Friday, May 11, 2012

শহর থেকে শহরে - ১৩

আ জার্নি ফ্রম নর্দাম্বারল্যান্ড স্ট্রীট টু বারাক রোড
=========================

জানুয়ারী ২১, ২০০২ - সেই দিনটা যেদিন মেরিল্যান্ড থেকে এসেছিলাম নিউক্যাসলে ইন্টারভিউ দিতে - সেই দিনটা ছিলো সেই বছরের সবচেয়ে ঠান্ডা দিন, আর রেকর্ড-ভাঙা জোরে হাওয়া বইছিলো। এতই জোর সেই হাওয়ার যে চুরাশি কেজির লাশ নিয়ে আমি সোজা হয়ে হাঁটতে পারিনি! হাত থেকে ক্যামেরার ব্যাগ উড়ে চলে যাচ্ছিলো প্রায়। ছয় বছর পর, ইউনিভার্সিটির কফি রুমে বসে পল ওয়াটসন বলেছিলো যে - ও ভাবেনি আমি শেষ অবধি নিউক্যাসলে আসবো, ওই আবহাওয়া দেখে হয়তো পিট্‌টান দেবো। পল ওয়াটসন - আমাদের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর, ইউনিভার্সিটির স্কুল অব কম্পিউটিং সায়েন্সে প্রোফেসর, এবং আমার পিএইচডি গাইড। অচেনা শহরে নিজেকে খুঁজে নিতে যে কয়েকজনের নাম সবার আগে মনে পড়ে তার মধ্যে পল ওয়াটসন আর পীট লী (আরেকজন প্রোফেসর) দুজন। আরো ছিলো - পিটার লি, অনিল ওয়াইপ্যাট, অ্যাঙ্কে জ্যাকসন, ডেবি করবেট...সকলেই ইউনিভার্সিটির - কম্পিউটিং সায়েন্সের স্টাফ আর রিসার্চার। ছিলো প্যাম বনার - ইউনিভার্সিটি অ্যাকোমোডেশন সার্ভিসের। এই প্যামের কথা লিখবো সবার আগে।

শহরে পৌঁছে তো উঠলাম উইন্ডসর টেরাসের টেম্পোরারি এক কামরার ফ্ল্যাটে - পনেরোদিনের বুকিং করে এসেছিলাম। বাড়ি খুঁজতে গিয়ে দেখলাম বাজারে যে কোনো বাড়ি কমপক্ষে চারশো পাউন্ড, তার সাথে এক মাসের সিকিউরিটি ডিপোজিট। ওদিকে আমেরিকা থেকে আনা ব্যাঙ্কার্স চেক ক্যাশ হতে সময় নেবে কমপক্ষে এক মাস। প্যামকে গিয়ে ধরলাম - উইন্ডসর টেরাসে আরো কিছুদিন এক্সটেন্ড করার জন্য। বিবাহিত স্টুডেন্টদের অ্যাকোমোডেশন পাওয়া দুষ্কর, তাছাড়া আমি তো তখনো শুধু রিসার্চ স্টাফ - পার্ট টাইম স্টুডেন্ট হিসেবে রেজিস্টার করতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। হাতে পয়সা নেই যে তক্ষুণি বাড়ি খুঁজে নেবো। প্যামের কাছে পুরো সারেন্ডার করলাম - দ্যাখো, আমার চেক ক্যাশ হতে দেরী আছে, কাজেই নিজে নিজে বাড়ি খুঁজে বের করা অসম্ভব, তুমি একটা ব্যবস্থা করে দাও। প্যাম উইন্ডসর টেরাসে এক্সটেন্ড করতে পারলো না বটে, কিন্তু ক্যাসল লীজেস-এ আবার কিছুদিনের ব্যবস্থা করে দিলো, আর ইউনিভার্সিটির প্রাইভেট অ্যাকোমোডেশন স্কীমে একটা ফ্ল্যাটও খুঁজে দিলো - যতদিন না সেই ফ্ল্যাটটা খালি হচ্ছে ততদিন ক্যাসল লীজেস, দিন পনেরোর জন্যে। প্রাইভেট অ্যাকোমোডেশন স্কীমেও স্টুডেন্ট রেজিস্ট্রেশনের দরকার - তার জন্যে আবার গিয়ে ধরলাম পল ওয়াটসনকে। ওই দুই সপ্তাহের মধ্যেই দুজনে খেটেখুটে একটা রিসার্চ প্রোপোজাল নামিয়ে রেজিস্ট্রেশনও সেরে ফেললাম। আমি তখন ইউনিভার্সিটি স্টাফ, একই সাথে পার্ট-টাইম পিএইচডি স্টুডেন্ট - রিসার্চ প্রোজেক্টের কাজের মধ্যে থেকেই পিএইচডি-র কাজ খুঁজে নিতে হবে - সুবিধা এই যে টিউশন ফী-টা আমার মকুব - ইউনিভার্সিটি স্টাফ হওয়ার দৌলতে। ২০০২-এর জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে আমার ঠিকানা হল ১০৪ ওয়ারউইক স্ট্রীট, পরের কয়েক বছরের জন্যে।

প্রথম প্রথম একা লাগতো। তিন মাসের ছেলেটা তখন আরো কত বড় হল, কী কী করতে শিখলো - এই সব খোঁজ নিতাম বাড়িতে ফোন করে। মেরিল্যান্ড থেকে কয়েকটা বাক্সে ঘরোয়া জিনিসপত্র পাঠিয়েছিলাম - সেসব তখনো এসে পৌঁছয়নি বলে রান্নার পাট শুরু করিনি। সকালটা মাফিন, দুপুরে হে-মার্কেট স্টেশনের পাশের বেকার্স কর্নার আর রাত্তিরে রাস্তার কোণের কর্নার শপ থেকে কিনে আনা ফ্রোজেন খাবার গরম করে সাথে পাঁউরুটি। শনি-রবি দুপুরবেলা হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম সিটি সেন্টারের দিকে - সেখানে গোল্ডেন বেঙ্গলে খেতে খেতে আলাপ হয়ে গেলো রেস্তোরাঁর মালিক সাদাতভাইয়ের সঙ্গে। সিলেটের লোক, বাঙালী। চাকরির খোঁজে এই মুল্লুকে এসে একটা ছোট রেস্তোরাঁয় কাজ শুরু করে আজ নিজেই একটা চালান। ছেলেকে ভর্তি করেছেন নর্দামব্রিয়া ইউনিভার্সিটিতে, যাতে সে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে অন্য কোনো একটা ভালো চাকরি করে। আমার দুপুরের খাওয়া (একটা স্টার্টার, ভাত, সাথে একটা নন-ভেজ ডিশ আর আইসক্রীমের তিন-কোর্স খাওয়া) শেষ হলে দু কাপ ক্রীম দেওয়া কফি (এক কাপ নিজের, এক কাপ আমার, আর সেটা ফ্রী) নিয়ে এসে বসতেন আমার সাথে - আর গল্প করতেন - বাড়ির গল্প - ওঁর, আমার...

আলাপ হয়ে গেলো সিড-এর সঙ্গে - আমির সিদ্দিকি - ওয়ারউইক স্ট্রীটে আমার ফ্ল্যাটের লাইনের শেষে যে কর্নার শপ-টা ছিলো, যার দোকান থেকে আমি ফ্রোজেন খাবার কিনে আনতুম - তার মালিক। পাকিস্তানের পঞ্জাবের লোক। এমন আলাপ হয়ে গেলো যে পরের দিকে ঋককে নিয়ে কখনো ওর দোকানে গেলে ও ঋককে এত লজেন্স/ক্যান্ডি ধরিয়ে দিত যে আমি লজ্জায় ঋককে না নিয়ে যাওয়া শুরু করেছিলুম। সিড আমাকে খোঁজ দিলো ফেনহ্যামের কোথায় দেশী মাছ পাওয়া যায়, কোথায় ফার্মার্স মার্কেটে টাটকা সব্জি পাওয়া যায়। আর নিউক্যাসল ইউনাইটেডের সাথে আমার চেনাশোনার শুরুও এই সিডের দোকানে। দোকান সামলাতে সামলাতে সিড রেডিও শুনতো, আমিও দাঁড়িয়ে পড়তাম আর দু তিনজনের সঙ্গে। ওয়ারউইক স্ট্রীটের বাড়ির পিছনের সিঁড়ির মাথায় দাঁড়ালে সিটিসেন্টারে সেন্ট জেম্‌স পার্কের আলো ঝলমল ছাদটা দেখা যেত। ভেসে আসতো পঞ্চাশ হাজার লোকের চিৎকার। তখন ববি রবসনের নিউক্যাসল - কেভিন কীগ্যানের এন্টারটেইনারদের পর আবার আরেকটা দল যারা জর্ডি রক্তকে গরম করতে শুরু করেছে...

গাড়ির বড় একটা দরকার ছিলো না - বাসেই যাতায়াত করতাম। কিন্তু বেড়ানোর নেশা, বলা ভালো খোলা রাস্তায় গাড়িকে দৌড় করানোর নেশা। বাড়িতে এলো লিট্‌ল ব্লু - নামটা ঋকের দেওয়া। লিট্‌ল নয় আদৌ, সাধারণ সেডান, ঋক কেন লিট্‌ল ব্লু নাম দিয়েছিলো সেটা ওই জানতো। নতুনও নয়, ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করা পুওর অ্যাকাডেমিক বলে নতুন গাড়ি নাগালের বাইরে ছিলো। কিন্তু সেই গাড়িই আস্তে আস্তে আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে গেলো। এত মায়া মনে হয় আর কোনো জিনিসের ওপর পড়েনি। সেই গাড়ি নিয়ে আমরা দৌড়ে বেরিয়েছি ইংল্যান্ডের এমাথা থেকে ওমাথা - নিউক্যাসলের কাছেই সী-সাইড থেকে পশ্চিমে লেক ডিস্ট্রিক্ট অবধি, দক্ষিণে ডেভন/কর্নওয়াল থেকে উত্তরের হাইল্যান্ডস ছাড়িয়ে জন ও গ্রোটস অবধি। শনিবার সকালে উঠে মনে হল চলো বেরিয়ে পড়ি - অল্প কিছু লাঞ্চ প্যাক করে আমরা তিনজন বেরিয়ে পড়তাম - থুড়ি - চারজন - লিট্‌ল ব্লুকে নিয়ে। নর্দাম্বারল্যান্ডের অলিগলি জঙ্গল, ডারহাম-ইয়র্কশায়ারের দিগন্তবিস্তৃত dales, লেক ডিস্ট্রিক্টের ছড়িয়ে থাকা শান্ত জলরাশি...এসবই ছিলো উইকেন্ডে একদিন বা দুদিনের বেড়ানোর জায়গা। খুঁজে খুঁজে বের করতাম কোন পথ দিয়ে গেলে আরো বেশি সবুজ পাবো - ইংল্যান্ডের সবুজের এক অসাধারণ চোখ জুড়নো সুওন্দর্য আছে। সেই সবুজ খুঁজতে গিয়ে দুর্গম রাস্তা পড়লে পোয়াবারো - পাহাড়ের মধ্যে সরু রাস্তায় এঁকে বেঁকে না গেলাম তো কিসের গাড়ি চালানো? একদিন খুঁজে পেলাম হার্ডনট এবং রাইনোজ পাস - বিবিসি লিখেছিলো "These days the pass is mostly used by intrepid motorists determined to test their nerve – and their car’s brakes – on the toughest of England’s roads." সেও ঘুরে এলাম - রাইনোজ আর হার্ডনট পেরিয়ে লেক ডিস্ট্রিক্টের একেবারে পশ্চিমে ওয়াস্টওয়াটার লেক - যেটা সেই বছর most serene tourist spot হিসেবে নাম করেছিলো। হাঁটতেও যেতাম - ডারহাম বা ইয়র্কশায়ার বা লেক-ডিস্ট্রিক্টের উঁচু নীচু পাহাড়ের গায়ে - গরডেল স্কার, মালহাম কোভ, লাফরিগ সামিট। ঋকও যেত - ওই চার পাঁচ বছর বয়সেই অক্লেশে পাঁচ-ছয় মাইল পাহাড়ি পথে হেঁটে দিত।

এই রকম একটা ট্রিপে একবার মাউন্টেন রেসকিউয়ের দরকার হয়েছিলো প্রায়। রোজবেরি টপিং-এ।

No comments: