেপে বসলুম। কন্ডাক্টরও বুঝলো ইস্কুলের ছেলে - ইস্কুলের বাস তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে আর ইউনিফর্মটা ছিলো ইউনিক। অন্য যাত্রীরা চাঁদা করে আমাদের ভাড়া দিয়ে দিলো। এখন কেউ দেবে? সন্দেহ আছে।
এর পর থেকেই আমাকে প্রতি মাসের শুরুতে দুটো করে টাকা দিত মা, এরকম ঘটনা ঘটলে যাতে বাসের ভাড়াটা দিয়ে দিতে পারি। সেই টাকাগুলো জমাতুম - দুর্গাপুজোর সময়ও অল্প কিছু জমাতুম, কালিপুজোর বাজি না পুড়িয়ে মা'র কাছ থেকে গোটা দশ-পনেরো টাকা নিয়ে জমাতুম - এই করে করে আস্তে আস্তে একটা ক্রিকেট ব্যাট, একটা হকি স্টিক কিনেছিলুম...
ওই সিক্সেই একদিন দুপুরবেলা সেকেন্ডারি সেকশনের প্রিফেক্ট এসে বল্লএন - ইস্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, খবর এলো ইন্দিরা গান্ধীকে গুলি করা হয়েছে। রাস্তাঘাট বন্ধ, বাস চলছে না, আর বাড়িতে ফোনও নেই যে ফোন করে বলবো - আর বললেই বা কে এসে নিয়ে যাবে? অগত্যা আমি, আসিফ আর বৌদি (মানে কৌশিক) হাঁটা দিলাম। কোথাও বাস জ্বলছে, কোথাও ঝুপড়ি, কোথাও ভাঙা কাঁচ ছড়িয়ে - তারই মধ্যে অলি গলি ঘুরে প্রায় দেড় দু ঘন্টা হেঁটে বাড়ি - মা চমকে উঠলো - তখনও খবরটা শোনেওনি কেউ।
দিদি ওই সময়ে বি ই কলেজে চলে গেছে, বাড়িটা ফাঁকা, মারামারি করার কেউ নেই। সপ্তাহের শেষে বাড়ি আসতো, নানা রকম গল্প হত। একদিন দিদি কলেজ লাইব্রেরী থেকে একটা বই এনে দিলো। একটা সপ্তাহ ঘোরের মধ্যে কাটলো পাভেল করচাগিনের সঙ্গে। মাথা বিগরোনোর সেই শুরু। দিদি কলেজে নাটক করতো, গানের গ্রুপে ছিলো - আমি বাড়িতে বসে সেই গানগুলো শিখতুম - হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরীতে ডুবে থাকার শুরুও সেই সময়েই। সল্টলেকে দ্বাদশ পার্টি কংগ্রেসে একটা এগজিবিশন হল, বি ই কলেজ থেকে বেশ কিছু মডেল গেলো, দিদিরাও দিয়েছিলো একটা - শহরের জলের লাইন, রাস্তার প্ল্যানিং-এর ম্যাপ কম্পিউটারে ধরে রাখলে কোথায় কোথায় কী সুবিধা হতে পারে সেই নিয়ে। একদিন ডেমোর সময়ে একজন ধুতি-পাঞ্জাবী পরা, ছোটখাটো কিন্তু টকটকে চেহারার একজন ভদ্রলোক এলেন - মন দিয়ে শুনলেন, প্রচুর প্রশংসা করলেন। আমাকে ওখানে দেখে প্রশ্ন করলেন আমি কে - ওদিকে টিভিতে সেই মুখ দেখা বলে আমি তখনও হাঁ করে তাকিয়েই রয়েছি, উত্তর দেওয়ার কথা ভুলে। তবে তখনই হয়তো মাথায় ঢুকে গেছিলো কোনোভাবে - যে কম্পিউটার নিয়েই পড়তে হবে আর সেটা বি ই কলেজেই।
ক্লাস টেনে পড়ি - তখন দিদির বিয়ে হয়ে গেলো - সেই প্রথম "নিজে পছন্দ করে" বিয়ে দেখার সৌভাগ্য। ইস্কুলটা তো গোঁড়া মিশনারী, তায় শুধু বয়েজ স্কুল - কাজেই ওই সময়ে আমি নেহাতই গুডি গুডি বয়। তখনো সিনেমা হলে দেখেছি গান্স অব ন্যাভারোন বা চ্যাপলিনের সিনেমা - মানে "নিজে পছন্দ করা" একটা বিশাল কিছু (এবং সম্ভবতঃ সেই টার্গেটটাও সেই সময়েই স্থির হয়)। দিদিরা বন্ডেল রোডের কাছে একটা বাড়ি ভাড়া নিলো - রাস্তাটার নাম খুব সম্ভবতঃ রাইফেল রেঞ্জ রোড। একদিন দিদি ওদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করলো - রান্না করে খাওয়াবে। সেদিন ইস্কুলে খেলা ছিলো, খেলার শেষে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কোয়ালিটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি - বিমানদা এসে নিয়ে যাবে - অথচ কারো পাত্তা নেই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি বন্ডেল রোড ধরে হাঁটা দিলুম - খুঁজে খুঁজে রাস্তাটা বেরও করলুম, নম্বর মিলিয়ে বাড়িটাও। আমি জানি ওরা থাকে দোতলায়, কিন্তু বাড়ির সামনেটা অন্য লোকের - দোতলায় কি করে ঢোকে সেটা ভেবে না পেয়ে, এবং আস্ত গর্দভের মত কাউকে জিজ্ঞেসও না করে ফের হাঁটতে হাঁটতে কোয়ালিটির সামনে এসে দাঁড়ালুম, কাউকে না দেখে বাসে চেপে বাড়ি। রাত্তির দশটার সময় একটা ট্যাক্সি এসে বাড়ির সামনে দাঁড়ালো - দিদি নেমেই জিজ্ঞেস করলো "মিতুল ফিরেছে"? উত্তর শুনে সেই গেটের সামনে রাস্তার ওপর বসে হাউহাউ করে কান্না - বেচারি সন্ধে থেকে রাত্তির অবধি টেনশন করেছে। রান্নাগুলো অবশ্য নষ্ট হতে দিইনি, পরেরদিন গিয়ে খেয়ে এসেছিলুম।
হায়ার সেকেন্ডারীও একই ইস্কুলে - শুধু ক্লাস শুরু হত সকাল সাতটায়, বাড়ি থেকে বেরোতুম ভোর সাড়ে পাঁচটায়। শীতকালে আকাশে চাঁদ থাকতো। পাঁচটা পঞ্চাশের ৪১/১ ধরলে সাড়ে ছটা নাগাদ ইস্কুলে পৌঁছতুম। তখন প্রায়ই আমরা হেঁটে ফিরতুম - মাঝে মাঝে সাইকেলে ইস্কুল যেতুম - তিরিশ বছরের পুরনো হারকিউলিস - চট করে অন্য কেউ চালাতে পারতো না।
বেহালা শিখতে শুরু করলাম। মিউজিয়ামের পাশের সাস্তা দিয়ে ঢুকে খুঁজে খুঁজে মার্কুইস স্ট্রীট বের করা - সেখানে ব্রাগাঞ্জার দোকান। ওদের তৈরী বেহালা, ওই দোকান থেকে কেনা ডাব্লু সি হানিম্যানের বই। টোনির বয়স তখন অনেক কম, দোকানে বেশিরভাগ সময়ে থাকতো ওর বাবা, তবে কখনো কোনো দরকারে বাজনা নিয়ে গেলে টুকটাক সারানো বা টিউনিং করতো টোনি। কিছুদিন আগে ছেলের জন্যে হাফ-সাইজ বেহালা কিনতে গিয়ে সেই টোনিকে দেখে মনে হল কত বছর পেরিয়ে গেছে। টোনি কিন্তু ওর সেই পুরনো খদ্দেরদের মনে রেখেছে।
প্রথম মিছিলে হাঁটাও এই সময়েই - সংহতি মিছিল - এসপ্ল্যানেড থেকে পার্ক সার্কাস ময়দান - এখন মনে নেই কী ব্যাপারে ছিলো, তবে অত লোকের মিছিলে হাঁটার সেই শুরু, আজও শেষ হয়নি। গলা খুলে স্লোগান দেওয়ার শুরুও সেই সময়ে, সেই মিছিলে। আজও চলছে।
তার পরের চারটে বছর সম্ভবতঃ সেরা সময় - গানে-স্লোগানে-মিছিলে হু হু করে কেটে যাওয়া...
No comments:
Post a Comment