Friday, May 11, 2012

শহর থেকে শহরে - ৮

ইন দ্য ল্যান্ড অব লেক্‌স
============

এই দেশটাতে লেকের সংখ্যা দুই লক্ষ, আর লোকের সংখ্যা পঞ্চাশ লক্ষ। মানে এক একটা লেক (বা পুকুর) পিছু মাত্র কুড়িটা লোক। পাড়ার যে কোনো পুকুরের কথা একবার চোখ বন্ধ করে ভেবে নিন।

লুফ্‌তহান্‌সার বোম্বাই সাইজের প্লেনে চেপে গেলুম ফ্র্যাঙ্কফুর্ট, সেখান থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এয়ারলাইন্‌সের পুঁচকে একটা প্লেনে হেলসিঙ্কি। এই পুঁচকে প্লেনটা আবার সেই বড় বড় প্রোপেলারওয়ালা - আওয়াজে কান ঝালাপালা করে দেয়। তো সেই আওয়াজের মধ্যেই ওপর থেকে সবুজের রমরমা দেখে বুঝলাম এক অন্য দুনিয়ায় এসে গেছি।

এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সিতে হোটেল - প্রিভাতেল - হোটেলের চেয়ে সঠিক হবে যদি সার্ভিসড অ্যাপার্টমেন্ট বলি। আসলে তখন তো এই সব ফান্ডাও ছিলো না। জনাপিছু এক একটা ঘর, সেখানে রান্না-বান্নার সমস্ত ব্যবস্থা রয়েছে, শুধু সকালের ব্রেকফাস্ট হোটেলে। জায়গাটা হেলসিঙ্কি থেকে অল্প দূরে একটা ছোট গ্রামে, যার স্টেশনের নাম লেপ্পাভারা। আরেকটা নাম - সুইডিশ ভাষায় - আলবার্গা। এদেশের দ্বিতীয় ভাষা হল সুইডিশ - যেহেতু ফিনল্যান্ড অনেকদিন সুইডেনের কব্‌জায় ছিলো। তবুও, আমরা তো কোনো একটা জায়গার নাম বাংলা বা হিন্দিতে যা, ইংরিজীতেও তাই দেখে অভ্যস্ত - কাজেই এই ফিনিশ ভাষায় এক নাম, আর সুইডিশ ভাষায় আরেক নাম দেখে নতুন লেগেছিলো। স্টেশন থেকে প্রিভাতেল প্রায় দুই মাইল দূরে, তায় একজায়গায় একশো চুয়াল্লিশটা সি`ঁড়ি ভাঙতে হত। হোটেল থেকে স্টেশন যেতে কষ্ট নেই, কিন্তু উল্টো পথে আসতে দম বেরিয়ে যেত। যে সময়ে গেছি সেটা গরমকাল। গরম বলতে দিনে হয়তো বিশ ডিগ্রী, রাতে একটু কম। বেশ আরামদায়ক। চমকটা অপেক্ষা করছিলো রাতের দিকে - ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে, আটটা - নটা - দশটা - অথচ দিনের আলো কমার নাম নেই। কারণটা খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু নতুন তো!

চাপে পড়লাম বাজার করতে গিয়ে। একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকে দেখি অজস্র জিনিস, আলু-পেঁয়াজ-ফুলকপি ইত্যাদি দেখে চেনা যাচ্ছে, কিন্তু বাদবাকি জিনিস দেখে তো চেনা যায় না, নাম দেখে বোঝারও উপায় নেই - কারণ যা কিছু লেখা আছে সবই ফিনিশ এবং সুইডিশে। চেনা জিনিস কেনা ছাড়া পথ নেই। একবারই দেখে কিনতে গিয়ে ঝাড় হয়েছিলো - একটা প্যাকেট দেখে মনে হয়েছিলো বেসন জাতীয় কিছু - ছোলার মতন কিছু ছবি লাগানো ছিলো। হোটেলের ঘরে বাঁধাকপির বড়া বানাতে গিয়ে সে ঘেঁটে চচ্চড়ি হয়ে গেলো। পরে একজনকে দেখিয়ে জেনেছিলাম সেটা gram flower নয়, সয়াবীনের গুঁড়ো।

এভাবেই চললো দিনগুলো। আগে কখনো নিজে রান্না করিনি - বাড়িতে ক্চিৎ কখনো ডিমটা ভাজা বা সুজিটা বানানো ছাড়া। আর এখেনে রান্না না করতে পারলে কপালে হরিমটর, কারণ সতেন্দার আর গুরপ্রীতেরও অবস্থা আমারই মত - শুধু চা টুকু বানাতে পারে। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে মনে হল ইমেল ভরসা। নোকিয়ার অফিসে ইমেল/ইন্টারনেট অবাধ - দিল্লীর গোয়ালে যেটা ভাবাই যেত না। দিদি তখন ম্যাঞ্চেস্টারে, কাজেই ইমেলে রেসিপি আসতে শুরু করলো, কখনো কখনো ফোনে ইনস্ট্রাকশনও। স্টিলের ডেকচি টাইপের জিনিসে রান্না চলছে, আর ফোনে শুনছি - এবার জিরেগুঁড়োটা দে, এবার হলুদটা দে। জিরে-হলুদ কোত্থেকে এলো? ওসব ওখানে পাবেন না, পেলেও ভরসা করে চিনে কিনতে পারবেন না - জিরের বদলে হয়তো ব্রাউন লঙ্কার গুঁড়ো নিয়ে এলেন। সতেন্দার আর গুরপ্রীত - দুজনেরই বাড়ি থেকে চাল আর রোজকার কিছু মশলা বেঁধে দিয়েছিলো - তাতেই আমরা অত হাতের কাজ দেখানোর সুযোগ পেতুম। তা এভাবে চলছিলো মন্দ না - ফুলকপির তরকারিটা, বা মুরগীর ঝোলটা মোটামুটি নেমেও যাচ্ছিলো। সাহস করে রুটিও বানাতে শুরু করলাম। চাকী-বেলুন নেই তো কী? বীয়ারের বোতল তো আছে, আর রান্নার টেবিলটাও পরিষ্কার। রুটিগুলো পাঁপড় বলছেন? ঘিয়ের ডাব্বা আছে, ঘি মাখাও, গরমাগরম খেয়ে নাও।

নোকিয়ার অফিসেও পুরোদমে কাজ চলছে। সাধারণতঃ শুনতে পেতুম অনসাইটে প্রচণ্ড চাপ, ক্লায়েন্ট অফিসে অফশোর থেকে আসা লোকজনকে বাঁকা চোখে দেখে। সে সব বালাই এখানে নেই। ফিনল্যান্ড চলে ঢিমে তে-তালায়, অফিসের কাজও তাই। লোকজনের মুখে শুনি তারা বেশ থার্ড ইয়ারে পড়তে পড়তে ড্রপ দিয়ে দু বছর দুনিয়া ঘুরতে চলে যায়। এও শুনি যে আমাদের যে বড় আর্কিটেক্ট - সে কোনো কলেজ গ্র্যাজুয়েট নয় - এক কালে ড্রাম বাজাতো কোনো এক ব্যান্ডে, এখন প্রোগ্রামিং শিখে ধুরন্ধর লিড আর্কিটেক্ট! নোকিয়া সবাইকে বাকি সমস্ত অফিসে যাওয়ার অ্যাকসেস দিয়েছে, তার মধ্যে লেপ্পাভারা থেকে আরো এগিয়ে একটা জায়গায় একটা দুর্দান্ত ফিটনেস সেন্টারও আছে - যেখানে মাল্টিজিম, সুইমিং পুল আর সাওনা দেখে চোখ কপালে ওঠার যোগাড়। চোখদুটো খসে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছিলো যেদিন জানতে পেরেছিলুম সাওনাগুলো ইউনিসেক্স - যখন নোকিয়ার অফিসেরই দুজন কলীগ সাওনায় ঢুকে নিশ্চিন্তে নিজেদের টাওয়েলগুলো সরিয়ে বসে পড়লেন। ওদিকে ততদিনে আমরা একবারও বিনা-টাওয়েলের কথা ভাবিওনি। অস্বস্তি হয়েছিলো, পালিয়ে এসেছিলাম। পরে মনে হয়েছিলো হয়তো সেটা ঠিক হয়নি - ওদের সমস্ত ডেফিনেশনগুলোই অন্যরকম। ওদের কাছে যেগুলো স্বাভাবিক, আমাদের কাছে সেগুলো অস্বস্তিকর। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ সুযোগ খুঁজে বেড়াই, অথচ ওদের এই স্বাভাবিক প্রকৃতি দেখে আমাদের অস্বস্তি হয় - বা অস্বস্তির ভান করি।

সুযোগ যে খুঁজি সে তো দেখলামই। নোকিয়ায় ওই সময় আমাদের গোয়ালের বেশ কয়েকজন গরু ছিলো। উইকেন্ডে সকলে যেত ডিস্কোতে। একদিন আমিও গেলুম। নাচতে তো ভারি পারি - বিশ্বকাপের মরসুম বলে রিকি মার্টিনের অলে-অলে চলছিলো গাঁক গাঁক করে - তর সাথে কিছুক্ষন হাত-পা ছুঁড়ে দম বেরিয়ে গেলো। চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়েছি, দুটি মেয়ে এসে সিগারেট চাইলো। ওই জিনিসটার ওখানে বেদম দাম বলে পাউচ কিনেছিলুম - সেটা ওদের দেখাতে ওরা সাহস করলো না। আরেকজন এসে ওদের সিগারেট দেওয়ার সময় রিটার্ন কিছু পাওয়া যাবে কিনা জিগ্গেস করলো। মেয়েদুটো মনে হয় অভ্যস্ত - হেসে চলে গেছিলো। নাচের সময় দেখেছি কয়েকজনকে কতরকমভাবে সুযোগ খুঁজতে। নিজের লজ্জা করেছে। তারপর মনে হয়েছে আমি শালা বলার কে...আমি হয়তো ডরপোক বলে বসে বসে এই সব ভাবছি। হয়তো তাই - হয়তো আমি ডরপোক, বা অন্য কিছু - সেদিন নাইট ক্লাবেও মিনিট পনেরোর বেশি বসে থাকতে পারিনি - খুবই বোরিং লেগেছিলো ওই পোল ডান্সিং ব্যাপারটা - বাকিদের ফেলে রেখে হোটেলে ফিরে এসেছিলুম।

চোখে লেগেছিলো অল্প বয়সীদের মধ্যে অ্যালকোহলের চলটা। ফিটনেস সেন্টার থেকে ফিরছি - স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামছি, এক দঙ্গল মেয়ে পাশ দিয়ে গেলো। তাদের মধ্যে একজন হঠাতই সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে একদম নীচে। বাকিদেরও পা টলছে, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা কারো নেই। তাও, সকলে সেই মেয়েটাকে ধমকানো শুরু করলো - কারণ ওই পড়ে যাওয়ার জন্যে ওদের ট্রেনটা বেরিয়ে গেছে। বা, সেদিনের কথা - যেদিন মিডনাইট সান - ২১শে জুন...আমরা গেছিলাম হেলসিঙ্কি থেকে সামান্য দূরে সুয়োমিলেনা বলে একটা দ্বীপে - সেখানে একটা পরিতক্ত্য দুর্গ রয়েছে। ফেরার সময় দেখি একটা ট্রাম দাঁড়িয়ে পড়েছে, তার পিছনে সার দিয়ে দিয়ে আরো ট্রাম। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে সামনের ফুটপাথে এমনভাবে বসে যে তাদের পা দুটো ট্রামলাইনের ওপরে - দুজনের কারো হুঁশ নেই, লোকে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়েও তাদের পা সরাতে পারছে না।

অথচ দেশটাকে ক্রাইম বলতে গেলে কিছুই নেই। হতে পারে বছরের ছটা মাস এরা অন্ধকার আর ঠান্ডায় থাকে বলে...শীতের ওই ছটা মাস যে কিরকম সেটা ওদের মুখেই শোনা - আলো ফোটে না সারাদিন, পাঁচ-ছয় ফুট বরফ জমে থাকে রাস্তায় - সে ভয়ঙ্কর কষ্টের সময়। হয়তো সেই কষ্টটাকে সুদে আসলে পুষিয়ে নেয় গরমের দিনগুলোতে...

দেখতে দেখতে ফিনল্যান্ডে তিন মাস কাটলো। জুলাই এলো, আমার দিল্লী ফেরার সময়ও। এবার দিল্লীতে ফিরে অনেক কাজ - একটা বাড়ি দেখতে হবে, কিছু আসবাব কিনে সেই বাড়ি রেডি করতে হবে। হাতে বেশিদিন সময় নেই - দিল্লী থেকে যাবো কলকাতা, তারপর তো একা দিন কাটানোর দিন শেষ...