রোজবেরি টপিং, ফাটা প্যান্ট এবং মাউন্টেন রেসকিউ
===========================
২০০৬ সালের জুলাইয়ের এক রবিবার নিউক্যাসল জার্নালে হয়তো আরেকটু হলে হেডলাইন হত - "মাউন্টেন রেসকিউ সেভস কাপল ফ্রম রোজবেরি স্লোপ" বা "আ ডেয়ারিং রেসকিউ বাই দ্য মাউন্টেন রেসকিউ টীম"...
গল্পটা বলি শোন।
তখন প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও যাই - বয়স হচ্ছে, ওজন বাড়ছে - তাই হাঁটতে যাই, বেড়ানোও হয়, সাথে একটু গা-ঘামানো - এই করে যদি ওজনটা কমে। ব্রিটিশরা হাঁটতে খুব ভালোবাসে, তাই হাঁটার র্যুট নিয়ে প্রচুর ওয়েবসাইট আছে, ওয়াকিং র্যুটগুলো খুব ভালো করে মেইনটেইন করা হয়, রীতিমতন ভালো ডিরেকশন দেওয়া...তো সেই রকম এক সাইট থেকে রোজবেরি টপিং-এর খবর যোগাড় হয়েছিলো। মিড্লসবরোর কাছে নর্থ ইয়র্ক মুর-এর একদম শুরুর দিকে, মাইল চারেকের পথ, ক্যাটেগরি "strenuous" (যদৈ সেটা আগে খেয়াল করে দেখা হয়নি) - হেঁটে একটা পাহাড়ের মাথায় ওঠা এবং নামা। পথটা একটা বনের মধে দ্যিয়ে গেছে, আশেপাশের দৃশ্য অতীব সুন্দর - এরকমই দাবী ছিলো লিফলেটে। তাই গেলুম। পার্কিং লটে লিট্ল ব্লু-কে দাঁড় করি একটু খেয়ে হাঁটার শুরু।
কিছুদূর গিয়ে দেখলুম রাস্তা দু ভাগ হয়েছে, একটা পথ বাঁদিকে চলে গেছে - দিব্যি সুন্দর ফুটপাথ, আরেকটা সিধে ওপরদিকে উঠেছে, ভালো চড়াই (সেটা কতদূর ভালো তা ক্রমশঃ প্রকাশ্য)। সিধে রাস্তায় দেখলাম বেশ ওপরে জনা দুই লোক উঠছে, আমরাও ভাবলুম এটাতেই যাই। একবার সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলুম বটে - একটা পুঁচকে ছেলে আছে, ফুটপাথ ধরে গেলে ভালো হয় না...কিন্তু...তো যাই হোক, এই ভোটের ফল তো জানা - ভোট নয়, ভেটো - চড়াইটা ধরাই ঠিক হল।
চাড়িতে তিনটে ধাপ - প্রথম ধাপটা ছোট - ফুট পঞ্চাশেক হবে - খুব বেশি খাড়া নয়, কিন্তু ঝুড়ো মাটি। তার মধ্যে যে পাথর-টাথরগুলো আটকে আছে সেই ধরে প্রথম ধাপের মাথা অবধি তো পৌঁছনো গেলো। সেখানে আবার মোলাকাত সেই আগের ছেড়ে আসা ফুটপাথের সাথে - চড়াইয়ে উঠছি - কাজেই সেটাকেইগ নোর মোডে ফেলে দেওয়া হল। এবার দ্বিতীয় ধাপ। প্রথম কুড়ি তিরিশ ফুট অবধি ঠিকঠাক, কিন্তু হাত ব্যবহার না করে শুধু হেঁটে ওঠা অসম্ভব। আমি সুমনাকে বল্লুম - তুমি আর ঋক আগে ওঠ, আমি পিছনে আসছি - কেউ গড়ালে ধরতে পারবো। কিন্তু সে প্ল্যান খাটলো না, ঋকবাবু মায়ের স`ঙ্গে যাবেন না, এবং তাঁর প্রথম আপত্তি হল হাতে মাটি লাগবে। একটু চেষ্টা-চরিত্তির করতে করতেই তিনি একবার ধপাস্ হয়ে ভ্যাঁ জুড়লেন - অগত্যা আমার হাত ধরে তাঁর ওঠা শুরু হল। আমি এক হাতে ঋককে একটু করে তুলছি, তারপর নিজে উঠছি, পিঠে ব্যাগ, পিছনে সুমনা আসছে। এবার যত উঠি, তত দেখি স্লোপটা খাড়া হচ্ছে। সামনের প্রায় শ তিনেক ফুট বেশ খাড়া - আমাকেও হাত-পা ব্যবহার করে রীতিমতন স্ক্র্যাম্বল করে উঠতে হচ্ছে, আর ঋককে নিয়ে ওঠা ক্রমশঃ আরো মুশকিল হ্ছ্হে। কিন্তু ততক্ষণে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট ফুট উঠে এসেছি, ওই পথে নামা আরোই কঠিন। আমি আগে পুরুলিয়ার পাহাড়ে চড়েছি দড়িদড়া নিয়ে - আমি পারলেও ঋককে নামাতে পারবো না, আর সুমনা বলেই দিলো ও নামবে না, মানে পারবে না। সুতরাং উঠে যাওয়াই একমাত্র উপায়।
প্রায় মাঝামাঝি যখন পৌঁছেছি, তখন আরেকটা কোনোক্রমে দাঁড়ানো বা বসার জায়গা, সেখানে ঋককে বসিয়ে ভালো করে ওপর-নীচ খতিয়ে দেখলুম। সামনে আরো অন্ততঃ দেড়শো ফুট, প্রায় ন্যাড়া, মাটিতে অল্প ঘাস, কিন্তু সে ঘাস ধরে ওঠার চেষ্টা করলে ঘাস উপড়ে আসবে। আগে অন্যান্য লোক গেছে, এবং ভেজা অবস্থায় গেছে নির্ঘাৎ - তাই কিছু খোঁদল রয়েছে - জুতোর খোঁদল। ওগুলো ধরে ওঠা ছাড়া কোনো গতিক নেই। আরেকবার বহ্বালুম নেমে যাবো কিনা - কিন্তু ততক্ষণে সেও অসম্ভব হয়ে গেছে। সুমনা যখন ওই ছোট ধাপের কাছাকাছি পৌঁছেছে তখন আমি ঋককে নিয়ে আবার উঠতে শুরু করলুম - এবার আর কোথাও দাঁড়ানোর উপায় নেই। নীচে নেমে সুমনাকে যে টেনে তুলবো তাও সম্ভব নয়। এক হাতে ঋককে একটু করে তুলছি, এবার ওকেও বাধ্য হয়ে হাত দিয়ে খামচে উঠতে হচ্ছে। একটা জুতোর গর্তে ঋক যখন পা রাখছে ওকে পিছন থেকে ধরে আমি নিজে এক ধাপ উঠছি। মাঝে মাঝেই ঋক আমার ঘাড়ে ওঠার জন্যে বায়না করছে - ঘাড়ে উঠবে কী - পিঠে বাঁধা গেলে হয়তো ওঠা সম্ভব। হঠাৎ ">pharhaa`t<" - আমার সাধের আউটডোর ট্রাউজারের পায়ের ভ্তিঅরের দিকে যে সেলাই থাকে সেখানে ফাটলো। প্রথমে ছোট। তারপর কে ধাপ উঠছি, আরেকটু ">pharhaa`t<" - ঋকের কান্না, ওই ফড়াৎ ফড়াৎ, আর সুমনার "এবার কোনদিকে" শুনতে শুনতে আর ঋককে কোনোমতে ঠেলতে ঠেলতে দ্বিতীয় ধাপের মাথায় তুলে ধপ্ করে বসে পড়লুম। ঋককে একটা পাথরের মাথায় বসিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে চমৎকৃত - ওখান থেকে পড়লে আর দেখতে হবে না, গড়গড়িয়ে সোজা নীচে, তাতে মরণ না হলেও হাসপাতালে গমন অবশ্যম্ভাবী। দ্বিতীয় চমক নিজেকে দেখে - বেল্টের ঠিক নীচ থেকে হাঁটুর তলা অবধি - প্যান্টটা পুরো পতাকা হয়ে ঝুলছে, পুলিশে চাইলে ইনডিসেন্ট এক্সপোজারের জন্যে হাজতে ভরতে পারে। একদম কেলেংকারী কেস নয় যদিও, তবুও...
এবার তৃতীয় সমস্যা হল সুমনাকে দেখতে পাচ্ছি না। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে, তার নীচের বেশ কিছুটা অতি খাড়া, তার নীচে খানকয়েক ঝোপঝাড়, কিন্তু সুমনা নেই। হাঁক পাড়লুম - ঝোপের আড়াল থেকে সাড়া এলো। সুমনা ওখানে আটকে আছে, আর এগোতে পারছে না। অনেক হাঁকডাকের পর মাথাটা বেরলো, তারপর বাকিটা - ওখানে চারটে খোঁদলে হাত-পা আটকে সুমনা প্রায় ত্রিশঙ্কু। বেশ কিছুটা মেহনত করে ফুট কয়েক উঠলো, কিন্তু এমন একটা জায়গায় চলে গেছে যেখান থেকে ধরে ওঠার মতন কিছু নেই। আমি যে গর্তগুলো বেয়ে উঠেছি সেগুলো থেকে বেশ কিছুটা ডানদিকে সরে গেছে। এবার আমি যত বলি গর্তগুলোর কাছে আসতে সে আর পারে না। বলে - আমি আর উঠতে পারবো না, নামতেও পারবো না, তুমি এমার্জেন্সী ডায়াল করো। মুশকিল হল আমি ঋককে বসিয়ে যেতেও পারছি না - কারণ আমি নামলেই তিনি ধারে এসে পর্যবেক্ষণ শুরু করবেন - তাহলে পড়ে যাবার প্রভূত সম্ভাবনা। দড়িও নেই যে দড়ি নামিয়ে দেবো...আর অন্য কেউ সেদিক দিয়ে আসছেও না যে সাহায্য করবে। গতিক না দেখে করলুম ৯৯৯ - তারা বললে "ফায়ার, অ্যামবুলেন্স না পুলিশ" - আমি বললুম "মাউন্টেন রেসকিউ" - তো সেখানে ট্রান্সফার করে দিলে। ওদের পুরো অবস্থাটা বললুম - যে আমার বউ রোজবেরি টপিং-এর স্লোপে ঝুলছে, উঠতেও পারছে না, নামাও সম্ভব নয়, বাঁচাও। সে কত প্রশ্ন - তোমার নাম কী, বউয়ের নাম কী, বয়স কত, তোমার সাথে আর কেউ আছে কিনা, বাচ্চা-টাচ্ছা - বললুম হ্যাঁ, একটা ছোট ছেলে আছে, কিন্তু সে সেফ...তখন বললে হ্যাঙ্গ অন, আমরা আসছি।
এর ঠিক পরেই দেখি একটা অল্পবয়সী ছেলে আর তার বাবা ওই পথেই উঠছে। ছেলেটা রীতিমতন মাউন্টেনিয়ারিং জানে, চটপট উঠছে, তার বাবাও তাই। ওরা পাশ দিয়ে আসার সময় সুমনাকে বললো যে ওরা যেখান দিয়ে যাচ্ছে, সেখান দিয়ে আসতে। ছেলেটার বাবা বেশ ভারিক্কী চেহারার - ওকে দেখে সুমনার মনে হয় ভরসা কিছুটা বাড়লো, হাঁচোড়-পাঁচড় করে মাথা অবধি চলে আসার পর আমি টেনে নিলুম। সাথে সাথেই মাউন্টেন রেসকিউয়ের ফোন - যে আমরা রওনা দিয়েছি, তোমরা ঠিক আছো কি? আমি ববলুম যে আরেকটা টীম আসছিলো, তারা সাহায্য করেছে, আমার বউ উঠে এসেছে...
এর পর আর গপ্পো নেই। আমার প্যান্ট তো ওইরকম পতাকা হয়ে রয়েছে, ব্যাগ থেকে ঋকের একটা স্পেয়ার জামা নিয়ে পায়ের ফাঁক দিয়ে বাঁধলুম, হাঁটুর কাছে নিজের রুমালটা বাঁধলুম, সুমনার কাছে সেফটিপিন ছিলো - সেই দিয়ে নিজের জামাটা প্যান্টের সঙ্গে আটকে দিলুম - যাতে কোনোরকমে রেখেঢেকে রাখা যায়। কিন্তু মুশকিল হল - এক পা করে হাঁটছি, আর ফুট্ করে আরেকটু ছিঁড়ছে...দেখলুম ওই করে আর পুরো পাহাড়ের মাথা অবধি যাওয়া যাবে না, তাহলে আর প্যান্টটাই থাকবে না...অগত্যা নেমে এলুম, এবার সেই সেই ফেলে আসা ফুটপাথ দিয়েই... ততক্ষণে সুমনার প্যানিক তৈরী হয়ে গেছে - রাস্তটা মাঝরি স্লোপের - কিন্তু তাতেও ভয়...ধরে ধরে নামলো।
সেদিন কয়েকটা জিনিস শিখেছিলুম।
(১) আউটডোর ট্রাউজার কক্ষণো সেল-এ কিনতে নেই।
(২) দড়ি আর হুক ছাড়া এমনভাবে যেতে নেই।
(৩) ফুটপাথ ছেড়ে শর্টকাট ধরতে নেই।
===========================
২০০৬ সালের জুলাইয়ের এক রবিবার নিউক্যাসল জার্নালে হয়তো আরেকটু হলে হেডলাইন হত - "মাউন্টেন রেসকিউ সেভস কাপল ফ্রম রোজবেরি স্লোপ" বা "আ ডেয়ারিং রেসকিউ বাই দ্য মাউন্টেন রেসকিউ টীম"...
গল্পটা বলি শোন।
তখন প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও যাই - বয়স হচ্ছে, ওজন বাড়ছে - তাই হাঁটতে যাই, বেড়ানোও হয়, সাথে একটু গা-ঘামানো - এই করে যদি ওজনটা কমে। ব্রিটিশরা হাঁটতে খুব ভালোবাসে, তাই হাঁটার র্যুট নিয়ে প্রচুর ওয়েবসাইট আছে, ওয়াকিং র্যুটগুলো খুব ভালো করে মেইনটেইন করা হয়, রীতিমতন ভালো ডিরেকশন দেওয়া...তো সেই রকম এক সাইট থেকে রোজবেরি টপিং-এর খবর যোগাড় হয়েছিলো। মিড্লসবরোর কাছে নর্থ ইয়র্ক মুর-এর একদম শুরুর দিকে, মাইল চারেকের পথ, ক্যাটেগরি "strenuous" (যদৈ সেটা আগে খেয়াল করে দেখা হয়নি) - হেঁটে একটা পাহাড়ের মাথায় ওঠা এবং নামা। পথটা একটা বনের মধে দ্যিয়ে গেছে, আশেপাশের দৃশ্য অতীব সুন্দর - এরকমই দাবী ছিলো লিফলেটে। তাই গেলুম। পার্কিং লটে লিট্ল ব্লু-কে দাঁড় করি একটু খেয়ে হাঁটার শুরু।
কিছুদূর গিয়ে দেখলুম রাস্তা দু ভাগ হয়েছে, একটা পথ বাঁদিকে চলে গেছে - দিব্যি সুন্দর ফুটপাথ, আরেকটা সিধে ওপরদিকে উঠেছে, ভালো চড়াই (সেটা কতদূর ভালো তা ক্রমশঃ প্রকাশ্য)। সিধে রাস্তায় দেখলাম বেশ ওপরে জনা দুই লোক উঠছে, আমরাও ভাবলুম এটাতেই যাই। একবার সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলুম বটে - একটা পুঁচকে ছেলে আছে, ফুটপাথ ধরে গেলে ভালো হয় না...কিন্তু...তো যাই হোক, এই ভোটের ফল তো জানা - ভোট নয়, ভেটো - চড়াইটা ধরাই ঠিক হল।
চাড়িতে তিনটে ধাপ - প্রথম ধাপটা ছোট - ফুট পঞ্চাশেক হবে - খুব বেশি খাড়া নয়, কিন্তু ঝুড়ো মাটি। তার মধ্যে যে পাথর-টাথরগুলো আটকে আছে সেই ধরে প্রথম ধাপের মাথা অবধি তো পৌঁছনো গেলো। সেখানে আবার মোলাকাত সেই আগের ছেড়ে আসা ফুটপাথের সাথে - চড়াইয়ে উঠছি - কাজেই সেটাকেইগ নোর মোডে ফেলে দেওয়া হল। এবার দ্বিতীয় ধাপ। প্রথম কুড়ি তিরিশ ফুট অবধি ঠিকঠাক, কিন্তু হাত ব্যবহার না করে শুধু হেঁটে ওঠা অসম্ভব। আমি সুমনাকে বল্লুম - তুমি আর ঋক আগে ওঠ, আমি পিছনে আসছি - কেউ গড়ালে ধরতে পারবো। কিন্তু সে প্ল্যান খাটলো না, ঋকবাবু মায়ের স`ঙ্গে যাবেন না, এবং তাঁর প্রথম আপত্তি হল হাতে মাটি লাগবে। একটু চেষ্টা-চরিত্তির করতে করতেই তিনি একবার ধপাস্ হয়ে ভ্যাঁ জুড়লেন - অগত্যা আমার হাত ধরে তাঁর ওঠা শুরু হল। আমি এক হাতে ঋককে একটু করে তুলছি, তারপর নিজে উঠছি, পিঠে ব্যাগ, পিছনে সুমনা আসছে। এবার যত উঠি, তত দেখি স্লোপটা খাড়া হচ্ছে। সামনের প্রায় শ তিনেক ফুট বেশ খাড়া - আমাকেও হাত-পা ব্যবহার করে রীতিমতন স্ক্র্যাম্বল করে উঠতে হচ্ছে, আর ঋককে নিয়ে ওঠা ক্রমশঃ আরো মুশকিল হ্ছ্হে। কিন্তু ততক্ষণে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট ফুট উঠে এসেছি, ওই পথে নামা আরোই কঠিন। আমি আগে পুরুলিয়ার পাহাড়ে চড়েছি দড়িদড়া নিয়ে - আমি পারলেও ঋককে নামাতে পারবো না, আর সুমনা বলেই দিলো ও নামবে না, মানে পারবে না। সুতরাং উঠে যাওয়াই একমাত্র উপায়।
প্রায় মাঝামাঝি যখন পৌঁছেছি, তখন আরেকটা কোনোক্রমে দাঁড়ানো বা বসার জায়গা, সেখানে ঋককে বসিয়ে ভালো করে ওপর-নীচ খতিয়ে দেখলুম। সামনে আরো অন্ততঃ দেড়শো ফুট, প্রায় ন্যাড়া, মাটিতে অল্প ঘাস, কিন্তু সে ঘাস ধরে ওঠার চেষ্টা করলে ঘাস উপড়ে আসবে। আগে অন্যান্য লোক গেছে, এবং ভেজা অবস্থায় গেছে নির্ঘাৎ - তাই কিছু খোঁদল রয়েছে - জুতোর খোঁদল। ওগুলো ধরে ওঠা ছাড়া কোনো গতিক নেই। আরেকবার বহ্বালুম নেমে যাবো কিনা - কিন্তু ততক্ষণে সেও অসম্ভব হয়ে গেছে। সুমনা যখন ওই ছোট ধাপের কাছাকাছি পৌঁছেছে তখন আমি ঋককে নিয়ে আবার উঠতে শুরু করলুম - এবার আর কোথাও দাঁড়ানোর উপায় নেই। নীচে নেমে সুমনাকে যে টেনে তুলবো তাও সম্ভব নয়। এক হাতে ঋককে একটু করে তুলছি, এবার ওকেও বাধ্য হয়ে হাত দিয়ে খামচে উঠতে হচ্ছে। একটা জুতোর গর্তে ঋক যখন পা রাখছে ওকে পিছন থেকে ধরে আমি নিজে এক ধাপ উঠছি। মাঝে মাঝেই ঋক আমার ঘাড়ে ওঠার জন্যে বায়না করছে - ঘাড়ে উঠবে কী - পিঠে বাঁধা গেলে হয়তো ওঠা সম্ভব। হঠাৎ ">pharhaa`t<" - আমার সাধের আউটডোর ট্রাউজারের পায়ের ভ্তিঅরের দিকে যে সেলাই থাকে সেখানে ফাটলো। প্রথমে ছোট। তারপর কে ধাপ উঠছি, আরেকটু ">pharhaa`t<" - ঋকের কান্না, ওই ফড়াৎ ফড়াৎ, আর সুমনার "এবার কোনদিকে" শুনতে শুনতে আর ঋককে কোনোমতে ঠেলতে ঠেলতে দ্বিতীয় ধাপের মাথায় তুলে ধপ্ করে বসে পড়লুম। ঋককে একটা পাথরের মাথায় বসিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে চমৎকৃত - ওখান থেকে পড়লে আর দেখতে হবে না, গড়গড়িয়ে সোজা নীচে, তাতে মরণ না হলেও হাসপাতালে গমন অবশ্যম্ভাবী। দ্বিতীয় চমক নিজেকে দেখে - বেল্টের ঠিক নীচ থেকে হাঁটুর তলা অবধি - প্যান্টটা পুরো পতাকা হয়ে ঝুলছে, পুলিশে চাইলে ইনডিসেন্ট এক্সপোজারের জন্যে হাজতে ভরতে পারে। একদম কেলেংকারী কেস নয় যদিও, তবুও...
এবার তৃতীয় সমস্যা হল সুমনাকে দেখতে পাচ্ছি না। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে, তার নীচের বেশ কিছুটা অতি খাড়া, তার নীচে খানকয়েক ঝোপঝাড়, কিন্তু সুমনা নেই। হাঁক পাড়লুম - ঝোপের আড়াল থেকে সাড়া এলো। সুমনা ওখানে আটকে আছে, আর এগোতে পারছে না। অনেক হাঁকডাকের পর মাথাটা বেরলো, তারপর বাকিটা - ওখানে চারটে খোঁদলে হাত-পা আটকে সুমনা প্রায় ত্রিশঙ্কু। বেশ কিছুটা মেহনত করে ফুট কয়েক উঠলো, কিন্তু এমন একটা জায়গায় চলে গেছে যেখান থেকে ধরে ওঠার মতন কিছু নেই। আমি যে গর্তগুলো বেয়ে উঠেছি সেগুলো থেকে বেশ কিছুটা ডানদিকে সরে গেছে। এবার আমি যত বলি গর্তগুলোর কাছে আসতে সে আর পারে না। বলে - আমি আর উঠতে পারবো না, নামতেও পারবো না, তুমি এমার্জেন্সী ডায়াল করো। মুশকিল হল আমি ঋককে বসিয়ে যেতেও পারছি না - কারণ আমি নামলেই তিনি ধারে এসে পর্যবেক্ষণ শুরু করবেন - তাহলে পড়ে যাবার প্রভূত সম্ভাবনা। দড়িও নেই যে দড়ি নামিয়ে দেবো...আর অন্য কেউ সেদিক দিয়ে আসছেও না যে সাহায্য করবে। গতিক না দেখে করলুম ৯৯৯ - তারা বললে "ফায়ার, অ্যামবুলেন্স না পুলিশ" - আমি বললুম "মাউন্টেন রেসকিউ" - তো সেখানে ট্রান্সফার করে দিলে। ওদের পুরো অবস্থাটা বললুম - যে আমার বউ রোজবেরি টপিং-এর স্লোপে ঝুলছে, উঠতেও পারছে না, নামাও সম্ভব নয়, বাঁচাও। সে কত প্রশ্ন - তোমার নাম কী, বউয়ের নাম কী, বয়স কত, তোমার সাথে আর কেউ আছে কিনা, বাচ্চা-টাচ্ছা - বললুম হ্যাঁ, একটা ছোট ছেলে আছে, কিন্তু সে সেফ...তখন বললে হ্যাঙ্গ অন, আমরা আসছি।
এর ঠিক পরেই দেখি একটা অল্পবয়সী ছেলে আর তার বাবা ওই পথেই উঠছে। ছেলেটা রীতিমতন মাউন্টেনিয়ারিং জানে, চটপট উঠছে, তার বাবাও তাই। ওরা পাশ দিয়ে আসার সময় সুমনাকে বললো যে ওরা যেখান দিয়ে যাচ্ছে, সেখান দিয়ে আসতে। ছেলেটার বাবা বেশ ভারিক্কী চেহারার - ওকে দেখে সুমনার মনে হয় ভরসা কিছুটা বাড়লো, হাঁচোড়-পাঁচড় করে মাথা অবধি চলে আসার পর আমি টেনে নিলুম। সাথে সাথেই মাউন্টেন রেসকিউয়ের ফোন - যে আমরা রওনা দিয়েছি, তোমরা ঠিক আছো কি? আমি ববলুম যে আরেকটা টীম আসছিলো, তারা সাহায্য করেছে, আমার বউ উঠে এসেছে...
এর পর আর গপ্পো নেই। আমার প্যান্ট তো ওইরকম পতাকা হয়ে রয়েছে, ব্যাগ থেকে ঋকের একটা স্পেয়ার জামা নিয়ে পায়ের ফাঁক দিয়ে বাঁধলুম, হাঁটুর কাছে নিজের রুমালটা বাঁধলুম, সুমনার কাছে সেফটিপিন ছিলো - সেই দিয়ে নিজের জামাটা প্যান্টের সঙ্গে আটকে দিলুম - যাতে কোনোরকমে রেখেঢেকে রাখা যায়। কিন্তু মুশকিল হল - এক পা করে হাঁটছি, আর ফুট্ করে আরেকটু ছিঁড়ছে...দেখলুম ওই করে আর পুরো পাহাড়ের মাথা অবধি যাওয়া যাবে না, তাহলে আর প্যান্টটাই থাকবে না...অগত্যা নেমে এলুম, এবার সেই সেই ফেলে আসা ফুটপাথ দিয়েই... ততক্ষণে সুমনার প্যানিক তৈরী হয়ে গেছে - রাস্তটা মাঝরি স্লোপের - কিন্তু তাতেও ভয়...ধরে ধরে নামলো।
সেদিন কয়েকটা জিনিস শিখেছিলুম।
(১) আউটডোর ট্রাউজার কক্ষণো সেল-এ কিনতে নেই।
(২) দড়ি আর হুক ছাড়া এমনভাবে যেতে নেই।
(৩) ফুটপাথ ছেড়ে শর্টকাট ধরতে নেই।
1 comment:
ফন্ট বোঝা যাচ্ছে না।
Post a Comment